হাসপাতালের বেডের কোন ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন জ্যাক, এই কেস সহ মোট ৮৭ জনের মৃত্যু হলো তার হাতে! অথচ একজন ডাক্তার হয়ে চোখের সামনে কাউকে যন্ত্রণায় উর্ধ্বশ্বাস নিতে দেখেও করার ছিলো না কিছুই। তার ৮৭ নম্বর কেস টা ছিলো একটি পাঁচ বছরের শিশু মেয়ের, মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও সে বলছিল “আমার মুখ থেকে এটা সরিয়ে দাও,আমি আর বায়না করবো না, সব সময় হেলদি খাবো। আমাকে প্লিজ বাবা মায়ের কাছে নিয়ে চলো!” বাচ্চাটার পরিবার কে আঁকড়ে ধরার এই নির্মম আকুতি তে স্তব্ধ উহানের সবচেয়ে বড় উহান উচাং হাসপাতাল।
আইসিইউ এর বাহিরে গ্লাস ধরে বুক চাপড়ে কাঁদছে শিশুটির অন্তঃস্বত্তা মা। কাঁদছে যেন পুরো পৃথিবী! ভেঙ্গে পরতে পরতেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে করিডোরের দিকে ছুটে জ্যাকব। হাজার টা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভেঙ্গে পরলে চলবে না, বাহিরে আবারও আর্তনাদ! হয়তো কারো জীবন যুদ্ধে আবারও কারো টিকে থাকার তাগিদ । জ্যাকবের চোখ লাল হয়ে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় কোটর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবুও মনে বল চাই, বলা চাই আমরা আছি আপনার পাশে! এ যে মানব ধর্ম।
রাত ১২ টা বেজে ১, ইতালির মিলান শহর অন্ধকারে স্তব্ধ। গত দু’মাসে রাতের শহর টা কে রাতের বেলায় ঠিক চেনার উপায় নেই। সন্ধ্যার পরপর সব ঘরে জানালা এঁটে যায়। প্রাণহীন শহর টা খুব স্বার্থপর হয়ে উঠে, দেখলে যে কারোর কান্না পায়। নিশ্চলতা নেই কেবল হাসপাতাল গুলোতে, হাসপাতালের টেবিলের ড্রয়ারে কল বেজে ভাইব্রেট হচ্ছে একটা ফোন, ফোন টা তোলার কেউ নেই৷ ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে এখন সময় ৩টা বেজে ২০ মিনিট, ধৈর্য্য হারা হয়ে কেঁদে উঠে রুশো। নিস্তব্ধ মিলানে কান্নাটা যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, আজ রুশো, রোজের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী! অথচ দু’জন আজ বিচ্ছিন্ন! তার স্ত্রী রোজ কে দেখার সৌভাগ্য টুকু নেই আজ তার।
রোজ একজন নার্স, পরিবারের সুরক্ষায় বাড়ি ফিরতে পারেন না তিনি, সপ্তাহে ১ দিন দূর থেকে দু’জনের দেখা হয়, তারপর আবারও মানব ব্রতে মনযোগি হন তিনি। অপর পাশ থেকে ফোন টা রিসিভ হতেই সারা শরীর কেঁপে উঠে রুশোর, তিনি ধরা গলায় বলেন “রোজ!” ফোনের দু’পাশ যেন দুই পৃথিবী। মুখ থেকে মাস্ক খুলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পরেন দু’জন । মুখে মাস্কের দাগ পরে গেছে! চেনার উপায় নেই যে তিনিই মিসেস রুশো! ফোনের অপর পাশ থেকে রোজের পছন্দের রেড ভেলবেট কেক টা সামনে এনে চোখে চোখ রেখে রুশো বলেন, “হ্যাপি ফাস্ট এননিভার্সারি রোজ”!
রোজ কান্নায় কথা বলতে পারেন না, কারণ প্রিয় মানুষদের সামনে শক্ত থাকার শক্তি নিয়ে মেয়েরা কখনো জন্মায় না। রুশো চোখ মুছে নিয়ে, চোখ মুখ শক্ত করে বলেন, ” আমি একবার তোমায় জড়িয়ে ধরতে চাই শুধু একবার, সারাজীবনের জন্য একবার! আর কক্ষনো চাইবো না প্লিজ আমায় দেবে? ” এবার দু’পাশ চুপ! হয়তো ভাগ্যে থাকলে আবারও এই দেয়াল ভেঙ্গে কাছাকাছি আসা হবে, নয়তো এই দেয়ালই জীবনের দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে। কারণ তারা যে আত্মত্যাগী! সর্বভোলা! মানবপ্রেমী! শাহনাজ রহমান চতুর্থ বারের মত চশমা খুললেন, দু’চোখ ছলছল করছে পানিতে। পরিবারের সবাই একসাথে খেতে বসলে অনেক গল্প হলেও আজ সবাই চুপ। শাহনাজ রহমান এবং ফিরোজ রহমান দম্পতির একমাত্র কণ্যা জাকিয়া রহমান। পেশায় তিনি একজন ডাক্তার। কোভিড ১৯ এ তার দায়িত্ব পরেছে সরকারি কুর্মিটোলা হাসপাতালে। শাহনাজ রহমান রুই মাছের মাথা টা মেয়ের থালায় তুলে দিতেই জাকিয়া বলেন,
-মা, আজ আমি মাথা খেতে পারবো না। পেট ভরা ভরা লাগছে। শাহনাজ রহমান মেয়ের দিকে চেয়ে বলেন, -আমায় ছেড়ে ঢাকায় যাচ্ছিস, আমি যদি মরে যাই তবে তো এটা বলেই কাঁদবি যে মা খাওয়াতে চেয়েছিল! জাকিয়া এবার অভিমান করেই বলে,
-তবে খাইয়ে দিচ্ছো না যে? আমি না ফিরলে তো এটা বলবে যে “মেয়েটা নিজের হাতে খেয়েছিল কাঁটা বেছে”!
শাহনাজ রহমান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। নিজেকে শক্ত রেখে বাবার কাছ থেকে বিদায় নেন জাকিয়া, ফিরোজ রহমান কেবল বলেন, ” শহীদ হয়ে ফিরো, তবুও পলাতক হয়ে নয়!” জাকিয়া মাথা নেড়ে সায় দেয়। সিএনজিতে সব মালপত্র তোলা শেষ, শেষ বারের মত বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে জাকিয়া! কিন্তু পানি মাটিকে স্পর্শ করতে দেয়না। বীর হয়ে ফিরতে হবে ভীতু হয়ে নয়। সিএনজি ছুটে চলছে, বাহিরের ঠান্ডা বাতাসে বারবার শিহরিত হচ্ছে জাকিয়া। ফিরোজ রহমান চশমা খুলে চোখের পানি মুছেন, স্ত্রী কে ডেকে বলেন শাহনাজ,
-মনে পরে ৭১ এর কথা? শাহনাজ রহমান মনে বল ফিরে পান, ফিসফিস করে বলেন, “মা শহীদ হয়ে ফিরিস!”…