করোনা ভাইরাস ও সুবর্ণার স্বপ্নগুলো

করোনা ভাইরাস ও সুবর্ণার স্বপ্নগুলো

আমি সুবর্ণা। একজন পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট গৃহবধূ।দুই বছর আগে খুব ধুমধামের সাথে একজন ইতালি প্রবাসী ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়।আমার এই বিয়েতে আমার বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাই খুব খুশি।ছেলে শিক্ষিত,ভদ্র,মার্জিত। ইতালিতে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো চাকুরী করে,দেখতেও সুদর্শন।এমন যোগ্য স্বামী পেয়ে আমিও আল্লাহর রহমতে খুব সুখী।

আমার স্বামী শিহাব আমাকে তার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে।আমাদের পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়েছে,বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত আমরা এক জন আরেক জনের কাছে ছিলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত।কিন্তু এখন যে কেউ আমাদের এত মনের মিল,প্রেম আর এত ভালোবাসা দেখে জানতে চায় বিয়ের আগে থেকেই আমাদের জানাশোনা ছিল কিনা।

আমার ভিসা সংক্রান্ত সব কাগজ পত্র এসে গেছে, সবকিছু ঠিক থাকলে এই বছর এপ্রিলেই আমি ইতালি চলে যাব। ডেলিভারি ওখানেই হবে।কত শত স্বপ্ন আমাদের দুজনের চোখে ভাসে এখন । নতুন সংসার সাজাবো।ঘরের রং,পর্দা থেকে ব্যালকনির ফুলের টব কিংবা বাবুর জামা পেন্ট খেলনা,সব কিছুর প্লান করি আমরা প্রতিদিন।গত মাসে শিহাব ব্যাচেলর বাসা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে।আমি যাবো কিছুদিনের মধ্যেই তার কাছে ,কতশত প্রস্তুতি নিচ্ছে সে !

হাজার হাজার মাইলের এই দূরত্ব আমাদের স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসাকে যেন আরো গভীর থেকে গভীরতর করে দিচ্ছে। দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে প্রেম। কবে যাবো তার কাছে,কবে হবে দেখা ,কবে একটু ছুঁয়ে দিব তার আঙ্গুল,ঠোট, মুখ,চোখ ! তার প্রশস্থ বুকে কবে মুখ লুকাবো,সেই প্রীতিক্ষায় প্রতিটা প্ৰহর গুনছি এখন। আমাদের দিনকার রুটিনের সব চেয়ে প্রিয় আর আনন্দের কাজ হলো শিহাব আর আমার ভিডিও কলে কথা বলা।

আমাদের দুজনের স্থানীয় সময় এক না,তার ওখানে রাত হলে আমার দিনের শুরু।আবার আমার দিন হলে তার গভীর রাত।তারপরও প্রতিদিন ঠিক সময় করে দুই তিন বার কথা হয় আমাদের। এই প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে আমার পাশে না থাকাটা কে সে খুব মিস করে। খুব আফ্সোস করে, আর নিজেকে অপরাধী ভাবে।আমি ঠোট ফুলিয়ে বলি ধূর বোকা এইতো আগামী মাসেই তো আমি চলে আসবো তোমার কাছে তখন দেখবো কত যত্ন করো আমার আর বাবুটার।

যদিও আমরা এখনো জানিনা পেটের বাবুটা টা ছেলে নাকি মেয়ে,তবে আমরা দুজনেই একটা মেয়ে চাই।শিহাব তো মেয়ের নাম ও ঠিক করে রেখেছে। ও আমাকে আদর করে “সেনরিটা” র আম্মু ডাকে। আমি খুব রেগে যাই। আসলে কপট রাগ।আমি রেগে গেলে শিহাব দিশেহারা হয়ে যায়।আমার রাগ ভাঙানোর হাজারটা বাহানা করে সে।আমি মুখ টিপে টিপে হাসি,ওকে বুঝতে দিই না।মনে মনে মজা নিই।

কিন্তু কয়েকদিন হলো আমার পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেছে। হঠাৎ করে আমাদের এত ভালোবাসায় নজর লেগে গেছে ।আজ বেশ কিছুদিন হলো শিহাব ঘরে বন্ধি জীবন যাপন করছে। “করোনা” ভাইরাস সমস্ত ইটালিতে মহামারী রূপ ধারণ করেছে।

দেশ কে লক ডাউন করা হয়েছে। কারফিউ চলছে। শুধু ঔষুধ আর কিছু গ্রোসারি সপ বাদে সব দোকান পাট বন্ধ।খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না।এত দূরে থাকি আমি যে কিছুই করার নেই আমার।গত তিন দিন আগে শিহাবের পাশের বাড়ির একজন কোবিড 19 এ এফেক্টেড হয়ে মারা গিয়েছে।সমস্ত এলাকা নাকি তখন পুলিশে ছেয়ে গিয়েছিল।সরকারের লোকেরা ঘর থেকে লাশ নামিয়ে কবরস্থানে নিয়ে গিয়েছে।এম্বুলেন্স এর বিকট শব্দে প্রীতিটা বাড়ির জীবিত মানুষগুলো ও তখন দিশেহারা,আতংকিত।রাস্তায় কোনো জনমানব নেই।পর্যটকের নগরী টা হঠাৎ যেন থমকে গেছে।চারদিক খা খা করছে,শুধু স্তব্ধতা আর পিনপতন নীরবতা। কি এক অদৃশ্য মহাশক্তি যেন সব নিয়ন্ত্রণ করে চলছেন।ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোও সেই মহাশক্তির কাছে অসহায় পরাজিত ।কিছুই করার নাই কারো। দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে মৃতের হার।

হসপিটালে জায়গা নেই।জায়গা নেই কবরের,চারদিকে লাশের মিছিল। মৃতের গোসল হচ্ছে না,দাফন হচ্ছে না।কাছে গেলেই ভাইরাস লেগে যাবে।উফ,কি অস্থিরতা আজ পৃথিবীতে।এমন অস্থির সময় জীবনে আগে কখনো পার করিনি আমি।

আমার এখন টিভি দেখা নিষেধ।নিউজ চ্যানেল গুলোও আমাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। হাইপারটেনশন হচ্ছে আমার। প্রেগনেন্সি তে নাকি এটা অনেক বড় সমস্যা বাচ্চা এবং মা দুজনের জন্য।আমি ঘুমাতে পারছিনা।শরীরের অবস্থা কয়েক দিনে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। আমার ডক্টর ভাবি আমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন আজ।এভাবে না ঘুমালে বাবুর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।সারাক্ষন একটা অনিশ্চিত আশংকা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে।

আমার শাশুড়ি জায়নামাজে বসে চোখের পানি ফেলছেন। শিহাব একা সেই মৃত্যুপুরী ইতালিতে আর আমরা এখানে তার চিন্তায় মৃত প্রায়। আজ কয়েকদিন দিন ধরে শিহাব আর আগের মত ভিডিও কলে আসে না,আমাদের সাথে কথা বলা ও কমিয়ে দিয়েছে। ওর ভয়,পাছে ওখানকার অবস্থা শুনে আমরা আরো না ভেঙে পরি,আরো না অস্থির হয়ে পরি।

শুরুর দিকে যখন “করোনা” ভাইরাস ইতালি তে ছড়িয়ে যাচ্ছিল আমি তাকে বলেছিলাম তুমি চলে এসো,আমাদের বাবুটার জন্য হলেও এসো। আমার শশুর,শাশুড়ী মা ও অনেক আকুতি মিনতি করেছিল।কিন্তু শিহাব শুরু থেকেই এই দুর্যোগের মুহূর্তে দেশে চলে আসাটা উচিত মনে করেনি।তার কথা একটাই “বিদেশ থেকে দেশে এই রোগ বহন করে নিয়ে এসে ছড়ানোর কোনো মানে নেই।এখনো উন্নত দেশগুলো এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে পারিনি। তাই নিজের কথা ভেবে অন্য কে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া ঠিক না। কোরআন হাদিস মানলে অবশ্যই মহামারীর স্থান থেকে পালানো উচিত হবেনা।শিহাব বলেছিল দেশে আমার মা বাবা স্ত্রী পরিবার আর সকল আপনজন রয়েছে। তাদের কে তো আমি অনিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারিনা।শুধুমাত্র দেশকে ভালবাসি বলেই আমি নিজের স্বার্থে পালাবো না। দেশে আমি কোনোভাবেই এই অবস্থায় ফিরবোনা।ইনশাআল্লাহ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে আর আমরাও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকবো। ”

গলকাল সকালে তার সাথে আমার লাস্ট কথা হয়,কথা বলার সময় তার চোখ মুখ লাল ছিল,কাশির জন্য ভালো করে কথা বলতে পারছিলনা।কিন্তু গতকালের পর থেকে আর তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিনা। জানিনা সে কেমন আছে এখন।মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছি।সারাক্ষন যত আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসছে।এই মুহূর্তে জীবনের কাছে কিছুই চাওয়ার নাই আমার । প্রিয়জনের হাসি মাখা মুখের প্রতিচ্ছবি সারাক্ষন দুচোখে ভাসে।

উপরওয়ালার কাছে আর একটা মৃত্যু ও কাম্য নয়।শুধুমাত্র এতটুকুই চাই আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর চোখ খুলে প্রথম যেন তার বাবার মুখটা দেখতে পায়,তার প্রথম কোল যেন হয় তার বাবার পরম ভরসা আর আদরের বাহুজোড়া।অনাগত সন্তান যেন বড় হতে পারে বাবার ছায়ায়। যে যেখানে আছে আল্লাহ সবাইকে হেফাজতে রাখুন।কাছে দূরে,আত্মীয় অনাত্মীয়,পরিচিত অপরিচিত সবাই সুস্থ থাকুক।আবার আগের মত সজীব হয়ে যাক পৃথিবী। আমিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত