আমার বাবা দারোয়ানকে বিদায় করে দিয়ে গেইটে সারাদিন নিজেই পাহাড়া দেন। ভাড়াটিয়ারা কেউ বাড়ি থেকে বের হতে নিলেই হাজারটা প্রশ্ন।
-কই যাও? কেন যাও?নাকে মাস্ক কই? হাজারটা প্রশ্ন। যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে বাইরে যাওয়া বন্ধ। বাইরে থেকে কেউ আসলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এগিয়ে দিয়ে বলে,
-হাত পরিষ্কার কইরা প্রবেশ করেন। আপনের জন্যে বাড়িতে বালা-মুসিবত ঢুকাইতে পারব না।
সম্ভবত বাবার কারণেই আমাদের তিনতলা বাড়িটা লকডাউনে চলে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া পারতপক্ষে কেউ বাড়ি ছেড়ে বের হয় না। একতলার ইন্টারে পড়ুয়া হাসিব পর্যন্ত সিগারেট খাবার জন্যে মোড়ের চায়ের দোকানে ঘুরঘুর করে না। চুপিসারে ছাদ গিয়ে ধোয়া ছাড়ে।আমি অবশ্য শান্তিতেই আছি। ছুটির দিনে একদল অচেনা লোকের সামনে সেজেগুজে বসে থাকার চেয়ে মুক্তি। কিন্তু আজ বের হওয়া চাই। সে ফোন করে বলেছে,
-অ্যামেতিস, এক ছটাক সয়াবিন তেল হবে! তিনদিন ধরে ডিমসেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ খাচ্ছি। চমৎকার অভিনয়। এই মানুষটা কখনও মুখ ফুটে বলবে না,
-বেলা, আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কাছে এসো। আলু,পটলের বাহানা না হলেই কি নয়!
সে যাই হোক মা গোসলে গেলে চুপিচুপি ব্যাগ গুছালাম।আমার খাটের নীচে মা অন্তত তিন মাসের পেঁয়াজ স্টক করেছে, দুটো আট লিটার ফ্রেশ সয়াবিন তেল। ফ্রীজ থেকে আদা-রসুনের পেস্ট, পেঁয়াজ, আলু, তেল টুকিটাকি সব পলিথিনের ব্যাগে মুড়িয়ে মনটা খচখচ করতে লাগল। রোববার বাবা দুই কিলো পাবদা মাছ এনেছেন সেখান থেকে গুটিকয়েক সরিয়ে নিলে মা ধরে ফেলবেন নাতো! ওর খুব পাবদা মাছের ঝোল পছন্দ! না থাক! ততক্ষণে দেরি হয়ে যাবে! ব্যাগটা চিলেকোঠায় রেখে এসে মাকে বললাম,
-রুম্পা ভাবীর বাসায় গেলাম। উনার ছেলের শরীর খারাপ।
-সে কি! করোনা নয়ত?
– ডায়েরিয়া। বাচ্চাটা কাহিল হয়ে গেছে খুব।
-যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস।
তিনটা বাড়ির পর জুনায়েদের মেস। দেড় কামরার ঘরে চারজন মানুষ গাদাগাদি করে বাস করে। ও ছাড়া বাকি সবাই গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। ও বাড়ি না ফেরার পিছনে যুক্তি দেখিয়েছে মা-বাবা দুইজনে ডায়াবেটিসের পেশেন্ট। একমাত্র ছোটবোনের দশ বছর।এইটুকু মেয়েকে ও এতিম করতে চাইছে না। সেই শৈশবের এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফালাফি এই দুর্দিনে কাজে লাগল বেশ। ওদের মেসবাড়ি দো’তলা। আয়তুল কুরসি পড়ে চোখ বন্ধ করে দোতলার ছাদে দিলাম লাফ।
ওর বাড়ির সদর দরজা ভিজিয়ে রাখা।আলতো করে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। মশারি টানানো, সিগারেটের এশট্রে উল্টে পড়ে আছে। টেবিলের নীচে ছেঁড়া কাগজের স্তুপ। অর্ধেক শেষ করা ডিজাইনের উপর কম্পাস চাপা দেওয়া। বদ্ধ ঘরে কাঁটা পেঁয়াজের উৎকট গন্ধ। সে রান্নাঘরে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে রুই মাছে লবণ, হলুদ মাখাচ্ছে। সে আমায় দেখে হাসল,
-মহাশয়া, এত দেরি হল কেন? তেলের অভাবে মাছ ভাজতে পারছি না।
-তুমি জানতে আজ আমি আসব?
-হুম। পিঠ চুলকে দাও।মশা কামড়াচ্ছে।
– হাত ধুয়ে আসি।
-হ্যান্ডওয়াশ নাই। চাকা সাবানে কাজ চালাও। আর হাতমুখ ধুয়ে ঘরটা পরিষ্কার দিও। বাথরুমে শার্ট-প্যান্ট ভিজিয়ে রাখছি। একটু কষ্ট করে কেচে দিও। চোখ বড় বড় করে বললাম,
-তুমি এজন্যে আমাকে আসতে বলছ?
-অবশ্যই।চেহারা দেখতে মন চাইলে তো ভিডিও কল দিতাম। যাও দেরি করো না।
-আচ্ছা।অসভ্য লোক তুমি!
চোখ ফেটে কান্না আসছিল। ওর কাছ থেকে সরে এসে চোখের জল লুকালাম। এত নতুন নয় যখন ইর্ন্টানি করত রাত জেগে ওর অ্যাসাইমেন্টের কাজ করে দেওয়া ছিল আমার ডেইলি রুটিন। ওর নোংরা কাপড় লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে ইস্ত্রী করে দিতাম। আজ অবধি কখনও ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানায় নি ও কী না এতটাই অকৃতজ্ঞ। আর আমি অদৃশ্য সম্মোহনে এই স্বার্থপর লোকটার কাছে বারবার ছুটে আসি। তার পিঠে মুখ ঘষে বলি,
-ভালোবাসি। সে বলে,
-সস্তা ন্যাকামো করবে না প্লিজ। চুলগুলো টেনে দাও।মাথাটা ভারী লাগছে। ঘর সাফ করছিলাম সে রান্না করার এক ফাঁকে এসে দেখা করে গেল,
-চা খাবে?
-আমি কি চা খাই!
-বিস্কিট আছে বিস্কিট খাবে?
-বুয়ার কাজ করতে ডাকছ করছি এত অ্যাপায়ন করতে হবে না। ও হাসতে হাসতে আরাম করে চেয়ারে বসল।
-ভাবছি দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তোমার বাবার সাথে কথা বলব। কিন্তু টাকাপয়সার সঙ্কটে ভুগছি।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। ও চাকরি পেয়েছে দেড় বছর। এতদিন পরও ও বিয়ে করবার মত কিছু টাকা জমাতে পারল না। ব্যাংকার বাবাকে সংসার চালাতে সাহায্য করতে হয় না। নিপা নামের ওর কোন স্কুলের বান্ধবীর ডির্ভোস হয়ে গেছে তাকে সাহায্য করতে হয়। মেসের খরচ আছে আর আছে প্রতি মাসে নেপাল,ইন্ডিয়া সফর।।প্রতিদিন দেড় প্যাকেট বেনসন না হলে তার চলে না। শুধু সস্তা বেনারসি আর নাকছাবিতে সাজিয়ে বউকে ঘরে তোলার সুযোগ হচ্ছে না। টাকা-কড়ির অভাব তারচেয়ে বড় কথা ওর সদিচ্ছার অভাব।প্রেমিকা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না শুভদিন থেকে কোর্ট ম্যারেজ করলেই হল। এদিকে দফায় দফায় পাত্রপক্ষের সামনে হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত আমি। প্রেমিকা হোন কিংবা স্ত্রী পুরুষের কাছে কখনই প্রকাশ করতে নেই আপনি তাকে কতটা ভালোবাসেন। ভালোবাসা প্রকাশ পেলেই আপনাকে স্বপ্নের রানী থেকে দাসী বানাতে দু’সেকেণ্ড ভাববে না। ও জানে আমার সিগারেটের গন্ধে কষ্ট হয় তবু খচ করে সিগারেট ধরাল,
-বেলা, একটা ভুল হয়ে গেল।
-কি?
-বিয়েটা আগে সেরে নিলেই হল।একা থাকার এই দিনগুলোতে তোমাকে মিস করছি।
-সত্যি বলছ?
-ইয়ে.. খালা আসে না আমার খাবার-দাবারে কষ্ট হয় খুব। এবার আমি স্থান-কাল ভুলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলাম। সে চেয়ার থেকে মেঝেতে পাশাপাশিতে বসে আমার হাত ধরল,
-আরে, আমি তো মজা করছিলাম। এইযে দেখো তুমি ঘর পরিষ্কার করছ,এটা সেটা কাজ করছ৷ সবকিছুতে তোমার আঙুলের ছাপ রেখে যাচ্ছ৷ তুমি যখন চলে যাবে ঘর জুড়ে তোমার ঘ্রাণ রেখে যাবে। পেন্সিল, কলমদানি, বিছানা, বালিশ ছুঁয়ে আমি তোমার স্পর্শ খুঁজে পাব।
-তুমি একটা কুৎসিত লোক।
-তাই! অফিসের পায়েল বলে আমি দেবরাজ ইন্দ্রের মত দেখতে।
-এটা আবার কে!
-পায়েল কর্মকার। আমার কলিগ।বয়স ৪৫। আপনার অতিউৎসাহী হবার কোনো কারণ নেই।
-সরো। কাজ করতে দাও।
-তুমি করো আমি তাকিয়ে দেখি। কেমন বউ বউ ফিলিংস পাচ্ছি।
-যত্তসব। চুলায় তোমার তরকারি পুঁড়ছে।
ও তড়াক করে উঠে চলে গেল। একজন মানুষ অথচ এক কড়াই মাছের তরকারি রেঁধে রেখেছে৷ যুক্তি দেখাল এক সপ্তাহের রান্না একেবারে রেঁধে ফেলেছে।ফ্রীজে রেখে রেখে খাবে।
-তুমি রোজ রুই মাছ খাবে?
-হু। রান্নাবান্না একটা ঝামেলার ব্যাপার। অরুচি লাগলে সাথে ডিম ভেজে নিব।
-যা খুশি করো।
সে হাসল,
-তুমি জব করলেও আমার সমস্যা নাই পচা বাসি খেয়ে অভ্যস্ত আমি।
-আমি জব করলেও তোমার খাওয়ার কষ্ট হবে না।
-আমার খুব ইচ্ছা তুমি শাড়ি পরে লম্বা বেনী ঝুলিয়ে বাচ্চাদের ক্লাস নিচ্ছ।
-খোলাসা করে বললেই পারো শিক্ষকতা ছাড়া অন্য চাকুরি করতে দিবে না।
-আহা! তা বললাম কই!তবে দেশের বাইরে হলে অন্য কথা।
-জুনায়েদ,আমি যাই। মা বারবার ফোন করছে।
-চলো। সে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল।চোখ ছলছল।প্রতিবার এই চোখের মায়ার আমি ফিরে ফিরে আসি।
-অ্যামেতিস,আরেকটা কথা।
-কি?
-আমি অসু্স্থ হলে দেখতে এসো না।তোমার হ্যান্ডব্যাগে একটা মুক্তার নাকছাবি আছে হয়তবা এটাই শেষ উপহার।ভালো থেক।