ঘরবন্দী এই দিনগুলোতে অন্যদের কি অবস্থা হচ্ছে জানি না তবে আমার অবস্থা খুবই লজ্জাজনক হয়ে পড়েছে। কেন সেটা পরে বলছি। আগে আমার সংসারের বাকি দু’জন সদস্যের কথা বলে নিই৷ ফুপু শ্বাশুড়ি তার ভাঙা কোমড় নিয়ে নিজেও ভুগছেন এবং আমাদেরও ভোগাচ্ছেন। যে মানুষটা কিছুদিন আগেও একাকীত্বের মজা পেয়ে আমার সাথে বসে বিকেলের চা টা পর্যন্ত খেতে চাইতেন না, সেই মানুষটা এখন আমাকে ছাড়া চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। ফুপুর ভাষ্যমতে, এখানে এসে তিনি নিজেকে একটু সময় দিতে পারছেন। নিজের প্রতি যত্ন নিতে পারছেন৷ যত্ন নেয়া বলতে বুঝিয়েছেন একের পর এক পান মুখে দেওয়া, পুরনো পেটিকোটগুলোর যে যে জায়গায় একটুখানি ছিঁড়ে গেছে; চোখে চশমা লাগিয়ে সেগুলো সেলাই করতে বসে যাওয়া আর মুখের চামড়ায় আগে ক’টা ভাঁজ ছিলো আর এখন ক’টা ভাঁজ পড়েছে তার হিসেব রাখা। গ্রামের বাড়িতে সবদিকে নজর রাখতে রাখতে নিজের দিকে আর আলাদা করে নজর দেয়ার সময় হয়ে উঠে না।
তাই এ সময়গুলোকে তিনি বেশ উপভোগ করছেন। কিন্তু হঠাৎ করে কোমড় ভেঙে গিয়ে তার উপভোগের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেলেও আরেকজনের সাহায্য লাগে। তো এই অবস্থায় কি করে আর নিজের মত করে সময় কাটানো সম্ভব! সেজন্য তিনি আমার সময়গুলোতে ভাগ বসিয়েছেন৷ আমাকে সামনে বসিয়ে পান চিবুতে চিবুতে তার যৌবনকালের রসালো কীর্তিগুলো বেশ আয়েশ করে শোনান। তার দ্বিগুণ বয়সী বান্ধবীর বড়ভাইকে তার রূপের ফাঁদে ফেলে কিভাবে নাজেহাল করেছেন, পাড়ার ভদ্র ছেলেদের বিনাদোষে কি করে বাবার কাছে বকা খাইয়েছেন, পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে বড়শিতে মাছ না উঠায় জেলেদের ভুলিয়েভালিয়ে কি করে তাদের মাছগুলো ঝুলি ভরে নিয়ে এসে সবার সামনে দিদিগিরি ভাব নিয়ে থেকেছেন এ গল্পগুলো শুনতে শুনতে আমার চোখ চলে যায় ফুপুর সাদা চুলের আড়ালে ঢেকে যাওয়া গুটি কয়েক কালো চুলগুলোর উপর।
অবাক হয়ে ভাবি, বয়সকালে এই রূপবতী নারী না জানি কত পুরুষের রাতের ঘুম হারাম করেছেন! পানের রসে লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এককালে এই ঠোঁটজোড়া কোনোরকম প্রসাধনী ছাড়াই না জানি কত রঙিন আর সতেজ হয়ে থাকতো! ফুপুর প্রত্যেকটা গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি আমি। মাঝেমধ্যে শোনা গল্পগুলোই আবার শোনানোর আবদার করি ফুপুর কাছে। ফুপু আমার আবদার রাখেন। আরেকটা পান মুখে পুড়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠে একটুখানি চুন নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলতে শুরু করেন। দেশের বর্তমান পরিস্থির ব্যাপারে ফুপু তেমন একটা অবগত নন। টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি ঘণ্টার সংবাদে তুলে ধরা চিত্রগুলো তার বোধগম্য হয় না। আমরাও তাকে বুঝানোর বা জানানোর চেষ্টা করি না৷ কি দরকার? অন্তত একজন মানুষ এসব আহাজারি, দুশ্চিন্তা থেকে বিরত থাকুক। তাছাড়া ফুপু দূর্বল প্রকৃতির মানুষ।
তারপর আসি বরমশাইয়ের কথায়৷ তিনি কেমন আছেন সেটা জানার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তিনি তার সাথে থাকা মানুষগুলোকে কেমন রাখছেন, তা জানা। কিন্তু এটা জানতে হলে আপনাদের যেতে হবে আমাদের বাসায় ফার্ণিচার আর দেয়ালগুলোর কাছে। কারণ আপাতত বরমশাইয়ের আশেপাশে এই ফার্ণিচার আর দেয়াল ছাড়া আমরা কেউ থাকছি না৷ গতকাল সকালে চা দিতে এসে দেখি, তিনি একা একা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন৷ দেয়ালকে করোনার আপডেট জানাচ্ছেন৷ তার মানে তিনি এদের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে৷ আজকাল তো আমি রাতেরবেলাও ফুপুর সাথে গিয়ে ঘুমোচ্ছি। প্রথমে ভেবেছিলাম বরমশাই আপত্তি জানাবেন কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল।
তিনি বরং আমার বালিশ আর কাঁথা নিজের হাতে এগিয়ে দিয়ে এসেছেন। ঠিকই আছে, প্রতিদিন ডাল-ভাত কার ভালো লাগে? মাঝেমধ্যে বিরিয়ানিরও প্রয়োজন আছে। আর আমার কাছে বিরিয়ানি হচ্ছে আমির খান। রাতে ফুপু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি ল্যাপটপের সামনে আমির খানের মুভি ছেড়ে বসি। তারপর সকালে ঘুম ভাঙে আমির খানের সাথে রোমান্সের স্বপ্ন দেখে। তবে বরমশাইয়ের বিরিয়ানির খবরও রাখি আমি কিন্তু তাকে বুঝতে দেই না যে আমি জানি। তার বিরিয়ানি হচ্ছে কারিনা কাপুর। শুনেছি, কারিনা কাপুরের ছেলে তৈমুর হওয়ার পর, তিনি নাকি নিজেকে তৈমুরের মামা ভাবতেন। আপন মামা না আবার, প্রাক্তন সুবাদের মামা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ফুপু ঘুমোচ্ছিলেন বলে আমি ড্রয়িংরুমে বরমশাইয়ের পাশে গিয়ে টিভি দেখতে বসে গেলাম। বরমশাই টিভিতে সংবাদ দেখছিলেন। আমি বসেই রিমোট ছিনিয়ে নিলাম তার কাছ থেকে।
– সারাক্ষণ শুধু নিউজ দেখেন কেন? দুশ্চিন্তায় থাকতে ভালো লাগে? বরমশাই সেন্টার টেবিলের উপর রাখা ম্যাগাজিনটা তুলে নিতে নিতে বললেন,
– কি দেখবে দেখো না৷ এত কথা শোনানোর কি আছে?
চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে একটা হিন্দি সিনেমাতে আমার চোখ আটকে গেলো। সিনেমাতে না বলে বলা ভালো, সিনেমার নায়কের উপর চোখ আটকে গেলো৷ ঠিক সিনেমার নায়কের উপরও না। কি করে বুঝাই! আসলে নায়কের ফিগারের উপর চোখ আটকে গেলো। আপনারা ভুলভাল কিছু ভাবার আগে কারণটা একটু ক্লিয়ার করে নিই। সেদিন ফুপুর সাথে বসে এই নায়কের অন্য একটা সিনেমা দেখছিলাম৷ নায়কটাকে দেখে ফুপুর মন্তব্য ছিল অনেকটা এরকমঃ
“এইডা পোলা না মাইয়া? মাইয়াগো মতো ঠোঁটে লিপস্টিক মারছে, মাইয়াগো মতো গায়ের রঙ আবার বুকটাও দেহি মাইয়াগো মতো উঁচা। ও বউমা, এইডার ভিত্রে মাইয়া না পোলা বাস করে কও তো?” ফুপুর প্রশ্নটার কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই আপাতত। কিন্তু এই মন্তব্যটা মাথায় ফিক্সড হয়ে গেছে তখন থেকেই। তারপর থেকে যতোবার এই নায়ককে দেখি ততোবার শুধু তার ফিগারের দিকে চোখ চলে যায় আমার। নিজের কাছে নিজে লজ্জা পাওয়ার মত অস্বস্তিকর অবস্থা আর হয় না৷ রাগের মাথায় টিভি বন্ধ করে দিয়ে উঠে পড়লাম সেখান থেকে।
– লুঙ্গিটা সুন্দর না? রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। বরমশাইয়ের প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম তার দিকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি লুঙ্গি কোথায় পেয়েছেন? আপনার সব লুঙ্গি তো আমি কেটেকুটে ফেলে দিয়েছিলাম।
– তোমার খালুর কাছ থেকে এনেছি৷
– খালু তো সহজে কাউকে কিছু দেয়ার মানুষ না। তো আপনাকে শুধু শুধু লুঙ্গি কেন দিতে যাবে?
– কাহিনী আছে। কিন্তু এখন বলার মুড নেই৷ এখন শুধু রোমান্সের মুড আছে।
– মেজাজ গরম করে দিবেন না প্লিজ। আপনি জানেন না, আপনার লুঙ্গি পরা আমার একদম পছন্দ না? একে তো ঠিকঠাকভাবে পরতে জানেন না, তার উপর সামলাতেও জানেন না।
– উঁহু, থামো না। মুড নষ্ট করো না প্লিজ। তাড়াতাড়ি এসো।
– ফুপু যে বাসায় আছে ভুলে গেছেন?
– থাকলেই কি! ফুপুর কোমড় ঠিক করে দিবো বলেছিলাম কিন্তু ভাবলাম এখনি ঠিক করা উচিৎ হবে না।
তাহলে এই সুযোগগুলো আর পাবো না। ফুপু সুস্থ থাকতে পুরো বাসা ঘুরে বেড়াতেন বলে আমি ঠিক করে আমার আবেগ প্রকাশ করতে পারতাম না তোমার কাছে। আর এখন দেখো। মনে প্রেম প্রেম ভাব এলো আর সাথে সাথে আমি উড়ে উড়ে চলে এলাম। আমি বরমশাইয়ের কাছে এগিয়ে এসে কোমড়ে হাত রেখে সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে জানতে চাইলাম,
– কি মুভি দেখে এসেছেন বলুন তো?
– আরে মুভি না, হইচই তে একটা সিরিজ দেখে এসেছি।
– কি সেটা? তিনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক চোখে উত্তর দিলেন,
– দুপুর ঠাকুরপো।
– আমি আপনার বৌদি লাগি নাকি আপনি আমার ঠাকুরপো লাগেন? আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বলে দিলাম। এক্ষুণি আমার সামনে থেকে যান আর লুঙ্গিটা খুলে রাখুন। আমি এসে এটাও কাটার ব্যবস্থা করছি।
– দেখো, তুমি কিন্তু আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছো।
– এবার কিন্তু আসল জায়গায় হস্তক্ষেপ করবো।
আমার হুমকি শুনে আর কথা না বাড়িয়ে শুকনো মুখে বরমশাই আমার সামনে থেকে চলে গেলেন। ওহ্, লজ্জাজনক অবস্থার কথা বলতে ভুলে গেছি৷ এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে একটা অন্যরকম সংবাদ আছে। কানে কানে বলছি শুনুন, আমি বোধহয় মা হতে চলেছি। এখনো সেভাবে নিশ্চিত হতে পারিনি বলে কাউকে জানাই নি। এমনকি বরমশাইকেও না। আপনাদেরই জানালাম শুধু। আপনারাও কাউকে বলবেন না কিন্তু হ্যাঁ?