লিনার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল আমার এক দুঃসম্পর্কের মামার মাধ্যমে। মামা বলেছিলেন, মাইয়্যা সাক্ষাৎ চাঁদের টুকরা। তবে চাঁদের মতো মাইয়্যারও একখান কলঙ্ক আছে। আমি সেই কলঙ্কের কথা না জানতে চেয়ে, জিজ্ঞেস করেছিলাম লিনা গ্রামে এসে থাকতে পারবে কি না। মামা বলেছিল, এই মাইয়্যা মঙ্গল গ্রহেও থাকতে রাজি।
বউ নিয়ে অন্য সবার মতো আমার কোনো বাতিক ছিলো না। আমার চাওয়া ছিলো মেয়েটা যেন কংক্রিটের শহর ছেড়ে আমার সাথে গ্রামে থাকতে রাজি হয়।
লিনাকে দেখতে গিয়ে আমি রিতীমত চমকে উঠেছিলাম। এই মেয়ে সত্যিই আমাকে বিয়ে করে গ্রামে গিয়ে থাকবে। কোনোরকম সাজগোজ ছাড়াই লিনা আমাদের সামনে মাথানিচু করে বসেছিল। আমি পাশে বসা বড় আপাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপা মেয়ে কী বিয়েতে রাজী নয়? আপাও ফিসফিস করে বলেছিল, এমনও তো হতে পারে মেয়েটা এরকমই! সাজতে পছন্দ করে না। তুই না হয় বিয়ের পর শিখিয়ে পড়িয়ে নিস। আমি আর কিছু বললাম না। এরপর লিনার সাথে একা কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হলো। লিনা ই প্রথমে কথা বলল, স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো, আপনার কী আমাকে পছন্দ হয় নি?
আমি সেকথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী সত্যিই গ্রামে থাকতে পারবেন? লিনা সেকথার জবাবে বলল, বোধহয় কষ্ট হবে না। এরপর আমি কিছু বলার আর খুঁজে পেলাম না। লিনা কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, আমার বাবা আপনাদের কাছ থেকে একটা ব্যাপার লুকিয়ে গেছেন। ইউনিভার্সিটি তে একটা ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। আমি লিনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি আর শুনতে চাই না। লিনা কিছু না বলে মাথানিচু করে একটু হাসলো। ফিরে আসার সময় আমি লিনাকে বললাম, আমার পরিবার ও আপনাদের একটা মিথ্যে কথা বলেছেন। বছর খানেক আগে আমার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। লিনা ওইটুকু সময়ে সেই প্রথম চোখ তুলে তাকিয়েছিল। কি সুন্দর সেই চোখ! অথচ একটু কাজলের ছোঁয়াও যেন নেই।
বিয়ের পর লিনা গ্রামে এসে থাকতে লাগলো। প্রথম দিকে ওর মানিয়ে নিতে যে কষ্ট হতো সেটা আমি বুঝতাম। কিন্তু লিনা কখনো মুখে সেটা বলেনি। আমি খেয়াল করে দেখতাম লিনা খুব আগ্রহ নিয়ে, যত্ন নিয়ে সংসারের কাজগুলো করছে। কিন্তু একটু পান থেকে চুন খসলেই মা কথা শোনাতেন। লিনা কখনো তার উত্তরে কিছু বলতো না।
আমি গ্রামের এক এনজিও তে চাকরি করি। শহর ভালো না লাগায় আর শহরমুখী হওয়া হয়ে ওঠে নি। লিনা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিল। তারপর ই বিয়ে হয়। বিয়ের মাস সাতেক পর আমার হঠাৎ মনে হলো লিনা কে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো, ও আর পড়তে চায় কি না! এক রাতে লিনাকে জিজ্ঞেস করার পর লিনা বলেছিল, কী হবে এতো পড়াশোনা করে! তার চেয়ে যেসব করলে ভালো হবে সেগুলো করি। লিনা কথাগুলো বলেছিল সরল গলায়। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, দুটো বাক্যে এক সমুদ্র অভিমান, অভিযোগ লুকিয়ে আছে।
এরপর থেকে আমার মনে হতে লাগলো, লিনা এখানে সুখী নেই। সুখী হওয়ার ভান করে যাচ্ছে কেবল। সবকিছুই নিয়মমাফিক করে যাচ্ছে। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে, রান্না করে, সংসারের কাজ করে। আর পড়ন্ত বিকেলে বারান্দায় বসে উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই লিনাকে দেখে আমার ভিতর টা ভেঙেচুরে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ইচ্ছে করে লিনাকে আটকে রেখেছি। লিনা শহুরে মেয়ে। ওর হয়তো এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো যেটা আমি বুঝতে পারিনি।
হঠাৎ এক রাতে সাহস করে লিনাকে বলে ফেললাম যেন ও চলে যায়। লিনা চোখে ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে আর কিছু বলল না।
লিনাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে লিনা হয়তো বলবে যে, ওর যেতে ইচ্ছে করছে না। ওর এখানেই ভালো লাগছে। কিন্তু লিনা সেরকম কিছুই বলল না। থমথমে মুখে ট্রেনে উঠে বসলো। আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম, লিনা তুমি চাইলে ঢাকায় থেকে যেও। আমি ছুটি পেলে আসবো। লিনা আমার চোখে চোখ রেখে হাসলো। সেই প্রথম দেখার মতো। ট্রেন ধীর গতিতে চলতে শুরু করছে। লিনা জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দ্রুত পায়ে হেটে লিনার চোখের আড়াল হলাম। চোখের কোনে জমতে শুরু করা পানি যেকোনো সময়ে গড়িয়ে পড়তে পারে। কী দরকার সেটা লিনাকে দেখানোর!
ঢাকায় যাওয়ার পর লিনার সাথে অল্পবিস্তর কথা হতো। দুজনের কম কথা বলার কারনে অল্পেই কথা ফুরিয়ে আসতো। আমি আশায় ছিলাম, লিনা হয়তো বলবে ও ফিরে আসতে চায় কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। মা বারবার তাড়া দেয় লিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কিন্তু আমার অভিমানী মন লিনাকে ফিরে আসতে বলতে চায় না।
লিনার ফিরে আসার আশা বাদ দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎই এক সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় মাখামাখি হয়ে লিনা ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালো। আমি হারিকেনের মৃদু আলোয় অবাক হয়ে লিনাকে দেখছিলাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিনা বলল, তোমার ইচ্ছেমতো যেমন গিয়েছিলাম তেমনি নিজের ইচ্ছেমতো ফিরে এসেছি। এতে অবাক হওয়ার কী আছে!
আমার বিস্ময় যেন কাটছিলো না। লিনা যেন এই কয়েকমাসে পাহাড়ি ঝর্নার মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। লিনা হেসে বলল, তোমার বাড়ির রান্নাঘর, বারান্দা, মায়ের কথা শোনানো, কাদামাটি এসব ছাড়া ভালো লাগছিল না তাই চলে এলাম। এবার তো ঢুকতে দাও! হারিকেনের মৃদু আলোয় দেখলাম লিনার চোখ কাজলে লেপ্টে গেছে। তবে কী লিনা আমার মন পড়েছিল! চোখের কোনে আবারও পানি জমতে শুরু করেছে। আমি হারিকেন টা নিভিয়ে দিলাম। লিনা কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ঠিক ই করেছ পুরুষ মানুষের চোখের জল দেখানো ঠিক না।