-কেমন আছেন ভাবী?
-এইতো ভাই চলছে দিনকাল। তোমার কি খবর বলতো?
-বুঝেনি তো সব। পেটে ক্ষুধা থাকলেও বাড়িতে বলতে হয় কেবল খেয়ে কাজে আসলাম।
-তো এতোদিন পর আমাদের কথা মনে হলো?বিদেশে গেলে সবাই পরিবর্তন হয়। আমি কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বললাম,
-জ্বী ভাবী সবাই পরিবর্তন হয়। যখন দশ ঘন্টা রোদে পুড়ে এসে খাবার রান্না করে খেতে হয় তখন মন চাইনা কাউকে ফোন দেই।
-তো কি মনে করে ফোন দিলে হঠাৎ? টাকা পাঠাবে নাকি? আমতা আমতা করে টাকার কথাটা লুকিয়ে বললাম,
-না ভাবী। বাড়িতে ফোন করতেছি, কিন্তু কারো সাড়া পাচ্ছি না।
অল্পখানি হাসি দিয়ে ভাবী আমাদের বাড়িতে ফোন নিয়ে যায়। দুই দিন আগে ফোনে মা বাবার সাথে কথা বললাম। মা বলেছিল, মিমের আম্মা টাকার কথা বললো। বুঝতে আর বাকী নাই, মা বলবে বেতন পেয়েছি কি না! আমি এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম, মা এখনো বেতন পাই নাই। শুনেছি কাল পরশু দিবে। মা আবার বললো, তুই বিদেশ গেলি চার বছর চলেছে। সুদ ছাড়া এক লাখ টাকা কেউ কাউকে এমনি এমনি তো আর দিবে না। ওদের টাকাটায় আগে দেয়া উচিৎ ছিল তোর বাবা।
মাথায় প্রায় এখনো তিন লাখ টাকার বোঝা ঝুলছে। যে কয় হাজার টাকা বেতন পাই সে হিসেবে ঋন শোধ হতে আরও দের বছর লেগে যাবে। লক্ষ করি, চোখ জোড়া ঘোলাটে হয়ে আসলো। ঝাপসা চোখে বাম হাতে লোহার বেড ধরে বললাম, দেখি মা বেতন হাতে পাইলে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দেয়ার চেষ্টা করবো। মা বললো, এর বেশি দিতে পারবি না? আমি হাসি দিয়ে বলি, খাওয়া খরচ বাদে বাংলা টাকার পঁচিশ হাজার টিকে। বাকী দশ হাজার ঋন করে দিতে হবে। ভাবী বাড়িতে ফোন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রেখে দেয়। দীর্ঘ পনেরো মিনিট অপেক্ষায় বসে থাকলেও ওপাশের ফোন এলো না। বাধ্য হয়ে ফোন দিলাম। ত্রিশ সেকেন্ড বেজে কেটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসে। ধরতেই শোনি মায়ের কণ্ঠ। মা বললো,
-ভালো আছিস বাবা?
-হ্যাঁ মা, তুমি?
স্পষ্ট শুনতে পেলাম মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-আল্লাহ্ যেভাবে রেখে খুশি। বেতন পাইছস?
-হ্যাঁ পাইছি। কিছুক্ষণ পর শারমিনের(বোন) বিকাশে পাঠাবো।
-কতো দিবি?
-পঁয়ত্রিশ হাজার। পঁচিশ হাজার দিবে মিমের আম্মাকে, আট হাজার দিবে টিউবওয়েল পাকা করতে যা খরচ হয়েছে সেখানে। বাকী দুই হাজার তুমি আর আব্বা মিলে খাবে। এই বলেই কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে দেই।
ডিউটি থেকে এসে রাতের খাবার রান্না করি। খাবার শেষ করে যে ব্যক্তি বিকাশ করে তার রুমে যাই। ঢুকতেই দেখি আরো কয়েকজন বিকাশ করার জন্য দাঁড়ানো। আমার উপস্থিতি দেখে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলবে? নরম সুরে বললাম, আপনার ব্যস্ততা শেষ হোক পরে বলি। এখানেও সবার সামনে সত্যটা বলতে লজ্জা পেলাম। কারণ, যদি বলি দশ হাজার টাকা বেশি পাঠাতে হবে! তাহলে বাকী মানুষ গুলোও বলতে পারে ওরে দিলে আমাদেরকেও দিতে হবে। তাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এক এক করে সবাই চলে গেল। তার পাশে বেডের উপর বসে বলি, বাড়িতে টাকা পাঠাবো। তিনি বললো, কতো পাঠাবে? আমি আমতা আমতা করে বললাম, পঁয়ত্রিশ হাজার। সে বিকাশ নাম্বার চাইলো। আমিও দিলাম। সাথে ছিল বারোশ পঞ্চাশ টাকা। টাকা’টা তার হাতে দিলাম। তিনি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, আর টাকা কই? লজ্জা নিয়ে মাথা নিচু করে বলি, সামনে মাসে দিয়ে দিবোনি। পরদিন ডিউটি থেকে এসে আবার ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে ধরতেই মাকে বললাম,
-টাকা পেয়েছো?
-বাবা তোর কথা নাকে বাজছে কেনো?
-হাল্কা একটু ঠাণ্ডা লাগছে মা। ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ খেয়াল করি মায়ের কান্না জড়ানো কণ্ঠ। আমি বললাম,
-কি হলো তোমার আবার? এভাবে কান্না করো কেনো? মা তবুও কান্না করেই চলেছে। কান্না মাখা স্বরে বললো,
-শুনেছি সৌদিতে বয়াবহ অবস্থা। বাবা দেশে এসে পড় তুই। টাকা লাগবে না। মায়ের কান্না শোনে আমারও চোখ ভিজে একাকার।
-কিভাবে যাবো? প্রায় ২১ কোটি জনগন। ৪২ কোটি গালি শুনতে হবে। ২১ কোটি জনগনকে মারতে চাইনা।
-আল্লাহর পায়ে সপে দিলাম। আল্লাহ্ দেখে শোনে রাখবে।