উদ্দেশ্য

উদ্দেশ্য

এই যে তুমি বারবার এখন “শুনো, শুনো” করছ। ধরো আমি আর কোনদিন তোমার ডাকে সাড়া দিলাম না, আর কথা হল না আমাদের, কি হবে? আচ্ছা, তোমার জন্মের কতদিন হল? মোটামুটিভাবে তাও সতেরো-আঠারো বছর তো হবেই। তো আমাকে এর মধ্যে কতদিন চিনো? সতের মাস হবে কি? না না, সম্ভবত একটু বেশি হবে মানে বছর দুই। তো যে আমাকে ছাড়া তোমার পনেরো-ষোলোটা বছর পার হয়েছে সে আমি এমন কে বলো? আমি না থাকলে কী বা হবে? শোনো কেউ সারাজীবন থাকে না।

কষ্ট লাগে, মেনে নেওয়া কঠিন হয় কিন্তু বাবা-মাও সাধারণত সারাজীবন থাকে না। সেখানে এই একটা আমি চলে গেলে এটা বিশেষ কিছু না। আমাকে ছাড়াও তোমার জীবন চলেছে, আমি আছি তাও চলছে, আমি হারিয়ে গেলেও চলবে। কিছু সুবিধা-অসুবিধা হবে তবে তা মানিয়ে নিতে হবে। আস্তে আস্তে মেনে যাবে। তোমাকে আবার কিভাবে মানিয়ে নিবো তা নিয়ে ফর্দ করতে বসা লাগবে না। যখন যেখানে যেটা সমস্যা হবে তখন সেইটা নিয়ে ভাববা, একটা সমাধান করে নিবা। ধীরে ধীরে কয়েক মাসের মধ্যেই আমি যে নেই তার জন্য কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হবে না।

আমি কয়েকবার বলেছি তো, পৃথিবীতে কোন জায়গা ফাঁকা থাকে না। যেখানটাকে তুমি ফাঁকা দেখো সেখানে আছে বাতাস। আর যেখানে তুমি ভরা দেখো সেখানে তো দৃশ্যমান কিছু আছেই। এই আমি তোমার নিত্যদিন থেকে মুছে গেলে নতুন একটা কেউ বা কিছু আমার জন্য সৃষ্ট ফাঁকা স্থানটা দখল করে নিবে। আর তোমার কি মনে নেই পুরোনো সেই দিনের কথা, আমি কিভাবে এসেছিলাম তোমার জীবনে? আমি তো এসেছিলামই একটা শূন্য সাময়িক ভাবে পূর্ণ করতে। তুমি কাজ চালানোর জন্য আমাকে চেয়েছিলে। দেখো আজ দিব্বি কাজ চলছে। আজ আর সেই বিশাল শূন্য স্থানটা নেই। মানছি আমি সরে গেলে হাল্কা ফাঁকা তৈরী হবে তা বেশি সময় থাকবে না। আমার মত মানুষ গুলো তোমরা বাঁচতে ভুলে গেলে তোমাদের একটু সাহায্য করার জন্য আসে। হ্যাঁ, তোমাদের সাথে থাকার যে কিছু সুবিধা আমরা পাইনা তা না। অনেক সুবিধা পাই কিন্তু একস্থানে বেশিক্ষণ আমাদের থাকা হয়না।

আমরা আসলে তোমাদের বাড়ির ফার্নিচার। সময়ের সাথে সাথে পুরাতন হয়ে একটা সময় বেমানান হয়ে যাই। তুমি আমাকে পুরাতন বলে ভাঙড়িপট্টিতে বেচে দেওয়ার আগে আমাকে চলে যেতে হবে। তুমি আমাকে বেচে দিলে অন্য যাদের আমাকে দরকার তারা যে পাবে না। তোমার মত এই “তুমি” দের বাঁচতে শিখাতে শিখাতে আমরা রক্ত-মাংসের জড় বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছি। এটা আমাদের বিজনেস ভেবোনা, এটা আমাদের চ্যারিটি মানে সমাজসেবা। ওহ, তোমরা তো আজকাল সমাজসেবাকে আবার বেশ্যামী ভাবো। তা যে ভাবো না কেন আমরা আছি বলে যে তোমরা জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাও তা অস্বীকার করবে? অথবা বেশ্যারা আছে বলেই তো তাদের খদ্দেররা কয়েক মূর্হুতের তৃপ্তি পায়, মিথ্যে কি?

জানো তুমি যেমন একদিন কাঁদার জন্য একটা কাঁধ ধার চেয়েছিলে আমার কাছে। আমি তোমাকে দিয়েছিলাম কিন্তু কেন দিয়েছিলাম ভেবেছ? কারণ একদিন না একরাত না, আমার জীবনে অনেক গুলো মাস কেটেছে আমি কেঁদেছি অনবরত কেঁদেছি; বালিশে মুখবুজে। আমার বুকের ভেতরে খাঁ খাঁ করেছে মনে হয়েছে কেউ কি নেই আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে। একটু শক্ত করে ধরবে, আমার যে বুকে মধ্যে থেকে ফেটে যেতে লাগছে। সেদিন-সেরাতে কেউ কাছে আসেনি একটু, একটুখানি চোখের জল মুছে দেয়নি।

এই একাকী কাঁদার সুখের মাঝেও কেউ এসে চোখ মুছে দিতে চেষ্টা করুক। তার কাছ থেকে দূরে হটে যাবো তাও মনে মনে চাইবো সে আবার কাছে আসুক চোখটা মুছে দিতে। এই আকাঙ্ক্ষার কষ্ট আমার জানা। আমি চাইনি এই কষ্ট আর কেউ পাক। তাই তো তোমাকে আমার কাঁধে এলিয়ে কাঁদতে দিয়েছি। এখন আর তুমি কাঁদোনা আগের মত, এখন আর সকালে-বিকালে আমার তোমার হাত ধরে তোমাকে টেনে বেড়ানো লাগে না। এখন তুমি অনেকটা হাসিখুশি থাকতে পারো। তুমি এখন আমাকে সবসময় আশেপাশে পেলে অস্বস্তি কর। উলটো তুমি এখন মাঝে মাঝে আমাকেই এমন করে আঘাত করো যে আমারই একটু কান্না চলে আসে।

শোনো ভালো থাকার জন্য লড়ো। আমাকে চলে যেতে হয়। আমি অনেকবার চলে এসেছি এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। এখন আবার আমার যাবার পালা এগিয়ে আসছে। আমাকে যেতে হবে, আমি চলে যাবো। তুমি যদি আমাকে কাঁদিয়ে দাও তবে কি হবে ভেবেছ? আমি কাঁদলে কেউ যে কাঁধ বাড়িয়ে দিবে না, কেউ বুকে চেপে ধরবে না। তাই আমার কাঁদা বারণ। তুমি আমাকে কাঁদিয়ে ফেলার আগে আমাকে চলে যেতে হবে। তোমাকে আমি আমার সাধ্যমতো বাঁচতে শিখিয়েছি।

একেকজন একেটা জিনিস শিখাতে পারে। আমি যাওয়ার পর যদি আবার তোমার কান্না আসে। তাহলে আমার মত অন্য কেউ চলে আসবে, এ নিয়ে চিন্তা করো না। আমার মত অনেক রক্ত মাংসের জড় খেলনা আছে। আমাকেও তো এমন হতে শিখিয়েছে কেউ। রাতের খোলা জানালা ধারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকো মাঝে মাঝে। হারিয়ে যাওয়া কেউ আকাশের তারা হয়না। তবে আকাশের তারার মাঝে কাউকে খুঁজে নিয়ে, বুকের জমানো কিছু কথা বলে দিতে হয়।

বুকটা হাল্কা হলে জীবনের ওজনটা কম হয় একটু। জীবন বেশি ভারি হলে তো বাঁচা কঠিন হয়। তাই বাঁচার জন্য মন ভুলানো কিছু কাজ করতে হয়। বাচ্চাদের যেমন মায়েরা, “আয় আয় চাঁদ মামা” শুনিয়ে মন ভোলায়। মা জানেন চাঁদ মামা কোনদিন তার বাচ্চার কাছে আসবে না তারপরেও বাচ্চাকে শান্ত করতে শোনান এই গান। বয়স যতই বাড়ুক যদি মন থাকে, আবার বলছি যদি মন থাকে। জীবিত একটা মন থাকে তবে মনের বাচ্চামি কম-বেশি থাকবেই। আর তাই মন ভুলাতে মাঝে মাঝে এমন কিছু বাচ্চামি করতে হয়। বড় হয়েছি বলে ইগোতে চেপে থেকো না। একটু চেষ্টা করে দেখো, মায়ের আদর বৃথা যায় না তাই মায়ের বুদ্ধি বড় হয়ে গেলেও কাজে লাগে। তবে ইতি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত