প্রথম আত্মতৃপ্তি

প্রথম আত্মতৃপ্তি

বিয়ের পরেই নিজের জামাই সম্পর্কে যে ব্যাপারটা আমি প্রথম খেয়াল করেছিলাম,সেটা হলো– আমার জামাই কখনো কারো হাতে টাকা দিতে চায় না..বিষয়টা হলো এরকম যে, কোন কিছু প্রয়োজন হলে সে নিজে কিনে এনে দিবে..কিন্তু নগদ টাকা সে হাতে দিবে না এমনকি আমারও না.। তবে কিছুদিন যেতেই আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম,আমার জামাই প্রতিবার বাজার করে ফিরে আসার পর শ্বাশুড়ি মা তার কাছে এসে টাকা চায়.. কোন পরিমাণ বলে না।কড়া গলায় শুধু বলে,

–আমাকে কয়টা টাকা দে তো,নিশান..

আমার জামাই কোন উত্তর না দিয়েই,বাধ্য ছেলের মতন পুরো ওয়ালেট ধরেই শ্বাশুড়িকে দিয়ে দেয়..ওয়ালেটের ভেতরটা উঁকি-ঝুঁকি মেরে ওখান থেকে তার ইচ্ছে মতন খুচরা টাকা নিয়ে যায় অর্থাৎ এক শ্বাশুড়ি মা ছাড়া কেউই আমার জামাইয়ের কাছ থেকে নগদ টাকা পেতো না বিষয়টা আমার কাছে শুরুতে খারাপ লাগতো না। কিন্তু আস্তে আস্তে আমার কাছে কেমন জানি বিঁধতে লাগলো.. না না..শ্বাশুড়ি মায়ের উপর না..জামাইয়ের উপর কারণ,বিয়ের পরে মেয়েদের নিজের কম করে হলেও আলাদা টাকা-পয়সা লাগে..যেগুলো মেয়েরা বলতে পারেনা,কিন্তু তাদের প্রয়োজন টা আসলেই থাকে ব্যাপারটা নিয়ে মাঝে মাঝেই মন খারাপ লাগতো আমার..বিশেষ করে বাবার বাড়িতে যাওয়ার সময়.. ওখানে যাওয়ার সময় কোন জিনিস কেনাতে কার্পণ্যতা করেনা..কিন্তু মেয়েদের মনে গোপন কিছু ইচ্ছের সাধ থাকে,যেটা কিনা তার স্বামীর সম্মানের কারণেই।।

বাবার বাড়িতে ছোট ছোট ভাইবোনকে টাকা দিয়ে বলতে ইচ্ছে করেতোদের দুলাভাই দিয়েছে, ইচ্ছে করে মায়ের হাতেই একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলি মা তোমার জামাই তোমাকে দিলো,ইচ্ছে করে বাড়ির বুয়া চাচীকেও কয়টা টাকা ধরিয়ে বলি আপনাদের জামাই দিয়েছে চাচী,পান খেয়েন ইচ্ছে মতন যখন আমি পারতাম না এগুলো করতে, তখন আমার মনটা খুব খারাপ হতো ওকে কিছুই বলতে পারতাম না,আমাকে যদি ও ভুল বোঝে সেই শংকাতে..মাঝে মাঝে অভিমান এতোটা জমতো যে আমি কিনা,মনের অজান্তেই মনে মনে ভেবে বসতাম– “সে মাকে টাকা দেওয়ার সময় আমাকেও তো একবার দিতে পারে..অল্পই না হয় দিক..” এসব মনে আনতে চাইতাম না..কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না,”সংসার বড়ই জটিল জিনিস..”

অতঃপর কিছুদিনের ভেতর আমার কাজিন বোনের বিয়ে ঠিক হলো..সব বোনেরা ফোন করে বলছে,কনে কে এটা দিবে,ওটা দিবে,আলাদা করে এটা-ওটা করবে…আমি শুধু শুনতাম আর হেসে হেসে উত্তর দিতাম..সবার সাথে কথা বলার পর আমার মনটা এতোটাই খারাপ হয়ে যেতো যে আমি অনেকক্ষণ কান্না করেছিলাম.।জামাই অনেক বার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলো,কিন্তু বলতে পারিনি…

সেসময় একটুও ইচ্ছে হচ্ছিলো না,বিয়েতে যাওয়ার…যেহেতু আপন কাজিন,আমাদের যেতেই হবে..মনটা অনেক ভার করেই সব গুছিয়ে নিলাম যাওয়ার জন্য..বের হবো তার কিছু সময় আগ দিয়ে হুড়মুড় করে আমার শ্বাশুড়ি মা আমাদের ঘরে ঢুকলেন..এসেই আমাকে কাছে ডেকে,আমার ডান হাত টা নিজের হাতের ভেতর করে উঠিয়ে আমার মুঠোভরে কাগজের মতন কি জানি দিলেন আমি অবাক হয়ে মুঠো খুলেই দেখি- হাতের মধ্যে পাঁচশ টাকার অনেক গুলো নোট আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না অবাক চোখে মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম..শ্বাশুড়ি মা খুব শুভ্র চেহারা নিয়ে বললেন– “আমার ছেলের কাছে থেকে টাকা নিয়ে নিয়ে তোমার জন্য জমা করেছিলাম..ও ছোটবেলা থেকেই টাকা-পয়সা দিতে চায় না..ভেবেছিলাম বউয়ের সাথে অন্তুত এমন করবে না..যখন থেকে জানতে পেরেছি,তোমার সাথেও ও এমন করে।তখন বাধ্য আমাকে এটাই করা লাগলো…তুমি কিছু মনে নিও না,বউমা..বাবার বাড়িতে যাচ্ছো,টাকাটা প্রয়োজন মত খরচ করো শ্বাশুড়ি মায়ের কথাগুলো আমি মুগ্ধ চোখে হা করে শুনছিলাম।খারাপ লাগা গুলো একেবারেই গায়েব হয়ে গেলো।।

হঠাৎ করেই আমার চোখের কোণা দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে গেলো শ্বাশুড়ি মা ওটাও বুঝতে পেরে একেবারে কাছে এগিয়ে এসে আমার মুখে আলতো স্নেহে হাত রেখে বললো– “আমিও তো বউ সেজে এসেছিলাম এই ঘরে আমি জানি,কোথায় কেমন লাগে বউমা আমি নিজে যেসব পাইনি সেসব তোমাকে দিতে চাই..তুমি শুধু খেয়াল রেখো সবার এতো মমতার কথা শুনে আমার বুকটা খুশিতে ভরে উঠলো।সে এক অদ্ভুত রকমের উচ্ছ্বসিত খুশি। শ্বাশুড়ির মাঝে প্রথমবার আমার মায়ের ছায়া অনুভব করে গর্ববোধ করলাম নিজের জন্য..ভরসা নিয়ে মাকে বলে উঠলাম– “আপনার ভালোবাসা আমার অনুপ্রেরণা হবে মা দোয়া করবেন..আমি ভুল করলেও,মায়ের মতই আমাকে শুধরে দিয়েন মুহুর্ত টা ছিলো অন্যরকম সুখের ছোঁয়া,নতুন জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম আত্মতৃপ্তি…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত