সংযোজক অব্যয়

সংযোজক অব্যয়

খিদির, তোর বউ নাকি ভাইগ্যা গেছে? মাইগ্যা মাইনষের বউ কোনোকালেই টেকে নাই, মাইয়্যাডা গিয়া ভালাই করছে, শইলেরও তো একটা হক আছে। জয়নবেরর এমন ট্যারা কথার জবাব দেয় না খিদির, গোবর ছেনে পাতলা করে নিতে ব্যস্ত সে৷ জয়নব বোঝে খিদিরকে তাতিয়ে দিয়ে আজ আর লাভ হবে না। জয়নব টালের বুড়ো পুঁইশাকের গোটা কয়েক পাতা ছিঁড়ে নিয়ে খিদিরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় যুদ্ধে হেরে যাওয়া মিচকা ইঁদুরের ন্যায়। খিদিরের বিশাল দেহ, চওড়া বুক আর ঘন দাড়ি দেখে অচেনা কেউ প্রথম সাক্ষাতেই সুপুরুষের উদাহরণ টানতে খিদিরকেই যে বেছে নেয় এই নিয়ে বিন্দুমাত্র সংকোচ থাকা চলে না।

তবে স্বভাব, আচরণ জানবার পর তকে না-মেয়ে, না-ছেলের মধ্যবর্তী জায়গাটাতে বসিয়ে দিতে কেউ কার্পণ্য করে না৷ চিটচিটে রোদ ওঠা দুপুরে কিংবা খালি পেটে থাকা অবস্থায় কেউ যদি খিদিরকে মাইগ্যা বলে সম্বোধন করে তবে খিদির ঠোঁট মুখ বাঁকিয়ে বলে ” কিরে নটির ছেলে, দুই পোলাপাইন কি তোর বাপে বানাইছে “? । খিদিরকে তাতিয়ে দেয়া মানুষটা কখনো ওমন প্রশ্নে মেকি হাসি হেসে নিজেকে অপ্রস্তুত হতে দেয় না আবার কখনোবা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ” দুই পোলাপাইনের বাপ কেডা হেইডা তোর বউরে গিয়া জিগা”। খিদির এমন জবাবে ঝগড়া বাঁধাবে কি না সেটা অনেকটাই অপর পাশের মানুষের গায়ের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে।

আড়াই হাত সমান পাঠকাঠিতে মুঠ মুঠ করে গোবর লাগিয়ে এক এক করে তা আধকোমর সমান বাঁশের মাচায় হেলান দিয়ে রেখে চলেছে খিদির। বাসি গোবরের মাঝে কয়েক ফোঁটা চোখের জল নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে চলেছে। খিদির ফুঁপিয়ে কাঁদে না, গোঙায় না, চোখও মোছে না। ঝাপসা চোখ দুটোর পাতা বুজে নিতেই যেন স্বপ্নের মতো দেখতে পায়, এইতো সেদিন রাহিলা ঘরে পা রেখেছিল লাল টুকটুকে একখানা শাড়ি বেশ যত্নে গায়ে মুড়িয়ে। রাহিলার হাতে থাকা চুড়ির ঝনঝনানি, কিটকিটে হাসিতে সদ্য ছা দেয়া মা পায়রাটাও খুশিতে বাক বাকুম করে বার কয়েক ডেকে উঠেছিল। রাত্রির প্রথম ভাগে রাহিলার নাকফুলের চিকন আঁচড়ে খিদিরের ধবধবে মুখের বাঁ দিকটায় লাল সুতোর মতো দাগ হওয়ায় রাহিলার সে কী লজ্জা!

খিদিরের ঘোর কাটে, স্বপ্নের মতো উড়ে আসা দগদগে স্মৃতিগুলো পোঁজা তুলোর মতো উড়ে পালায় ছবীরের ডাকে। ছবীর খিদিরের বড়ো ছেলে, বয়স কেবল আট । ছবীর সকাল থেকে না খাওয়া, এখন দুপুর ছুঁইছুঁই। খিদির হাতের পাতায় কোনোরকমে চোখ মুছে নিয়ে বলে, বও আব্বা, আমি হাত ধুইয়া ভাত দিতাছি। ছবীর ঘাড় নাড়িয়ে ধৈর্য ধরার সম্মতি জানিয়ে চোখ বাড়িয়ে তার মা আর বোনটাকে খোঁজে, পায় না, বাবাকে মা-বোনের কথা জিজ্ঞেস করার সাহস করে না আর। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করাতে খিদির ধমকা ধমকি করে ছবীরকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। হাঁপানিতে ভোগা শীর্ণ শরীরের ছবীরের আজ যেন নিশ্বাস নিতে কষ্টটা বেশিই হচ্ছে, এর দায় যতটা না হাঁপানির তার চেয়ে খানিকটা বেশি তার ছোটো বোন টুনটুনির অনুপস্থিতি। ছবীর ভারী বুক নিয়ে,কাঁচা চোখ দুটো নিয়ে লেবুতলার দিকে তাকায়। না, টিয়ে রঙা জামা পরা টুনটুনিটা আজ আর নেই লেবুতলায়।

খিদির ঝপাঝপ হাত ধুয়ে কলপাড়ের লেবু গাছ থেকে গোটা চারেক লেবু পাতা ছিঁড়ে নিয়ে হেঁশেলে ঢুকে যায়। মাটির হাঁড়ির তলানিতে থাকা মুঠো দুয়েক পান্তাভাতের সাথে আধা জগ বাসি পানি ঢেলে দিয়ে, বেশ খানিকটা নুন আর নুনের বয়ামে তুলে রাখা শুকনো মরিচ ভালোভাবে বাসনে ডলে নিয়ে ছবীরের দিকে এগিয়ে দিয়েই ব্যস্ত গলায় বলে, তুমি খাও আব্বা। আমি নিজামগো বাড়িত যাই, বেলা হইছে মেলা। ছবীর অবাক হয়ে ভাতের বাসনটা কোলের কাছে এগিয়ে নেয়, ছোট্ট ছবীরটাও বোঝে তারা বাবা মিছে অভিনয়ে ব্যস্ত, তারা বাবা পালাতে চাচ্ছে। অথচ একটাবারও স্বীকার করতে নারাজ, স্ত্রী-কন্যা হারাবার ব্যথার সাথে পাড়াপড়শির তীক্ষ্ম খোঁচাটা এই নরম মনের মানুষটার বুকখানিতে ভিমরুলে হুল ফোটাচ্ছে। ছবীর মাথা নেড়ে বাবার কথায় সম্মতি জানাতেই খিদির বেরিয়ে পড়ে।

নিজের খেতে ধান বুনে, মুড়ি ভেজে হাটে বেচে, বন্যাশ্বরীর বিলে মাছ ধরে খিদিরের সংসার চলে। অভাব আছে, আবার নেইও। খিদির নিজামদের বাড়ির দিকে প্রতি কদম ফেলতে ফেলতে নিজেকেই প্রশ্ন করে, কেন চইলা গেল রাহিলা? উসমানের চাতাল আছে, দালানঘর আছে বইলা? হ, তা-ই হইব। খিদির নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয়। তবে এই নিঁখাদ সত্যর বাইরে আরো একখানা সত্য মানতে খিদিরের যত আপত্তি। উসমানের গায়ে লেগে থাকা সিগারেটের গন্ধ, ঘোলাটে নেশাতুর চোখ আর সুড়সুড়ি দেয়া বেফাঁস কথা আর দশজনের সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষ খাঁটি পুরুষের সিল উসমানের কপালে এটে থাকায় রাহিলা উসমানের আবেদন উপেক্ষা করার মতো একটা কারণও পায়নি। রাহিলার উসমানের কাছে নিজেকে সঁপে দেবার যতটা না দায় খিদিরের স্বভাবসুলভ আচরণ, আর অভাব তার চেয়েও বেশি ছিল ত্রিশে পা দেয়া বয়সখানা।

মেয়েদের ত্রিশে পা দেয়া বয়স কার্তিকের বৃষ্টির মতো, এই বয়সে যৌবনের শেষ ঝলকানির দেখা মেলে। তারপর দুম করেই হারিয়ে যায়, ঠিক যেমনি হুড়মুড় করে ঝরে হুট করে হারিয়ে যায় কার্তিকের বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে উসমানকেই কেবল ভাসায়নি, রাহিলা নিজেও ভেসেছে বৈ। খিদির হুট করেই থেমে দাঁড়ায়, জোরে নিশ্বাস নেয়, আশাপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে কেউ আছে কি না । না, কেউ নেই। খিদির বুকে থাকা গামছাখানা মুখের সাথে চেপে ধরে গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে। রাহিলাকে কেন চাতালে পাঠাত মুড়ির ধান শুকাতে এই আফসোসের ঝাঝ মেটাতে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে নরম মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে যেতে চায় সে।

নিজামদের বাড়িতে একদুপুর ধান বাড়িয়ে শেষ দুপুরে বাড়ি ফিরেই পেয়ারা তলার দুমুখো মাটির চুলোয় ভাত আর সজনে বসিয়ে দেয় খিদির। ছবীরটা বারান্দায় পাটি ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে খিদে নিয়েই, সূর্যের মোটা দাগের আলো তার মুখে আছড়ে পড়েও ঘুম ভাঙাতে পারছে না। চুলোয় শুকনো বাঁশপাতা ঠেলতে ঠেলতে খিদিরে টুনটুনির কথা মনে পড়ে, মেয়েটা তাকে বাজার থেকে আসতে দেখলেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ত বুকে। পাতলা দুটো ঠোঁট নেড়ে বলত, আব্বা, কী আনছো আমার লাইগা? বাতাসা নাকি দানাদার? খিদির যখন মুখ গোমড়া করে বলত, না গো মা, কিছু আনি নাই। টুনটুনিটা তখন কপাল কুঁচকে বুড়িদের মতো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলত, থাক তাইলে আর কী করা ।

খিদির হেসে কুটিকুটি হয়ে বলত, দুইডাই আনছি রে মা। বাতাসা আর দানাদার হাতের মুঠোয় নিয়ে টুনটুনিটার সে কী হাসি! কেবল দুটো ডানার অভাবেই উড়ে উড়ে এ ডাল, সে ডাল ঘুরে বেড়ানো হতো না তার। আর রাতের বেলায় সে তার মায়ের পাশ থেকে উঠে এসে খিদিরের গলা জড়িয়ে ধরে বলত, আব্বা, তোমার শইলের গন্ধটা এত মজা কেন? খিদির কেবল হাসত। না, খিদির আর ভাবতে পারে না। ব্যস্ত হাতে কঞ্চি দিয়ে বাঁশপাতা ঠেলে দিতে থাকে চুলোর ভেতর।

রূপ, যৌবন কিংবা চামড়ার সৌন্দর্য কাছে গেলেই ফিকে হয়ে আসে। মেঘ দূর থেকেই মোহ জাগায়, কাছে গেলেই কেবল অর্থহীন ঠেকে। এই নিয়মের বাইরে যায়নি রাহিলাকে ঘিরে থাকা উসমানের বিস্তর নেশা, পাগলামি কিংবা মোহ। বছর খানেক ঘুরতেই উসমানের আদুরে গলার সম্বোধনগুলো বুড়ো কাকের মতো কর্কশ হয়ে এসেছে, সে আবার প্রথম পক্ষের বউয়ের শাড়ির আচঁল আর চাতালে কাজ করা পরের বউদের দিকে বেশ ঝুঁকে পড়েছে। টুনটুনিটার মন খারাপ যেন আজকাল বেশিই হয়, ছয়ে পা দেয়া টুনটুনি বিকেল হলে গোল্লাছুট খেলতে যায় না, মায়ের কাছে এটা সেটার বায়না ধরে না।

প্রায়ই ঘ্যানঘ্যান করে ছবীরের কাছে, খিদিরের কাছে যাবার বায়না ধরে। রাহিলা প্রথম দিকটায় চোখ পাকাত, ভয় দেখাত। ইদানীং সেই সাহসটুকুও হারিয়েছে রাহিলা। চোখের সামনে পৌষ পেরিয়ে চৈত্রের দাবদাহ সহ্য করা যায়, মেনে নেয়া যায়, তবে প্রিয়জনের বদলে যাওয়া? এতটা সহজ নয় বলেই রাহিলা আজকাল কান্নার জন্য ফাঁকা জায়গা খোঁজে, অনুতাপে ভোগে। কেবল সেই অনুতাপ স্বীকার করার সাহসটুকু দেখাতে পারে না, কোন মুখেই বা দেখাবে?

পাশের ঘর থেকেই উসমান আর তার প্রথম পক্ষের বউয়ের ফিসফিসানিতে ঘুম ভেঙে গেছে রাহিলার। রাহিলার চিকন দাগের উপেক্ষা, অভিমান মোটা হবার আগেই খেয়াল হলো যে টুনটুনিটা জেগে আছে। রাহিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ঘুমাস না কেন?

টুনটুনি বুঝদার রমণীর ন্যায় অন্যপাশ ফিরিয়ে অভিমানের সুরে বলে, ঘুম আহে না, আমারে আব্বার কাছে নিয়া যাও, ভাইয়ের কাছে নিয়া যাও। রাহিলা জবাব দেবার আগেই পাশের ঘর থেকে বাজখাঁই গলায় উসমান বলে, কিরে মাগি! এত রাইতে গলা শোনা যায় কেন? মাইনষেরে ঘুমাইতে দে, নাইলে কালকাই লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু। উসমানের এমন নির্লিপ্ত আচরণে তার চব্বিশে পা দেয়া প্রথম পক্ষের বউটা কিটকিটিয়ে হেসে ওঠে আর রাহিলা দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যায় কেবল। অসহায়ের মতো রাহিলা টুনটুনিকে জড়িয়ে শান্ত হতে চায়, টুনটুনি সেই সুযোগটুকুও দেয় না। রাহিলার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে যায় টুনটুনি।

শকুনতলা খালের বাঁশের সাঁকোর বদলে ছোটোখাটো একটা ব্রিজ বসেছে, বাজারে দোকানপাটের সংখ্যা বেড়েছে, গাঁয়ে জমির দামও বেড়েছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে রাহিলার প্রতি উসমানের অত্যাচার। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে উসমান। এইতো সেদিন উঠানে এঁটো পানি ফেলার কারণে টুনটুনিটাকে কী মারটাই না দিল! রাহিলা হাতেপায়ে ধরে মেয়েকে বাঁচিয়েছে কোনোরকমে । উসমানের অত্যাচারের সাথে সতীনের নানারকম মানসিক অত্যাচারে রাহিলা আর টিকতে পারেনি। মেয়েটাকে বাঁচাতে, নিজেকে বাঁচাতে উসমানের বাড়ি ছেড়ে অগত্যা বেরিয়ে যেতে হয় রাহিলাকে। লজ্জায়, দ্বিধায়, নিজের প্রতি থাকা ঘৃণায় খিদিরের বাড়িতে ওঠার সাহস হয় না তার। ভাইদের সংসারে যেয়ে উঠতে হয় যাবার কোনো জায়গা না থাকায়।

ওদিকটায় খিদিরের দগদগে ঘা প্রায় শুকিয়ে এসেছিল কেবল দাগটুকুন বাদে। বাপ ব্যাটার সংসারে খিদির যখন সন্ধ্যা হলেই মুড়ি ভাজতে চুলোয় খড়ি ঠেলে তখন গরম বালুতে পাকা হাতে চাল ঢেলে চলে ছবীর। খিদির কলাই শাক চুলোয় তুলে দিয়ে খালাস, তেল-নুন যা দেবার ছবীরই দেয় বাপের পাশে বসে। বাপ ব্যাটার সংসারে অভাব নেই, ব্যস্ততা আছে। খিদিরের তামাম ব্যস্ততা মাটির ব্যাংকে দুটো পয়সা জমাবার ধান্দা খোঁজা আর ছবীরের ব্যস্ততা বাপটার কষ্ট কমাতে হেঁশেলে ভাগবাটোয়ারা করে তরকারি রাঁধা, পাটকাঠিতে গোবর দেয়া, মুড়ি ভাজার সময় চুলোর পাশে থেকে তপ্ত বালুতে চাল ঢালা।

এতসব সুখ আর ব্যস্ততার ভিড়ে ছবীরের ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে কাউকে মা ডাকতে, কাউকে বোন করে ছোট্ট উঠোনটায় চাড়া দিয়ে কুতকুতের ঘর করে আস্ত বিকেলটাকে সন্ধ্যা করতে। খিদির ছবীরের মন খারাপের সময়টাতে যখন থুঁতনি ঝাঁকিয়ে বলে, কী হইছে আমার বাজানের? উত্তরে ছবীরের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, ছবীর নিশ্চুপ থেকে জানান দেয় তার যে রোগ হয়েছে সে রোগের রোগী তার বাবাও, সে একলা নয়৷ ছেলের চোখে রোগের সন্ধান পাওয়া মাত্রই খিদির বুনো বুকে ছেলের মাথাটা লুকিয়ে ফেলে, সুযোগ পেয়ে ছবীরটা হাপুসহুপুস করে এক বিকেল কাঁদে।

বাপ ব্যাটার এমন বুনো কষ্ট মিইয়ে যাবার পথ বাতলাতেই এক ভরদুপুরে খিদিরের বাড়িতে এসে হাজির রাহিলার মেঝো ভাই তরিকুল । খিদির আর ছবীর পেয়ারা তলায় রাঁধতে বসেছিল। ছবীর তার মামাকে দেখে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখায় না, নির্বিকার ভঙ্গিতে কড়াইয়ের গরম তেলে পেঁয়াজকুচি নেড়ে চলে। খিদির সৌজন্যতার হাসি হেসে বলে, ভাইজান যে! তা আছেন কেমন? অনেকদিন পর আইলেন।

-হ, তা আইলাম। মুখে যে চুনকালি লাগাইছিল বইনে সেই মুখ লইয়া কেমনে আয় কও তো দেহি। আবার তোমরাও তো যাও না, তা ছবীর আছোস কেমন?

ছবীর তার মামার দিকে ফিরে তাকায় না, শাসনের সুরে খিদিরকে বলে, পেয়াঁজ তো লাল হইছে, হলুদ দেও না কেন?
খিদির পুত্রের বাধ্যগত পিতার ন্যায় ব্যস্ত হাতে হলুদের গুড়ো কড়াইয়ে ঢেলে দিয়ে তরিকুলকে বলল, তা ভাই আইছেন যখন খাইয়া যান তরিকুল ছবীরের এমন নিরব অপমান গায়ে মাখে না, বোঝে ভাগনের এমন আচরণ দোষের না। তরিকুল ঈষৎ হেসে বলল, হ তা খামু। ঘটনা শুনছো কিছু? কী ঘটনা, ভাই? খিদির প্রশ্ন করে।

-রাহিলা ফিইরা আইছে টুনটুনিরে নিয়া। ঐ গোলামের পুতে টুনটুনিরে, রাহিলারে কী মারাধরাই না করছে! তালাক নিয়া আইছে রাহিলা।

তরিকুলের কথা শুনে কড়াইয়ে পানি দিতে ভুলে যায় ছবীর। খিদির চোখে এক সমুদ্দুর সমান অবাক হওয়া নিয়ে তরিকুলের দিকে চেয়ে থাকে। হলুদ পোড়া গন্ধ বাপ ব্যাটার নাকে ঢোকে না। তরিকুল আবার বলতে শুরু করল, অহন আমাগোও অভাবের সংসার, দিন আনি দিন খাই। কী করমু কিছুই বুঝতাছি না, রাহিলা কইছিল ঢাকায় যাইয়া গার্মেন্টসে কাম নিব। ছোডো মাইয়াডারে নিয়া যত চিন্তা আমার, মাইয়াডার একটা ব্যবস্থা করোন যায় না ভাই?

খিদির তরিকুলের জবাব না দিয়ে ছবীরের দিকে তাকায়, ছবীরের চোখ দুটো দুর্লভ কোনো কিছুর খোঁজ পেয়ে চকচক করছে। খিদির বোঝে, চেনে এই চোখ দুটোর ভাষা। খিদির একমুহূর্ত দেরি করে না, নিজেকে সুপুরুষ প্রমাণের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে ধরা গলায় বলে, সে করোন যায়, খাইয়া পথ দেওন যায় না? তরিকুল পিঁড়ি ঠেলে মাটিতে বসে পড়ে। খিদিরের হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলে, যায় রে ভাই, যায়। ছবীর আকস্মিক এমন বিহ্বলতায় কোনো কথা খুঁজে পায় না, কেবল কাঁচা চোখ দুটো নিয়ে দেখে একটা মোমে গড়া মানুষ তার সামনে বসে আছে। যে অল্প আঁচেই গলে যাচ্ছে।

ভ্যানে করে খিদিররা চলেছে তরিকুলদের বাড়িতে। মাইল দশেকের পথ৷ অথচ পথ ফুরাচ্ছেই না যেন। ছবীরের ইচ্ছে করছে ভ্যান থেকে নেমে দৌঁড়ে তার টুনটুনির কাছে ছুটে যেতে, তারা মায়ের কাছে ছুটে যেতে। যতটা জোরে দৌঁড়ে গেলে মানুষ দুটো তাকে আর ছেড়ে যাবে না। ছবীর ভাবতে থাকে টুনটুনিটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই হাঁসের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে খালে গিয়ে সাতার শেখাবে, চড়ুইভাতিতে সে বসে থেকে নিজে রাঁধবে, আট ঘরের বদলে কুতকুতের ঘরে বারো ঘর দেবে । মায়ের সাথে সে কথা বলবে না প্রথমে, আস্তে আস্তে বলবে, এমনটাই ভাবে ছবীর। আর খিদির? সে শুধু একটা প্রশ্নই মনেমনে ঠিক করে রেখেছে। সে রাহিলাকে জিজ্ঞেস করবে, ঠিক কতটা কাছে গেলে মানুষ দূরে যায় না? সে ঠিক ততটাই কাছে যাবে রাহিলার।

তরিকুলদের বাড়ির সামনে ভ্যান থামতেই ছবীর লাফ দিয়ে ভ্যান থেকে নেমে বাড়ির ভেতর দিকে ছুটে যায়, টুনটুনি, ও টুনটুনি বলে ডাক পাড়তে পাড়তে। খিদিরের পা দুটো যেন জমে গেছে মাটির সাথে। এগোতেই চায় না শ্লথ পায়ে খিদির বাড়ির ভেতর ঢোকে।

না, রাহিলারা বাড়িতে নেই। রাহিলা খবর পেয়েছে খিদিরের বাড়িতে গিয়েছে তার ভাই। সে খবর পেতেই রাহিলা মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। দ্বিধা, ভয়, লজ্জা, অপমান কিংবা অপরাধবোধ থেকে ছেলের সামনে, স্বামীর সামনে দাঁড়াবার সাহসটুকু সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। ছবীর ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ও মামি, আমার টুনটুনি কই? আমার মা কই? মামি উত্তর দেয় না, দিতে পারে না।

এরপর কেটে গেছে বহুদিন, কয়েকবছর। খিদিরের বুকে ব্যথার রোগ বেড়েছে, মস্ত বড় মাটির ব্যাংকটা ভরে গিয়েছে। ছবীরের গায়ে বেশ মাংস জমেছে, গোঁফগুলো শক্ত হতে শুরু করেছে। বাবার সাথে কয়েকশোবার ঢাকায় গিয়েছিল মা বোনের খোঁজে, পায়নি। খিদিরের আজকাল হুট করে বুকে ব্যথা ওঠে, এমন বুকে ব্যথা হয় যে চোখে কিছু দেখতে পারে না, কেবল সব ঝাপসা মনে হয়। খিদির বিছানায় পড়ে থাকে আর ছবীরটা ওদিকে হাটে যায় মুড়ি বেচতে, নিজে মুড়ি ভাজে, দুবেলা রাঁধে। এখন ছবীরটা চুলোয় খড়ি ঠেলে আর খিদির তেল-নুন দেবার কাজটা করে। শরীর ভালো থাকলে মুড়ি ভাজার সময় এখন হাঁড়ির তপ্ত বালুতে চাল ঢালে খিদির। বাপ ছেলের সংসার এমনি করেই যাচ্ছিল। হুট করে ঝড় ওঠা এক সন্ধ্যায় উঠান থেকে কেউ একজন নিচু গলায় বার দুয়েক ডেকে ওঠে, ভাই, ও ভাই। ছবীর খিদিরের বুকে তেল মালিশ করে দিচ্ছিল, কান সজাগ থাকায় ঘরের ভেতর থেকে ছবীর গলা বাড়িয়ে বলে, ডাকে কেডা?

-আমি, টুনটুনি। ছবীর খিদিরের বুকে মালিশ করা থামিয়ে কান খাড়া করে আবার বলে, কেডা?

-আমি টুনটুনি ।

ছবীর তাড়াহুড়ো করে দরজা খোলে। বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে দেখা যায় দুটো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এ যে চেনা মুখ! বছর সাতেক পরও একটা মুখ চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না ছবীরের। আরেকটা মুখ অনুমানে বুঝে নিতেও কষ্ট হলো না ছবীরের, এ যে টুনটুনিটা! ছবীর নিচু গলায় ডাকল, আব্বা, ও আব্বা।

খিদির বিছানা থেকে উঠে এলো। বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে সেই মুখখানা দেখামাত্রই খিদিরের বুকের ভেতরটায় কেবল ধুপ আওয়াজ বয়ে গেল। টুনটুনিটা ভিখেরীর মতো কাতর গলায় বলল, মা আর আমি কাল থেইকা একটা দানাও মুখে দেই নাই ভাই। আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝুমঝুম করে আকাশ চিরে বেয়ে পড়তে শুরু করেছে। কার্তিকের বৃষ্টি হুট করেই হারিয়ে যায়, তার দেখা পাওয়া না গেলেও আষাঢ়ের বৃষ্টি বারবার ফিরে আসে খাল-বিলের কাছে, রাহিলাও বুঝি ফিরে এলো আষাঢ়ের বৃষ্টি হয়ে, যার নিয়মই ফিরে আসে। হোক অনুশোচনায় কিংবা মোটা দাগের অপরাধবোধে।

অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল, এমন সমাপ্তিখানা খিদিরদের কপালে জুটল না। আষাঢ় পেরোতেই তীব্র বুকে ব্যথায় শ্রাবণের মাঝ রাত্তিরে ঘরের পেছনের গোরসস্থানে নতুন ঘর করে শুয়ে পড়তে হলো খিদিরকে। ঐ ঘরে যাবার আগে খিদির জানিয়ে গেছে, ব্যাংক ভর্তি টাকা রেখে যাচ্ছে সে, ছবীরদের খেয়ে পরে বাঁচতে এক চিমটি কষ্টও হবে না।

ফিরে আসার পর খিদির একটাবারও ছুঁয়ে দেখেনি রাহিলাকে, রাহিলাও সাহস পায়নি। না, পেয়েছিল। খিদিরের নিথর দেহটা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদার সুযোগ, সাহস দুটোই পেয়েছিল। রাহিলার এমন প্রাপ্তির ভীড়ে ছবীরের অপ্রাপ্তি ছিল এক আসমান সমান। শৈশবের কুতকুত খেলার ঘর, মায়ের গায়ের গন্ধ, বোনের বেণি ধরে টানাটানির সুযোগ কোনোটিই পায়নি সে। আর না পেয়েছে বাবা নামক মানুষটাকে ঠিকঠাক ভালোবেসে যাবার সুযোগ, মানুষটা নিজের চিকিৎসার জন্য দুটো পয়সা খরচ করেনি যাতে অভাবে আবার ছেলেটা না হারিয়ে যায় তার কাছ থেকে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত