তখন সবে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছি। হেমন্তদা প্রথম আমাদের বাসায় আসে মেজো ভাইয়ার বন্ধু হিসেবে। দুজনেই সেবার মাধ্যমিক দিবে। বয়সের তুলনায় মনের বিভেদ ছিল বিস্তর। লোকটাকে প্রথম থেকেই আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমাদের বাড়িতে আসলেই খালি মুখে এক কথা- “যা তো ছোঁয়া, এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। ফ্রিজের পানি আনবি না, কলের পানি আনবি। নিজে কল চেপে পানি তুলবি। ভালো পানি আনবি কিন্তু।” রাগ লাগতো…ভীষণ রাগ। রাগে কলের পানির পরিবর্তে ট্যাপের পানি দিতাম। এতো কাজ কেনো করবো? আমি কী তার বউ লাগি?
তবে মাঝে মাঝে হেমন্তদা কে আমার খুব দরকার পড়তো। কারণ? কারণ হলো সে আসলেই আমাকে মাথা টিপে দিতে বলতো। আমিও প্রতি পনেরো মিনিট হিসেবে পাঁচ টাকা করে পারিশ্রমিক নিতাম। তখন এক টাকায় দুটো লজেন্স পাওয়া যেত। আহা, কী মধুর দিন ছিল! তখন সবে র্যাপ মিউজিকের চল উঠেছে। ছোট ভাইয়া কবিতা আর গলার স্বরের মাধ্যমে অদ্ভুত গান গাইতেন। আর আমরা হেসে লুটোপুটি খেতাম। হাসি দেখে ভাইয়া রাগ করেই বলতেন- “জানিস কিছু সংগীতের? ভালো গান তো শুনে অভ্যাস নেই তোদের।” হেমন্তদা তখন উত্তরে বলতেন- “হ্যাঁ রে সুমন, এগুলা গান? আমি তো ভাবলাম পাশের বাসার মোরগ চিল্লায়। বলি এই গান গেয়ে তুই আমার বাংলা ভাষার অপমান করতে পাড়িস না। মনে নেই মাতৃভাষা আন্দোলনে কত বাঙালি প্রাণ দিয়েছে? আমরাই প্রথম যারা ভাষার জন্য প্রাণ দেই।”
আমি মানুষটাকে সহ্য করতে না পারলেও অবাক হতাম উনার জ্ঞানের প্রতিভা দেখে। সময় আপন স্রোতে চলতে থাকে। সময়ের বহমানতার সাথে সাথে বড় হতে থাকি আমি। মাধ্যমিক দিয়ে কলেজে উঠি। আস্তে আস্তে হেমন্তদার উপর তৈরী হওয়া রাগ গুলো ভালোবাসায় রূপ নেয়। ভালোবেসে ফেলি জ্ঞানি হেমন্তদাকে। বাসায় থাকলে অপেক্ষা করতাম হেমন্তদা কখন আসবে আর বাইরে বের হলে পাড়ার মোড়ে উকিঁ দিতাম তাকে একদণ্ড দেখার জন্য। এরপর? এরপর নতুন নতুন সাজে নিজেকে প্রতিদিন সাজাতে লাগলাম, বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে অপেক্ষা করতে থাকলাম আর ফেরারি বিকেলে হালকা ডাইরির ভাজে তার কথা লিখতে শুরু করলাম। সবশেষে ভালোবাসার কথা জানানোর জন্য গোটা গোটা অক্ষরে চিঠি লিখলাম।
প্রিয় হেমন্তদা,
সালাম নিবেন। আমি আগে কখনো চিঠি লিখিনি। তাই লিখতেও পারিনা। যদি জানতাম আপনার কাছে ভবিষ্যতে চিঠি লিখে আমার মনের ভাব প্রকাশ করতে হবে, তাহলে অবশ্যই চিঠি লিখার ধরণ শিখে নিতাম। ছোটবেলা থেকেই আপনি ছিলেন আমার খুব অপ্রিয় একজন। আস্তে আস্তে সেই অপ্রিয় আপনি কীভাবে যেন আমার প্রিয় হয়ে উঠেন। ভালোবেসে ফেলি আপনাকে। অনেক ভালোবাসি, হেমন্তদা। আমি আপনার মনের কথা জানিনা। যদি আপনার মনেও আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বিচরণ করে তাহলে আমাকে অতি শীগ্রই নিজের বউ করার আয়োজন করবেন। আমি পড়াশুনা শেষ করেই আপনাকে বিয়ে করে ফেলবো। তারপর টুনাটুনির সংসার হবে। দারুণ হবে না? আজ আর নয়। চিঠির উত্তর চিঠিতে দিয়েন। আমি আপনার সামনে যেতে পারবোনা, লজ্জা করবে খুব।
ইতি
ছোঁয়া
চিঠি পাঠিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু তার প্রাপক পাল্টে গিয়েছিল। আব্বার হাতে চিঠি পড়েছিল। একপাক্ষীক ভালোবাসা আর কিশোরী মন উভয়ের উপর আব্বা আক্রমণ চালায়। তার মতে ছোঁয়া দোষ করেছে, ভীষণ এক অন্যায় করেছে। যেহেতু হেমন্তদা এই বিষয়ে কিছু জানেন না; সুতরাং, বলা বাহুল্য, দোষ নিজের মেয়ে করেছে, তাই শাস্তি ও তিনি আমাকে দিলেন। সাতদিনের মাথায় ছেলে ঠিক করে ফেলেন। বিয়ে দিবেন! মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। এবার?
এক ছুটে যাই হেমন্তদার কাছে। অনেক হয়েছে গোপনীয়তা, এবার সব সরাসরি বলবো। হেমন্তদা ওইদিন উনার বাড়িতে ছিল। আমি যখন তাকে নিজের ভালোবাসার কথা বলি সে চিল্লিয়ে উঠে।
“বয়স কত তোর? থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিব। বেয়াদব মেয়ে। তুই জানিস আমি তোর থেকে কত বছরের বড়?”
“ভালোবাসি তো হেমন্তদা।”
“ভালোবাসার কি জানিস তুই। দুধের দাঁত পড়েছে? যা এখান থেকে।”
” না যাবো না। আগে তুমি আমাকে বিয়ে করবা বলো তারপর আমি যাবো।”
“বিয়ে! কিসের বিয়ে? ঠাটা একটা। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে?
জানিস আমি তোর কত বড়। নির্লজ্জ। এইটুকু পুচকি একটা মেয়ে বলে কি না বিয়ে করবে!” চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারিনি। অনেক জোড়ে বলে ফেলি, ” আর এইটুকু পুচকি মেয়ের বিয়েই তার বাবা ঠিক করেছে। পাত্রের বয়স আমার দ্বিগুণ। দারুণ না বিষয়টা?” হেমন্তদা মনে হয় একটু চমকায়। চোখে অবিশ্বাসের মেঘ জমতে শুরু করে আর আমি সামনে দাঁড়িয়ে তা পরিষ্কার লক্ষ্য করি।
“আমার বিয়েতে এসো কিন্তু হেমন্তদা।” না হবে না। হেমন্তদা তো আমাকে ভালোবাসে না। তাহলে আমি বাবার পছন্দেই বিয়ে করে ফেলবো? “ছোঁয়া বাড়ি যা। এইসব আজাইরা মিথ্যা কথা বলে লাভ নেই।” আমি ব্যাথাতুর চোখে তাকাই। আমি মিথ্যা বলছি কোথায়। আমার ভালোবাসা উনার কাছে মিথ্যা মনে হয়? হে খোদা! “বিয়ে ঠিক হয়েছে সত্যি?” আমি উপর নিচে মাথা ঝাঁকাই। “যা চিন্তা করিস না। আমি চাচার সাথে কথা বলবো।” ধীর পায়ে বেড়িয়ে আসি। হেমন্তদা মনে হয় আমাদের বিয়ের কথা বাবাকে বলবে। আমি একবার চেষ্টা করবো? আব্বা কী রাজি হবে? বাসায় ঢুকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আব্বার ঘরের দিকে পা বাড়াই। হয়তো বাবাকে রাজি করানোর শেষ চেষ্টা! তবে আব্বা শুনে নি। আব্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলি,
“আব্বা, আরেকবার ভেবে দেখেন দয়া করে। আমি মরে যাব।”
“বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও যাও।”
“আব্বা আমি এখান থাকে লাফ দিয়ে মরে যাব তবুও বিয়ে করবো না।”
“এই দুইতলা থেকে লাফ দিলে সর্বোচ্চ হাত-পা ভাঙবে, মরবে না।
বাড়িতে ফিনাইল আছে। সেটা খাও। এমনিতেও তোমার মতো মেয়ের মরে যাওয়া উচিত। আমাকে হুমকি দেওয়ার সাহস পাও কোথায় তুমি।” মাথা নিচু করে চলে আসি আব্বার ঘর থেকে। বয়স কত তখন, সবে আঠারো। আব্বার মুখের উপর কথা বলার সাহস আমার হয়ে উঠেনি আর। বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। বিয়েতে লাল বেনারসি, বউভাতে কাতান আর অনেক সোনার গয়না। উচ্চবিত্ত পরিবার সাথে শিক্ষিত ছেলে। এ তো সোনার হরিণ! কনে সেজানো হয়। গায়ে বেনারসি,মাথায় টিকলি, কানে ঝুমকো, গলায় জড়োয়া, হাতে চুড়ি-বালা আর কোমরে বিছা পড়ে আমি কবুল বলার আগ পর্যন্ত হেমন্তদার পথ চেয়ে বসেছিলাম। আসেননি.. কথা রাখেননি।
পরিশিষ্ট: আজ আমার বিবাহ বার্ষিকী। সাত বছরের সংসার। তবে টুনাটুনির মতো নয়। ভালোবাসার চেয়ে প্রয়োজন বেশি। বহুবছর পর একদিন দেখা হয় সেই হারিয়ে ফেলা মানুষটির সাথে।
“কেমন আছিস ছোঁয়া?”
“ভালো, খুব ভালো।”
“পুরো গিন্নি গিন্নি লাগছে তোকে।”
“ধন্যবাদ হেমন্তদা। বিয়ে করোনি?”
উত্তর হেমন্তদা দেয় নি। বিয়ে উনি করেন নি। মেজো ভাইয়া জানতেন উনি আমাকে ভালোবাসে। বিয়ের কয়েকদিন পর জানতে পারি আমার বিয়ে আটকাতে উনি আব্বার কাছে গিয়েছিলেন ঠিকই। তবে আব্বা উনাকে অপমান করেছিল। আর আমি অভিমান করে বিয়ে করে ফেলি স্বার্থপরের মতো। আপনারা হয়তো ভাববেন আব্বা কেনো এতো নিষ্ঠুর হয়েছিলেন? বাপ-মা মরা ফুফুর কাছে বড় হওয়া বেকার ছেলের কাছে আঠারো বছরের কিশোরী মেয়ে কখনো দেওয়া যায় না। আব্বা টাকার মাধ্যমে আমার সুখ খুঁজে দিয়েছেন। আব্বা চাইলে আমাকে দূরে কোথাও পাঠাতে পারতেন। তবে আমি যদি আবেগে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি! আমার উড়ান দেওয়ার ডানা কাটতে তাই বিয়ের ব্যবস্থা। বিয়ে হয়েছে ঠিকই। মনের মিল? সেটা কি আদৌ হয়েছে? সব প্রশ্নের উত্তরের প্রয়োজন হয় না। কিছু প্রশ্ন শুধু প্রশ্নকর্ত্রীর অন্তরেই থাকুক।