রাঁধুনি বউ

রাঁধুনি বউ

বিয়ের পর দশ বছর পার হয়ে গেল । আমার স্বামীর এবং আমার প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয় । মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটির ঝড় এমন উঠে মনে হয় এই বুঝিই সংসার নামক ঘরটা ভেঙ্গে গেল । কিন্তু না দশ বছর ধরে ক্ষণে ক্ষণে উঠা ঝড় আবার দশ মিনিটেই থেমে যায় । আমাদের সংসারে ক্ষণে ক্ষণে উঠা ঝড়ের একমাত্র কারণ হল, আমি ভাল করে রান্না-বান্না করতে না পারা । আমার রান্না তার সব সময় পছন্দ হয় না । কখনও বলে সব্জির মিশ্রণ ঠিক হয় না । আবার কখনও বলে

-কালকে এক ভাবীর বাসায় এতো সুন্দর শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছি । স্বাদ জিহ্বায় এখনও লেগে আছে । মেজাজটা অনেক খারাপ হয়ে যায় । আমি গরগর করে উঠি । রাগে মাথা গরম হয়ে যায় । আবার কখনও বলে

-রাসেলের মার হাতে ১০ বছর আগে একবার করলা ভাজা খেয়েছিলাম কি চমৎকার ! কখনও বলে

-তোমার রান্না করার দরকার কি কাজের মেয়েকে দিলেই তো পারো?

আমার মেজাজটা যায় আরও বিগরে । আমার সংসারে আমি রান্না না করে কাজের মেয়েকে রান্না ঘরের কর্তৃত্ব দিয়ে কি বাসন-কোসন মাঝব আর ঘর-বাড়ী মুছবো ! মাঝে মাঝে যে করি না তাও না ! তার পৃথিবীর সবার রান্না ভালো লাগে শুধু যেন আমার না তার জন্য অনেক যত্ন নিয়ে রান্না করলেও যেন তার পছন্দ মতো রান্না করতে পারি না । একটা ব্যাংকে ছোট খাটো পদে জব করি । সকাল বেলা বড় ছেলেকে স্কুলে দিয়ে ছোটটাকে ফিডিং করানোর পর যেটুকু সময় থাকে তার মধ্যেই কোন মতে রান্না সারতে হয় । কি করবো? আমার রান্না জিনিসটা বেশ কঠিন মনে হয় বিশেষ করে আমার স্বামীর পছন্দ মতো রান্না করা । আর সে বার বার বলে

-রান্নাটা কোন ব্যাপার ! একটু বুদ্ধি খাটালেই হয় ! ঝগড়ার মাঝখানে মাঝে মাঝে বলি

-তুমি রেধে দিও । আমি বসে বসে খাবো ।

রান্না অনেক কঠিন কাজ বলে তাকে অনেক সময় চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেই । দশ বছর পর আজ দেখি সে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে । কাল রাতে আমাদের অনেক তর্ক হয়েছিল । আজ দুপুরে আমি যখন ছোট ছেলেকে ফিডিং করানোর জন্য তার সাথে শুয়ে আছি তখন আমার স্বামী দেখি অনেক সুন্দর করে মাছ ভাজি আর পটল ভাজি করে ফেললো ? তারপর বড় ছেলেকে বলল-

-আয় আয় ভাত খা জীবনে এতো সুন্দর খাবার কখনো খাস নাই ।

সরিষার তেল দিয়ে রুই মাছ ভাজা আর পটল ও আলু ভেজেছে ডিম দিয়ে । এসব তার নিজস্ব রেসিপি । সত্যি অনেক সুন্দর হয়েছে রান্নাটা । সে তো আমার মুখে চুন কালি মাখিয়ে চ্যালেঞ্জে জয়-লাভ করলো । তবে এটা জানি যে সে প্রতিদিন রান্না করার ধৈর্য পাবে না ।

মেয়েদের কাজগুলো কেমন যেন, কাজগুলোর প্রোডাক্টিভিটি এবং ডিউরেশন কম । সে জন্যই হয়তো ছেলেরা হাউজওয়াইফ স্ত্রীকে বলে সারাদিন কি করো খাও আর ঘুমাও ! সকালে নাস্তা রেডি করো দুপুরের তার মেয়াদ শেষ, বিকেলে ফার্নিচার মুছো রাতেই তাতে আবার ধুলা বালি পড়ে যায়! তাহলে এমন কাজের মুলয্যন হবে কীভাবে?

অথচ ছেলেদের কাজগুলোর লংজিটিভিটি অনেক বেশী । একবার ফসল ফলালে সারা বছর ধরে তার ফল ভোগ করা যায় । সপ্তাহে একবার ঠিকভাবে বাজার করলে ৭ দিন অনায়াসে পার করা যায় । এক মাসে ঠিক মতো অফিস করলে পরের মাসে তার বেতন দিয়ে নিশ্চিন্তে চলা যায় । আর মেয়েদের একই কাজ সকাল, বিকা্‌ল সন্ধ্যা এমনকি রাতেও সমান তালে করতে হয় । রোবটের মতে শুধু করা, করা আর করা, কাজ শেষ আর হয় না । সে আমাকে মাঝে মাঝে বলে-

-কি শিখেছ তুমি?

আসলেই তো কি শিখেছি আমি? আমি যা করি বা করতে চাই তার তো কোন মূল্য সমাজে নেই । গল্প লেখা আর বই পড়ার মূল্য কি সমাজে আছে? না পারি ভালো মতো রান্না করতে । সংসার চলে কোন মতে ।স্পেশাল কোন ডিশ যেমন ফ্রাইড রাইস, চিকেন রেজালা, কাচ্চি বিরিয়ানি এগুলোতো কিছুই পারি না । মুরগীর রোস্টটাও ঠিক মতো পারি কি না সন্দেহ আছে । ছোট বেলা থেকে পড়াশুনা নিয়েই বেশী ব্যস্ত ছিলাম । পড়াশুনা করে ভালো একটা চাকুরী করবো, বাবা-মার দুঃখ দূর করবো । এই ছিল স্বপ্ন । তাছাড়া তিন বেলা সবজী আর মাসে দুই একবার মাছ-মাংস খেয়ে যাদের দিন কেটেছে, সেই ঘরের মেয়ে কীভাবে শিখবো চিকেন রেজালা আর কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না ।

চাকুরী পেয়েছি একটা কিন্তু নিজের দুঃখ তো বাড়িয়েছি অনেক গুণ । এর চেয়ে পড়াশুনা না করে রান্না-বান্নার প্রশিক্ষণ নিলেই মনে হয় ভালো করতাম । অন্তত স্বামীর পছন্দ মতো খাবার তো তৈরি করতে পারতাম । বাংলাদেশী মাদের উচিৎ মেয়েদের আগে ভালো করে রান্না শেখানো কারণ আপনার মেয়ের যার সাথে বিয়ে হবে তার সংসারের জন্য দরকার রাধুঁনি বউ বিশাল ডিগ্রীধারী স্ত্রী নয় । যদিও অনেকে বলে সময় হলে এমনই শিখে নিবে । আসলেই কি সব কিছু এমনই শিখে নেয়া যায়? শিখে নিলেও তা জীবনে বাস্তবায়ন করা অনেক অনেক কঠিন ! মানিয়ে নেয়া তো না মুনকিন হে !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত