আজ ৯ দিন ধরে আমি ঘরে বন্দী। পুরো শহর লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে গিয়েছে আমার ৫ বছরের ছেলে কাব্য। কাব্য এখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এমন সময় আমার স্ত্রী শ্রাবণী এসে কাব্যকে ধমক দিয়ে বললো,
– তোমায় না বলেছি বেলকনিতে না আসতে। তুমি আবার এসেছো কেন? শ্রাবণীর কথা শুনে কাব্য চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বললো,
-তোমার চোখের সামনে ছেলেটা দরজা খুলে বেলকনিতে যায় কিভাবে?একটু কি খেয়াল রাখতে পারো না? আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— একটু বেলকনিতে গেলে কি এমন হবে? তাছাড়া তুমি হয়তো জানো করোনা বাতাসে ছড়ায় না। সেই হিসাবে বেলকনিতে একটু আধটু গেলে সমস্যা কি? তাছাড়া আমাদের বাসার আসে পাশে কোন বাসাও নেই। শ্রাবণী আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে কাব্যকে নিয়ে টানতে টানতে চলে গেলো আমি শুয়ে যখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছি তখন খেয়াল করি কাব্য এসে আমার বুকের উপর শুয়ে বললো,
~ আব্বু, আমি কি আর কখনো স্কুলে যেতে পারবো না? আমার স্কুলের বন্ধু রাফি, ফাহিম, মিথুন ওদের কারো সাথে কি আমার আর কখনো দেখা হবে না? আমি আমার ছেলেকে আমার বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
— অবশ্যই সবার সাথে দেখা করতে পারবে বাবা। আর কয়েকদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথা শুনে কাব্য আমায় বললো,
~আচ্ছা আব্বু হঠাৎ আমরা সবাই ঘরে বন্দী হয়ে গেলাম কেন? আমি মুচকি হেসে আমার ছেলেকে বললাম,
— আমরা যে কেউ নামাজ পড়ি না তাই আল্লাহতালা আমাদের উপর রাগ করে বাসার বাইরে ছোট ছোট পোকা রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। এখন আমরা বাসার বাহিরে গেলে এইসব পোকা আমাদের শরীরে ঢুকে যাবে। আর আমাদের কামড় দিবে। কাব্য অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~ আব্বু, এইসব পোকা মরবে কিভাবে? আমি আবারও হেসে ছেলেকে বললাম,
— যদি তুমি নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করো। আর নিয়মিত আমার সাথে নামাজ পড়ো তাহলেই এইসব পোকা মরে যাবে কাব্য কিছুটা চিন্তা করে আমায় বললো,
~আব্বু আমিও তোমার সাথে নামাজ পড়বো। আমি তখন বললাম,
— নামাজ পড়তে হলে একটা জিনিস শিখতে হয়। কাব্য বললো,
– কি? আমি তখন কাব্যকে সূরা ফাতিহাটা শিখাচ্ছিলাম। এখন সময় শ্রাবণী এসে কাব্যকে বললো,
– তোমায় না বলেছিলাম হাতের লেখাগুলো লিখতে? তুমি না লিখে আব্বুর বুকের উপর শুয়ে আছো কেন? আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,
— আরে থাকুক না আমার কাছে একটু। সারাক্ষণ ছেলাটাকে শুধু পড়তে বলো। শ্রাবণী আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
– স্কুল খোলার পরেই তো ওর পরীক্ষা শুরু হবে। আর পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলে রাফি ফাহিমের মার কটু কথা গুলো তো আমাকেই শুনতে হয়। তোমার তো শুনতে হয় না। শ্রাবণীর কথা শুনে আমি মিনমিন করে বললাম,
— বিয়ের আগে শুনেছিলাম তুমি মাস্টার্স পাস করেছো। বিয়ের এক মাস পর জানতে পারলাম তুমি মাস্টার্স না তুমি ইংলিশে অনার্স করেছো। ৩ বছর সংসার করার পর জানতে পারলাম তুমি ইন্টার পাস করেছো তাও আবার দুই বারে। আমার আস্তে আস্তে কথা বলাটা শ্রাবণী কিভাবে যেন শুনে ফেললো। তাকিয়ে দেখি রাগে ও লাল হয়ে গেছে। আমার বুকের লোম ধরে জোরে টান মেরে বললো,
– আমি দুইবারে হলেও তো ইন্টার পাশ করেছি। তোমার মত তো নকল করতে গিয়ে ধরা খাই নি।
আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না কারণ এখন যদি কিছু বলি তাহলে শ্রাবণী আরো কিছু গোপন কথা ফাঁস করে দিবে। তাই চুপচাপ শুয়ে রইলাম আর শ্রাবণী কাব্যকে নিয়ে চলে গেলো মাগরিবের সময় আমি যখন ওযু করছি তখন কাব্য দৌঁড়ে আমার কাছে এসে বললো,
~আব্বু আমিও তোমার সাথে নামাজ পড়বো। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— নামাজ পড়ার আগে ওযু করতে হয়। আমি যা যা করবো তুমিও তা তা করবে কেমন? আমার দেখাদেখি কাব্য ওযু করছিলো। নাকে পানি দেওয়ার সময় কাব্য ভুল করে নাকের ভিতর পানি ঢুকিয়ে ফেলে। যার ফলে কাব্য সমানে কাশতে লাগলো। কাব্যর কাশি শুনে শ্রাবণী দৌঁড়ে এসে কাব্যকে ধরে বললো,
– বাবা, তোমার কি গলা ব্যাথা করছে? তোমার কি গায়ে জ্বর এসেছে। তুমি এইভাবে কাশছো কেন? আমি অবাক হয়ে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর জোরে একটা ধমক দিয়ে বললাম,
— একটা গাধীকে বিয়ে করেছি আমি। ওর ওযু করার সময় নাকের ভিতর একটু পানি চলে গিয়েছে আর তুমি ভাবছো ওর কি না কি হয়েছে। শ্রাবণী কাব্যকে কোলে নিয়ে বললো,
– তোমায় কে বলেছে ছেলেকে ওযু শিখাতে? বড় হলে এমনিতেই সব শিখে যাবে।
এই কথা বলে শ্রাবণী চলে গেলো আমাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না জুম্মার নামাজের সময় আমি আর কাব্য তৈরি হচ্ছি মসজিদে নামাজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শ্রাবণী কিছুতেই আমাদের বাইরে যেতে দিবে না। শ্রাবণী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে দরজা খুলতে দিবে না। আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,
— করোনার উৎপত্তি স্থল হলো চীনে। সেই চীন কি করতে চেয়েছিলো জানো? ওরা কুরআন শরীফ বদলাতে চেয়েছিলো। চীন থেকে যারা হজ্ব করতে গিয়েছিলো তাদের দেশে আসতে বাঁধা দিয়েছিলো। অথচ দেখো চীনে করোনাতে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো অথচ একজন মুসলিম মারা যায় নি। চীনের প্রধানমন্ত্রী মুসলমানের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন ওরা কিভাবে জীবন যাপন করে যে ওদের কারো করোনা হয় না সেটা জানার জন্য।
ইটালি ফ্রান্স আর জার্মানিতে আজ হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ এইসব ইউরোপ দেশে পর্দা করা আযান দেওয়া নিষেধ করে দিয়েছিলো। ওরা মুসলমানদের উপর খুব অত্যাচার করতো। যার ফল সরূপ আজ এই অবস্থা। যে দেশে আযান দেওয়া নিষেধ ছিলো সেই দেশে আজ প্রকাশে আযান দেওয়া হচ্ছে। হাজার হাজার অমুসলিমরাও নামাজে অংশ নিচ্ছে। এটা আল্লাহতালার একটা পরীক্ষা। দেখো আল্লাহতালায় আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করবেন। আমার কথা শুনে শ্রাবণী চুপ হয়ে আছে। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
— আমি বুঝতে পারছি তোমার ভয় টা। আমি জানি আমাদের সাবধানে থাকতে হবে তাই বলে বেশি সাবধান হতে গিয়ে যদি আল্লাহর ঘরকে খালি করে দিই তখন তো অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে। আল্লাহতালা প্রতিটা বান্দাকে শাস্তি দেওয়ার পূর্বে অনেকবার সুযোগ দেন। কেউ সময় থাকতে সুযোগ কাছে লাগায় আবার কেউ বা সময় ফুরিয়ে গেলে আফসোস করে। তুমিও আফসোস করবে যদি এখন সুযোগ কাজে না লাগাও। আমি খেয়াল করেছি তুমি ছেলের দুনিয়ার শিক্ষা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছো। অথচ আমরা কাল পর্যন্ত বাঁচি কি না তার ঠিক নেই নামাজ পড়ে এসে দেখি শ্রাবণী ছোট ছোট ব্যাগে চাল ডাল আলু এইসব ভরছে। আমাকে দেখেই মিষ্টি হেসে আমাকে বললো,
– কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবো কি না তার ঠিক নেই অথচ আমি বোকার মত ১ মাসের বাজার করে রেখেছিলাম। আমরা না হয় ৩ বেলার জায়গায় দুই বেলা খাবো আর একবেলার খাবারটা এমন একটা পরিবারকে দেবো যাদের তিন বেলায় এক বেলারও খাবার জুটে না আমি অবাক হয়ে শ্রাবণীকে দেখছি আর শ্রাবণী তখন আমার কাছে এসে মাথাটা নিচু করে বললো,
– পিয়াস আমি নামাজটা শুদ্ধভাবে পড়তে পারি না। তুমি তো এখন সারাক্ষণ বাসায় থাকো। আমায় একটু শিখিয়ে দিও তো। শ্রাবণীর কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। শুধু আমার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি এসে জমা হয়েছিলো..
বিঃদ্রঃ- এখন আমরা সবাই বাসাতেই অলস সময় পার করছি৷ সেই অলস সময়টা আমরা মোবাইলের পিছনে ব্যয় না করে একটু আল্লাহ সন্তুষ্টি কাজেও ব্যয় করতে পারি। আমরা যারা নামাজটা ভালো করে পড়তে পারি না তারা নামাজটা শিখতে পারি। যারা কুরআন শরীফ পড়তে পারি না তারা কারো সাহায্য নিয়ে কুরআন শরীফ পড়াটাও শিখে নিতে পারি। আর সম্ভব হলে নিজের একবেলার খাবারটাও অসহায় একটা পরিবারকে নিয়ে সাহায্য করতে পারি। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করুন দেখবেন আল্লাহই সব ঠিক করে দিবেন..