– “নীল শাঁড়ি পরেন আপনি?” জমে থাকা মেসেজ রিকোয়েস্টগুলো ডিলিট করতে গিয়ে চোখে পড়ল ঠিক এরকম’ই একটা মেসেজ। অবাক আমি কিছুটা কৌতূহলের সাথেই মেসেজ রিকোয়েস্ট’টা একসেপ্ট করলাম। যদিও আমি মেসেজ রিকোয়েস্ট তেমন একসেপ্ট করি না। রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আরো একটা মেসেজ আসল। “উত্তরটা কিন্তু আপনার কাছে রয়েই গেল হাসলাম আমি। যদিও সেই মুহূর্তে এমন হাসির কারণ আমি নিজেও জানি না। যায় হোক। লোকটির প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম- ” না অনলাইনে থাকতে থাকতেই আরো একটা মেসেজ।
– ” কাঁচের চুড়ি পরেন কি?” হাসলাম এবারো। পুনরায় একই উত্তর দিলাম-” না….”
– সেটাও না…?!!!
আচ্ছা, শাঁড়ি চুড়ি না পরেন চোখে গাঢ় কালো কাজল তো পরেন নাকি? শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি। উত্তর দিলাম- ” নাহ আচ্ছা! মানলাম। শাঁড়ি, চুড়ি, কাজল কিচ্ছু পরেন না আপনি। কিন্তু পায়ে নূপুর, সেটা নিশ্চয় পরেন..! এবারো হাসলাম আমি। লোকটার দৃঢ় বিশ্বাসকে ভেঙে চূড়ে দিলাম। উত্তর দিলাম- ‘নাহ সেটাও পরি না।’ তারপর আর কোনো মেসেজ আসেনি। দু’দিন পর ঐ আইডি থেকে পুনরায় মেসেজ আসে, “আচ্ছা মেসেজটা সিন করে রেখে দিলাম যেহেতু উত্তর দেয়ার মতো কিচ্ছু ছিল না তাতে। একসপ্তাহ পর মেসেজ আসে- “আচ্ছা, আপনি পরেন না কেন?” ভ্রু-কুচকে প্রশ্ন করলাম- ” স্যরি, বুঝলাম না?”
ও প্রান্ত থেকে আর কোন মেসেজ আসে না। বোধ হয় মানুষটা অবাক হয়েছে। আসলে আমিও যে অবাক হইনি তাও কিন্তু নয়। সেদিনের চ্যাটালাপগুলো আমি ডিলিট করে দিয়েছিলাম সাথে সাথে। তাই আচমকা ওনার এ ধরনের মেসেজের মানেটা আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। বিকেলের দিকে মেসেজ আসে আবারো, ঐ যে নীল শাঁড়ি, চুড়ি, কাজল, নূপুরের কথা বলছিলাম না আমি সে একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেললাম আমি। ” ওহ, তাই বলেন হু, এখন আমার প্রশ্নের উত্তরটা কি পেতে পারি? জানতে কি পারি এগুলো না পরার কারণ? হাসলাম আমি। উত্তর আর কি দেবো ভাই। নীল শাঁড়ি, কাঁচের চুড়ি, কাজল, নূপুর এসব’ই তো আমার নাই।
– নাই মানে?
— নাই মানে, নাই।
– কিনুন তাহলে…
— টাকা নাই।
– আমি কিনে দেই?
— শখ নাই।
– কিসের শখ নাই?
— অন্যের টাকা আত্মসাৎ এবং মূল্যবান সময় নষ্ট করে আজাইরা কাজ করার কোন শখ নাই।
– একটা কথা বলব?
— জ্বি, বলুন।
– আমার না আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
— সেটা অবশ্য পূরণ করা যায়।
– সত্যি?
— এক কথা বার বার বলার অভ্যাস নেই আমার।
– আচ্ছা। আমাকে কোথায় আসতে হবে?
— নরসিংদী আসুন।
– আপনার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম?
— ফেসবুক।
– আপনাকে চিনার উপায়?
— নাম দুঃখবিলাসী। এমনিতে বিরহের প্রেমিকা আমি। চিনে নিতে খুব বেশী কষ্ট হবে না আপনার।
– ওকে।
— কবে আসছেন?
– আগামীকাল ভোরে রওয়ানা দেবো, ইনশাআল্লাহ।
— আমি কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব।
– আচ্ছা, শুভ রাত্রি।
— শুভ রাত্রি। পরদিন সকাল এগারোটায়_
– কোথায় আপনি?
— যেখানে থাকার কথা ছিল।
– আমি মাত্র ভেলানগর গাড়ি থেকে নামলাম। ঐ যে রিক্সা ডাকতেছে আমায়। আপনি একটু অপেক্ষা করোন। আমি আসছি….
— আচ্ছা।
১১টা বেজে ১৫মিনিট। চোখে সানগ্লাস আর পরনে সাদা শার্ট পরোয়া এক উদাসীন যুবক একটা রিক্সা থেকে নামে। ভাড়া মিটিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সে। অনার্স ১ম বর্ষের ভর্তির কার্যক্রম চলছিল। কলেজ গেইট এবং আশেপাশের দোকানগুলোতে তাই ছেলে মেয়েদের বিস্তর ভীড় জমেছিল। এতগুলো মানুষের ভীড়ে শুভ্রর খুঁজে পেতে হবে আমাকে। যাকে আগে কখনো দেখেনি সে। চেনার নির্দশন হিসেবে আমি শুধু শুভ্রকে বলেছিলাম, বিরহের প্রেমিকা আমি। নাম আমার দুঃখবিলাসী।
ও বার বার এদিকে-ওদিক আর মেসেঞ্জারের দিকে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে করেই আমি ওকে মেসেজ ব্লক করে রাখলাম। কারণ, আমি চাইনি ও আমাকে মেসেজ দিক আর আমার মনোযোগটা ফোনের দিকে চলে যাক। আমি চাই না ও আমাকে চিনুক। সত্যি কথা বলতে আমার এই যে এখানে আসা সেটা ওর নয় আমার ইচ্ছেতেই আসা। গত একটা বছর যাবত ওকে দেখার ইচ্ছেটা ভিতরে চেপে রেখেছিলাম। কিন্তু সে কথাটা প্রকাশ করতে পারিনি। বলতে পারিনি ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে। একটু কি দেখা দিবে? এই শেষ বার। কথা দিচ্ছি পিছু থেকে ডাকব না আর.! ওর সাথে আমার সম্পর্কের ইতিটা ঘটেছিল আজ থেকে ৩বছর আগে। না, সেটা কোন ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। খুব ভালো একটা বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মাঝে। সেই সম্পর্কের ইতি ঘটে।
আমাদের পরিচয়টা হয় লিখালিখির মাধ্যমে। লিখালিখি’টা ছিল আমার নেশা। এফবিতে লিখতাম আমি। আর সেই লিখার সৌন্দর্য্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিত ওর করা মন্তব্য। ওর মন্তব্যগুলো আমার হৃদয় ছাপিয়ে যেতো। অনুপ্রাণিত হতাম আমি। লিখতাম। বেশী করে লিখতাম। আর একটু পর পর ঐ লেখায় ওর মন্তব্য খুঁজতাম। বার বার পড়তাম। মনটা কেন জানি খুশিতে নেচে উঠত। ইনবক্সে টুকটাক যা কথা হতো সেগুলো লিখালিখি নিয়েই। ও পরামর্শ দিতো, প্রশংসা করত। মাঝে মাঝে দু’একটু বেশী কথা হতো। ওর সাথে করা ছোট ছোট হাসি আনন্দ, দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটির মধ্যেই একদিন ভেতরে কারো উপস্থিতি টের পাই। বুঝতে পারি একটু একটু করে আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি ওর প্রতি।
বাবা অসুস্থ, মা নানু বাড়িতে গিয়েছিল। পরদিন বোনের পরীক্ষা। রান্না করার জন্য কিচ্ছু নেই বাসায়। চাকরীর বেতন তোলা মাত্রই ব্যাগ হাতে বাজারের দিকে ছুটলাম। বাজার করা শেষে বিশেষ দরকারে কসমেটিকসের দোকানে গেলাম। দেখা হয়ে হলো প্রাক্তনের সাথে। বউকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছে। আমাকে দেখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল বউকে। আমাকে দেখিয়ে শুনিয়ে অনেকগুলো ভালোবাসার কথা বললো। আমার চোখে জল টলমল করে উঠে। বহুকষ্টে আটকে রাখলাম সে জল। কেনাকাটা শেষে চোখের সামনে দিয়ে বউয়ের হাত ধরে বিদায় নেয় প্রাক্তন। বাসায় এসে হাউমাউ করে কাঁদলাম। ফেসবুকে গেলাম। ব্লক করে দিলাম শুভ্রকে। ব্লক করার আগে অহেতুক গালিগালাজ করলাম। ও আশ্চর্য হলো। কিন্তু কিচ্ছু বললো না।
একবছর পর ব্লকলিস্ট থেকে মুক্তি দিলাম ওকে। কিন্তু ততদিনে নিজ আইডির সবার থেকে বিদায় নেয়। চলে যায় অভিমানে চুপটি করে। দুরে কোথাও চলে যায়। আর পাইনি ওকে। ওকে হারিয়ে অন্ধকারে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছি। আসলে সত্যি বলতে নতুন করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। কিন্তু প্রথম ভালোবাসার দুঃখজনক পরিনতির জন্য সেদিন ওর সাথে এমন করেছিলাম ।
বছর তিনেক পর ‘ফেরারি প্রেম’ নামক একটা ফেক আইডি থেকে মেসেজ রিকোয়েস্ট আসে- নীল শাঁড়ি পরেন আপনি?” সেদিনের সেই ব্যক্তিটাকে চিনে নিতে আমার খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। এ যে আমার শুভ্র সেটা চিনে ফেললাম একদিনের ব্যবধানেই। খুঁজতে লাগলাম দেখা করার উপায়। হঠাৎ করে ও নিজেই দেখা করার কথা বলল। রাজি হয়ে গেলাম আমি। ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। পিছন থেকে কারো ডাকে ঘোর কাটে। পিছনে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। এ যে স্বয়ং শুভ্র। দুঃখবিলাসীকে তবে কি চিনেই নিল? প্রশ্ন করলাম-
— জ্বি, আমাকে বলছেন?
– হাঃ হাঃ হাঃ
— কি হলো? হাসছেন কেন?
– এই যে লেখিকা ম্যামকে চিনে গেলাম।
— ওহ…
– প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। এভাবে দাঁড়িয়েই থাকবেন নাকি কিছু খাওয়াবেন?
— চলুন।
– কোথায় চলছি আমরা?
— এইতো চলুন না সামনে।
– সেই কখন থেকে বলছেন চলুন, চলুন। আমার তো পা আর চলছে না।
— আরেকটু চলুন।
– অসম্ভব! এই যে রিক্সা মামা। এদিকে প্লিজ…
– স্যরি, না বলেই রিক্সা ডাকলাম। আসলে পা ব্যথা করছিল খুব।
– কি হলো? দাঁড়িয়ে কেন? উঠুন।
নিঃশব্দে রিক্সায় উঠে বসলাম আমি। রিক্সা চলছে। এদিকে দু’জনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করছে। আড়চোখে দু’জন দু’জনকেই দেখছি কিন্তু বুঝতে দিচ্ছি না কেউ কাউকে। আমি যখন’ই ওর চোখের দিকে তাকাতাম, ও চোখ ফিরিয়ে নিত। আবার আমি যখন এদিক-ওদিক তাকাতাম তখন ও আমার চোখে বিচরণ করত।
যায় হোক! কাঙ্খিত জায়গায় এসে রিক্সা থামলো। একটা নিরিবিলি রেস্টুরেন্টের ভিতর প্রবেশ করল ও। ওকে অনুসরন করে ওর পিছু পিছু আমিও ঢুকলাম। পর্দার আড়ালে একটা ছোট্ট রুমে গিয়ে বসলাম। ও খাবার অর্ডার করল। নিচের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম ওকে, আপনি জানেন কিভাবে আমি এরকম জায়গা খুঁজছিলাম? হেসে দেয় ও। পাল্টা প্রশ্ন করে, তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। এভাবে বার বার ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢাকতেছেন কেন? জবাবে লজ্জায় কিচ্ছু বলতে পারিনি আমি। ও আবারো হাসল। আমায় জানালো, ‘ আপনি মনে হচ্ছে খুব লাজুক। কারো সামনে খেতে পারেন না। এমনকি চোখের দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে পারেন না। তাই এখানে নিয়ে আসলাম। কিচ্ছু বলিনি আর।
খাবার চলে আসল। খেতে শুরু করলাম। শুভ্রও খাচ্ছে। আড়চোখে আমি বার বার ওর দিকে তাকাচ্ছি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর হাতে একমুঠো ভাত খেতে। কিন্তু তাতো আর হবে না। তাই দেখেই নয়ন জুড়াচ্ছি। হঠাৎ বিষম খায় ও। পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম ওর দিকে। কেন জানিনা তখন অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল মনে। মনে হচ্ছিল যেন সেটা আমাদের ছোট্ট বাসা আর আমি ওর বউ। পানি খাওয়া শেষে ও আমার দিকে তাকালো। ইতস্তত আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।
বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এলো। ঐদিকে কাউন্টার। টিকিট কাটার জন্য দু’জনেরই রাস্তা অতিক্রম করে ঐদিকে যেতে হবে। শুভ্র দু’লাফে রাস্তার ও পাশে চলে গেছে। বোকা আমি এখনো এপাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির গতিবিধি লক্ষ করছি। ভিষণ ভীতু আমি। একা একা কখনো রাস্তা পার হতে পারি না। এপাশে দাঁড়িয়ে আমি যখন গাড়ির গতিবিধি দেখছিলাম, তখনি ওপাশ থেকে ফিরে আসে ও। আমার হাতটা এসে ধরে। নিয়ে যায় ওপাশে। আমাকে টিকিট কেটে বাসে উঠিয়ে দিয়ে নিজে ঢাকাগামী বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের বাসটা আরো যাত্রী নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আজও পারিনি ওকে মনের কথা বলতে। হয়তো আর কখনো বলা’ও হবে না। ভাবতেই চোখের জল টলমল করে উঠে। পিছনে বসা ছেলেটা কার যেন কেয়ার করছে ফোনে। এই শুনো, বাইরে বের হলে ছাতা নিয়ে বের হবে। এটা খাবে না, ওখানে যাবে না আরো কত কি! ভালো লাগছে না কিছুই। দৃষ্টি যায় পাশের সারিতে বসা একজোড়া কপোত কপোতীর দিকে। বোধ হয় ঢাকা থেকে এসেছে। ক্লান্ত মেয়েটা ছেলেটার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে। এরকম’ই একটা নির্ভরযোগ্য কাঁধ আমি চেয়েছিলাম। ভাবতেই চোখে জল চলে আসে। গাল গাড়িয়ে তা ঝরে পরে নিচে। আমাকে এখনি নামতে হবে। কান্না লুকাতে হবে। দ্রুত বাস থেকে নেমে গেলাম।
বাসস্টপে ব্যাগ হাতে শুভ্র তখনো দাঁড়িয়ে। ছুটে গেলাম ওর কাছে। ওর কিছু বুঝে উঠার আগেই জাপটে ধরলাম ও’কে। কিচ্ছু বলেনি ও। পরম নিবিড়ে ও শুধু আমায় জড়িয়ে ধরেছিল। চোখের জলে আমি ওর শার্ট ভিঁজিয়ে একাকার করে দিয়েছি। আশেপাশের মানুষজন সবাই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার তাতে একটুও ক্রুক্ষেপ নেই। আমি কান্না করছি তো, করছি। শুভ্র নিজেও পারছে না আমার কান্না থামাতে। বাধ্য শুভ্র আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, ঘটনা কি? দুঃখবিলাসী তো দেখছি একেবারে শুভ্রবিলাসী হয়ে গেছে!