বাবার ইচ্ছে ছিলো তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিবাহ দিবেন। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম ভেবেছিলাম বাবা যেহেতু আমার বিয়ে ঠিক করেছেন তাহলে ভালোই হবে। কিন্তু একদিন আম্মা আমাকে বলল মেয়েটাকে দেখে আসতে। আমিও খুশিমনে রাজি হলাম। ভাবলাম দেখা হোক, কথা হোক, প্রণয় হোক তাতে কিছুটা ভাব বিনিময় হবে। বিবাহের মতো সম্পর্ক আরও মজবুদ হবে।
সকালবেলা দ্রুত উঠলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে মসজিদে। বাসায় ফিরে বোয়া কে বললাম পানি গরম করে দিতে৷ কুসুম-গরম পানি তে সুন্দর করে গোসল সেরে একটা পাঞ্জাবি পরে খেতে বসলেন তারপর আম্মার কাছে বললাম “মেয়ে আমার পছন্দ হলে জানাবো” আম্মা শুনে রাজি হলো।
বাইক নিয়ে বের হলাম স্টেশনের দিকে। মেয়েটা আসছে আমার জন্য দেখা করতে। আমি তাকে ওখান থেকে নিয়ে একটা রিসোর্টে যাবো। প্লান আগেই করা। মেয়েটাকে নিয়ে চললাম রিসোর্টে, প্রথমে ভালমতো খেয়াল করিনি। কারণ মুখ বাধা ছিলো হিজাব দিয়ে। ওখানে প্রবেশ করার পর মেয়েটা আমার সামনে মুখ খুলে বসেছে। এই মুহূর্তে আমি যেন ৪২০ ভোল্টের একটা শক খেলাম। মেয়েটা দেখতে একদম যা-তা। আমার সাথে কোনোভাবেই যায়না। কালো একটা মেয়ে যাকে বলে “গেয়ো” বাবার পছন্দ এমন? বাবা আমার জন্য এরকম একটা মেয়ে কিভাবে পছন্দ করতে পারলো? ভেবেই অবাক হচ্ছি। বাবা কী তাহলে আমার ভালো চায় না? আবার দেখলাম, না মেয়েটা একদম কালো। মুহূর্তে আমার রাগ উঠে গেল। ইচ্ছ করছিলো এ-ই নিয়ম মেপে দেখা করা আমার উচিৎ হয়নি। আগে লুকিয়ে দেখা উচিৎ ছিলো তারপর বাবাকে বলে দিতাম ‘এই মেয়ে আমার অপছন্দ’ এখন বাবা আমাকে কি ভাববে?
মেয়েটা চুপচাপ আমার সামনে বসে আছে। তার চেহারা দেখে আমি মুগ্ধ নই সে বুঝে নিয়েছে। নাম পর্যন্ত শুনিনি রাগে। এরকম কালো একটা মেয়ের নাম শুনে আমার কী কাজ? ভেতরে ভেতরে আমার জ্বলছে। তবুও রাগ সামলে নিয়ে তাকে বললাম,
‘কেমন আছেন?’
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপন”
‘সেইম! নাম কী আপনার’
“মায়া”
‘কই আমি তো কোনো মায়া খুঁজে পাচ্ছিনা আপনার কাছে, তবে নাম মায়া কেন?’
”জ্বী”
‘এই নাম কে রেখেছে?’
“বাবা”
‘আমরা আজ কেন দেখা করেছি জানেন?’
“জ্বী”
‘কী জানেন?’
“বাসা থেকে আপনার আর আমার বিবাহের ব্যাপারে কথা বলছে এজন্য”
‘হুম! তা তোমার কী মনেহয় এই বিয়ে করা ঠিক হবে?’
কথাটা বলতেই মায়া চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। মায়া এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। চুপ করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।
‘কী হলো বলো?’
“আমি জানি আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। আমি কালো এজন্য। কী করব বলেন আমার যে কোনো হাত নেই। আমি তো ইচ্ছা করে কালো হইনি। জানেন, কালো বলে কেও কখনো প্রেম/বন্ধুত্ব করতে চায়নি। কালো বলে আমার পাশে কেও বসেনি। কালো বলে কেও কখনো তাদের বাচ্চা আমার কোলে দেয়নি। বলতে পারবেন কালো কী অভিশপ্ত কোনো রং? কালো মানেই কী কলঙ্ক? কালো দের কী কোনো স্বপ্ন বা ইচ্চা থাকতে নেই? আজ কালো বলে আপনি আমার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেন না। ফর্শা হলে ঠিক আমার প্রশংসা করতেন। মন বলে কিছু আছে তার কোনো দামই নেই এই ইঁটকাঠের শহরে। আমি জানি আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি বাবার ইচ্ছে ছিলো এজন্য দেখা করতে এসেছেন। চিন্তা করবেন না আমাকে বিবাহ করতে হবেনা। যারা কেবল বাইরের চেহারা দেখে আমি তাকে বিবাহ করতে চাইনা। এই বিয়ে হবেনা চিন্ত করবেন না, ভালো থাকবেন”
কথা গুলো বলে কিছুটা কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো এখান থেকে৷ আমি ঠায় চেয়ে থাকলাম ওর চলে যাবার দিকে। একটা মেয়ে কতটা অবহেলা পেলে এসব বলতে পারে। একটা মেয়ে কতটা কষ্ট জমিয়ে রেখেছে তার বুকের গহীনে যা কাওকে বুঝতে দেয়নি। শুনেছিলাম মেয়েরা তাদের বাবার রাজকন্যা হয়। এই মুহুর্তে কল্পনা করছি “আমারও একটা মেয়ে হয়েছে আমি সুন্দর আমার বউ সুন্দর কিন্তু মেয়েটা কালো, এই মেয়েটা তার জীবনে কি পরিমাণ লাঞ্চনা অবজ্ঞা পেয়েছে? ভাবতেই কেমন শিহরে উঠলাম আর ভাবলাম, গায়ের রং দিয়ে মানুষ কে বিচার করা উচিৎ নয়” বাড়ি ফিরলাম, বাবা-মা আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। আমি শুধু বাবাকে একটা প্রশ্ন করলাম,
‘আপনি কেন এই বিয়েটা করাতে চাচ্ছেন?’ বাবা খুব সহজ ভঙ্গিতে বললেন,
‘এই মেয়েটা অনেক লক্ষী আর বুদ্ধিমতী সে তোমাকে ভালো রাখতে পারবে এজন্য’ আমি চুপচাপ রুমে চলে গেলাম। তারপর মায়ের কাছে বললাম।
‘আম্মা আমি বিয়েটা দ্রুত করতে চাই, বিয়ের কাজ শুরু করো’
আম্মা আমার কথা শুনে অবাক আর বিষ্মিত হলেন তারপর হাসিমুখে বলল ঠিক আছে বাবা’ শুনেছিলাম মেয়েটা নাকি রাজি ছিলোনা প্রথমে। তারপর আমার বাবা ওই মেয়ের সাথে কথা বলার পর মেয়েটা রাজি হয়েছে। মেয়েটা শেষ আমার বউ হতে চলেছে। যেহেতু সে সুন্দরী নয় সেহেতু কোনো উপমা পাবার যোগ্যতা সে রাখেনা। কিন্তু না তার উপমা আছে। বিয়ের দিন রাতে তার সাথে আবার আমার কাছাকাছি চলে আসা। সে বসে আছে বিছানার উপরে। তাকে বললাম,
‘ছাদে যাবেন?’
সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তারপর বলল,
“এতো রাতে ছাদে”
‘আহা চলেন না প্লিজ’
সে রাজি হলো, শর্ত আমি চোখ বেধে নিয়ে যাবো। এবং সে বোকার মতো আমার সব শর্ত শুনতে রাজি হলো। একটা সময় ছাদে তাকে নিয়ে গেলাম তারপর একটা চেয়ারে বসতে বললাম। কিছুক্ষণ পরে আমি উধাও হয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পেল না হতাশ হলো। এমন সময় আতসবাজি ও ফটকা ফুটে উঠলো বেশ জোরে। মেয়েটা ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে এলো। এবার তার পায়ের কাছে একটা চিরকুট, তাতে লেখা ‘মায়া ফুচকা চলবে?’ লেখাটা পড়ে হেসে দিলো। আমি ফুচকার বাটি হাতে হাজির। সাথে অনেক বেলুন আর একটা ফানুস। তাতে লেখা ‘গল্পটা মেঘ ও মায়ার’ ফুচকা পেয়ে মেয়েটা খেতে শুরু করলো। এবার আর লজ্জা পাচ্ছেনা।
এবার তাকে সাথে নিয়ে আবার বাজি ফাটালাম। ততক্ষণে কজিন রা রেডি মায়াকে সার্প্রাইজ দিতে। মায়া জানেওনা এই ছাদে আরও পাঁচজন মানুষ মিশে আছে অন্ধকারে। কিছুক্ষণ পরে মায়া ভাবীর জয় হোক বলে সবায় একসাথে উঠে এলো। মায়া অবাক হলো আর কান্না করে দিলো খুশিতে। তারপর সবার সাথে পরিচয় হলো। মায়া খুব খুশি হয়েছে তা ওর চোখ বলে। ওরা সবাই নিচে নেমে গেলো। ছাদে আবার নেমে এলো অন্ধকার। মায়া এবার আমার কাছে এসে আমার বুকে মাথা রেখে বলল ‘ভালোবেসে ফেলেছি’ আমি হেসে বললাম
‘এ মা মাত্র বিয়ে হলো এর মাঝেই ভালোবাসা, আগে চেনো জানো তারপর নাহয়, আমি এখনো গ্রহণ করিনি কিছুদিন ঝুলে থাকুন তারপর’ মায়া হেসে দিলো আর বলল,
”কী করলে আজকে রাজি হবেন বলুন?”
‘আমাকে আজ থেকে তুমি বলে ডাকতে হবে আর অনেক অনেক ভালোবাসতে হবে তাহলে’
মায়া ভারী কণ্ঠে বললো,
”আর আপনি বুঝি আমাকে ভালোবাসবেন না?”
‘আবার আপনি’
“আচ্ছা বাবা, তুমি কী আমাকে ভালোবাসবে”
‘হুম আগে বলো তুমি আমাকে বাবা ডাক কবে শোনাবে?’
“যাহ দুষ্টু কি বলে! মুখে কিচ্ছু আটকায় না”
তারপর শুরু হলো মায়াকে ভালোবাসা। একটা মেয়ে কালো কিন্তু মায়ার মনটা ছিলো খুব ফ্রেশ। আমাকে প্রচুর ভালোবাসতো এবং বিশ্বাস করতো। যা দেখেই আমি মুগ্ধ হইছিলাম। আমার সকালে ঘুম ভাঙ্গে মায়ার মিষ্টি কণ্ঠে। তারপর লাগে ঝগড়া। সে অভিমান করে, আমি অভিমান ভাঙায় তারপর তার মুখে হাসি ফোটে। নামাযের আগে মসজিদে যাবার জন্য মায়া আমার সাথে খুব কাহিনী করে। তারপর মসজিদ থেকে বাসায় এলেই বলে “হিহিহি সব ছিলো ছলনা মিঃ লেখক সাহেব”
আমিও হাল্কা রেগে গিয়ে বলি “তবে রে পাগলী এইবার তো ছাড়ছিনা” ঠিক তখুনি মায়া বলে “এরকম করলে কিন্তু বাবা হতে দিবো না” আমি বলি কান্নাকান্না কণ্ঠে “তাহলে কী করব” মায়া হাসিহাসি মুখ নিয়ে বলে “কী আবার লক্ষী ছেলের মতো আমার সব কথা শুনতে হবে তবেই বাবা হতে পারবেন বুঝেছেন মেঘ ভাইয়া?” এইবার বউকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘ওরে আমার চালাক বউ রে’ মাঝেমধ্যে ভাবি সে কালো দেখতে। কিন্তু আমার কাছে সে রাজরানী। সে কালো বাইরে কিন্তু ভেতরে সাদার থেকেও সাদা। তার মুখে আমি সবসময় ভালোবাসা দেখি। খুব সুখে আছি! খুব ভালো আছি কালো মেয়েকে বিয়ে করে। অনেক ভালো লাগে বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি বলে। বাবা চেয়েছিলেন যেমন তেমনই হয়েছে। আমি চাইলে বোধহয় হতোনা এমনটা……