ক্লাসে ঢুকতেই অন্তরা’কে দেখে সবাই হেসে উঠলো। তার ক্লাসের সবাই তাকে দেখে নিশ্চুপ হাসি হাসতে শুরু করলো। অন্তরা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে ক্লাসমেটদের হাসির কারণ সে নিজে। তাই অন্যদিনের মতো আজও সে স্বাভাবিক আচরণ করলো। ভার্সিটিতে এমন হাসিটা খুব বেশি অস্বাভাবিক কিছুনা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারণে ক্লাসের আগে একটু হাসির আমেজ সৃষ্টি হয়। অন্তরা এতে নাক গলালো না। কিন্তু অন্তরা যখন তার প্রতিদিনের বসতে গেলো তখন ক্লাসমেটরা ফিসফিস করে একে অপরকে কিছু একটা বলতে শুরু করলো। নিশা প্রতিদিন অন্তরার সাথে বসতো। কিন্তু আজ অন্তরা যখন তার পাশে এসে বসলো তখন সে তার সাথে কোনো কথা না বলেই অন্য সিটে গিয়ে বসলো।
বিষয়টা দেখে অন্তরা একটু অবাক হলো আর সাথে সাথে একটু চিন্তিত। যে নিশা প্রতিদিন কল করে জিজ্ঞেস করতো অন্তরা আজ কলেজ আসবে কিনা সেই আজ এমন আচরণ করছে কেন? অন্তরা দেখলো সবাই তার দিকে চেয়েই হাসছে। সে এবার একটু আন্দাজ করতে পারলো হাসিটা ওকে নিয়েই। কিন্তু কেন? প্রশ্নটা গভীরভাবে দাগ কাটছে তার মনে। একটু পর পেছনে বসা দু’জনের কথোপকথন সে শুনতে পেলো। কথাগুলো ছিলো “দোস্ত ঐ দেখ রিক্সাওয়ালার মেয়ে! প্রতিদিন যে রিক্সায় অন্তরা আসে সে রিক্সা ওর বাপের।” প্রথমজন উক্ত কথাটা বলে হাসতে শুরু করে। দ্বিতীয়জন তারপর প্রথমজনকে বললো “ছিঃ একজন রিক্সাওয়ালার মেয়ে আমাদের ক্লাসে!আমার তো ভাবতেই ঘৃণা করছে!”
পেছন থেকে দুজনের কথাগুলো শুনে অন্তরা মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে। চোখ দিয়ে তার অঝোরে পানি পড়তে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও অন্তরা তার কান্না থামাতে পারছেনা। এখন থেকে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করবে। এগুলো ভেবে আরোও কাঁদছিলো অন্তরা। ভার্সিটিতে কোনো ঘটনাই ভাইরাল হতে সময় লাগেনা। আজ শুধু তার ক্লাস জানে যে সে রিক্সাওয়ালার মেয়ে। কাল হয়তো পুরো ভার্সিটি জুড়ে কথাটা ছড়িয়ে যাবে।
ক্লাস শেষ হলো। পুরো ক্লাসেই অন্তরা অমনোযোগী ছিলো। তার বান্ধবী নিশাও তাকে অবহেলা করছে দেখে অন্তরা নিশাকে জিজ্ঞেস করলো, “নিশা তর কি হয়েছে? তুই কেন এমন বিহেইভ করছিস? নিশা একটু বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, ” অন্তরা আমি আগে জানতাম না যে তর বাবা একজন সাধারণ রিক্সাচালক!” আমার বাবা একজন রিক্সাচালক তাতে কি হয়েছে? পুরো ক্লাস জেনে গেছে তুই রিক্সাওয়ালার মেয়ে। এখন তকে নিয়ে পুরো ক্লাস হাসাহাসি করছে। কাল হয়তো পুরো ভার্সিটি হাসবে তর উপর। এমন অবস্থায় যদি আমিও তর সাথে চলাফেরা করি তাহলে আমাকে নিয়েও মানুষ হাসবে। আমি চাইনা অন্তরা আমি সবার সামনে হাসির পাত্রী হই।
অন্তরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিশা চলে গেলো। অন্তরা আবারো ভেঙে পড়লো। চোখজোড়া থেকে জলের ধারা বইতে লাগলো অঝোরে। হয়তো এখন প্রতিদিনই অপমানের সম্মুখীন হতে হবে। ক্লাসমেটরা প্রতিদিনই তাকে নিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবে। ভেবে আরোও ভয় পেয়ে যায় অন্তরা। কিন্তু অন্তরার সবচেয়ে বড় ভয় তার বয়ফ্রেন্ড, তার ভালোবাসা সুজয় কে নিয়ে। মাত্র কয়েকমাস হলো অন্তরা একটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে। সম্পর্কটা ভালোবাসার। সুজয় আর অন্তরা একে অপরকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু সুজয় যদি জানতে পারে অন্তরার বাবা একজন সাধারণ রিক্সাচাকল তাহলে বিষয়টা সে কিভাবে নেবে? সেও কি অন্তরার সাথে সব সম্পর্ক ভেঙে চলে যাবে?
ভাবতেই অন্তরার ভেতরটা কেঁপে উঠে। বুকের বাঁ পাশটা যেন অচেনা এক ব্যথায় কাতর হয়ে যাচ্ছে অন্তরার।
মনমরা হয়ে বাসায় ঢুকে অন্তরা। অন্তরার ঝুলে যাওয়া চেহারা আকৃষ্ট করে তার মাকে। মেয়েকে এমন চিন্তিত দেখে মায়ের মনটাও আর ভালো থাকেনা। অন্তরার কাছে এসে তার মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে মা? কলেজে কিছু হয়েছে নাকি? অন্তরা কিছু বললনা। মায়ের মন কি আর শান্ত থাকে। তিনি আবারো বললেন, কি হয়েছে কিছু বলবি? না বললে কি করে জানবো তর কি হয়েছে!!! অন্তরা আড় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকরভাবে বলল, কিছু হয়নি। তুমি তোমার কাজ করো।
অন্তরার মা জানেন যে কিছু একটা হয়েছে। নইলে অন্তরা মন খারাপ করবে কেন!! তিনি এবার একটু কড়াভাবে জিজ্ঞেস করলেন সমস্যা কি। তখন অন্তরাও চিৎকার করে তার মাকে জবাব দিলো, সবাই আমাকে রিক্সাওয়ালার মেয়ে বলে ডাকে। কেউ এখন আর আমার পাশে বসতে চায়না, আমার আশেপাশে ঘেঁষতে চায়না। সবাই আমার উপর হাসে। বিভিন্ন রকমের কথাবার্তা হয় আমাকে নিয়ে। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দেয় অন্তরা। মেয়ের ভিষণ কান্না দেখে মাও কেঁদে ফেলেন। মেয়েকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন। অন্তরা তার মাকে বলল, মা তুমি বাবাকে বলে দিও আর আমাকে নিয়ে ভার্সিটিতে না যেতে। আমি চাইনা বিষয়টা বেশি বড় হোক। রাতে অন্তরার বাবা ঘরে আসলেন। প্রতিদিন এমন সময়েই ঘরে আসেন আর আসামাত্রই অন্তরা তার বাবাকে পানি এনে দেয়। কিন্তু আজ অন্তরার মা পানি নিয়ে আসলেন। পানি নিয়ে অন্তরার মাকে আসতে দেখে অন্তরার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, সূচনা আমার মেয়েটা কই? তার মা বললেন, অন্তরা তার রুমে পড়ছে।
-ও, তোমাকে পানি আনতে দেখে আমি মনে করলাম যে অসুস্থ হয়ে পড়লো নাকি।
-আপনাকে কিছু বলবো?
-কি বলবে??
আজ ভার্সিটিতে যা কিছু ঘটেছে অন্তরার মা সব খুলে বললো। কথাগুলো বলতে বলতে অন্তরার মা কেঁদে ফেললেন আর কথাগুলো শুনে অন্তরার বাবাও কেঁদে ফেললেন। যদিও সেই কান্নাতে আওয়াজ নেই, কিন্তু ব্যথা অনেক আছে।
সকালে অন্তরার বাবা রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। প্রতিদিনের মতো আজ আর মেয়েকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেননি। কিন্তু বেরুনোর আগে অন্তরার মায়ের হাতে অন্তরার ভার্সিটি যাওয়ার ভাড়াটা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু অন্তরা আজ ভার্সিটি যায়নি।
অন্তরার মনে একটা ভয় কাজ করছে, কিভাবে সে ভার্সিটির সবার সামনে মুখ দেখাবে? আর যদি সুজয় কোনো প্রশ্ন করে তার বাস্তবতাকে নিয়ে তাহলে তাহলে সে কি ই বা জবাব দিবে?? কিভাবে বলবে তার বাবা একজন রিক্সাওয়ালা? বিভিন্ন প্রশ্নের ঝড় উঠছে অন্তরার মনে। কয়েকদিন অন্তরা ঠিকি ভার্সিটিতে যায়নি। এই কয়েকদিন সুজয় অনেক মেসেজ, কল ইত্যাদি করে অন্তরার না আসার কারণ জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু অন্তরা প্রতিবারই কোনো না কোনো বাহানা করে দিতো। কয়েকদিন পর অন্তরা ভাবলো যে সবাই হয়তো বিষয়টি ভুলে গেছে। আর সুজয়কেও অনেক মিথ্যে কথা বলে ফেলেছে সে। এভাবে ভার্সিটিতে না গেলে তার পড়ালেখারও ক্ষতি হবে। অনেক কিছু চিন্তাভাবনার পর অন্তরা ভার্সিটি গেলো। অন্তরাকে দেখে সুজয় বলল, মহারানি এতোদিন কোথায় ছিলেন? চলো আজ আর কোনো ক্লাস করবোনা। চলো আজ তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে।
সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন। সুজয়ের কথামতো অন্তরা তার সাথে গেলো। সুজয় তাকে একটা বটগাছের নীচে নিয়ে গেলো। সুজয় অন্তরাকে বসতে বলল। তারা দুজনে গাছের নীচে বসলো। সুজয় অন্তরাকে অবাক করে দিয়ে বললো, আমি তোমার কাছ থেকে এমনটি কখনো এক্সপেক্ট করিনি অন্তরা। তোমার এতোদিন ভার্সিটি না আসার কারণ আমি জানতে পেরেছি। তুমি এতোবড় একটা কথা আমার কাছে লুকাবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
অন্তরার চোখ মুখ কালো হয়ে গেলো। ভয়ে কাঁপতে লাগলো অন্তরা। প্রায় প্রায় কেঁদেই ফেললো সে। আজ হয়তো তার ব্রেকআপও হয়ে যাবে। ভাবছে আর কাঁদছে অন্তরা। সুজয় তখন অন্তরাকে জিজ্ঞেস করলো, প্রতিদিন যে তোমাকে রিক্সায় করে ভার্সিটিতে নিয়ে আসতেন উনি কি তোমার বাবা? অন্তরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ তে জবাব দিলো।
-আজ উনি কেনো আসেন নি?
-অন্তরা কাঁদো কাঁদো ভাবে জবাব দিল, আমি মানা করেছি আসতে!!
-কেন মানা করেছো? উনি আসলে সবাই তোমাকে নিয়ে হাসবে তাই? তোমার জন্য সারাদিন যে বাবা সারাদিন পরিশ্রম করেন, যে বাবা তোমাকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেয়ার জন্য রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে রিক্সা চালিয়ে উপার্জন করেন তাকে অপমানিত হতে দেখতে পারলে তুমি? কি আশ্চর্য্য!!! তোমার বাবা কি চুরি করেন?
-অন্তরা অবাক হয়ে বলল, এ তুমি কি বলছো সুজয়? আমার বাবা চুরি করবে কেন?
– তাহলে তুমি উনাকে নিয়ে লজ্জা পাচ্ছো কেন? উনাকে নিয়েতো তোমার গর্ব হওয়ার কথা! এমন বাবা কয়জনের হয় যে তার মেয়েকে এতোদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। আজ তুমি যা কিছু আছো সব তোমার বাবার কারণে।
-সরি সুজয়। আমি আসলে লোকলজ্জার ভয়ে উল্টো পথে চলতে শুরু করেছিলাম।
-সরি আমাকে না সরি তোমার বাবাকে বলো।
সুজয়ের প্রত্যেকটা কথা অন্তরার চোখ খুলে দিলো। অন্তরা নিজের ভুল বুঝতে পারলো। পরেরদিন অন্তরা ভার্সিটিতে গেলো। আজ সে একা নয়, সাথে তার বাবা। অন্তরা তার বাবাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলো। সবাই অন্তরা আর তার বাবার দিকে তাকালো। অন্তরা সবাইকে বললে, আজ থেকে কয়েকদিন আগে এই ব্যক্তিকে নিয়ে সবাই ক্লাসে হাসাহাসি করেছিলেন তাইনা?? উনার নাম চন্দ্রনাথ। সবাইতো ভালোকরেই জানেন যে আমি একজন রিক্সাওয়ালার মেয়ে। জানেন এই রিক্সাওয়ালা আমার বাবা দৈনিক কত টাকা আয় করেন? আটশো থেকে হাজার টাকা। এই আটশো থেকে হাজার টাকা আপনাদের একেকজনের পকেট খরচ মাত্র।
কিন্তু এই সামান্য টাকায় আমার বাবা তিনজনের একটা পরিবার সহ আমার পড়ালেখার খরচও চালান। আমার বাবা যখন আমার মতো ছিলেন তখন উনারো ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা করার। কিন্তু গরীব হওয়ার কারণে স্টাডি কান্টিনিউ করতে পারেননি। কিন্তু আমাকে উনি কখনো মনে হতে দেননি যে আমার পড়ালেখা চালাতে উনার কষ্ট হচ্ছে। জীবনে বাবার কাছে বেশি কিছু চাইনি কিন্তু পেয়েছি অনেককিছু। আমার বাবা নিজের শরীরের ঘাম ঝড়ান কারণ আমি যেন পড়ালেখা করে জীবনে সুখী হতে পারি। সত্যি বলতে আপনারা আমার বাবার উপর হেসে যত বড় অপরাধ করেছেন তার চেয়ে বড় অপরাধ আমি করেছি আমার বাবার উপর আপনাদের হাসতে দিয়ে। আমার উচিৎ ছিলো সেদিন আপনাদের কে উচিৎ জবাব দেয়া। কিন্তু আমি সেদিন সেটা করতে পারিনি।
অন্তরার বলা কথাগুলে শুনে সবাই চুপ করে মাথা নীচু করে রইলো। নিশ্চয়ই সবাই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। অন্যদিকে অন্তরার বাবা কাঁদছেন। হয়তো ক্রন্দনটা খুশির। অন্তরা এবার তার বাবাকে বললো, বাবা আমাকে মাফ করে দাও৷ সেদিন আমার উচিৎ হয়নি তোমার বিরুদ্ধে একটি কথাও শুনা। আমাকে মাফ করে দাও বাবা। আমি আজও চাই আমাকে তুমি তোমার রিক্সায় করে প্রতিদিন ভার্সিটিতে পৌঁছে দাও। অন্তরা কাঁদছে। সে কাঁদতে কাঁদতেই তার বাবার বুকে মাথা গুঁজে নিলো। বাবার বুকেই তো সন্তান পরম শান্তিটা খুঁজে পায়।