অপেক্ষা

অপেক্ষা

— আপনাকে না ছাদে আসতে মানা করেছিলাম তারপরও আজ আবার আসলেন?
— আসলে এই ছাদ ছাড়া আর কোথায়ই বা যাবো বলুন? ছাদের চিলেকোঠায় থাকি। আমার তো আর বেলকনি নাই যে সেখানে একটু আসবো।
— আপনাকে শুধুমাত্র ওই চিলেকোঠাই ভাড়া দেয়া হয়েছে ছাদ না।
— কিন্তু আমার যে আকাশ না দেখলে একটা রাতও যে কাটে না।
— রুমে বসে দেখা গেলে দেখবেন না হলে নাই। তবুও আপনাকে যেন আমি আর ছাদে না দেখি। বিশেষ করে আমি থাকা সময় তো না-ই।

আমি আর প্রতি উত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। তার আগেই নিলা হাঁটা শুরু করলো। আর যেতে যেতে আস্তে আস্তে বললো,

— আব্বু কেন যে এসব ব্যাচেলর ভাড়া দেয় সেটাই বুঝিনা, ধুর!

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো সন্ধ্যার আকাশ দেখতে লাগলাম। কি করবো। এই আকাশই যে আমার সব! কিছু সময় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে রুমে চলে এলাম। এখন আবার রাতের রান্নাবান্নাও করতে হবে। ব্যাচেলর মানুষের আবার এই একটা সমস্যা মন চাক বা না রান্না করতেই হবে। তবে ইদানীং নিজের রান্না আর মোটেও খাইতে ইচ্ছে করেই না। মন চায় বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের খুব ঝাল দিয়ে চচ্চড়ি করা ছোট মাছ দিয়ে গোগ্রাসে কয়েক প্লেট ভাত খেতে। তবে তাও যে পারি না। তাইতো গিলতে না পারলেও জীবন বাঁচাতে হলেও আমাকে খেতেই হচ্ছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি প্রায় মাস চারেক হবে। এসে উঠেছি মনোয়ার আঙ্কেলের বাসায়। উনি মানুষ হিসেবে অমায়িক। এর আগে আমি একটা মেসে থাকতাম। বছর তিনেকের মতো ওনার ছোট ছেলে মৃন্ময় কে পড়াচ্ছি। উনি বারবারই বলতেন,

— বাবা, তোমার কোনো সমস্যা না হলে আমাদের বাসার ছাদে একটা ছোট্ট রুম আছে সেখানে এসেই থাকিও।
আমি থাকিনি তখন। তবে মাস চারেক আগে না এসে আর পারলামও না। যদিও আঙ্কেল আমার থেকে ভাড়া নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শুধু বিনিময় হিসেবে মৃন্ময় কে ভালো করে পড়াতে হবে আর সবার সাথে টুকটাক সময় দিতে এই তার চাওয়া। আমিও মেনে নিয়েছি। সব মিলিয়ে ভালোই চলছে। আর ছাদে যে মেয়েটা রাগ দেখিয়ে চলে গেলো সে মনোয়ার আঙ্কেলেরই বড় মেয়ে। এবার অনার্সে পড়ছে। খুব ভালো ছাত্রী সে। শুনেছি ব্যবহারও তার বাবার মতোই অমায়িক।

শুধু আমার সাথেই আজ অবধি কখনোই ভালো ব্যবহার করেনি। তার সাথে আমার যতবারই কথা হয়েছে আমি লক্ষ্য করেছি তার মুখে তখন বিরক্তি চরমে ছিল। জানিনা, কেন জানি মেয়েটা আমাকে সহ্যই করতে পারেনা। অথচ আমি তার সাথে এমন কিছু করিনি যার জন্য সে এমন করবে। তবে একটা অপরাধ ধরা যায় সেটা হলো ওইযে ছাদে যাওয়া। কিন্তু আমিও যে নিরুপায়। বদ্ধ ঘরে বসে বসে কী আর আকাশ দেখার স্বাদ মেলে? রান্না শেষ করে খানিক সময় রেস্ট নিলাম। দিনদিন কেমন যেন ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছি। যদিও হওয়াটা স্বাভাবিক। আগের মতো নিয়ম করে আর কিছু করতে পারি না। ইদানিং ডায়েরি লেখার নেশাটাও একদম মরে গেছে। কি মনে করে যেন তাই ডায়েরিটা নিয়েই বসলাম। বিন্দু বিন্দু স্মৃতিগুলোকে বন্দী করে রাখাটায় আলাদা একটা স্বাদ।

.রাত প্রায় একটা বাজে। খাওয়া শেষ। অভ্যাস মতো ছাদে যাবো ভাবছি। তবে মনে পড়ে গেলো নিলার কথা। তার কথার যুক্তি আছে। আমাকে শুধু রুম ভাড়া দেয়া হয়েছে ছাদ না। তাই যা করার রুমেই করতে হবে। তবে মেয়েটা যদি জানতো যে তার বাবা আমাকে রুম ভাড়া দিয়েছে ঠিকই কিন্তু ভাড়া কখনোই নেয় না তবে মেয়েটা নিশ্চয় আমাকে সেই কবেই রুম থেকে তাড়িয়ে দিতো। এমনিতেই তো দেখতে পারে না। তাই উপায় না পেয়ে রুমে বসেই আকাশের কিছু অংশ দেখতে থাকলাম। আর গুনগুন করে ইচ্ছে মতো গান গাচ্ছি,

” মেঘ তুমি উড়ে চলো আকাশে, নেবে কি মোরে ভর করে বাতাসে, তোমার সাথে? আমিও হারাতে চাই সেখানে, যেখানে সুখ গুলোও ডানা মেলে বাতাসে। আর কষ্ট গুলো খুঁজে পায় রাতের জোছনা”। বিকেল চারটা ছুঁইছুঁই। মৃন্ময়কে পড়ানো শেষ করে বাইরে এসেছি। উদ্দেশ্য বাড়িতে একটা ফোন করা। প্রায় দেড়মাস হলো কারও সাথে কথা হয়নি। বাবা-মা, ভাইয়া -ভাবি আর পিচ্চি গুলারে বড্ড মনে পড়ছে। সাবিত ভাইয়ের দোকানে গিয়ে ফোন দিলাম। বুকটা খুব কাঁপছে। আমাকে শক্ত হতে হবে না হলে সমস্যা।

— আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুম আসসালামু। কে?
— ভাইয়া আমি আসিফ।
— আসিফ! ভাই তুই কোথায়? কেমন আছিস? বাড়ি আয় ভাই। আম্মু -আব্বু তোরে খুব মিস করে। প্রতিদিন কাঁদে তোর জন্য। তুই বাড়ি আয় ভাই।
— আম্মু আছে?
— হ্যাঁ।
— আম্মুকে দাও তো।
— দিচ্ছি লাইনে থাক। গলাটা ধরে আসছে খুব। নাহ, আরও পাষাণ হতে হবে। চোখকে ভিজতে দিলেই সব শেষ।

— আব্বুরে তুই কই? তাড়াতাড়ি বাড়ি আয় আব্বু। আমরা কি এতটাই অক্ষম যে আমাদের না বলে তুই চলে গেলি?
ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়ে আম্মু বলতে লাগলো।
— তোমরা অক্ষম নও আম্মু। আমার আর এসব সহ্য হচ্ছিল না তাই চলে এসেছি।
— কেমন আছিস বাবা? কী খেয়েছিস? তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয় বাবা আমি তোকে তোর পছন্দের সব কিছু খাওয়াবো তবুও বাড়ি আয়। তোকে খুব দেখতে মন চাচ্ছে!
— যাবো আম্মু। হুট করেই একদিন যাবো। আম্মু, আব্বুকে ফোনটা দাও তো।
— তোর বাপ তোর উপর রাগ করে আছে। কথা বলবে না। আব্বা তোর ভাবি কথা বলবে নে ধর,

— বাবু তুমি এভাবে বাড়ি ছেড়ে গেলে? আমাদের কথা একটা বারও ভাবলে না? তোমার বাবা-মা ভাই আমরা কি এতটাই খারাপ?
— না ভাবি এসব কিছু না। তুমি কেমন আছো? আমার চাচ্চু তরী কেমন আছে?
— কেউ ভালো নেই। তুমি চলে আসো। আমরা যেভাবে পারি তোমাকে দেখবো। তবুও তুমি চলে আসো।
— আসবো ভাবি। হুট করেই একদিন চলে আসবো।
— কবে আসবা?
— আসবো একদিন। আচ্ছা ভাবি রাখি তাহলে এখন।
— তুমি তো নিজের নাম্বার ও বন্ধ করেছো তো আবার কবে ফোন দিবা?
— জানি না ভাবি।

বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। আর একটু কথা বললেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। শেষমেশ সব ধূসর হয়ে যেত। একটা টিউশনিতে কোনো ভাবেই আর চলতে পারছি না। এদিকে শরীরটাও আজকাল বড্ড বেঈমানী করছে। শুধু ঘুম পায়। অসার হয়ে আসে। নড়তে পারি না। দেখতেও ফ্যাকাশে হয়ে গেছি। কয়েকদিন ধরেই বন্ধু নয়নকে বললাম একটা টিউশনি খুঁজে দিতে। দিয়েছিল খুঁজে তবে অনেক দূর। প্রতিদিন গাড়িতে যাওয়া আসায় আমার পোষাবে না। গুনীজনরা আসলেই সত্যি বলেন। টাকা ছাড়া দুনিয়ার সবই অচল সব! সিঁড়ি বেঁয়ে ছাদে যাচ্ছি তখনই মনোয়ার আঙ্কেলের সাথে দেখা। আমাকে দেখতেই একগাল হেসে বললেন,

— যাক, তোমাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম।
— কেমন আছেন আঙ্কেল?
— আলহামদুলিল্লাহ। তা রাতের রান্না করেছো?
— না আঙ্কেল করিনি। একটা টিউশনির খোঁজে বাইরে গেছিলাম। এখন গিয়েই রান্না করবো।
— তাহলে ভালোই হলো। বলছি আজ আর রান্না করা লাগবে না। তোমার আন্টি আজ রাতে তোমাকে আমাদের সাথে খেতে বলেছে।

— কিন্তু আঙ্কেল এসবের কি দরকার ছিলো?
— আরে তাতে কী। তুমি তো আমার ছেলের মতোই তাই না?
— জ্বি আঙ্কেল।
— আচ্ছা শুনো, আমি মৃন্ময়কে পরে পাঠিয়ে দিলে তুমি তখন যেও কেমন?
— আচ্ছা ঠিক আছে যাবো।
— আচ্ছা আমি তাহলে নীচে গেলাম কেমন?
— আচ্ছা, আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম।

মনোয়ার আঙ্কেল যে আসলেই অমায়িক তার প্রমান এটাই। অনেকদিন নিজের রান্না খেয়ে একদম জিভটাও বিষাদ হয়ে গেছে। আহ! কতদিন পর যে একটু ভালো রান্না খাবো! এসব ভাবতে ভাবতেই ছাদে উঠে আকাশ দেখায় মনোযোগ দিলাম। আজ আকাশে বিশাল বড় চাঁদ। তবে মেঘের কারণে একটু বেশিই ভালো লাগছে। মাঝেমাঝেই কোথা থেকে যেন একফালি মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। ঠিক যেন লুকোচুরি খেলা। হুটহাট মন ভালো হওয়ার জন্য এটাই তো যথেষ্ট।

একটু পরই মৃন্ময় এসে খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। আমিও ওর সাথে চলে গেলাম। খাওয়ার টেবিলে বসে তো অবাক! এত রকমের খাবার! তাও বেশির ভাগই আমার পছন্দের। ছোট মাছ, লালশাক ভাজি, করলা ভাজি আর কবুতরের মাংস। আঙ্কেল খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিলেন। আন্টিও আমার আসাতে খুব খুশি। শুধু দেখলাম নিলার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। খেতে খেতে আন্টি বললেন,

— আসিফ তোমার কী শরীর খারাপ?
— না আন্টি শরীর তো ঠিকই আছে।
— না মানে অনেক দিন ধরেই দেখছি তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।
— আসলে আন্টি পড়াশোনার খুব চাপ তো। তার উপর একা রান্না করে খাওয়া। ওসব খেয়ে আর কতো মোটা হবো বলেন? তবে আজ যা খাওয়ালেন না তার জন্য আমি মোটা হলেও হতে পারি। হাহাহা।

আমার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো তবে নিলা বাদে। খাওয়া শেষে কিছু সময় গল্প করে আমি আবার ছাদে চলে এলাম। আজ দিনটা খুবই ভালো। মাঝে মাঝে এমন খাওয়া পেলে আসলেই মন্দ হয় না। আর আন্টির রান্নার হাতও যথেষ্ট ভালো।

— আপনাকে না মানা করেছিলাম ছাদে আসতে।

আকাশ দেখছি আর সাতপাঁচ ভাবছি তখনই পেছন থেকে কথাটি শুনে থমকে গেলাম। আমার মনেই ছিলোনা যে ছাদে থাকা মানা। তবে এত ভালোভালো খেয়ে মনটা এতই উতলা ছিলো যে এটা ভুলেই গেছিলাম।

— কেন এসেছেন? লজ্জা নাই না কি?
— দুঃখিত। আসলে আপনার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে সব একদম ভুলে গেছিলাম।
— আমার বাবার মাথাটাও তো খেয়েছেন।
— মানে?
— মানে আর কী? রুম ভাড়া তো বাবা মাফই করে দিয়েছেন। তবুও আপনি একটা কথাও শুনেন না, কেন? লজ্জা নাই না কি?

আমি মাথাটা নিচু করে নিলাম। জেনে গেছে তাহলে? আর না জানারই বা কি আছে। মিথ্যাও তো বলেনি। আমিতো ফ্রি থাকি। সত্যি কথাটাই বলছে মেয়েটা। তবুও কেমন যেন লাগলো। কেমন?

— দেখেন আমি আপনাতে বিরক্ত হচ্ছি খুব। আপনার জন্য একটু শান্তিতে ছাদে আসতেও পারি না। আপনি দয়া করে এই বাসা থেকে অন্য কোথাও চলে যান প্লিজ। মেসেও তো থাকতে পারেন। আমি সহ্য করতে পারছি না আপনাকে। আপনি ভাবতেও পারেন যে সামান্য কারণে এমন করছি। তবে সত্যি বলছি কেন জানিনা আপনাকে আমার সহ্য ই হয়না মোটেও। আপনি যদি চলে যান তো আমি খুব খুশি হবো। দয়া করে আমার কথাটা রাখবেন প্লিজ।

মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়েই আছি। নিলা পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বুঝলাম না কিছুই। সামান্য ছাদে আসাটাই মেয়েটার এতটা বিরক্তির কারণ! হতেও পারে। হয়তো সে চায় না। বা আমাকে ভালো চোখে দেখে না। অপরিচিত হিসেবে বিষয়টা স্বাভাবিক। আকাশটাও মেঘলা। চাঁদটাও আর দেখাই যাচ্ছে না। নাহ, রুমেই বরং যাই। ছাদে থাকলে আবার যদি সে রাগ করে!

বিকেলে মৃন্ময়কে পড়াচ্ছি আর সাতপাঁচ ভাবছি। তবে কাল রাতেও অনেক ভেবেছি। ভেবে দেখলাম এখানে থাকাটা আর ঠিক হবেনা। কারণ হিসেবে দুইটা বিষয় দাঁড় করিয়েছি আমি। এক হলো আমি আকাশ না দেখে, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস না নিয়ে একটা দিনও বাঁচতে পারবো না আর একটা হলো এখানে থাকলে নিলার মেজাজটা আরও খারাপ হবে। যদিও চলে গেলে আমার খুবই কষ্ট হবে। কারণ সামান্য একটা টিউশনি দিয়ে তো আর পুরো মাস চলা সম্ভব না। এখানে থাকাকালীন তাও ভাড়াটা বাঁচতো কিন্তু চলে গেলে! তবুও আমাকে যেতেই হবে। আমি কারও বিরক্তির কারণ হতে চাইনা।

— ভাইয়া একটা কথা বলি? ভাবনায় ছেদ ফেলে মৃন্ময় জিজ্ঞেস করলো।

— হ্যাঁ বলো।
— অনেকদিন ধরেই দেখছি আপনি শুধু শুকিয়ে যাচ্ছেন। চোখমুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ভাইয়া, আপনার কী কিছু হয়েছে? মৃন্ময়ের কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো। তাহলে সেও আমার শরীরের অবনতি ধরে ফেলেছে! যদিও ধরতে পারাটা স্বাভাবিক। তবুও ওকে বুঝানোর জন্য বললাম,

— পড়াশোনার অনেক চাপ বুঝলা তো তাই শরীরের যত্ন নিতে পারি না। সমস্যা নেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন পড়ায় মনোযোগ দাও। মৃন্ময় আর কিছু বললো না। তবে ওর যে উত্তর টা পছন্দ হয়নি সেটা বুঝে নিলাম। এখন মনোয়ার আঙ্কেলের সাথে দেখা করাটা খুব জরুরি। তাই আন্টিকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বললেন,

— তোমার আঙ্কেল তো এখন বাসায় নেই তবে রাতে আসিও।
— আচ্ছা।

পড়ানো শেষ করে রুমে চলে এলাম। এমাসের আর পাঁচদিন বাকি আছে। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি মেস ঠিক করতে হবে আর মাসের।শুরুতেই চলে যেতে হবে। সাথে যেভাবেই হোক একটা টিউশনি যোগাড় করতেই হবে। আর এই কয়দিনে ভুল করেও ছাদে একটা সেকেণ্ডও থাকা যাবে না। আমি দ্বিতীয়বার আর নিলার বিরক্তিমাখা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। সন্ধ্যায় সাবিত ভাইয়ের দোকানে নয়নের সাথে বসে আমার মেসে ওঠার কথাটা ঠিক করে নিলাম। সাথে যেখানেই হোক দু’একটা টিউশনিরও খোঁজ দিতে বললাম। এবার যতই দূর হোকনা কেন আমাকে টিউশনি করাতেই হবে। নয়নের সাথে কিছু সময় আড্ডা দিয়ে ফিরে এলাম। সিঁড়ি বেঁয়ে উঠছি তখনই মনে পড়লো মনোয়ার আঙ্কেলের সাথে কথা বলা দরকার। রুমে না গিয়ে তাই কলিং বেল বাজালাম। দরজা খুললেন আন্টি। আমাকে দেখেই একগাক হেসে বললেন,

— আরে আসিফ যে! এসো ভিতরে এসো।
— আন্টি আঙ্কেল আছে?
— হ্যাঁ রুমেই আছে তুমি ভেতরে এসে বসো আমি ডেকে দিচ্ছি।
— আচ্ছা দেন।

আমি ভেতরে এসে বসলাম আর আন্টি ডাকতে চলে গেলো। সংক্ষিপ্ত সময়ে আমি চাচ্ছি কোনোভাবেই যেন নিলার সামনাসামনি না হই। আর আঙ্কেলকে চলে যাওয়ার কথাটা কেমন করে বলবো সেটাও ভাবছি। যেভাবেই হোক বাসাটায় আর থাকা যাবে না।

— কি খবর বাবা আসিফ?
— আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো। তা হঠাৎ কি মনে করে?
— না মানে একটু জরুরি কথা ছিলো আরকি।
— তা বলো শুনি কি এমন জরুরি কথা তোমার।

— আসলে আঙ্কেল, আপনি তো জানেনই আমি একা থাকি। একাই রান্না করে খেয়ে ক্লাস করি, টিউশনি করি সবই করি। নিজের ওই বিশ্রী রান্না খেতেখেতে জিভটা একদম বিষাদ হয়ে গেছে। তাই আমি চাচ্ছিকি যে আমি বরং মেসে গিয়ে উঠি। ওখানে তাও বুয়া রান্না করে দেবে আমিও কিছুটা সময় পাবো আর নিজের বিষাদও কাটবে।

— এইটা কেমন কথা বাবা? তোমার খাওয়ার কষ্ট হয়েছে এটা আমাকে বললেই হয়। এত চিন্তা করা লাগে? আজ থেকে তুমি তিনবেলা আমাদের সাথেই খাবা। শুধু শুধু মেসে গিয়ে মেসভাড়া দিয়ে বুয়ার হাতের জঘন্য খাবার খাওয়ার কী দরকার বলো?

— না আসলে সমস্যাটা শুধু খাওয়ার না। আসলে মেসে থাকলে আমার পড়াশোনাটাও একটু ভালো হতো আরকি। আর সামনেই পরীক্ষা। রান্নাবান্না করে সময় নষ্ট করতে চাইনা।
— এখানেই থাকো সমস্যা তো নাই।
— না আঙ্কেল গেলেই বেশি ভালো হতো।
— তুমি যখন এতো করে চাইছো তখন আমি আর কি বলবো। তবে কখনও আসতে মন চাইলে আসিও। তোমার জন্য সব সময় আমার চিলেকোঠা বরাদ্ধ থাকবে।

— একদিন হুট করেই আসবো আঙ্কেল।
— তা চলে যাচ্ছো কবে?
— মাসের আর পাঁচদিন বাকি আছে। আমি ওই মাসের শুরুতেই উঠবো মেসে।
— একটা আবদার করি বাবা?
— করেন।
— অন্তত এই কয়টা দিন তুমি আমাদের সাথেই খাওয়াদাওয়াটা করিও কেমন। আমি কিন্তু না শুনতে চাই না।
— আচ্ছা খাবো। তবে খাওয়ারটা একটু কষ্ট করে পাঠিয়ে দিলে ভালো হতো।
— আচ্ছা আমি মৃন্ময়কে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বলবো।
— আচ্ছা আঙ্কেল উঠি আমি। আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। আচ্ছা বাবা যাও।

আঙ্কেলের কথা মতো রাতে মৃন্ময় এসে খাবার দিয়ে গেছিলো। খেয়ে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছুই ভাবছি। মানুষের এই একটা সমস্যা। একটু বিশ্রামে থাকলেও অবুঝ মনটা একাই বকবক করে। এই বকবকের কোনো শেষ নেই।
ইদানিং রাতে একদম ঘুম হয়না। দু’দিন হলো ঘুমানোর জন্য স্লিপিং পিল খাই তবুও ঘুম আসেনা। অথচ এই আমি রাত এগারোটা বারোটার বেশি জেগে থাকতেই পারতাম না। বুঝছি না। দিনদিন আমি মানব থেকে মহামানব টামন হচ্ছি কী না কে জানে!

আমি আকাশ দেখে নির্দিধায় একটা রাত পার করে দিতে পারি। তবে এই বদ্ধ ঘরে বসে আকাশ দেখতে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই জানলা দিকেই একটু চোখ বুলিয়ে ডায়েরি লিখতে বসে গেলাম। আজকাল এই ডায়েরি লিখতেও আলসে লাগে। অথচ এই ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠায় আমার জীবনের উত্থান-পতনের সব ঘটনাই লিপিবদ্ধ আছে। সকাল থেকেই দারুণ দৌড়ের উপর ছিলাম। নয়ন একটা টিউশনির কথা বললো সেই বাসাতে গিয়েছিলাম। ক্লাস ফোরের এক বাচ্চাকে পড়াতে হবে। সব ঠিক করে এলাম। তারা আমাকে টিউটর হিসেবে সহজেই গ্রহন করছে ভেবেই খুশি লাগলো। যদিও বেতনটা একটু কম তবে এই বেহাল জীবনে সামান্য টাকাটাও আমার কাছে হীরের মতো মূল্যবান এখন।

রাত হয়েছে অনেক। এদিকে খাবারও দিয়ে যায়নি এখনও। শরীরটার অবনতিও ইদানিং আমিও লক্ষ্য করছি খুব তবে মনটা ভালো আছে। তাই ডায়েরি লিখছিলাম। হঠাৎই মনে হলো আব্বু-আম্মু আর ভাইয়াদের সাথে একটু কথা বলি। উঠে চলে এলাম সাবিত ভাইয়ের দোকানে। ভাইয়াকে ফোন দিতেই সাথেসাথে রিসিভ হয়ে গেলো। বুঝলাম না। তারা কি আমার ফোনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে?

— কেমন আছো ভাইয়া?
— এভাবে কেউ ভালো থাকে? আমরা একটুও ভালো নেই। তুই ফিরে আয় ভাই, আমি বড় হয়ে তোর পায় ধরে বলছি ফিরে আয়।
— আম্মুকে দাও তো।

— কেমন আছিস আব্বু?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আম্মু। তুমি, আব্বু কেমন আছো?
— ছেলে কাছে না থাকলে কী মা-বাবা ভালো থাকে? তুই আসবি কবে বাবা?
— আসবো আম্মু, হুট করেই একদিন চলে আসবো।
— খেয়েছিস?
— না আম্মু খাবো বাসায় ফিরে। আব্বাকে একটু দিবা?
— তোর আব্বা খুব অভিমান করছে রে। কথা বলবে না।
— আমি রাখি তাহলে আম্মা।
— আবার কবে ফোন দিবি?
— হুট করেই একদিন দেবো আম্মা। এত টেনশন করিও না তো। আমি খুব ভালো আছি। রাখি। আসসালামু আলাইকুম। চোখটা জ্বলছে খুব। হয়তো পানি আসতে বাঁধা পাচ্ছে তাই। দোকান থেকে চলে আসার সময় সাবিত ভাইও বললো,

— আসিফ, তোর শরীরটা দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে কোনো সমস্যা হলে ডাক্তার দেখা। বুঝলাম না। সবার চোখেই আমি পড়ছি এখন! এটাতো মহামানব হওয়ারই লক্ষণ। হি হি হি।

 

অপরদিকে মৃন্ময় ঘুমিয়ে যাওয়ায় নিলার মা নিলাকে আসিফের খাবার দিয়ে আসার জন্য বলেছেন। নিলা রাজি না হলেও মায়ের কথা বাধ্য হয়ে রাজ্যের সব বিরক্তি নিয়ে খাবার নিয়ে এসে দেখে দরজা খোলা তবে ঘরে কেউ নেই। মিনিট কয়েক এদিকে ওদিকে খুঁজেও না পেয়ে আরও বিরক্ত হয়ে রুমে ঢুকে খাবার বিছানায় রেখে চলে আসবে তখনই চোখ যায় বিছানায় খুলে রাখা ডায়েরিতে। নিলার কেন জানি কৌতূহল জাগে। ছোটবেলা থেকেই নিষিদ্ধ সব কাজে নিলার খুব বেশি আগ্রহ। নিজের কৌতূহলকে দমাতে না পেরে কী মনে করে যেন ডায়েরিটা পড়বে বলে নিয়ে চুপিচুপি চলে আসে নিলা। আর ভাবে, দেখি কী লেখা আছে এখানে। খিদে লেগেছিলো খুব। ঘরে আসতেই দেখলাম বিছানায় খাবার রাখা। খুব খিদে লাগায় গপগপ করে খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে শুয়ে শুয়ে ভাবছি কাল কী কী করবো। কালও যে অনেক কাজ। অথচ আমার ঘুম আসছেই না। রাত প্রায় একটা বাজে। কৌতুহলী নিলা ডায়েরিটা পড়বে বলে খোলে। প্রথমের দিকটা ফাঁকা। পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে।
কয়েক পৃষ্ঠা পর থেকেই লেখা। নিলা পড়তে শুরু করে,

ইদানিং মোটেও ঘুম হয়না আমার শরীরটাও দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই বাসায় এসেছিলাম আম্মুর কথা মতো। ডাক্তার দেখালাম। অনেকগুলা টেস্ট দিলো। এই অবধি তো সব ঠিকই ছিলো। তবে কে জানতো আমার জন্য বিশাল বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। ডাক্তার টেস্ট দেখে জানালো আমার ব্লাড ক্যানসার। আর সেটা অনেক আগে থেকেই। এখন রোগটা ভয়ানক হয়ে গেছে তাই শরীরের রক্ত নষ্ট হওয়ায়ই আমার শরীর ভেঙে আসে। শুকিয়ে যাচ্ছি। কত স্বাভাবিক ভাবেই না ডাক্তার বললো, আমি নাকি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত! আমি জানতাম ক্যানসারের চিকিৎসা অনেক ব্যায়বহুল। আর মৃত্যু অবধারিত। তবুও আমার বাবা-মা আমাকে ভালো করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন।

তিন ভাই আর বাবা মা মিলে আমাদের সুখের সংসার। কখনও এই সংসারে দুঃখ আসেনি। আসলো সেটা আমার কাঁধে চড়ে। আমাকে যে আমার মা-বাবা, ভাইয়া – ভাবিরা এতটা ভালোবাসে তা এই অসুখ না হলে জীবনেও জানতাম না। তিনচার মাসের ভেতরই আমার জন্য প্রায় তিন-চার লাখ টাকা ফুরিয়ে ফেললেন আব্বু। সেদিন গভীর রাতে শুনতে পেলাম বাবার কথা। আমি যে না ঘুমিয়ে জেগে ছিলাম তারা বুঝেনি। বাবা ভাইয়াকে বলছিলো,

— দরকার হলে ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে দেবো তবুও আমার ছেলের আমি কিচ্ছু হতে দেবো না। আমার তো এই বাড়ি ছাড় এখন আর কিছু ই নাই।

কথাটা শুনে নিরবে খুব কেঁদেছিলাম। কতটা স্বার্থপর আমি! এই সুখের পরিবারে অসুখ হয়ে এসেছি। আবার বাবার শেষ সম্বল বাড়িটুকুও শেষ করবো? আমার বড় দুইটা ভাই দু’জনই বিবাহিত। ছেলেমেয়েও আছে। আমার জন্য বাড়ি বেঁচলে সবাই থাকবে কোথায়? খাবে কী? আমার ভাইয়া ভাবি তবুও একবারও বলেনি যে আমাদের জায়গা বেঁচবো না। আমরা থাকবো কোথায়! এতটা ভালোবাসে আমাকে সবাই। তবে আমি যে পারবো না এতটাও স্বার্থপর হতে। এক আমার জন্য সাত আটটা মানুষ না খেয়ে ঘরছাড়া হয়ে মরবে এটা আমি কী করে মানবো। তাই খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। বাড়ি থেলে পালিয়ে যাবো । একমাত্র এই রাস্তাটাই আমার জন্য খোলা। হয়তো কষ্ট হবে আমার, সবার। তবে আমি পারবো না বাবার শেষ সম্বল আর ভাইয়া ভাবিদের গৃহহারা করতে।

সকাল হওয়ার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে ঘরে একটা চিঠি লিখে রেখে চলে এলাম। চিঠিতে লেখা ছিলো তারা যেন আমার জন্য বেশি চিন্তা না করে। হুট করেই আমি আবার ফিরে আসবো। ডাক্তার বলেছে চিকিৎসা করালে হয়তো বেশিদিন বাঁচবো। তবে মরবোই। আমিতো এমনিতেই মরবো। হয়তো একটু আগেই মরলাম। এতে অন্তত আর সাত আটটা জীবন বেঁচে থাকলো। আমি জানি আমার জন্য আমার পরিবার নিজেদের জীবন দিয়ে দিতেও একটা বারও ভাববে না। কিন্তু আমি যে এতটাও স্বার্থপর হতে পারি নি।

শেষ ধাপ! হয়তো হুট করেই একদিন চলে যাবো। হি হি হি। তবুও শেষ নিঃশ্বাস অবধি হাসতে চাই। আকাশ দেখতে চাই। কষ্ট গুলোকে হজম করতে শিখতে চাই। আমিও যে বাঁচতে চাই। হি হি হি। টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো নিলার চোখ বেঁয়ে। এইতো ডায়েরিটা ধরার সময়ও ছেলেটার প্রতি বিরক্তি ছিলো তার। অথচ এখন! নিলা ভাবে, ছেলেটা এমন কেন? এতবড় একটা অসুখ, সে জানেও যে মারা যাবে তারপরও মুখে এতটুকুও কষ্টের ছাপ নেই! শুধুমাত্র বাবা – মা, ভাইয়াদের কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে নিলো? সবার কাছেঔ নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। আর ছেলেটা!

কত বাজে ব্যবহার করেছি তার সাথে অথচ একটা বারও আমাকে মাথা তুলে জোর গলায় কিচ্ছু বলেনি। এতটা কষ্ট বুকে রেখে ছেলেটা কি সুন্দর ভালো থাকার অভিনয় করছে। আমরা কেউ বুঝছি না। কেউই না! খুব কষ্ট হচ্ছে নিলার। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। এতটা খারাপ ব্যবহার করা আসলেই ঠিক হয়নি। মানুষের কারও উপর রাগ করতে যেমন সময় লাগেনা তেমনি মায়া লাগাতেও সময় লাগে না। এই মুহূর্তে নিলারও তেমনি মায়া কাজ করছে। মনে হচ্ছে সে যদি পারতো ছেলেটাকে ভালো করতে! একটু সাহায্য যদি পারতো! অঝরে কাঁদছে নিলা। এতটা কষ্ট কখনোই হয়নি ওর। সকাল থেকেই শরীরটা একটু বেশিই খারাপ লাগছিলো আমার। তাই হাসপাতালে এসেছি। ওদিকে কাল রাতে ডায়েরিটা না পেয়ে টেনশনে ছিলাম। পরে মনে হলো মৃন্ময় হয়তো দুষ্টামি করে নিয়েছে। কিন্তু ভয় হচ্ছে ডায়েরিটা না পড়ে। যদিও এতবড় ডায়েরির আসল কথাগুলো পড়তে হলে অনেক সময় লাগবে। এতটা ধৈর্য ওর নেই। তাই একটু টেনশন কম হচ্ছে।

এদিকে ডাক্তার বললো আমার শরীরের রক্ত একদম কমে গেছে। প্রায় ছয় পয়েন্ট রক্ত আছে মাত্র। অথচ স্বাভাবিক একজন মানুষের জন্য দশ পয়েন্ট রক্ত প্রয়োজন। ডাক্তার বললো তাড়াতাড়ি রক্ত না নিলে যেকোনো সময় আমার স্ট্রোক হতে পারে। তাই নয়নকে ফোন দিয়ে বললাম। ঘন্টা খানেক পর ডোনার নিয়ে চলে এলো ও। রক্ত নিতে নিতে অনেক সময় লাগবে। নয়নকে তাই চলে যেতে বললাম। প্রতিবার যদিও একাই আসি। সমস্যা হয়না এখন।

রাত আটটা বাজে প্রায়। সারাদিন কিছুই খাইনি। মাথাটাও ভারি ভারি লাগছে। তাই ঘরে এসেই শুয়ে পড়লাম। মৃন্ময় এসেছিলো সারাদিন কোথায় ছিলাম জানতে আর খাবার দিতে। বলে দিলাম কাজ ছিলো। ও চলে যেতেই টেবিলে দেখলাম ডায়েরিটা রাখা। বুঝলাম বেচারা পড়েইনি। হা হা হা। এসব গল্প না পড়াই ভালো। জীবনের গল্প গুলো খুবই কষ্টের হয়। দুইটা টিউশনি যোগাড় হয়ে গেছে। দুদিন খুব ব্যস্ততার মাঝে ছিলাম। কাল সকাল সকাল মেসে উঠবো তাই আঙ্কেল আন্টির থেকে বিদায় নিতে তাদের রুমে যেতেই আন্টি বললো,

— থেকে গেলেই কী ভালো হতো না?
— না আন্টি। আসলে একটু সময় দরকার আমার। তাই যাওয়া আরকি।
— শরীরের অবস্থা দেখেছো তোমার? মেসের খাবার খেয়ে তো বাঁচতেই পারবে না। সমস্যা নেই আন্টি অভ্যাস আছে আমার।
— এখন গেলে তো আর জোর করা যায়না। তা বের হবে কখন?
— গাড়ি বলেছি। সামান্য কিছু জিনিস আছে সেগুলো নিতে আসবে একটু পর। নেয়া হলেই কাল সকালের মাঝে বের হবো ইনশাআল্লাহ।

— রাতে তাহলে খেয়ে যেও কেমন?
— আচ্ছা আন্টি খাবো। আরও কিছু সময় কথা বলে ছাদে আসতেই পেছন থেকে নিলা বললো,
— আমি সেদিন চলে চলে যেতে বলাতেই কী চলে যাচ্ছেন?
— আরে না না তা কেন হবে। আসলে এখানে আর ভালো লাগেনা। সত্যি বলতে আকাশ না দেখলে আমার ভালো লাগেনা। আর ওই মেসে বিশাল ছাদ। সারাদিন রাত আকাশ দেখলেও কেউ বিরক্ত হবে না।

— না গেলে হয়না?
— এখানে থাকলে আপনিই বেশি বিরক্ত হবেন। আমি চাইনা আমার জন্য কেউ বিরক্ত হোক।
— আমি কিন্তু আপনার ডায়েরিটা পড়েছি! নিলার কথায় বুকটা ধক করে উঠলো। তারমানে সেদিন ও এসেছিলো। তবুও স্বাভাবিক হয়ে বললাম,

— সমস্যা নেই।
— আমি আর কখনোই আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। ছাদে আপনি সব সময় থাকলেও কিচ্ছু বলবো না। আপনি চলে যাইয়েন না প্লিজ ।
— যাত্রাগামী মানুষকে না আটকে বরং শুভকামনা জানাতে হয়।
— আমাকে মাফ করা যায়না?
— আপনি তো কিছু করেন নি। আর যদি করেও থাকেন তো মাফ করে দিলাম।
— থেকে গেলে হয়না?
— একদিন হুট করেই চলে আসবো সমস্যা নেই।

নিলা আর কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো। আমিও রুমে এসে সব গুছিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে থাকলাম। .রাত প্রায় একটা বাজে। বসে আছি স্টেশনের ওয়েটিং বেঞ্চে। বসে থাকতে ভালো লাগছে। দূরের আরেকটা বেঞ্চে একজন মানুষ বসে আছে। সাথে কয়েকটা ব্যাগ। ঘড়িতে তাকিয়ে বারবারই সময় দেখছে। আজ রাতের শেষ ট্রেন এটা। লোকটা ট্রেনটার অপেক্ষাই করছে। তার যে আজ বাড়ি ফিরতেই হবে। বাসায় সবাই হয়তো অপেক্ষা করছে।

বাসার সবার সাথে খুব কথা বলতে মন চাচ্ছে। আমি জানি সবাই আমার জন্য খুব টেনশন করে। আমাকে তারা বাঁচাতে চায়। আমার বাবা-মা, ভাইয়া ভাবি আর পিচ্চি গুলাও খুব করে চায় আমি সুস্থ হয়ে যাই। আমি জানি আমার পরিবার আমার বাড়ি ফেরার জন্য প্রতিটা ন্যানো সেকেণ্ড অপেক্ষা করে। আমি জানি আমার মা পথের পাণে চেয়ে অপেক্ষা করে আর ভাবে, আব্বু আমার ঠিক আসবে।

তবে মা-বাবার চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু কোনো বাবা-মা’ই সহ্য করতে পারবে না। তাইতো আমি সরে এসেছি।
আমি জানি আমি খুব বড় স্বার্থপর। আমি এটাও জানি আরও একটা মানুষ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিলা মেয়েটার না জানলেই ভালো হতো। হয়তো একটা অপেক্ষার প্রহর কমতো। ঝাপসা চোখে দেখলাম ট্রেন আসছে। অপেক্ষা করা মানুষটার মুখে সে কী হাসি! এ যেন শত অপেক্ষার অবসান। লোকটা ব্যাগ নিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়ি ফিরবে বলে। একটু পরই ট্রেনটা আবার আঁধারের মাঝে মিলিয়ে গেলো। শার্টের হাতা দিয়ে চোখটা মুছে নিয়ে একগাল হাসলাম।

সবাই অপেক্ষা করে। আমিও অপেক্ষা করি। একদিন হুট করেই আমিও ট্রেনে করে বাড়ি ফিরবো। হয়তো সে ট্রেন আমাকে ভুল করে আর বাড়ির পথে নেবে না। ডাক্তার বলেছে আমার রক্ত পনেরো দিনের বেশি টিকছে না। আমার আয়ু সর্বোচ্চ একমাস! হি হি হি। আমিও অপেক্ষায় আছি। একদিন হুট করেই আমার অপেক্ষারও অবসান হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত