ফানুস

ফানুস

খুব তাড়াহুড়োয় দীপ্তাকে যেদিন ডালাস এয়ারপোর্টে আনতে গেলাম আমার মন ভীষণ বিগড়ে ছিল। এয়ারপোর্টে অচেনা একটা মেয়েকে আনতে যাওয়ায় যেরকম রোমান্টিকতা থাকার কথা তা ছিল না। কারণ আমার নারীবিষয়ক একটু জড়তা আছে, তার ওপর ছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। দীপ্তা আমাদের বেশ দূরের আত্মীয়। আমার মামির কেমন যেন ভাইয়ের মেয়ে। আমার মামি আমাকে ফোন করে বললেন, বাবা মেয়েটা পিএইচডি করতে যাচ্ছে, ফুল স্কলারশিপ পেয়েছে। লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করবে না। ওর বাবা মা দ্বিধায় ছিলেন, আমি বলেছি তোমরা ওকে দেখে রাখবে। বিশেষত তোমার উপর ভরসা করছি।

এয়ারপোর্টে যেদিন গেলাম বেশ শক্তপোক্ত মেয়ে হবে ভেবেছিলাম। দেখলাম বেশ নরম আর ভীতু, সুটকেসভর্তি বই নিয়ে চলে এসেছে জ্ঞান সাধনায়। নিজেই ট্রলি ঠেলে ঠেলে হাঁটছিল। তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। হাইওয়েতে উঠার পর রিনরিনে গলায় বলল, রাস্তা এতো অন্ধকার কেন? গাড়ি কি একটু বেশি জোরে যাচ্ছে? আমি স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। বিদেশ বিভুঁইয়ে ভীতু মেয়েকে আরও ভয় দেখিয়ে আমার কেন ভালো লাগলো জানি না।

ক্যাম্পাসে যে-বাসায় থাকবে সেখানে নিয়ে গেলাম। কেউ দরজা খুলল না। রুমমেটদের না পেয়ে মেয়েটা ঘাবড়ে গেছে। কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সে নার্ভাস ভাবে বলল, ভাইয়া এখন তাহলে কী করবো? মেয়েটাকে অন্তত সেদিন রাতে বাসায় নিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু আমাদের অসামাজিক বাসায় তাকে আনার আগে কিছু কথা বলা জরুরি ছিল। আমি রাশভারী ভাব করে বললাম, তোমরা কয় ভাইবোন?

– দুই বোন। খেয়াল করলাম জেট ল্যাগে সে চোখ খুলে রাখতে পারছে না।

– তোমার ঘুম আসছে?

– হ্যাঁ, একটু একটু।

– আমাদের পরিবার নিয়ে কিছু কথা বলি যদি কিছু মনে না করো।

– অবশ্যই

– আমরা তিন ভাই। আমি সবার বড়। ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষেই আমরা ডিভি পেয়ে গেলাম। প্রথম তো মনে হলো সোনার হরিণ পেয়েছি। পুরো পরিবার আমেরিকা চলে আসলাম। আমরা আসার ছয় মাসের মাথায় বাবা আকস্মিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল।

– ওহ! তার যেন ঘুম ছুটে গেল।

– নতুন একটা দেশের ট্রাফিক সিগন্যাল বুঝতে একটু ভুল করেছিলেন। আমার মায়ের তখন বেবিসিটিং করা ছাড়া আর তেমন কোনো কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমাকেই সংসারের হাল ধরতে হলো। লেখাপড়া ছেড়ে ট্যাক্সি চালানো শুরু করলাম। সে বোধহয় একটু অবাক হলো।

– দেশে অনেকেই জানে না আমি কী করি। ভাই দুটো ভালোই আছে। পড়াশোনা শেষে মেঝো ভাইটা হিস্পানিক একটা মেয়েকে বিয়ে করে এখন অন্য বাসায় থাকে। আর ছোটো ভাইটা চাকরি পেয়ে অন্য স্টেটে চলে গেছে। কিন্তু মাকে নিয়ে একটু সমস্যা আছে।

– কী সমস্যা?

– একটা ব্রেন স্ট্রোকের পর মা মাঝে মাঝে সময় গুলিয়ে ফেলে। তার ডিমেনশিয়া আর এক ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে আমরা নিজেদের মধ্যেই থাকি। আমি কাজে যাই, ফিরে এসে রান্না করি, ঘর সামলাই আর মাকে সামলাই। দেশে যাওয়া হয় না বহুদিন।

– ভাইয়া আজ আপনাকে রান্না নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আম্মু অনেক খাবার দিয়েছে আমরা এক সাথে সবাই মজা করে খাব।

আমি মৃদু হাসলাম। ছোটো মেয়ে হলেও তার বুদ্ধি বিবেচনা আছে, অযাচিত অতিথি হয়ে আমাকে সে ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছে না। ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই আমাদের অসামাজিক বাসায় ততোধিক অসামাজিক অভ্যর্থনা পেল সে। মা তাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এই মেয়ে কে? অচেনা মানুষ দেখলে মা ভয় পেয়ে যায়। প্রথম এক বছর আমি তাকে ভালোই সময় দিয়েছি। সে আমাকে ভীতু কণ্ঠে ফোন দিয়ে বলতো, আপনার কি একটু সময় হবে? আমিই ইচ্ছে করেই একটু ভাব নেই, আমিতো খুব ব্যস্ত। দশ মিনিট পরে করি?

আমি তাকে ওয়ালমার্ট আর ইন্ডিয়ান স্টোর নিয়ে যেতাম। সে বেশ বুদ্ধি করে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতো মাঝেমাঝে কুপন নিয়েও আসতো। খাবার বিষয়ে আমি তাকে টুকটাক জ্ঞান দিতাম। অর্গানিক খাবার কেন খাওয়া উচিৎ তার উপর একটা লেকচার দিয়ে দিলাম। সে হরিণীর মতো চোখ করে সব গম্ভীরভাবে শুনত। জিনিসপত্রের নাম দেখে মাঝে মাঝে তার চোখ কপালে উঠত। বিদেশে এসে মানুষ এই ধাক্কাগুলো খায়। আমি তার সেই ভয় ধরা মুখ উপভোগ করতাম। একদিন শপিংমলেও নিয়ে গিয়েছিলাম। একটা ব্যাগ ধরে বলে, ওহ্ মাগো! এই ব্যাগের দাম সাড়ে তিনশ ডলার ভাইয়া? তারপর সে হাসে আমিও হাসি। ধীরে ধীরে ফোন আসা কমে গেল, সে ড্রাইভিং শিখে গেছে। বন্ধুবান্ধব হয়ে গেছে। আমার মতো মানুষকে আর তার কী দরকার?

আমার ঘরে একটা কাচভাঙা জানালা ছিল। শীতের দিনে অনেক কষ্টেও কাগজ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আটকানো যায় না। আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে দীপ্তা মাঝে মাঝে রোদের মতো ঝিলিক দেয় নাকি ভাঙা জানলা দিয়ে আসা ঠান্ডা হওয়ার মতো আমাকে অবশ করে দেয় আমি জানি না। এই মেয়েটির সাথে আমাকে মানাবে না। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে তার ভুলত্রুটি বের করি। ওই মেয়ে বেটে, মোটা আর হরিণীর মতো চোখদুটো তো কপালের চুল দিয়ে ঢেকে থাকে। শুধু নীরব একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে বিহ্বল করে দেয়। আমাকে গ্যাস বেলুন উড়ানোর মেশিন কিনতে দেখে সে চোখ বড় করে ফেলল। রাজ্যের অবিশ্বাস!

– বেলুন দিয়ে আপনি কি করবেন?

– আমি বেলুন উড়াই।

– সিরিয়াসলি?

– হুম। মেজাজ খারাপ থাকলে বারান্দায় বসে আকাশে বেলুন ছেড়ে দেখি কতদূর যায়।

– ঘুড়ি উড়ালেই পারেন।

– ঘুড়ির স্বাধীনতা নেই।

– আমাকেও দুই একটা বেলুন দিয়েন।

– কী জন্য?

– আমি বেলুন সেফটিপিন দিয়ে ফুটো করি। হাত দিয়ে মুখ চেপে নীরবে হাসতে হাসতে তার মুখটা লাল হয়ে যায়।

একদিন দেখলাম টেক্সট করেছে ডালাসে বেলুন উৎসব হচ্ছে। তারপর একটা হাসির ইমো। সে কী বুঝেছিল কে জানে? ওই বেলুনে আসলে মানুষ উঠে আকাশে ভাসে। দীপ্তার পিএইচডি খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। সে দেশে তার ইউনিভার্সিটির চাকরিতে ফিরে যাবে। সে আমাকে শেষ কল করলো, ভাইয়া আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। আমি এখন ভালো রান্না করতে পারি। একদিন রেঁধে খাওয়াতে চাই।

আমি একটা কেক নিয়ে গেলাম। সবুজ কলাপাতা রঙের শাড়িতে তাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছিল। যত্ন করে সে রেঁধেছিল কিন্তু আমি তৃপ্তি করে খাইনি। অনেকেই এসেছিল। আমি পুরোটা সময় কাঠ হয়েছিলাম এই বুঝি কেউ জিজ্ঞেস করে আপনি কোথায় কাজ করেন? আরিফ নামক এক ছেলে মনে হলো বেশ ঘনিষ্ঠ। তুই তোকারি করছে। দীপ্তার কপালের উপর পড়ে থাকা চুল সরিয়ে দিলো। এরপর আমি কাজের অজুহাত দেখিয়ে চলে এসেছি। দীপ্তা চলে যাওয়ার দুইমাস পর মাকেও রিহ্যাবে রেখে আসলাম। ডাক্তার নিজেই আমাকে বলেছিলেন যারা দীর্ঘদিন কোনো অসুস্থ মানুষের দেখাশোনা করে তাদের ডিপ্রেশন হয়, তাদের ব্রেক দরকার। আমি যেন আর টানতে পারছিলাম না। কাজে গিয়েও দুশ্চিন্তা হতো দরজা খুলে চলে যাবে নাতো।

যেই পাঁচজন মানুষ একটা উড়োজাহাজে চড়ে পৃথিবীর একেবারে অন্য প্রান্তে এসেছিলাম তারা কেউ আর এক সাথে নেই। শূন্য বাসার ভাঙা জানালা দিয়ে এখনো হু হু করে কনকনে বাতাস আসে। আমার আবার স্কুলে ফিরে যেতে ইচ্ছা করলো। আধ বুড়ো বয়সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লাস করে কিছু সার্টিফিকেশন করে ফেললাম। মার জন্য খুব খারাপ লাগে কিন্তু অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। আমার ছোটোখালা আমার জন্য পাত্রী দেখেছেন। প্রথম দিকে বলতেন, তোর দশ বছর আগের একটা ছবি দে, কত সুন্দর ছিলি তখন! আমি তো রেগে যেতাম। রাগ হয়ে বলতাম, খালা তখনকার ছবি দেখে বিয়ে করলে বিয়ের পরে তো আমাকে চিনতে পারবে না।

হায় শেষমেশ কোন হতভাগা পাত্রী আধবুড়ো আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে! আচ্ছা আমার সারা জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে মেয়েটাকে জ্বালিয়ে মারবো নাতো? আমি ঠিক করেছি বিয়ের পর ওকে নিয়ে প্রথমেই বেলুন উৎসবে যাব। সেই ফানুসে কোনো মানবীর চুল উড়ে এসে চোখ ঢেকে দিবে আর আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চুল সরিয়ে দিব। আমার সেই কল্পনার ফানুস ঠিক মতো ভাসবে তো আমাদের নিয়ে? মৌমিতা পাতা উলটে দেখল আর কিছু লেখা নাই। বোকা লোকটা বিয়ের আগে লেখাটা লুকাতে ভুলে গিয়েছিল।মৌমিতা বারান্দায় এসে লেখাটা কালো সুতোয় মুড়িয়ে একটা গ্যাস বেলুনের পায়ের সাথে বেঁধে দিলো। নাহ্, বেলুনটা কিছুতেই উড়ছে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত