বছরখানেক আগের কথা! একমাত্র ছোট ভাই পিএইচডি করতে চলে যাবে দেশের বাইরে।দুই ভাই বোনে কথা হচ্ছে, এবার আর আম্মুকে একটা ট্যাব কিনে না দিলেই নয়।বসুন্ধরা সিটি থেকে কিনলামও একটা ট্যাব দু ভাইবোন মিলে পছন্দ করে।অন্তত ভিডিও কলে সিবানকে দেখতে পারলেও আম্মু কিছুটা শান্তিতে থাকবে।সিবান আমার একমাত্র ছোটভাই।ফ্লুইড ডিনামিক্সে পিএইচডির জন্য মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে যাচ্ছে।
চলে যাওয়ার আগে আম্মুকে ফেসবুকের টুকটাকি কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেলো।একেবারে যতটুকু লাগে, ঠিক ততটুকুই।বেশি শিখালে আম্মু যা শিখানো হয়েছে তাও ভুলে যেতে পারে এই ভয়টা দুজনের মধ্যেই ছিলো।সিবান চলে গেলো।আমিও ঢাকা চলে এলাম আর আম্মু আব্বু দুজনেই গ্রামে থাকেন।আব্বু ব্যাস্ত থাকেন, সবসময়ই বাড়ির বাইরে বাইরে।আর সিবানতো বিদেশের মাটিতে নতুন জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো, পড়াশোনা, ল্যাব, ক্লাস এসব নিয়ে রিতীমত যুদ্ধে নেমেছে! দম নেয়ার সময়টুকু নেই তার হাতে।এমন অবস্থায় আম্মুর স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই আর ফেসবুক ব্যবহার রিলেটেড যাবতীয় বিষয়ের শিক্ষক একমাত্র আমিই।
আমি একটু বদমেজাজী বলে আম্মু সহজে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনা, করলেও কল করে শুরুতেই বলে নেয় “আম্মু রাগ কইরোনা আমার মোবাইলডাত জানি কী হইছে”! তখন খারাপ লাগতোনা কিন্তু আজ লিখতে গিয়ে খুব খারাপ লাগছে। এটা ভেবেই নিজেকে আকাশ সমান অপরাধী লাগছে যে আম্মুকেও আমার কাছে অনুমতি নিয়ে নিজের সমস্যার কথা বলতে হয় অথচ আমার সমস্যাগুলোতো আম্মুকে না বলতেই বুঝে যান।
আমার এখনো মনে পড়ে, আম্মুর নামে ফেসবুক আইডি খুলে লগ ইন করে দিতেই আম্মু খুব অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো “এইডা দিয়া আমিও সবার মতো দেইখা দেইখা কথা কতা কইতে পারমু?” ! আমিতো হেসেই খুন।হ আম্মু পারবা।আমার আম্মু ক্লাশ এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।তিনি লিখতে ও পড়তে পারেন খুব ভালোভাবেই।তাঁর বাংলা ও আরবী লিখা মুগ্ধ করার মতো সুন্দর।কিন্তু আধুনিকতার এই প্রযুক্তি তাঁকে সময়ের অনেক পরে গিয়ে ছুঁয়েছিলো।বলতে পারেন এতদিন প্রয়োজন ছিলোনা বলে আম্মুকে ওরকম স্মার্টফোন বা ফেসবুকের দখল দিতে চাইনি আমরা।একটা কিপ্যাড মোবাইলও আম্মু ঠিকমত সামলে রাখতে পারতোনা বলে বাধ্য হয়েই একটা মোবাইল ব্যাগ কিনে আম্মুর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম আমি।
সিবানের সাথে আম্মুর কথা চলতে লাগলো।আমাকেও আম্মু প্রায়ই ভিডিও কল দিয়ে থাকেন।আমার ভাই হচ্ছে এমন মানুষ যে দুনিয়ার সব সমস্যা হলেও মুখ ফুটে কিছু না বলা লোক কিন্তু আমি তার পুরাই উল্টা।তাই হয়তো ভিডিও কলে আম্মুর নাকের সাথে কথা বলাটাও তার স্বভাবের সাথে যায় কিন্তু আমি আম্মুর নাকের সাথে কথা বলতে একেবারেই নারাজ।
– আম্মু ফোনটা তোমার পুরা ফেইসে ধরো, ভিডিওতে তোমার শুধু নাক দেখা যাচ্ছে।
– এইবার ঠিকআছে? বলেই ফোনটা এমনভাবে ধরলো যে আমি শুধু আম্মুর একটা নাকের ফুটা দেখতে পাচ্ছি।
– আম্মু, ফোনটা একটু ডানে বামে ঘুরাও! তোমার ফেইস দেখতে পেলে আমি বলবো তখন তুমি আর মোবাইল নড়াবানা।
– এবার ঘরের মোটামুটি সব আসবাবপত্র আমার চোখের সামনে ঘুরতেছে।ডান বামের সব মুখস্থ হয়ে গেছে আমার।বাবার বাড়ির সেই চিরচেনা সব জিনিসপত্রগুলো এই সুযোগে আবার দেখা হয়ে গেলো আর আমি আমার স্মৃতির জগতে হারাতে থাকলাম।সম্বিত ফিরে পেলাম আম্মুর ডাকে, আফরিন ফেইস পাওনাই? মোবাইল ঘুরানো থামামু?
– পাইছি আম্মু! তুমি মোবাইল ঘুরানো থামাও।একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।বুঝলাম পুরা চেষ্ঠাই বৃথা, পরের সপ্তাহ বাড়ি যাওয়া অত্যাবশ্যক।হাতে কলমে শিখানো জরুরী।
এর পর দীর্ঘ ১১ মিনিট আমি আম্মুর কপালের সাথে কথা বলতে বলতে পার করেছিলাম।ভেবে দেখেছেন কখনো নাকের ফুটার সাথে কথা বলতে কেমন লাগার কথা? মুখ না দেখে কথা বলা যায় নাকি? আম্মুর কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আম্মুর নাক আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আফরিন খাইছো? এভাবেই চলতে থাকে। চলতেই থাকে। আজ অবধি আমি কখনো আম্মুর নাকের ফুটা, কখনো বাম গাল, কখনো ডান গাল, কখনো মেহেদি দিয়ে রঙ্গিন করা পাঁকা চুল আর কখনোবা কিউট ঐ থুতনির সাথেই কথা বলে যাচ্ছিলাম।
ভেজালেতো পড়লাম সেইদিন যেদিন আম্মু তার প্রথম সফল জিলাপির চেহারা আমাকে ভিডিও কলে দেখাতে চাইলো।নিজের চেহারা ভিডিও কলে দেখানো এক জিনিস আর জিলাপি দেখানোতো আরেক জিনিস।তারউপর ট্যাবটাও বড়, হাতে অনেকক্ষণ রাখাও কষ্ট।অনেক কষ্টে বুঝাতে পারলাম যে ক্যামেরার সাইনটাতে ক্লিক করলেই ক্যামেরা উল্টে গিয়ে ঐ জিলাপিতে ফেলো।আম্মু ক্যামেরায় ক্লিক করেছিলো ঠিকই কিন্তু জিলাপি আর দেখাতে পারেনাই সেদিন।কোনভাবেই ক্যামেরা পুরোপুরি জিলাপিতে আর পরেনা।কী আর করা, আগামি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়া অত্যাবশ্যক।
আরেকদিন অফিসের কঠিন চাপের মধ্যে মেজাজ আমার পুরাদমে তুঙ্গে তখন, এর মধ্যে আম্মুর কল এলো।
– আফরিন, লেহু আমাকে বন্ধু অনুরোধ পাঠাইছে।কী করবো?
– বন্ধু অনুরোধ আবার কী? লেহু কে? অতিরিক্ত কাজের প্রেসারে আমার মাথাতেই ছিলোনা আম্মুর ফেসবুক আমি বাংলা করে রেখেছিলাম।
– লেহু চিনোনা? ঐ যে আমাদের বাসায় বাজার দিয়ে যায় ঐ যে লেহাজউদ্দিন।ওর ও ফেসবুক আছে? ও বুঝে??
– হু মা সবাই বুঝে খালি তুমিই বোঝনা।ওর অনুরোধ বাতিল করে দাও।কাউকেউ তোমার বন্ধু করা লাগবেনা।আমি রাতে কল দিবোনে বলে তখনকার মতো ফোনটা রেখে দিলাম।আবারও বুঝলাম পরের সপ্তাহে বাড়ি যাওয়া অতি অত্যাবশ্যক।
এর মধ্যেই আম্মুকে টুকটাক ইউটিউব, ছোটখাটো কিছু স্টিকার কমেন্ট আর ফোন দিয়ে না পেলে ভয়েস রেকর্ড করে কিভাবে পাঠাতে হয় সেটা কিছুটা শিখিয়ে ফেলি আমি।আরো বুঝালাম নামের পাশে সবুজ মানে সিবান অনলাইন, শুধু সবুজ থাকলেই সিবানকে কল দিবা অন্যসময় সিবান কল ধরতে পারবেনা।আর আমাদের সব ছবিতে তুমি লাভ রিয়্যাক্ট দিবা।আম্মুও সভ্যবাচ্চার মতো আমাকে আস্বস্থ করলো যে সে সব বুঝছে।কিন্তু আমার এই বিশ্বাস পুরোপুরি আম্মু ভেঙ্গে টুকরাটুকরা করে খানখান করে দিয়েছিলো সেদিন যেদিন রাত ১০ টায় আমাকে কল দিয়ে বললো——
– আফরিন, সিবানের সবুজতো নাই!!
– কি বলো মা?? সিবানের বন্ধু সবুজ আর নাই? কেমনে মারা গেলো? কী হইছিলো?
– কি কও? সবুজে মরবো কেরে? সবুজ বাত্তির কথা কইতাছি। সিবানের নামের পাশে সবুজ বাতিতো জলতাছেনা!!
– আম্মু সিবানের ওখানে এখন রাত ১ টা বাজে।সবুজ বাতি জলবো কেমনে? ওতো ঘুমাচ্ছে, তুমিও ঘুমাও।
রাত পার করে সকাল হলো।সেদিন শুক্রবার ছিলো।একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছিলাম সেদিন।উঠেই ফোন হাতে নিয়ে আমার মাথাতো চড়কগাছের মতো ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতেছে।আল্লাহ আম্মু এটা কি করছে! আমাদের দুজনেরই কমন ফেসবুক ফ্রেন্ড আমাদের এক আত্মীয়ের বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে।সেই পোস্টে ১০৩ টা রিয়্যাক্ট পড়ছে।১০২ টা ক্রাই রিয়্যাক্ট, শুধুমাত্র ১ টা রিয়্যাক্ট ছিলো লাভ।ঐটা আমার আম্মু দিয়েছেন।পাসওয়ার্ড জানা থাকায় আইডি লগইন করে তারাতারি লাভ রিয়্যাক্ট তুলে দিলাম।আমি আবারো বুঝলাম বাড়ি যাওয়া অতি অবশ্যই অত্যাবশ্যক। আজ দুপুর ২ টার দিকে আমার অফিস নাম্বারে আম্মুর কল এলো।কলটা সাধারনত আমি আম্মুকে সবসময়ই কেটে ব্যাক করি।আজও তাই করলাম।ওপাশ থেকে আম্মু রিসিভ করেই প্রথম যেটা বললো—
– আফরিন সিবানের পরীক্ষাডা কেমুন অইলো জানতে পারতাছিনাতো।
– আমি ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন করলাম, কেনো আম্মু? কী হইছে?
– মেসেঞ্জারে যে ভিডিও দেয়ার চিহ্নডা আছেনা? ঐডা পাইনা! কই জানি গেছেগা।
– কোন একটা টিভিসি তে আম্মু দেখেছিলো যে, “মা মোবাইল চালানো শিখতে চাইলেই সন্তান বিরক্ত হতো”! তো মোবাইল রিলেটেড কিছু হলেই আম্মু আমাকে ঐ টিভিসিরর কথা বলে খুব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতো বলে আমি আগে ভাগেই আম্মুকে সব বলে দিতাম।এবারও তাই করলাম।বললাম, আম্মু সিবানতো পিএইচডি করতে গেছে, ও এখন অনেক বড়।ওতো আর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যায়নাই।আমি রাতে তোমাকে জানিয়ে দিবো ওর পরীক্ষা কেমন হলো, তুমি চিন্তা করোনা।
রাতে বাসায় এসে সব কাজ শেষ করে ঘুমোতে যাওয়ার সময় কী একটা মনে করে যেনো ঐ টিভিসি টা দেখলাম।আমার সত্যিই আজ মনে হচ্ছে আম্মুকে এতোটা যত্ন করে, এতোটা সময় নিয়ে কোনদিনতো কিছু শিখাই ই নাই আমি।আম্মু তাহলে শিখবে কিভাবে? এতো অদ্ভূত একটা অনুভূতি হলো ঐ টিভিসির শেষের কথা গুলোতে।
“ ছোটবেলা থেকেই মা আমাদের কত কিছুইনা শিখিয়েছে, অথচ মা’কেই কখনো নতুন কিছু শিখানো হয়নি! মা কিছু জানতে চাইলেই কোথা থেকে জানি একটা অবহেলা চলে আসে।বলতে পারি বা নাই পারি তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি “মা” !
চাপা একটা কষ্ট বুকে নিয়ে আম্মুকে ভিডিও কল দিলাম।এরপর যে দৃশ্যটা দেখলাম তা আমার বুকটাকে দুমড়ে মুচড়ে আরো বেশি ভেঙ্গে ভেঙ্গে চৌচির করে দিলো।আম্মুর গায়ে সিবানের পাঞ্জাবী।আম্মু পাঞ্জাবী কেনো তোমার গায়ে? এ প্রশ্নের উত্তর ছিলো, সিবানের গন্ধ পাইনা অনেকদিন, এখন সিবান সিবান গন্ধ পাইতাছি।আর তুমিনা সিবানরে তিনডা নতুন পাঞ্জাবী পাডাইছো, পুরানগুলাতো ও আর পরতোনা।এগুলা এহন আমারই থাক।আমিই মাঝে মাঝে পইরা রাতে ঘুমামু।
এবার কিন্তু আম্মুকে স্পষ্টই ভিডিও কলে দেখা যাচ্ছে।ছেলের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে ছেলেকে অনুভব করার কত অদ্ভূত পদ্ধতি আমার মা জানে, না জানলো ফেসবুক আর স্মার্টফোনের আধুনিকতা, তাতে কী? আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরলো।