অবাক বিষপান

অবাক বিষপান

“ইতালির সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি: গত ২৪ ঘণ্টায় ৬২৭ জনের মৃত্যু। নতুন করে আরও আটহাজার আক্রান্ত। লোকজনকে ঘরে অবস্থান করে সচেতন হওয়ার আহ্বান করেছে সরকার। পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাজারও সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমেছে।” বিবিসি বাংলায় নিউজ দেখছিলেন মোনাফ সাহেব। কার ডাকে যেন টিভির ভলিউমটা কমিয়ে কান খাড়া করলেন। তাঁর স্ত্রী তিথি ডাকছে পাশের রুম থেকে জানালার গ্রিল ধরে।

-কী হয়েছে? ডাকছো কেন?
-একটু জল হবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে।’ তিথির কণ্ঠটা দুর্বল শুনালো।
-ঠিক আছে। থাকো তুমি, আমি জল পাঠাচ্ছি।’ বলেই তিনি ভেতরে মেয়ের উদ্দেশ্য ডাক দিলেন,
-মনি, তোর মায়ের জল ফুরিয়ে গেছে, একটু জল দিয়ে আয়।’

মোনাফ সাহেবের দায়িত্ব শেষ। তিনি আবার ভলিউমটা বাড়িয়ে নিউজে মন দিলেন। তিথি বদ্ধ একটা ঘরে ঘনঘন কাশছে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে যাচ্ছে। একটু পর তার দশ বছরের মেয়েটা দরজা খুলে টিস্যুতে ধরা একটা পানির বোতল মেঝেতে রাখলো।

-মা, তোমার জলের বোতলটা এখানে রাখলাম। নিয়ে নিও…’ বলেই মনি বাহির থেকে আবারও দরজাটা আটকে দিয়ে চলে গেল। তিথি পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিলতে লাগলো। এক নিশ্বাসেই সাবাড় করে দিলো পুরো বোতলটা। খালি বোতলটা ছুড়ে ফেলে আবারও কাশতে থাকে সে। কপালে হাত দিয়ে দেখে আবারও জ্বর আসছে। কিন্তু কিছুই করার নেই, জ্বর এসে চলে যাবে, কাশতে কাশতে মরে যাবে, কেউ তাকে ডাক্তার দেখাবে না। আজ ৭ দিন এই বদ্ধ ঘরে তার কোয়ারেন্টাইন চলছে। প্রথম প্রথম একটু কাশি আর গলা ব্যথা হতো তার। ব্যাপারটা স্বামীকে জানালে মোনাফ সাহেবই এই ব্যবস্থা করেন। বলেন, তার করোনা হয়েছে, অন্য কারোর যাতে না হয় তাই আলাদা থাকতে হবে। তিথি তখন ডাক্তার দেখানোর কথা বললে, মোনাফ সাহেব কড়া গলায় জবাব দেন, ‘

-তা করা যাবে না। ব্যাপারটা ডাক্তার পর্যন্ত যেতে দেয়া যাবে না। দেশে করোনার চিকিৎসা নাই।”
-তাহলে এতগুলো হেল্পলাইন নাম্বার কেন দিয়ে রেখেছে?’ তিথির প্রশ্ন।
-ওরা করোনা রোগীদের শনাক্ত করে নিয়ে যায়, তারপর বিষের ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলে। মৃত্যুর পর কারও জানাজাও হয় না। প্লাস্টিকের বড় একটা প্যাকেটে ভরে পুঁতে ফেলা হয়।”

তিথির মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয় স্বামী। তারপর সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তারের কাছে যাবে না। ডাক্তারের কাছে না গেলেই হয়তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারবে সে। কিন্তু সপ্তম দিনে এসে তিথির সবকিছু কেমন যেন অসহ্য লাগছে। তার হাতে গড়া পরিবারটার সাথে কেমন যেন দূরত্ব হয়ে গেল। কেউ তার সাথে কথা বলে না। শুধু প্রয়োজনের সময় খাবারগুলো দূর থেকে দিয়ে যায়। এসব দেখার চেয়ে যেন বিষের ইনজেকশনে মৃত্যুটাই অধিক ভালো ছিল।

বাপের বাড়ি চলে আসে তিথি। বিয়ের পর এই প্রথম বাপের বাড়ি আসে সে। নিজের চেয়ে বিশবছরের বড় এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছিল বলে এতদিন অভিমান করে সে বাপের বাড়ি আসেনি। আজ এসেছে, ভেবেছে এখানকার সবাই একটু হলেও তার সাথে কথা বলবে। কাছে না আসুক, অন্তত দূর থেকে হলেও কথা বলবে। এত বছর পর তাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে সবাই। সবাই না হোক, মা অন্তত তার কথা বলার সঙ্গী হবে। কিন্তু এখানে এসে তিথি দেখলো তার সব ভাবনা ভুল। এখানেও সবাই তাকে আলাদা রেখেছে। তিথির অবশ্য এতে আপত্তি নাই, সে নিজেই চায় কেউ যেন তার কাছে না আসুক। কিন্তু যখন বড় ভাবীরা তাকে ইশারা করে বাচ্চাদেরকে বলে, “ওর কাছে যেও না, তাহলে অসুখ হবে, তুমি মরে যাবে,” তখন খুব কষ্ট লাগে তিথির। ওরা বলুক, তবে যেন একটু আড়ালে বলে। এসব শুনলে নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার। এখানেও একই পরিস্থিতি তিথির। শুধু মাঝেমাঝে মা এসে দেখে যায় কিছু লাগে কি না। তিথি নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, “না মা, কিছু লাগবে না।”

বদ্ধঘরে অসহায় পড়ে থাকে তিথি। সবার সাথে যখন এভাবে দূরত্ব তৈরি হলো, তখন সে জাভেদের কথা ভাবে। ছেলেটা প্রচণ্ড ভালোবাসতো তাকে, পাগলের মতো। তিথিও ভালোবাসতো। কিন্তু একদিন দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। জাভেদকে কেমন যেন অবিশ্বাস করতে শুরু করে সে। কেন যেন মনে হয় জাভেদ শুধু তার শরীরটাকেই ভালোবাসে, তার মনটাকে না। জাভেদ প্রায় তার ঠোঁটে চুমো খেতে চাইতো। প্রথম প্রথম তিথিও নিজের ঠোঁট এগিয়ে দিতো বিনাবাক্যে। কিন্তু পরে গিয়ে সে বিরক্ত হতে শুরু করে জাভেদের আচরণে। দেখা হলেই জাভেদ প্রথমেই জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমো খাবে, তারপর যাওয়ার সময় আবার দ্বিতীয় দফা। একদিন তিথি তার বিরক্তি প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে,

-তোমার এতো ঘনঘন ঠোঁটে চুমো খেতে হয় কেন?
-ভালো লাগে, তোমার ঠোঁটে যেন আমি অমৃত খুঁজে পাই। তোমার রসালো ঠোঁটদুটো আমাকে লোভী করে তুলে।
-ছিহ্, অশ্লীল!
-হুমম, অশ্লীল আমি ঠিকই। তবে, তোমার শরীরের অন্য কোনো অংশের প্রতি আমার চাহিদা নেই। শুধু…
-কাল থেকে ঠোঁটে বিষ মেখে আসবো…
-তাহলে ঐ বিষটুকু আমি অমৃত মনে করে তোমার ঠোঁট থেকে চুষে চুষে খাবো। হা হা হা…’
-ধুর!’ নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটা তুলে হনহন করে চলে যেতে থাকে তিথি।

জাভেদ ভেবেছিল সামান্য রাগ, পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয়নি আর। তিথি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় জাভেদের সাথে। এরইমধ্যে তার বাবা বয়সে অনেক বড় এক লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করে বসে তিথির। ছেলের প্রচুর ধনসম্পদ আছে, এটাই যথেষ্ট! মেয়ের মতামতের কোনো মূল্য নেই। তিথিও আর বাবার অবাধ্য হতে পারেনি। বিয়ের পর পুরনো সব স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে সে ভুলতে থাকে ফেলে আসা দিনগুলো। জাভেদ কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানে না সে। তবে গতবছর শুনেছিল, জাভেদ গ্রামেই আছে, এখনও নাকি বিয়ে করেনি। মাঝেমাঝে পাগলের মতো প্রলাপ করে কাঁদে তার নাম ধরে। তিথি তখন বুঝতে পারে জাভেদ আসলেই তাকে খুব ভালোবাসে।

মধ্যরাত। তিথির প্রচণ্ড গলাব্যথা হচ্ছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাউকে ডাকতেও পারছে না। ডাকলেও যে কেউ কাছে আসবে তা না। এ কেমন রোগ? আপনজনকেও দূরে ঠেলে দেয়? তিথির হঠাৎ খুব জানতে ইচ্ছে হলো, যে ছেলেটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো, সেও কি দূরে দূরে থাকতো তাকে এই অবস্থায় দেখে?
কাশতে কাশতে দরজাটা খুলে তিথি। স্বামীর বাড়িতে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিতো, এখানে অন্তত কেউ তা করেনি। তিথি বাইরে বের হয়। চাঁদের আলোতে নিজের ছায়ামূর্তির সাথে হাঁটতে থাকে সে এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। শুধু জানে দূরে কোথাও চলে যাবে, যেখানে মানুষ থাকে না। সেখানে সে ধুঁকেধুঁকে মরবে। অন্তত তার কারণে অন্য কারও এই রোগটা হওয়ার চান্স থাকবে না। চাঁদের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তিথির মনে হলো তার পাশাপাশি অন্য কেউ হাঁটছে। পেছনে ফিরে দেখে, চাদরে মুড়ানো একটা মুখ।

-কে তুমি?’ কাশতে কাশতে প্রশ্ন করে তিথি। মুখ থেকে চাদর সরায় আগন্তুক। তিথি অবাক হয়। বহুবছর পর সে জাভেদকে দেখলো এভাবে। মুখে দাড়ি রেখেছে, তবুও চিনতে কষ্ট হলো না।

-জা..ভে…দ!!!’ অস্ফুটে শব্দ করে তিথি।
-হুমম… কেন জানি ঘুম আসছিল না। বারবার বাইরে ছুটে আসতে মন চাচ্ছিল, তাই এলাম…
-কিন্তু এসে ভুল করেছো… আমার সংস্পর্শে তোমার মরণব্যাধি হবে।
-হোক, ভালোবাসার মরণ কজনের ভাগ্যে জুটে?
-এখনও ভালোবাসো কেন? আমি তো অন্যের স্ত্রী।
-কিন্তু আমার প্রথম ভালোবাসা…’ বলেই তিথিকে স্পর্শ করতে চাইলো জাভেদ। তিথি নিজেকে সরিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,

-না না, কাছে এসো না, ছুঁইয়ো আমায়। তোমারও এই রোগ হবে।
-হোক না, হতে দাও…
-না, প্লিজ… চলে যাও তুমি…
-আর তুমি?
-জানি না, কোনো গহীন জঙ্গলে ঢুকে মরবো…
-ডাক্তার দেখাওনি কেন? তোমার তো রোগটা নাও হতে পারে।
-হয়েছে রে। সব লক্ষণ তো মিলছে। আর ডাক্তার দেখালেও নাকি চিকিৎসা হয় না। বিষের ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলে।

-কে বলেছে ওসব? তবে এতো লোক ভালো হয়ে ঘরে ফিরছে কীভাবে?
-তা জানি না। তবে আর ভালো হওয়ারও ইচ্ছে নেই। কোনো গহীন বন-জঙ্গলে গিয়ে শেষ নিশ্বাসটা ছাড়তে চাই।
-আমিও তোমার সঙ্গী হতে চাই।’ বলেই দুহাতে আঁকড়ে ধরলো জাভেদ তিথিকে।
-এ কী করলে তুমি? আমাকে ছুঁলে কেন? এমন করলে কেন?’ হু হু করে কেঁদে ফেলে তিথি।
-চুপ একদম কাঁদবে না। অনেক বছর তো কষ্ট দিলে, শেষ মুহূর্তে অন্তত তোমার সঙ্গী হতে দাও না…
-আমার প্রচুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে জাভেদ, নিশ্বাস নিতে পারছি না।’ হাঁপাতে থাকে তিথি। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জাভেদ

তিথিকে। তারপর তিথির মুখে মুখ লাগিয়ে কিছুক্ষণ হাওয়া দিয়ে ধীরে ধীরে মুখ তুলে। হঠাৎ এভাবে জাভেদের স্পর্শ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তিথি। অস্ফুটে প্রশ্ন করে,

-এ কী করলে তুমি? জেনেশুনে বিষপান করলে?’ জাভেদ কিছু বলে না, চেয়ে থাকে তিথির ঠোঁটের দিকে।
-কী দেখছো ওভাবে?’ প্রশ্ন করে তিথি।
-ঠোঁট…’ নিচুস্বরে জবাব দেয় জাভেদ।
-বুড়ি হয়ে গেছি তো, ঠোঁট কি আর আগের মতো আছে?
-এখনও তো আমাকে লোভী করে তুলছে ঠোঁট দু’খানা…
-আজ কিন্তু সত্যি সত্যি বিষ আছে ঠোঁটে…
-তাহলে অমৃত মনে করে একটু পান করি…’ ধীরে ধীরে তিথির ঠোঁটের দিকে এগোতে থাকে জাভেদের ঠোঁট। তিথি চোখ বন্ধ করে ফেলে সমগতিতে,,,

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত