-আমার বাবা দুই দিন থেকে খুব অসুস্থ। তাই বাবার রিক্সাটা নিয়ে বের হয়েছি রিক্সা চালাতে। অনেক টানাপোড়া অভাবী সংসার আমাদের। আমি আর আমার বাবাকে নিয়েই আমার পরিবার। আমি জন্মের পরেই আমার মা একজনের সাথে পালিয়ে যায়।
– শুধু মাত্র আমার কারনেই আমার বাবা আর বিয়ে করতে রাজি হয়নি। যদি সৎমা আমার সাথে অত্যাচার করে।
আসলে আমার কাছে আমার বাবাই সব, ছোট থেকে এতো বড় হয়েছি কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি, বাবাই আমার মা। বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে, আমিও বাবাকে অনেক ভালোবাসি।
-এইতো সেদিন আমার পরিক্ষার ফি জগার করার জন্য বাবা সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে রিক্সা চালিয়ে পরিক্ষার টাকা জগার করলো। তাই আজ বাবার জর। কালকে একটু কম জর ছিলো কিন্তু আজ অনেক বেশি জর আসছে, জরের কারনে গায়ে হাত দেওয়া যায়না। সারারাত বাবার কপালে জলপট্টি দিয়েছি তবুও একটুও জর কমেনি।
-যেগুলা ঔষধ আনা হয়েছিলো সব শেষ হয়ে গেছে। আজ আর ঔষধ কিনার মতো কোনো টাকা নেই তাই বাবার রিক্সাটা নিয়ে বের হয়েছি। বাবাকে বলে আসিনি। কারন বাবা জানলে আসতে দিতোনা। শুধু আমার বাবা না কোনো বাবাই চাইবেনা তার শন্তান রিক্সা চালাক।
– আমি যখন খুব ছোট তখন থেকেই আমার বাবা রিক্সা চালানো শরু করেছে। আমি এখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমার বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রিক্সা চালিয়ে আমাকে মানুষ করেছে। বাবা রিক্সা চালায় তবুও কখনো আমাকে কষ্ট কি বুঝতে দেয়নি। শহরের ভালো স্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছে।
-আমি বুঝতে পারি আমার পড়ার খরচ চালাতে বাবার অনেক কষ্ট হয় তবুও কোনোদিন বাবা আমাকে বুঝতে দেয়নি। সব কষ্ট হাসি মুখেই মেনে নিতো। মধ্যরাতে বাবার রুম থেকে কান্নার আওয়াজ ভেষে আসতো, পায়ের ব্যাথায় অনেক কষ্ট পেতো।
-খুব ইচ্ছে হতো নিজ হাতে বাবার পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে, বাবার পা টিপে দিতে। কিন্তু আমি পারিনি, কখনো পারিনি আমার বাবার পা ছুতে। বাবা সব সময় বলতো আমি নাকি উনার বুকে থাকি তাই কখনো পা ছুতে দেয়নি। আমি যখন ছোট তখন বাবা আমাকে স্কুলে দিতে যেতো এবং নিয়ে আসতো। আর বলতো,
– ভালো করে পড়বি, কোনো দুষ্টামি করবিনা ঠিকআছে, কারন তোকে যে খুব বড় ডাক্তার হবে।
— আচ্ছা বাবা ভালো করে পড়বো, তুমি দেখো একদিন আমি খুব বড় ডাক্তার হবো। তখন আর তোমাকে রিক্সা চালাতে দিবোনা, কোনো কাজই করতে দিবোনা। আর তখন তোমার বুকের ব্যাথা আর পায়ের ব্যাথার ঔষধ বাইরে কিনতে যেতে হবেনা আমিই ঔষধ দেব। আমার কথা শুনে বাবা আমাকে কোলে নিয়ে কেদে ফেলতো কিন্তু কেনো কাঁদতো সেটা তখন আমি বুঝতে পারতামনা।
-সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ৩০০ টাকার মতো আয় হয়েছে। বাবার ঔষধ আর কিছু ফলমুল নিয়ে বাড়ির উদ্যেশে রাওনা দিলাম…
-বাসায় পৌছে বাবার রুমে ঢুকতেই যেন থমকে গেলাম,
কারন বাবা খাট থেকে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে আছে। বাবাকে রিক্সায় উঠিয়ে তারাতারি করে হাসতাপাতেলে নিয়ে এলাম। হাসপাতের একটা বেঞ্চে বসে আছি। আজ খুব ট্যানশন হচ্ছে বাবাকে নিয়ে, বাবার কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাচবো। বাবা ছাড়া যে আমার আর এই পৃথিবীতে কেউ নেই, খুব একা হয়ে যাবো আমি। একটা বেঞ্চে বসে এসবকিছু ভাবছি আর নিরবে চোখের জল ফেলছি…
-ফোনের রিংটনের শব্দে সকল ভাবনার ছেদ ঘটলো।
-আমার চেম্বারে বসে ভাবছিলাম পুরোদিনের সেইসব কথা, দেখতে দেখতে আমার বাবার মৃত্যুর ১৩ বছর হয়ে গেলো। সেদিন আমার বাবাকে বাচানো যায়নি, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে দুরে বহুদুরে, না ফেরার দেশে। আবারো ফোনটা বেজে উঠল, ফোন হাতে নিয়ে দেখি একটা হাসতাল থেকে ফোন এসেছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
– sir আমি আধুনিক হাসপাতাল থেকে নার্স সালমা বলছি, একজন রিক্সাচালককে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।
একটা বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করেছিলো রিক্সাটি, মারাত্নকভাবে আহত হয়েছে রিক্সাচালক দেখে খুব Emarjency বলে মনে হচ্ছে আপনি একটু তারাতারি আসলে খুব ভালো হতো।
— আপনি রোগীকে O.T. তে নিয়ে যান আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আসতেছি। তারাতারি করে হাসপাতে পৌছে গেলাম। প্রায় ২৫ মিনিট পর O.T থেকে বের হতেই আনুমানিক ১৬ বছরের একটা ছেলে কাদতে কাদতে বলল,
– আমার বাবা কেমন আছে ডাক্তার? আমি ছেলেটার মাথায় থাকা কোকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
— কিছু হয়নি সোনা, তোমার বাবা কিছুদিনের মধ্যেই সুস্হ হয়ে যাবে। ছেলেটার পিছনে তার মা’কে দেখলাম দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাদঁছে। আমি উনার কাছে গিয়ে উনার হাতে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বললাম,
-ভয় নেয়, ঠিকমতো ঔষধ খাওয়ালে আপনার স্বামী কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবে।
-সেখান থেকে বাসার উদ্যেশে রাওনা দিলাম, আমি মোঃ রাকিব। বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো।
বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি দেখে নিজেকে খুব গর্বিত বলে মনে হয়।
-আজ জুম্মার দিন, টুপি পান্জাবী পড়ে নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছি। আর আমার ডান হাতের দুই আঙ্গুল শক্ত করে ধরে আমার ৫ বছরের ছেলে রাতুল আমার সাথে মসজিদে নামায পড়তে যাচ্ছে। বাবা ছেলে একসাথে নামায পড়তে যাচ্ছি, কি আন্দময় একটা মূহুর্ত বলে বুঝাতে পারবোনা।
-হ্যা আমি বিয়ে করেছি আমার বউ এর নাম রিতু সুলতানা। একটা এতীম মহিলা মাদ্রাসায় বড় হয়েছে রিতু। কখনো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতোনা, আমিও রিতুর বিরুদ্ধে অভিযোক করার মতো কিছু খুজে পাইনি।
-নামায শেষ করে হাটা ধরলাম বাবার কবর জিয়ারত করার জন্য, বাসা থেকে কিছুটা দুরেই বাবার কবর। হেটে যেতে ৭ থেকে ৮ মিনিট সময় লাগে।
– বাবার কবরের সামনে দাড়িয়ে আছি, আর রাতুল আমার ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল খুব শক্ত করে ধরে আছে।
আমি আকাশ পানে তাকালাম, শত চেষ্টার পরেও যেন চোখ দুটি বাধা মানছেনা। চিকচিক করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। আজ চিৎকার করে বলতে খুব ইচ্ছে করছে,
-বাবা বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, আমি আবার তোমার আঙ্গুল ধরতে চাই…