কাল রাতে নীলার ফাঁসি হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম নীলার কাছ থেকে পাওয়া সেই চিঠিটাই শেষ। জানতাম না নীলা আমার জন্য একটা ডায়েরি রেখে গেছে। কাল লাশ নিয়ে আসার সময় জেলর সাহেব দিয়েছে। জেলর সাহেবের বেশি কথা বলার রোগ আছে। ডায়েরি আনার সময় কানে কানে বলেছিল, খুন করেছেন ভালো কথা, নিজে না ঝুলে বিউটাকে ঝুলিয়ে দিলেন আরো ভাল কথা কিন্তু একবার দেখা করলেন না? লাস্ট মোমেন্টে আপনার কথা বলছিল। আমি কথার উত্তর না দিয়ে ডায়েরি নিয়ে চলে আসলাম। বেশি কথা বলা মানুষ আমার একদম পছন্দ না। নীলাও বেশি কথা বলত। কাল রাত থেকে আর কথা বলছে না।
অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে অফিস আছে। ঘুম আসছে না একটুও। বিছানার পাশের ল্যাম্পটা বারবার অন অফ করছি। কাজ না পেয়ে বিরক্তি নিয়ে নীলার ডায়েরিটা হাতে নিলাম। কালো মলাটের ডায়েরিটা আমি নিলাকে দিয়েছিলাম। ছোট্ট একটা ডায়েরি পেয়ে মেয়েটা অনেক খুশি হয়েছিল। ডায়েরিটা থেকেও সেই পরিচিত ঘ্রাণ আসছে। নীলার চুলের ঘ্রাণ। ডায়েরির প্রথম পাতায় একটা কবিতা লিখা। কবিতা পরতে ইচ্ছা করছে না। সেকেন্ড পেইজ থেকে পড়া শুরু করলাম।
কেমন আছ জাদিদ? তুমি যখন আমার ডায়েরি পরছ তখন খুব সম্ভবত আমি বেঁচে নেই যদিনা কোন মিরাকল হয় যেমন ফাঁসির দড়ি ছিড়ে যাওয়া। তবে এসবের চান্স খুব কম। আচ্ছা, আমার ফাঁসির রাতটা কেমন ছিল? তোমার বৃষ্টি পছন্দ। সেদিন কি বৃষ্টি হয়েছে? নাকি আমার পছন্দের জোছনা। দুটাই কিন্তু আমরা সেলিব্রেট করতাম। মনে আছে, বিয়ের পর প্রথম বর্ষা? ফার্মগেটের সেই আগের বাড়িতে।
বৃষ্টি আসলেই আমার ভিজতে ইচ্ছা করত। তুমি আমি ছাদে হাত ধরে কত ভিজেছি। ভিজে একাকার হয়ে যখন ঘরে আসতাম, তুমি টাওয়াল দিয়ে আমার চুল মুছে দিতে। কেন মুছতে? আমার ভেজা চুল খুব ভাললাগতো। তোমার লাগতো না? তারপর দুকাপ কফি নিয়ে বারান্দায় ফেলে রাখা সেই পুড়ানো সোফায় গিয়ে বসতাম। আর একসাথে বৃষ্টি দেখতাম। উহু, আরো একটা কাজ করতাম। আমি তোমার কাধে মাথা রাখতাম আর তুমি গল্প বলতে। সেই দুকাপ কফি আর একটা গল্প দিয়ে যে কীভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা যেতো বুঝতে পারতাম না। মনে আছে একদিন তুমি গল্প বললে, সেই গল্পটা, নতুন স্বামী স্ত্রী বিয়ে করে যাওয়ার পথে ঝড় উঠল। মাঝ নদিতে ঝড়ের কারনে নৌকা ডুবে গেল। আমি সেদিন কাঁদতে কাঁদতে একাকার। সেরাতে বৃষ্টি থেমে গেল। আমার কান্না থামল না। আমার কান্না দিয়ে তুমার শার্ট ভিজে যাওয়া, খুব ইচ্ছে করছে ফাঁসির আগে আরএকবার আভাবে কাঁদতে।
মনে আছে বিয়ের আগের বর্ষাগুলো? বৃষ্টি হলেই তুমি আমার ফ্যাকাল্টির সামনে চলে আসতে। আমিও ক্লাশ বাদ দিয়ে চলে আসতাম। ফোর্থ ফ্লোরে উত্তর কোনায় একসাথে গুটিসুটি হয়ে বৃষ্টি দেখতাম। আমি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতাম। আর ভার্সিটি বন্ধ থাকলে তুমি আমার বাসার সামনে চলে আসতে। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি বের হয়ে যেতাম। এক ছাতার নিচে দুজন হাটতাম। অথবা রিক্সা নিয়ে ঢাকার অলিগলি ঘুরতাম। মনে আছে একদিন লিংকরোডে, হঠাৎ করে বৃষ্টি নামল। একটা রিক্সাও খালি নেই। সেদিন প্রথমবার একসাথে ভিজেছিলাম। তারপরদিন, আমার কিছু হলনা। তুমি সাতদিন জ্বরে ভুগলে। আচ্ছা, ফাঁসির আগে যদি একবার একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই, দিবে? মনে আছে, বৃষ্টির পর ঠান্ডা বাতাসে একটা চাদর ভাগাভাগি করে গায়ে দিতাম। জানো, এখানকার অবস্থা খুব খারাপ। আমি যে সেলে থাকি সেটা একদম বদ্ধ। তেলাপোকা ঘুরাঘুরি করে। আমার তেলাপোকা অনেক ভয় লাগে।
আমি যখন লিখছি তখন আমার সামনে তেলাপোকা ঘুরঘুর করছে। জানো, আমার সেলের জানালা দিয়ে কখনো আকাশ দেখা যায় না অথচ আমার আকাশ কত ভালো লাগে। মনে আছে, জোছনার রাতগুলোতে আমি তোমাকে ডেকে তুলে বলতাম, চলো জোছনা দেখি। তুম ঢুলুঢুলু চোখে বলতে এখন? কাল সকালে অফিস। আমি তখন মুখ বাঁকা করে বলতাম, আমার নেই? জোছনা দেখতে দেখতে কত কথা বলতাম। আর পরতে ভালো লাগছে না। দুরে কোথাও ফজরের আজান হচ্ছে। ডায়েরিটা আলমারিতে তুলে রাখলাম। অন্য একদিন পড়ব।