আমার হবু বরের সাথে আমার এক বান্ধবীর প্রেম চলছে! কথাটা শুনতে খারাপ হলেও এটাই বাস্তব! প্রথমবার যখন আমি ব্যপারটা টের পাই তখন খুব একটা পাত্তা দেইনি কিংবা সুযোগ পাইনি বুঝে উঠার। ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আমাকে এ ব্যপারে জানার সুযোগ করে দিলো। আমার হবু বরের নাম ঈশান। পারিবারিকভাবেই আমাদের বিয়ে ঠিক হয়। আমাদের বিয়ে ঠিক হবার আগে তিন বছরের প্রেম ছিলো আমাদের।
ঈশানের সাথে আমার প্রথম দেখা মানালিতে। একটা স্কলারশিপের মাধ্যমে ইন্ডিয়ার একটা সেমিনারে অংশগ্রহনের সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের ছাত্রী। একই সেমিনারে মাসুদ ভাইও ছিলো। তরুন এক ডাক্তার। ঈশান তখন মেডিকেলে পড়ে, ইন্টার্ন শুরু করবে। সেই সেমিনারের একটা অংশ ছিলো কাশ্মীর ভ্রমন। কাশ্মীরের সৌন্দর্যে আমি বিভোর হয়ে ছিলাম, আর ঈশানের ভাষ্যমতে সে তখন আমার প্রেমে পড়ে! প্রকৃতির প্রতি এত মুগ্ধতা নাকি ও আর কারো চোখে দেখিনি!
আমার অবশ্য প্রথম দেখায় ওকে নিতান্ত ভদ্র ও বুদ্ধিমান ছেলে ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। সেমিনার শেষে দেশে ফেরার পথে পুরোটা সময় দুজনে মেতে ছিলাম আড্ডায়। আমার গল্পের আয়োজন ছিলো জাহাঙ্গীরনগরের বটতলা, রাতের সৌন্দর্য আর সিগ্ধ সকাল নিয়ে। ও বারবার প্রশংসা করছিলো শহীদ মিনারের গরুর দুধের চায়ের আর বলছিলো মেডিকেলের বদ্ধ পড়াশোনাতেও মানব সেবার একটা অন্যরকম অনুভূতি যেন হাতছানি দেয়! সেই আড্ডার শেষ ছিলো বাড়ি ফেরা অব্দি।
বাড়ি ফেরার পর আমি ঈশানকে বেমালুম ভুলে বসি। আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরি। ও অবশ্য দেশে ফেরার আগেই আমার সাথে যোগাযোগের সব উপায় করে রেখেছিলো। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ঈশানের কল এলো। ফোন করেই বললো “কি নন্দিনী! এক কাপ চা খাবার সময় হবে? বটতলার বসে আছি। দেখা মিলবে?”
মেডিকেল পড়ুয়া ছেলের মুখে এমন কাব্য বেমানান হলেও সেদিন দেখা হয়েছিল। সেদিনই বুঝতে পারি এই ছেলে খুব পাগলাটে! এর পাল্লায় পড়া যাবে না। তবে মাস দুয়েকের মধ্যে এই পাগলাটে ছেলেই আমাকে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। ঝুম বৃষ্টিতে কদমফুল হাতে তার সেই তীব্র আবেদন উপেক্ষা করার শক্তি আমার ছিলো না। আমাদের প্রেম ছিলো দুরন্ত! আমাদের প্রেমে একাকার হয়ে গিয়েছিলো হাইওয়ে, বটতলা, টিএসসি, শহীদ মিনার, মেডিকেলের করিডোর, ক্যাফেটেরিয়া আর কার্জনের সবুজ মাঠ।
এদিকে আমার মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষার মাঝখানে একদিন ঈশানের জরুরি তলব! দেখা হবার পর জানতে পারলাম সাহেবের সরকারী হাসপাতালে পোস্টিং হয়ে গেছে! খুব তাড়াতাড়ি ঈশান ক্যারিয়ারটাকে ঠিক করে ফেলবে এ ব্যাপারে সন্দেহ রইলো না আর! চাকরীতে জয়েনের কিছুদিন পর ওর বাসা থেকে আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসলো। সবকিছু ঠিকই ছিলো, কিন্তু বেঁকে বসলেন আমার বাবা! বাবা বললেন “ঈশান নিজের কর্মজীবনের শুরু করছে, অথচ তুমি এখনো ক্যারিয়ারটাকে গোছাও নি! তোমার কর্মজীবন শুরুর আগে তোমার বিয়ে আমি দিচ্ছি না!” বাবার এরকম সিদ্ধান্তে প্রচন্ড রাগ হলো আমার! কিন্তু বাবা তার মতামতে অবিচল। আর ছোটবেলায় মাকে হারানো আমার কাছে বাবাই সব। এ কারনে বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সময়টা পিছিয়ে গেলো। আমি ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আর ঈশান অন্য সম্পর্কে মজে গেলো! তার কাছে রায়া হয়ে উঠলো নতুন মুগ্ধতা!
একদিন হটাৎ করেই বাবার শরীর প্রচন্ড খারাপ হয়ে পড়লো! বাবাকে নিয়ে টানা ১০ দিন হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি। আত্নীয় স্বজনরা আসছে, দেখে চলে যাচ্ছে। ঈশানও যেন দায়সারাভাবে খোঁজ নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে। নতুন চাকরি তাই কাজের চাপের বাহনা! টের পাই কোন পরিবর্তনের। কিন্তু হাসপাতালের করিডোর সব ভুলিয়ে দেয়। একা হাতে এতকিছু সামলে আমি যখন ক্লান্ত আর দিকহারা তখন বাবা আমাকে আরো দিকহারা করে শেষ নিশ্বাসটুকু ফেললেন! আমার একমাত্র আপন মানুষটা এক মুহূর্তে আমার সব চেষ্টাকে শেষ করে আমাকে একা করে চলে গেলেন!
হতাশা আর আর অসহায়ত্ব তখন আমাকে আকড়ে ধরতে পারেনি একটা মানুষের কারনে। সে মাসুদ ভাই। বাবার চিকিৎসা ওনার হসপিটালেই হয়েছিলো। বাবার চলে যাওয়ায় মাসুদ ভাই, তার মা আর ওনার ছোট বোন তিন্নি আমার পরিবার হয়ে উঠলো। একা বাড়িতে আমাকে তিন্নি একা থাকতে দেয় না। খাইয়ে দেয়, কথা বলে মন ভালো রাখে, রাতে ঘুমের মধ্যে যখন আমি ফুপিয়ে কেঁদে উঠি, তিন্নি আমাকে জাপটে ধরে রাখে! মাসুদ ভাই প্রতি বিকেলে দেখা করতে আসে। সে খুব চাপা স্বভাবের কিন্তু লোকটার মধ্যে আমার প্রতি একটা বিশেষ যত্ন কখনো কখনো যেন প্রকাশ হয়ে যায়। ঈশান এরমধ্যে একবার এসে দেখা করে যায়। চেনা ঈশানকে বড্ড অচেনা লাগে আমার।
সেদিন রাতে খুব ঝড় বৃষ্টি! ঈশানের এক কলিগ ফোন করে আমাকে। জানায় ঈশান আর রায়ার কথা। সম্পর্কের গভীরতার কথা। কিছু ছবিও পাঠায়। লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও যেন ভুলে বসি আমি! বাবার মৃত্যুর ধাক্কার কাছে এ তো কিছুই না! তবে এটা যেন কফিনের শেষ পেরেকের মতো ঠেকলো আমার কাছে! কাঁদতে ভুলে বসেছিলাম অনেক আগেই। তাই পাথরের মতো নিথর হয়ে গেলাম। এই ঘটনা যেন আমার মতো দূরন্ত মেয়ের দুটি ডানা কেটে দিলো! উড়তে চাওয়া দুটি পাখির একটি যেন আরেকটির ডানা কেটে দিয়ে একাই উড়ে গেলো নতুনের ডাকে!
এই ঘটনার ঠিক ৭ দিন পর নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে একটা উপহার দিলো। জানতে পারলাম আমি খুব নামকরা একটা এনজিওতে প্রোগ্রামিং অফিসার পোস্টের জন্য সিলেক্টেট হয়েছি! নতুন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। কর্মজীবন শুরু থেকেই আমায় দুহাত ভরে দিলো। বাবার স্বপ্ন বৃষ্টির পরের ঝকঝকে আকাশের মতো হেঁসে উঠলো। মাসুদ ভাইয়ের বোন তিন্নির বিয়ে হলো ধুমধাম করে। আর চাপা মাসুদ ভাই তার দীর্ঘদিনের চাপা ভালোবাসা প্রকাশ করলো। যেটা তৈরি হয়েছিলো সেই মানালিতেই!
আমরা মানালিতেই হানিমুনে গেলাম। আমি ডানাছাড়া পাখি হয়েও কেমন যেন উড়তে লাগলাম। আমার ডানা কেটে দেয়া যেন শাপেবর হলো আমার জন্য! মানসিকতায় এতটা দৃঢ় হয়ে উঠলাম যে, জীবনকে ভালোবাসতে শিখে গেলাম। তবে সবসময় জন্মদাতার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় দুচোখ ছলছল করে উঠে কেবল! সে যে আমায় উড়তে শিখিয়েছে!!!