প্রিয়জনদের হাসি

প্রিয়জনদের হাসি

প্রথম মাসের বেতন পেয়েই বাবাকে বললাম, ‘বাবা তোমার কিছু লাগবে?’ বাবা আমার এমন কথায় থতমত খেয়ে গেলেন। ছলছল নয়নে তাকালেন। আমি আবারো বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম….

-বাবা তোমার কিছু লাগবে নাকি? বাবা ঘাড়ে থাকা আঁধপুরোনো গামছা দিয়ে চোখটা একটু মুছলেন। আমার কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন…..

–আমার আর কি লাগবো, সবইতো আছে। তর মাইরে ক হের কি লাগব।

খুব ভালো করে খেয়াল করলাম বাবার চোখে পানি। গায়ের শার্টটাও পুরাতন হয়ে গেছে। পায়ে বাটা স্যান্ডেল, বোটা ছিরে গেছে। সেটা আবার গুনা দিয়ে সেলাই করা। আমি মার কাছে গেলাম। মার কাঁপড়টা সেকেলেই রয়ে গেলো। ১ বছর আগে মাকে বলেছিলাম কাপড়টা চেঞ্জ করতে। মা মুচকি হেসে বলেছিলো, ‘এখনোতো নতুন, আরো কয়েকবছর যাক।’ মাকে বললাম….

-ও মা তোমার কি লাগবো? মা খুব সাবলীল ভাবেই উত্তর দিলো….
–আমগো কিছুই লাগবনা। তোমার যা মনে চায় কিনো। নতুন চাকরি শার্ট প্যান্ট কিনতে অইবো। কত বন্ধু তোমার।

আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিনি। বাসা থেকে চলে আসলাম। বাবা মায়েরা সত্যিই মিথ্যুক হয়। ছেলের ভবিষ্যৎের জন্য, তাদের ভালোর জন্য প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলে। নিজের পুরোনো শাড়ি গায়ে জরিয়ে নিয়ে বলে আমার এটা নতুন। নিজের একটা ভালো শার্ট নেই তবুও বলে লাগবেনা। কেন মিথ্যে বলবে? কই আমি না চাওয়াতেও তো কোনদিন কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি।

দেরি হলেও সেটা দিয়েছে। কখনো অন্যের দুয়ারে হাত পাততে দেয়নি। সবসময় পাশে থেকে আশ্বাস দিয়েছে। রোজ রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মার্কেট থেকে বাবার জন্য নতুন একজোড়া স্যান্ডেল কিনলাম। ভালো দেখে দুটো গামছা নিলাম। একটা নতুন লুঙ্গি আর একটা নতুন শার্ট। মার জন্য ২ টা কাপড় নিলাম। সবশেষে জান্নাতের জন্য কিছু চুড়ি আর একটা পাতা টিপ নিলাম। এই মেয়েটাকে যত দেখি ততই অবাক হই। কখনো মুখ ফুটে কিছু চায়নি। যদি কখনো বলতাম….

–জান্নাত তোমাকে দেওয়ার মতন কোন সামর্থ্য তো আমার নেই।
-কি বললে তুমি? আমি কখনো কিছু চেয়েছি তোমার কাছে?
–না, কিন্তু!
-এত বেশি বুঝো কেন হু? আমাকে কিচ্ছু দিতে হবেনা, শুধু এই হাত দুটো আঁকড়ে রেখো। আর চাকরি পেলে বাবা মাকে নতুন কাপড় কিনে দিও। আমারতো শুধু তুমি হলেই চলবে। সত্যিই আর কিচ্ছু লাগবেনা রুবেল।

যদি তারপরেও কিছু বলতাম গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। একেরপর এক ইন্টার্ভিউ দিয়ে যখন ফিরে আসতাম জান্নাত আমার গাল ছুয়ে দিয়ে বলতো ‘আরেকবার দেখো, ঠিক চাকরি হবে।’অবশেষে হলোও তাই। সেদিন জান্নাত সেকি খুশি। তারপরতো রোজ বলতো এই মাকে এটা কিনে দিবে। বাবাকে ওটা কিনে দিবে। আর খবরদার ভুলেও আমাকে কিচ্ছু দিবেনা। নইলে খবর আছে হু সবকিছু কিনে বাসায় আসলাম। বাবা-মার হাতে কাপড় গুলো দিয়ে বললাম….

–মা এগুলো তোমার জন্য। আর বাবা এগুলো তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা। বাবা আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকালেন। আমি বললাম….
–খুলে দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা।
-এগুলো কেনার কি দরকার? আমারতো আছেই…(বাবা)
–হয় আমগোতো আছে, তুমি নিতা। নতুন অফিস। (মা)
-আরে আমিতো নিবই, আগে তোমরা নাও তারপর আমি। তোমরা ছাড়া কে আছে বলো?

বাবার চোখে জল স্পষ্ট লক্ষ করলাম। এই মানুষটা বড্ড আবেগী। মা তো পারলে কেঁদেই দিবে। অতিসুখে মানুষ কাঁদে। সেটা প্রকাশ পায় মানুষের চোখের এক ফোটা নোনাজলে। আমি সামনে থাকলে বাবার কান্না করাটা একদম বেমানান লাগবে। সব অনুভুতি সবার সামনে প্রকাশ করা মানায় না। আমি আঁচ করতে পারছি, এখন বাবা চোখের জল মুছবেন। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে মাকে বলবেন.. ‘তোমার ছেলেটা বড্ড বড় হয়ে গেছে রুবেলের মা। দেখছো এহন আমগোরে কতকিছু কিন্না দিলো।’ মা তখন শাড়ির আচল দিয়ে চোখের জল মুছে বলবেন… ‘পোলা মানুষকি সবসময় ছোট থাকব, বড়তো হইবই।’

আমি বাসা থেকে চলে আসলাম। উদ্দেশ্য লেকের পার। যেখানে রোজ জান্নাতের সাথে দেখা হয়। আচ্ছা জান্নাত চুড়ি দেখলে কি রাগ করবে? টিপ যদি নিজ হাতে পরিয়ে দেই অভিমান করবে? উহু বড্ড ভালোবাসবে আমি দিব। নিঃসংকোচ ভাবে, পাগলিটা গাল ফুলিয়ে থাকলেও বলব ভালোবাসি। বকা দিলেও কান ধরে বলব ভালোবাসি। তবুও দিনশেষে আমার প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলব ভালোবাসি তোমাদের।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত