জান্নাত

জান্নাত

রাত প্রায় দেড়টা বাজে অথচ এত রাতে জান্নাতের আম্মুর ফোন থেকে সাইত্রিশটা মিসড কল! ভাবতে ভাবতেই আবার ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করলো। রিসিভ করে সালাম দেয়ার আগেই উৎকণ্ঠা নিয়ে জান্নাতের আম্মু বলল,

— বাবা, সেই কখন থেকে তোমাকে ফোন দিচ্ছি তবে তুমি তো ঘুমে! তাড়াতাড়ি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে এসো বাবা! এত রাতে ঢাকা মেডিকেলে যেতে হবে? কার কী হলো হঠাৎ! রাতে তো ওদের ওখানেই ডিনার করে এলাম৷ তখনও তো সবাই ভাল ছিল তাহলে হঠাৎ কার এমন কী হলো যে মেডিকেলে আসতে হলো! এসব ভাবতে ভাবতেই জান্নাতের আম্মু আবার বলল,

–বাবা তাড়াতাড়ি তোমার পরিবার সহ চলে আসো।
–কিন্তু আম্মু কার কি হয়েছে একটু বলবেন?
— জান্নাতের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল রাতে অবস্থা নাকি খুব একটা ভাল না তোমরা তাড়াতাড়ি চলে এসো বাবা।

জান্নাতের অবস্থা ভাল না শুনেই বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠলো। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে আম্মু আব্বু আর আপুকে বললাম যেন তারা তাড়াতাড়ি চলে যায় আর আমি বাইক নিয়ে বের হয়ে গেলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর হাসপাতালে পৌছালাম। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে আমার৷ রাতেও তো জান্নাতের সাথে কথা হলো কই তখন তো ওর শরীর খারাপ এমন কিছু বলল না! আবার ওদের বাসাতেই তো ডিনারও করে এলাম তবুও তো কিছু বুঝলাম না! পা কেন যেন এগুতেই চাচ্ছে না! তবুও খুব জোরে হাঁটার চেষ্টা করছি। হাসপাতাল এতটা নিরব হয় জানা ছিল না৷ কেন যেন মনে হচ্ছে আজ আরও একটু বেশিই নিরব নিরব লাগছে। জান্নাতকে যে ওয়ার্ড এ রাখা সেখানে যেতেই দেখলাম ওর বাসার সবাই বসা। গিয়ে বললাম,

— আম্মু জান্নাত কেমন আছে? কোথায় ও?

কথাটি বলতে না বলতেই জান্নাতের আম্মুসহ বাকিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বুঝলাম না কিছুই। কাঁদার কি হলো এখানে! জান্নাতের আব্বু আমার হাত ধরে রুমের ভেতরে নিয়ে গেলেন। দেখলাম ভেতরে একটা বেডে কে যেন শুয়ে আছে। তবে মাথা অবধি সাদা কাপড়ে ঢাকা। জান্নাতের আব্বু আলতো করে মাথার পাশ থেকে কাপড়টা সরাতেই আমার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল!

— তোমরা যাওয়ার পর থেকেই আম্মু আমার বলছিল ওর কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ওদিকে ইনহেলারটাও নষ্ট ছিল কিছুদিন। আমরাও খুব বেশি গুরুত্ব দেইনি বিষয়টা। ওকে ঘুমাতে যেতে বলেছিলাম। পাগলি মেয়েটা শুধু বলতেছিল,
আব্বু আমার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে। যখন একদমই আর পারছিল না তখন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে করে এখানে নিয়ে আসি। তোমাকেও তখনই ফোন দিয়েছিলাম বাবা তবে ধরো নি। আমার কলিজার টুকরো টা এইভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে আমরা মানতে পারছি না বাবা ! বলতে বলতেই জান্নাতের আব্বু ডুঁকরে কেঁদে দিলেন।

খুব কষ্ট হচ্ছিল জান্নাতের দিকে তাকাতে। তবুও তাকালাম। শ্যামলা মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেছে। চোখের পাশে এখনও কয়েক ফোঁটা অশ্রু রয়েই গেছে। হয়তো শেষ বারের মতো হলেও নিঃশ্বাস নিয়ে খুব করে বাঁচতে চেয়েছিল। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন যে ফোনটা সাইলেন্ট রাখতে গেলাম৷ না হলে হয়তো আমার জান্নাতকে জীবিত দেখতে পেতাম। আম্মু আব্বুরা আসার পর আরেক দফা কান্নাকাটি হয়ে গেল। কিন্তু কি আশ্চর্য আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও পানি বের হচ্ছেই না। অথচ এত বড় হলেও আমার সামান্য কিছু হলেই চোখে পানি চলে আসে৷

আসর নামাজ পর জান্নাতকে কবরস্থ করে এসে ওর রুমে বসে আছি। রুমের দেয়ালে লাগানো ওর হাসিমুখের ছবিটার দিকেই বারবার চোখ যাচ্ছে। হঠাৎ কি হতে কি হয়ে গেলো ভাবতেই পারছি না। সামান্য শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল ওর৷ এতটুকুতেই আল্লাহ ওকে তুলে নিলেন! এইতো পরশুদিন জান্নাতের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উপরওয়ালার কি নির্মম চাওয়া৷ বিয়ে হওয়ার আগেই আমার জান্নাতকে তিনি কেড়ে নিলেন! মৃত্যু জিনিসটা আসলেই বড় আজব। তা না হলে কী আর সুস্থ, স্বাভাবিক একটা মানুষও মরে যায়? মৃত্যু এমনই! যার যতটুকু হায়াত আছে সে ঠিক ততো দিনই বাঁচবে, বেশি নয়! তবুও আমার জান্নাতকেই কেন আল্লাহ পছন্দ করলেন! আমার জান্নাতের যে অনেক স্বপ্ন ছিল সেগুলো কেন পূর্ণ করতে দিলেন না উপরওয়ালা!

জান্নাত মারা গেছে আজ নয়দিন হলো। এই নয়টা দিনে কেমন যেন হয়ে গেছি। জান্নাতের বাড়ির সবাইকে যেখানে সান্তনা দেয়ার কথা সেখানে ওরা সবাই আমাকে শান্তনা দিচ্ছে। আমার মেনে নিতে খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে যে জান্নাত আর বেঁচে নেই। সব সময়ই কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা আমার পাশেই আছে আর মাঝে মাঝেই হাতটা শক্ত করে ধরে বলছে, আমি তোমাকে ছাড়বো না। শুয়ে শুয়ে ভাবছি সেই প্রথমদিনের কথা। আপুর বলাবলিতে মেয়ে দেখতে গেলাম আমার জন্য৷ যদিও আপুরা আগেই দেখেছিল মেয়েকে আর সেই মেয়েটাই ছিল জান্নাত। পুরো নাম সাইরা বিনতে জান্নাত। আমি ওকে শুধুই জান্নাত বলতাম। দুই পরিবারের কথোপকথন পর সেদিন আমাকে আর জান্নাতকে আলাদা কথা বলার জন্য অন্য রুমে পাঠালেন বড়রা। রুমে ঢুকতেই জান্নাত বলল,

— এই আপনি এর আগে প্রেম করেছেন? রুমে ঢুকতেই এমন কথা শুনে খানিকটা ভকড়ে গিয়েই বলেছিলাম,
— আসলে প্রেম করবো করবো করেও আর করাটা হয়নি৷
— ভাল করেছেন৷ আমিও করি নি তবে এবার করবো!
— মানে?
— মানে টানে নেই তো। আর শুনেন, আমি কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করছি না ।
— তাহলে?
— তাহলে আর কী? আগে দু’মাস আমরা প্রেম করবো তারপর বিয়ে বুঝলেন?
— তাও বুঝলাম না!
— ধুর, এত বুঝতে হবেনা আপনার। আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে গিয়ে বলবেন আপনারও আমাকে পছন্দ হয়েছে বুঝলেন?
— জ্বি।
— চলুন তাহলে৷

সেদিন জান্নাতের কথা মতোই আমাদের বিয়ের ডেট দু’মাস পর দেয়া হয়েছিল৷ জান্নাতকে দেখে আসার দিন রাতেই ঘরে বসে ছিলাম তখনই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ধরতেই বলল,

— কি করো জামাই? আননোন নাম্বার থেকে জামাই শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
— কে আপনি?
— ওবাবা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? বিয়ের পর তাহলে কয়দিন মনে রাখবে?
— জান্নাত?
— হ্যাঁ।
— কেমন আছেন?
— খুব ভাল, হিহিহি। কারণ আমার খুব শখ ছিল প্রেম করে বিয়ে করার। সেই শখটা পূর্ণ হচ্ছে।
আচ্ছা শুনেন, আপনার কাছে আমার অনেক আবদার আছে কিন্তু শুনেন সব এখনই।

— আবদার? কি আবদার?
— এই দু’মাস খুব প্রেম করবো আমরা৷ অনেক জায়গায় ঘুরতে যাব, অনেক কিছু খাব, কেনাকাটা করবো কেমন?
— আর?
— আর প্রতিদিন আমাকে নিয়ে রিক্সা রাইডে যেতে হবে।
— বাইক রাইড হলে হয়না?
— না হয়না। আমার বাইকে উঠে এক্সিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি আপনার সাথে অনেক দিন বাঁচতে চাই।
— আচ্ছা রিক্সা করেই ঘুরবো। তারপর?
— তারপর মাঝে মাঝেই কিন্তু প্রচুর জ্বালাবো, সব মেনে নিতে হবে।
— আচ্ছা মানবো। আর?
— জানেন তো,

আমার বাড়ি, গাড়ি, গহনা এসব কিচ্ছু চাই না৷ আমার শুধু খুব বেশি ভালেবাসা চাই, এই আশাটা পূর্ণ করবেন? জান্নাতের এই একটা কথা শুনে সেদিন মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে আমার বউ হিসেবে নয় আত্মা হিসেবে পেতে চলেছি। যাকে ছাড়া বাঁচা যাবে তবে ভাল থাকাটা হবে না৷ এই দু’মাসে ওর সব গুলা শখই হয়তো পূর্ণ করার চেষ্টা করেছিলাম৷ একসাথে ঘুরতে যাওয়া, টং দোকানের রং চা খাওয়া, অনেক অনেক শপিং করা আর প্রতিদিন নিয়ম করে রিক্সা করে ঘুরতে যাওয়া তো ছিলোই। সেদিন রাতে যখন রিক্সা করে আমরা ঘুরছিলাম তখন ও আমার ডান হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিল৷ আমার তখনও কেন জানি মনে হচ্ছিল এই মেয়েটা আমাকে ছাড়তে চায় না, কখনোই না৷

ওর কথা বলার ভঙ্গি, আচার ব্যবহার যতটা না ম্যাচিউর ছিল তারচে বেশি ছিল বাচ্চামি। অল্প কয়টা দিনেই আমার বাসার সবাইকে তো আপন করে নিয়েছিলই সাথে আমার পুরোটা জুড়েই ও চলে এসেছিল। মাঝে মাঝে আমার মনেই হতো, চিনিনা- জানিনা, জানতামও না অথচ এই কয়টা দিনেই সে আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছে। নির্দ্বিধায় নিজের সব চাওয়া পাওয়া আমার কাছে অনায়াসে বলে দিচ্ছে। মেয়েটা আমাকে হয়তো আমার থেকেও বেশিই ভালোবাসে!এইতো সেদিনের কথা৷ অনেক রাতে বললো দেখা করবে। এখনই যেন ওদের বাসাতে যাই। বাইক নিয়ে ওদের বাসার সামনে যেতেই দেখি ও নীচে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতেই বলল,

–আমার আর তর সইছিল না তাই আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছি, হিহিহি৷ মেয়েটার পাগলামি দেখে অবাকই হতাম। রাত একটার দিকে সেদিন দু্’জন হাঁটতে বের হলাম৷ অনেকটা পথ হাঁটার পর রাস্তার পাশে বসে ও আমার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল,

–তোমাকে আমার কেন এত ভালো লাগে জানো?
— কেন?
— তুমি একটা গাধা, হিহিহি৷ যাই বলি তাই করো। অবশ্য ভালই হবে৷ বউ পাগল বর আমার খুব শখ ছিল আর তেমনটাই পেয়েছি। সোডিয়ামের আলোয় ওর হাসি দেখে সেদিন আরেকবার ওর প্রতি পাগল হতে মন চেয়েছিল। তারপর হাঁটা শেষে ওর বাড়ির নীচে এসে ফাঁকা রাস্তায় হুট করেই খুব বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যখন বলেছিল,

— তোমার বুকে ঠাঁই দিও প্রিয়, জনম জনমের লাগি। কথাটা শুনে খুব বেশি করে ইচ্ছে করছিল আমি হয়তো আমার জীবনটাও এই জান্নাত নামের মেয়েটাকে অনায়াসে উৎস্বর্গ করতে পারবো।

এইতো যেদিন মেয়েটা মারা গেল সেদিনও বিকেলে একসাথে কফি খেয়েছি। তারপর বিয়ের শপিং করে সপরিবারে ওদের বাসায় ডিনারও করে এসেছি। জান্নাত নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছিল। খাওয়া শেষে সবার আড়ালে নিজের রুমে নিয়ে অনেক সময় বুকে জড়িয়ে ধরেছিল মেয়েটা। সেদিনই প্রথম মেয়েটার চোখে আমি জীবনের প্রথম চুম্বন টা করেছিলাম। মেয়েটার চোখে আমি অনেক চাওয়া দেখেছিলাম। ভালেবাসার কাঙালী ছিল মেয়েটা।

.তবুও আল্লাহ উপর থেকে আমার জান্নাত এর কপালে এত সুখ রাখলেন না৷ মেয়েটার ছোট্ট ছোট্ট শখগুলো পূর্ণ হওয়ার আগেই নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। মেয়েটা আমাকে সারাজীবনের জন্য চেয়েছিল অথচ আমি তার শেষ সময়টাতেও পাশে থাকতে পারলাম না! অনেকদিনের জমা কষ্ট একফোঁটা অশ্রু হয়ে আমার গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়লো। উঠে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দু-হাত তুলে শুধু এতটুকুই চাইলাম, “হে আল্লাহ, তুমি আমার জান্নাতকে এই জীবনে তো দিলেনা, তবে দয়া করে ওই জীবনে জান্নাতে আমার জান্নাতকে সারাজীবনের জন্য আমার করে দিও”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত