ভাবুক আঙ্কেল

ভাবুক আঙ্কেল

–“ তোমার মতো ছেলের কাছে আমি মেয়ে বিয়ে দেবো না । তুমি এখনই নেমে যাও ট্রেন থেকে অথবা অন্য কোন বগি তে গিয়ে বসো। দয়াকরে আমার সামনে থেকে বিদেয় হও।”

শাখাওয়াত হোসেন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললেন। ছেলেটা যে ভিষণ লজ্জা পেয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এতগুলো যাত্রীর সামনে এই জাতীয় অপমান সহ্য করা কঠিন। ছেলেটা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে অন্য বগির দিকে রওনা হল।

শাখাওয়াত হোসেন যে বদমেজাজি লোক। বেপারটা এমন না। তিনি হুট করে রেগে যান না। তার মাথা ভিষণ ঠান্ডা। আর এটাই হচ্ছে উনার মূল সমস্যা। তার এই ঠান্ডা মাথা তিনি একটা বিশেষ কাজে ব্যবহার করেন । সেটি হচ্ছে টেনশন করা। যে কোন বিষয়ে তিনি টেনশন করতে ভালবাসেন। আর সব কিছু নিয়েই এডভান্স অনেক কিছু ভেবে ফেলেন। তার কথা হচ্ছে-জীবন কোন ছেলেখেলা নয়।সহজও নয়। কোন বিষয়কেই ছোট করে দেখতে নেই। সবারই উচিত তিল কে তাল করে দেখা।

আমি পাশের সীটেই বসে ছিলাম। পুরো ঘটনাটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হলো।আমি বললাম -“ আঙ্কেল, কিছু মনে না করলে আপনার সাথে একটু কথা বলি। ” উনি বললেন -“ বলেন, মনে করার কি আছে?” তাকে বেশ প্রফুল্ল দেখালো। আমি বললাম -“এই যে ছেলেটাকে এভাবে অপমান করে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন, এতগুলো মানুষের সামনে কি লজ্জাটাই না পেলো।” শাখাওয়াত হোসেন কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। আমি বললাম -“ আচ্ছা আঙ্কেল, ছেলেটার উপর আপনি এত রাগ কেন? ছেলেটা কী করেছে? ” এবারে উনি আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন। আমাকে তুমি করে বলতে শুরু করলেন। উনি বললেন -“কি করেছে তুমিতো নিজের চোখেই দেখলে। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছো?”

-“কই কিছুই তো দেখলাম না। কী করলো?”
-“আমাকে জিজ্ঞেস করলো না? ঘড়িতে কটা বাজে?”
-“হ্যাঁ, সে আপনাকে জিজ্ঞেস করলো ক’টা বাজে? সে তো কোন বেয়াদবি করে নাই। বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতেই সময় জানতে চেয়েছে? তাই বলে আপনি বিয়েটা ভেঙে দিলেন।”

-“বিয়ে ভাঙলাম কোথায়। বিয়ে তো ঠিকই হয় নি। ওই ছেলেকে তো আমি চিনিই না। বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই জানিয়ে দিলাম যে আমার মেয়ের সাথে আমি ওর বিয়ে দেবো না।”

-“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আঙ্কেল,একটু বুঝিয়ে বলবেন।”
-“তোমাদের ইয়াং জেনারেশনের এই এক সমস্যা। তোমরা সহজে কিছু বোঝো না। এর কারণ তোমরা কোন কিছু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করো না। সব কিছু সহজ ভাবে দেখো।”
-“সরি আঙ্কেল, আসলেই বুঝিনি। একটু যদি বুঝিয়ে বলতেন।”
-“আচ্ছা শোনো,এই যে ছেলেটা আমার কাছে সময় জানতে চাইলো আমি যদি ওকে বলতাম কটা বাজে তাহলে ও আমাকে ধন্যবাদ দিতো। ঠিক কি না বলো?”

-“জী আঙ্কেল। ছেলেটাকে ভদ্রই মনে হয়েছে। সে আপনাকে ধন্যবাদ দিতো।”
-“সে যদি আমাকে ধন্যবাদ দেয়, তাহলে আমার কি বলা উচিত না যে আরে ধন্যবাদ দেয়ার কি আছে। ইটস ওকে।”
-“জী আঙ্কেল,আপনি এটা বলতেন।”
-“তখন ওই ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিতো। দিতো কিনা বলো? ”
-“জী আঙ্কেল,হাসি দেয়ার সম্ভাবনা আছে।”
-“আচ্ছা, ছেলেটা ভদ্র।

সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলে আমারও তো উচিত তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়া এবং কিছু একটা বলা। ঠিক কি না বলো।” আমি বললাম – “জী ঠিক।”

-“এর পর ওই ছেলেও আমাকে কিছু একটা বলতো। এতে কি হতো আমাদের দুইজনের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়ে যেত। আমরা গল্প করা শুরু করে দিতাম। বল দিতাম কিনা?”
-“জী আঙ্কেল,গল্প করা শুরু করে দিতেন।”
-“কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করতাম ছেলেটা কোথায় যাচ্ছে,বাসা কোথায়, পড়াশোনা শেষ হয়েছে কিনা, চাকরি বাকরি করে কিনা?এসব জিজ্ঞেস করতাম কি না বলো।”

-“জী।জিজ্ঞেস করতেন।” আমি অসহায় ভাবে উত্তর দিতে থাকি।
আংকেল বললেন -“আমি ওকে এত প্রশ্ন করলে ও কি আমাকে আমার বেপারে জিজ্ঞেস করতো না?”
-“জী আঙ্কেল, অবশ্যই করতো।”
-“সে আমাকে জিজ্ঞেস করতো আমার বাসা কোথায়, বাড়িতে কে কে আছে আমার। আমার ফোন নাম্বার চাইতো। বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতো। ঠিক কিনা বল।”
-“জী আঙ্কেল, হয়তো ঠিক।”
-“আমার বাড়ি রাজশাহী।

আমি হয়তো সৌজন্যতার খাতিরে ওকে বলে ফেলতাম রাজশাহী কখনও এলে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসো। সামনে গ্রীষ্মকাল। আমাদের বাগানের পাকা আম খাওয়াবো তোমাকে। ছেলেটা আমার ঠিকানা, ফোন নাম্বার নিয়ে রাখতো।একদিন সত্য সত্য ছেলেটা আমার বাসায় চলে আসতো বেড়াতে। আমি হয়তো চোখ লজ্জার কারণে ওকে বলতাম দুইটা দিন থেকে যাও আমার বাসায়। ছেলেটাও হয়তো রাজি হয়ে যেত। আমার বাসায় থাকতো।” আমার মাথা তখন ঘুরছে। আঙ্কেল বলে যেতে লাগলেন – “আমার বাসায় ছেলেটা থাকলে এমনিতে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু বাসায় আমার যুবতী মেয়ে। একদম সহজ সরল মা মরা মেয়ে আমার। ওই ছেলেটা আমার মেয়ের প্রেমে পড়ে যেতো। আমার মেয়েটা অনেক লক্ষী, কিন্তু একটু বোকা টাইপ। মেয়েটা ওর প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে দিতো।দিতো কি না বল বাবা? ”

-“আমি আসলে বুঝতে পারছি না ,প্রেমের ফাঁদে পা দিতো কিনা।”
-“প্রেম করা যে একদম খারাপ আমি সেটা বলিনি। প্রেমে মানুষ পড়বে এটাই স্বভাবিক। প্রেম করে বিয়ে করা বেপারটা খারাপ না। কিন্তু আমার সমস্যা অন্য জায়গায়।”
-“ কোন জায়গায় সমস্যা আঙ্কেল ?”
-“যেই ছেলের নিজের হাতে একটা ঘড়ি নেই।

ট্রেনে উঠে অপরিচিত মানুষকে জিজ্ঞেস করে কয়টা বাজে। তার সাথে আমি কীভাবে মেয়ের বিয়ে দেই বল বাবা। আমার মা মরা মেয়েটা। অনেক কষ্ট করে বড় করেছি। নিজের কথা কখনও ভাবি নাই।” এই পর্যায়ে তিনি রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। আমি বললাম -“ কাঁদবেন না আঙ্কেল। ঘড়িতে ক’টা বাজে আপনি তো বলেননি। বিয়েও হয়নি। ছেলেটা জানতে চেয়েছে ক’টা বাজে, উত্তরে আপনি জানিয়ে দিয়েছেন মেয়ে বিয়ে দেবেন না। ভালো করেছেন আঙ্কেল । ওই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে না দিয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। বেঁচে গেছেন আঙ্কেল । ” আঙ্কেল কান্না থামালেন, বললেন -“ তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো বাবা। কেউ আমার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনে না। তুমি আমার কথা গুলো বুঝতে পেরেছো।” আমি নিরবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।

সন্ধ্যা নামতে শুরু করছে। আমি চুপচাপ বসে আছি। জানালা দিয়ে বাইরের জমাট বাধা অন্ধকার দেখতে ভালো লাগছে। এর পর আঙ্কেলের সাথে আর কথা হয়নি। কথা বললেই বিপদ। আমাকে নিয়ে কী ভাবা শুরু করে দেবেন তা ধারণা করার ক্ষমতাও নেই আমার। সন্ধায় আমার খিদে পেয়ে গেল। একটা সিদ্ধ ডিম খেলাম। পানি খেতে গিয়ে দেখি পানির বোতল খালি। আঙ্কেলের হাতে একটা বড় পানির বোতল। কিন্তু উনার কাছে পানি চাওয়ার সাহস হলো না।

সিদ্ধান্ত নিলাম দরকার হলে পানি না খেয়ে মারা যাব, কিন্তু উনার কাছে পানি চাওয়া যাবে না। এদিকে পানি না খেয়ে আমার হেঁচকি উঠে গেল। আঙ্কেল নিজেই পানির বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন – “এই নাও পানি। বোকা ছেলে। পানি নাই বলবা তো। ” আমি বললাম -“ ধন্যবাদ আঙ্কেল। ”উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বললেন -“ আরে ধন্যবাদ দেয়ার কি আছে? ইটস ওকে।” আমি উনার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। হাসির জবাবে উনিও হাসলেন। কিছু একটা বললেন। আমিও উনাকে কিছু একটা বললাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত