ক্ষিধার জ্বালায় আম্মারে কইলাম, “ মায়া ভাত দে। আর থাকতে পারতাছি না। ” আম্মা জবাব দিলো, “ ঘরে থাকলে না দিতাম! মুড়ি আছে খা! ”
“ মুড়িতো খাইয়া শেষ করছি কালকাই! ”
আম্মা আমার দিকে এমনভাবে তাকাইলো৷ মনে হইলো চোখে আজরাইল দেখছে! আম্মার এই চাহনি দেইখা বুইঝা গেছি যে ঘরে অবশিষ্ট আর কিছুই নাই! আমি নাহয়ে পেটে বান দিয়া থাকতে পারুম৷ আমার ছোট বইনটার পেটে তো আর বান দিতে পারি না। আমার কলারে টান দিয়া সে কইলো, “ ভাই আমার পেট ব্যথা করতাছে। কিছু আইনা দেওনা খাই। ”
বইনের দিকে চাইতে পারতাছি না। ওর চোক্ষের দিকে তাকাইলে আমার ভিতরটা কেয়ামত হইয়া যায়। ছোট্ট একটা মেয়ে কী আর বুঝে লকডাউন? সে কী বুঝে করোনা কী? তিন দিন হইয়া গেছে ওর পেটে তিনবেলা ডালের পানি দিয়া ভাত আর মুড়ি ছাড়া কিছুই পড়ে নাই! আম্মা দেখলাম আমাদের কথা শুইনা পাতিলের কাছে গেলো। সবকটা পাতিলের ঢাকনা তুইলা নাড়া দিয়া দেখতাছে। কোনো পাতিলেই যে কিছু নাই তা আমি আম্মার চোখ দেইখাই বুঝছি।
বইন আবার কইলো, “ ভাই, যাওনা তুমি টাকা নিয়া আসো, চাউল নিয়া আসো। কুলেন্তিন (কুরেন্টাইন) তোমারে কিছু করতারবো কী? ”পরশু বাইরে গেছিলাম। পুলিশের দৌড়ানি খাইয়া আর বাইর হই নাই। কিন্তু এখন দেখতাছি বাইরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। ঘরে একটা টাকাও নাই! দরজা খুলার লগে লগে আম্মা কইলো, “ কই যাস? ”
“ দেখি কোনো কাজ পাই কিনা। খাইয়া তো বাইঁচা থাকতে হইবো নাকি? ”
“ পুলিশে মাইরা যদি হাসপাতালের কাম লাগায় তখন তো তিন জনেরই মরণ লাগবো! ”
“ আয়েশার লাগি কমপক্ষে তো কিছু আনা লাগবো? ” আম্মা আর কিছু কইলো না আয়েশার দিকে তাকাইয়া। গল্লি থাইকা বাইর হওয়ার পরই সামনে পুলিশ!
“ কই যাস? ”
“ আমার ছোট বইন না খাইয়া রইছে কাল থাইকা। কাম খুঁজতাছি! ”
“ না খাইয়া মানুষ মরে না, করোনায় মরে। এই কথা কী জানস না? আজকে তোর হইলে কালকে তোর বোনের হইবো। তোর মার হইবো। পরে কী করবি? ”
“ মইরা যামু স্যার। আমাদের মতো বস্তির মানুষ মারা গেলে দেশের লাভ ছাড়া লস নাই স্যার। “
“ এখন পরিস্থিতি খারাপ। গল্লিতে ফিইরা যা। নাইলে মাইর খাইতে পারস। ”
“ আল্লার দোহাই লাগে স্যার। গায়ে একটা টুকা দিলে উপরওয়ালা সইবো না। সিদা মারা যাইবেন। ”
পুলিশ কী ভাইবা কইলো “ যা বেটা। সামনে যাইয়া ঠিকই সেনাবাহিনীর হাতে মাইর খাবি। আমার কথা তো শুনলি না।
মেইন রোডে যাইতে না যাইতে পুলিশ ভাইয়ের কথা ঠিক হইয়া গেলো! দুইজন সেনাবাহিনী আমার দুইপাশে দাঁড়াইয়া কইলো, “ কই যাস? ”
“ ছোট বইন না খাইয়া রইছে কাল থাইকা৷ আমি তো চোখের সামনে বইনরে না খাইয়া মইরা যাইতে দেখতে পারি না স্যার! ”
“ এখন তোকে লাঠি দিয়ে পিটাইলে তোর বোনের খাওয়া হইবো? ”
“ মারবেন মারেন, তার আগে বইনের খাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দেন। ” ড্রাইভার ভিতর থাইকা কইলো, “ এইসব নেশাখোর। বইনটইনের কথা কইয়া এখনই জোয়া খেলায় লাগবো। ” জীবনের মায়া ছাইড়া দিয়া কইলাম, “ স্যার আপনার মাইয়া কী কোনোদিন না খাইয়া থাকছে? ”
“ তোর তো বেটা সাহস কম না! ”
“ মরণ দরজায় আইসা ঠকঠকাইলে মানুষের এমনেই সাহস হইয়া যায় স্যার! ”
“ কী কাজ জানোস তুই? ”
“ যেই কাজই পাই, সেই কাজই করি। ট্যাকা লাগবো ব্যাস! ”ড্রাইভার পকেট থাইকা পাঁচশো ট্যাকার একটা নোট বাইর কইরা কইলো, “ এইদিকে আয়। ” আমি সামনে আগাইয়া গেলাম।
“ এই টাকা দিয়া যা পারস কিইনা লয়া যা৷ আর শোন, আমার ওয়াইফ আর মেয়ে, সেপ্টেম্বরে এক্সিডেন্টে মারা গেছে!চারজন সেনাবাহিনী আবার গাড়িতে উইঠা চইলা গেলো। আমি পাঁচশো ট্যাকা লইয়া চিন্তা করতাছি কাজটা ঠিক করলাম নাকি? কিন্তু আজকে আয়েশার পেটে কিছু না পড়লে ও মারা যাইবো ঠিক! ট্যাকা লইয়া বস্তিতে ফিইরা আসলাম। মোদির দোকান থাইকা চাইল, ডাইল, আলু আর পেঁয়াইজ লইয়া ঘরে আইলাম। ছোট বোন আমার হাতে এগুলা দেইখাই দৌড় দিয়া ঝাপটাইয়া ধইরা কইলো, ভাই তুমিই সুপালমেন, আমি জানতাম তুমি বাইরে গেলে খালি হাতে আইবা না! আম্মা তো কান্না করতাছিলো!