কৃষ্ণচূড়ার লাল রং

কৃষ্ণচূড়ার লাল রং

আমি যতদূর জানি মেয়েরা বিয়েতে বাবার বাড়ি ছাড়ার সময় কান্নাকাটি করে।কিন্তু,আমার সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিলো আমার সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী।কান্না তো দূর তার চোখে এক ফোঁটা পানিও দেখলাম না।তার মানে এই না যে সে খুব হাসি খুশি ছিলো।তার চেহারা ছিল ভাবলেশহীন।যেন সুখ -দু:খ সকল অনুভূতির বাইরে একটা রোবট সে।

তার চরিত্র যে পুরো রোবটের মতো এর প্রমাণ বাসর রাতে আরো জোরালো ভাবে পেলাম।আমার বিয়েটা হয়েছে বাবা মায়ের ইচ্ছায়।তারা জানেন যে বুকের উপর পাথর চেপে আমি বিয়েটা করেছি।তাই ফুলসজ্জা নিয়ে ফাজলামি করার মুডে আমার কোনো ভাই বোনই ছিল না। যাই হোক,যে ঘরে আমার আর নতুন বউয়ের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সে ঘরে ধাক্কা দিয়ে আমি দেখি দরজা ভিতর থেকে লক করা।আমি অবাক হই।এরপর নক করি।ভিতর থেকে সে প্রশ্ন করে,কে?? আমি বললাম,আমি সে আবার বললো,কে আমি?

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এ আবার কেমন সার্কাস?তবু মুখে বললাম, তানবীন। এরপর আমার ওয়াইফ দরজা খুললো।আমি ভিতরে ঢুকায় দরজা আটকালো।তাকে দেখে আমার চোখ চরকগাছ হয়ে গেল।সারি,গহনা খুলে সাদা মাটা একটা কামিজ আর প্লাজো পরে আছে।বাসর রাতে নাকি মেয়েরা লজ্জায় কুঁকড়ে থাকে।মাথায় দেড় হাত ঘোমটা টেনে বসে থাকে।বরেরা এসে সে ঘোমটা সরায়।এরপর মেয়েরা স্বামীর পা ছুঁয়ে সালাম করে।এসব মেবি মুভিতেই হয়।অন্তত আমার বউকে দেখে তো তাই মনে হয়।কারণ সে এখন খাটের উপর বসে বসে একটা বই পড়ছে।বইয়ের নাম ‘বি.সি.এস প্রস্তুতি’আমি শুনেছি সে বি.সি.এস. ক্যাডার ।তাহলে এই বই কেন কে জানে?আমি ভেবে রেখেছিলাম বউয়ের সাথে বেশি ভালো ভাবে কথা বলবো না।

একটু রাগ টাগ দেখাবো।কিন্তু এই মেয়ের সাথে ইম্পসিবল!যদি আমার বউ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলতো আমার বিএফ আছে তাহলে ধমকানো যেতো।কিংবা যদি আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক বিহেভ করতো হঠাৎ বউ ওরফে রোবট আমার দিকে তাকিয়ে বললো,হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?শুয়ে পরো।অনেক জার্নি হয়েছে একটু খানি ঘুমাও। তার সম্বোধন দেখে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।কিছু বলতে গিয়েও পারলাম না।ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পরলাম।ওর চোখে চোখ পরায় আবার বললো,’ঘুমাও।নাকি ফুলসজ্জা -টুলসজ্জা করতে মন চাইছে?চাইলে করতে পারো ।আই হ্যাভ নো প্রবলেম।’ আমি মনে মনে বললাম,’থাক আপা চলবে আপনি বি.সি.এস. প্রস্তুতি ই পড়েন।

পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরলাম।স্বপ্নে দেখলাম,আমার কৈশোর কালীন সময় টা।সেসময়কার মতো আমি আর নীরু খাল পাড়ে বসে মাছ ধরছি বড়শি দিয়ে।আমার টায় বারবার মাছ আসছে কিন্তু নিরুর টায় আসছে না।ও রেগে গিয়ে বললো,আয় তানবীন আমরা জায়গা বদলাই।তুই যেখানে ছিপ ফেলছিস সেখানে বেশি মাছ।জায়গা বদলানোর পরেও দেখা গেলো আমার বরশিতেই মাছ উঠছে।নিরু মুখ গোমরা করে তাকিয়ে আছে।কি মিস্টিই না লাগছে ওকে দেখতে! হঠাৎ ও চেঁচিয়ে বললো,মাছ টোপ নিয়েছে বলে ছিপ তুলে দেখলো একটা ব্যাঙ।আমি হো হো করে হেসে দিলাম।হঠাতই আমার বুকে কোনো কিছুর বারি অনুভব করলাম।চোখ মেলে দেখি স্বর্ণা(আমার স্ত্রী)বই দিয়ে আমার বুকে বারি দিচ্ছে।আমি তাকানোর পর বললো,ভূত টুত আছে নাকি সাথে?এরকম হাহা হিহি করছো কেন?
আমি বুঝলাম স্বপ্নের হাসি বাস্তবেও হেসেছি।

এভাবে দুই দিন কাটলো।কিন্তু স্বর্ণার সাথে আমার কোনো রকম সখ্যতাই হলো না।ও নিজের মতো সকালে হাসপাতালে যায় ;সন্ধায় ফিরে।নামাজ পরে,খেয়ে দেয়ে বি.সি.এস প্রস্তুতি কিংবা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে পড়তে বসে।রাত একটু বাড়লে বসে রং তুলি নিয়ে।এরপর কিসব ছাতার মাথা আঁকে।এসব নাকি আবার খুব দামে বিক্রি ও হয়।আমাকে যদি কেউ বলে,ভাই আপনি এই ছবিটা নেন টাকা দিতে হবে না দরকার হলে আমি আপনাকে টাকা দিবো;তাও তো আমি নিবো না। কয়েকদিন পর মা বললো,তোর বউ ডাক্তার ঠিক আছে।তাই কি ঘরের কাজে একটু খানি হাত লাগাবে না? একথা মনে হয় মহারাণীর কান পর্যন্ত পৌঁছেছে।এরপরের দিন সে এসে বললো,মা আপনার একা কাজ করতে খুব কষ্ট হয় তাই না? আমার মা খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো।বললো ,হুম গো মা। সে বললো,আমি একজন কাজের মেয়ে ঠিক করেছি।অনেক ভালো।আপনাকে হেল্প করবে। মায়ের মাথায় যেনো বাজ পড়লো।ঘরের কাজ করবে ঝি? চোখ দুটো কটমটিয়ে বাবার দিকে তাকালো মা।

কারণ বাবাই স্বর্ণাকে পছন্দ করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে। বাবা অপরাধী দের মতন বললো,’আচ্ছা,কাজের লোক কাজ করলে কি এমন প্রবলেম? মা চলে গেলেন। এরপর কিছুদিন যেতে অবশ্য মায়ের সাথে স্বর্নার ভাব হয়ে গিয়েছিল।একদিন বিকালে মাকে বললাম,এক কাপ চা বানিয়ে দিতে।মা বললো,পারবো না।তোর বউ আছে না?বউকে বল। রুমে এসে দেখি সে ছবি আঁকছে।আমি ইতস্তত করে বললাম,একটু চা যদি সে বললো,চা বানাবে?ঠিক আছে তাহলে আমার জন্যেও এক কাপ বানিও। মেজাজ পুরো বিগড়ে গেলো। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।এরপর একদিন মা স্বর্ণাকে বলছিল,একটা নাতি নাতনির মুখ দেখতে পারলে তবে শান্তি পেতাম।

স্বর্ণা সাথে সাথে বলে উঠলো,সে আশা আপনার পূর্ণ হবে না। মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন ,কেন ? স্বর্ণা বললো,আপনার ছেলে তো আমাকে আজ অব্দি টাচও করেনি। আমার মাথায় পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।রোবট এটা কি প্যাঁচ লাগালো? এরপর বাবা আর মা মিলে ইচ্ছে মতো আমাকে ধোলাই করলো,তাদের একটাই কথা :নিরুপমা ডাইনিটাকে এখনো ভুলতে পারিস নি? তাদের আর আমি কি বলবো? ভেবেছিলাম স্বর্ণাকে বকবো।কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।এরপর ট্রান্সফার এর কারণে আমরা ঢাকা চলে এলাম।আমি প্রথমে রাজি হইনি।কিন্তু বাবা,মা জোর করলো যে স্বর্ণা আর আমি একা থাকলে অান্ডার্স্ট্যান্ডিং ভালো হবে। কিন্তু যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেলো।তবে মাঝে মাঝে বলে,তুমি চাইলে আমার সাথে গল্প করতে পারো।

আমি রাতে শুলেই নিরুর চিন্তা মাথায় চলে আসে।ওকে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারিনি।কিভাবে তাড়াবো?ও যে আমার প্রথম প্রেম ছিলো।ছিলো এক বসন্তের দমকা হাওয়া যা আমাকে ওলট পালট করে দিয়েছে। আমি আর নিরুপমা সম্পর্কে ছিলাম চাচাতো ভাইবোন।আমাদের বিশাল বাড়িটার একপাশে ওরা আর অন্য পাশে আমরা থাকতাম।বলে রাখি আমাদের আর চাচাদের সম্পর্ক ততোটা মধুময় ছিল না।শুধু প্রতিযোগিতা হতো উভয়পক্ষের মধ্যে।সেসব কথা থাক। নিরুপমা আর আমি সেইম ক্লাসে পড়তাম।রোজ সকালে স্কুল যাওয়ার সময় দাদি আমার আর নিরুর হাতের কনিষ্ঠা আঙুলে কামড় দিয়ে দিতেন।তার ধারণা আমরা দুজন সুন্দর বিধায় আমাদের উপর নজর টজর লাগতে পারে। স্কুল যাওয়ার পথে আমি নিরুকে ক্ষেপাতাম।বলতাম ,তোর উপর কে রে নজর দিবে পেত্নী কোথাকার।

ও রাগে লাল হয়ে যেতো।বলতো,দাড়া আজকে তোর নামে স্যারের কাছে বিচার দিবো।তুই আমারে পেত্নী বলছিস।আমি ওকে আরো ক্ষেপাতাম।ও বলতো ,বিচার না যদি দিছি তো আমার নাম আর এরপর যথারীতি ক্লাস শুরু হলে আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম ও না বিচার দেয়।কিন্তু ও দিতো না।ছুটির সময় আমি আবার ওকে বলতাম,কিরে আমারে এতোই ভয় পাস যে বিচার দিলি না? ও কিচ্ছু বলতো না।হয়তো হঠাৎ আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতো,দেখ তানবীন কৃষ্ণচূড়া।আমাকে পেরে দিবি। ও আমার হাত ধরলে বুকের ভিতর একটা অন্য রকম শিহরণ কাজ করতো।সেই শিহরণের চোটেই মনে হয় ঐ উঁচু কৃষ্ণচূড়া গাছটায় উঠে ফুল পেরে আনতাম।নিরু বিনুনিতে গাঁথতো সেই ফুল।

ছোট ছোট পাপড়ি গুলো দিয়ে নখ বানিয়ে আমাকে ভয় দেখাতো।সেই দিনগুলো খুব মিস করি।একবার হলো কি বাবা আমার জন্য একটা সাইকেল কিনে আনলেন।বললেন এখন থেকে এটা চালিয়ে স্কুলে যাবি।খবরদার নিরুকে সাইকেলে তুলবি না।এরপর দুদিনেই সাইকেলের বারোটা বাজিয়ে আমি আবার নিরুর সাথে স্কুল যেতাম।ও জিজ্ঞেস করলে বলতাম,তুই কোথাকার মহারাণী ভিক্টোরিয়া যে তোর জন্য আমি সাইকেল নষ্ট করবো? স্বপ্নে দেখতাম ও সারি পরে আমার সামনে আসে।একদিন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম,নিরু সারি পরবি? নিরুও পটাপট উত্তর দিলো,আমি কি তোর বউ নাকি যে তোর কথায় সারি পরবো? আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।কিন্তু সেদিন দুপুরেই ও সারি পরলো।নিলু আপা জিজ্ঞেস করলো হঠাৎ সারি কেন?

ও আমার দিকে লাজুক দৃষ্টিতে তাকালো।সেই চাহনি আমাকে পাগল করে দিল।আমরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলাম।আসলে আমিই পরেছিলাম ও নয়।ও আমাকে দিয়ে ওর প্র্যাকটিক্যাল করাতো ।বাড়িতে যা ভালো রান্না হতো তাই ওকে লুকিয়ে দিয়ে আসতাম।এরপর দুই পরিবারের মধ্যে বড় একটা ঝামেলা হয় আর চাচারা খানিকটা দূরে নতুন বাড়িতে গিয়ে ওঠে।তখন আমরা কলেজে পড়ি। আমি ওর সাথে আগের মতো দেখা করতে পারতাম না।ও সন্ধ্যায় একটা প্রাইভেট পড়াতো।অবশেষে সে সময়টুকু আমি আমার সাথে কাটাতে বলি।চাচা যদি টাকার কথা জানতে চায় ওর এমন প্রশ্নে আমি ওকে মাসে মাসে ঐ টাকার সমান টাকা দিবো বলে রাজি হই। বিনিময়ে ও এক ঘন্টা সময় কাটাতো।ঐ সময় টা ওর হাত ধরে বসে থাকতাম।আর স্বপ্ন বুনতাম ভবিষ্যতের। অনেক কষ্ট হতো মাসে মাসে টাকা যোগাতে।তবুও ওকে অনেক ভালোবাসতাম আমি।বিনিময়ে কি পেলাম?

ওর বাবা এক সময় এক পয়সাওয়ালা বিদেশি ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে।বিয়ের পর নাকি ওকেও বিদেশ নিয়ে যাবে।আমি পাগল পাড়া হয়ে যাই।সারাদিন বাবার কাছে কান্না কাটি করতাম।শেষে বাবা বিয়ের প্রস্তাব দেয়।কিন্তু ওরা রিজেক্ট করে।আমি নিরুর পা ধরেও কেঁদেছি আমাকে ছেড়ে যেনো না যায়।কিন্তু ও বোধ করি বিদেশ যাওয়ার লোভটা সামলাতে পারেনি।আমাকে ছেড়ে চলে গেলো অনেক কষ্ট পেয়েছি।পরে অবশেষে বাবা মা’র কথায় বিয়ে করলাম স্বর্ণা নামক রোবটকে।

একদিন স্বর্ণাকে বললাম সারি পরতে ও আমায় বললো,সারি ক্যারি করা খুব হার্ড।বিশ্বাস না হয় তুমি পরে দেখো। আমি প্রস্থান করলাম। এর কদিন পর রাতে অনেক ঝর বৃষ্টি হচ্ছিল।আমি ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিলাম।ওমা দেখি মহারাণী আমায় এপাশ ফিরতে বলছে। ওর নাকি ভয় লাগে।খোটা দিয়ে বললাম,রোবটরা কি ভয় পায়।একটু পর বাজ পরলো।ও ভয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো।কেন জানি ওর জন্য খুব মায়া লাগছিল তখন।খানিক বাদে ও মাথা উঁচিয়ে বললো,তোমার বুকে মাথা রেখেছি বলে তোমার কি প্রবলেম হচ্ছে?

আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।সেদিন বিকালে আমার ইউনি ভার্সিটির এক বান্ধবী বর্ষার সাথে দেখা হলো।ও আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল।আমাকে প্রপোজও করেছিল।বাট আমি নিরুকে নিয়ে কষ্টে থাকায় রিজেক্ট করি।তো ও আর আমি রেস্টুরেন্টে গেছি খেতে।ও খুব অন্যরকম।আমার হাত ধরে টরে কথা বলছে।হঠাৎ পাশের টেবিলে তাকিয়ে দেখি আমার বউ স্বর্ণা আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।কি যে হেজিটেশনে পড়লাম।ভাবলাম বাসায় গেলে হয়তো রাগ দেখাবে।কিন্তু সে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না।

আমার মেজাজ গরম হলো।এতো রোবটগিরী দেখানোর কি আছে?ও এমন ভাব করছে যেনো,বউ রেখে আমি অন্য মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে খাবো এটাই স্বাভাবিক।কোনো মেয়েই তো এটা সহ্য করতে পারে না।আমি রেগে ওকে ধমকালাম,যে ঐ মেয়েটার ব্যাপারে কেনো ও কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বাচ্চাদের মতো কান্না করে দিলো। বললো,আমাকে হয়তো ভালোবাসোনা তুমি।তাই তো অন্য মেয়ের সাথে গেছো।এখন জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? আমারও কেনো জানি কান্না চলে এলো।ওকে বললাম ,ভালোবাসিতো। এরপর একবার আমার বাইক অ্যাকসিডেন্ট হলো।পরে শুনলাম ও নাকি হাসপাতালে সব কাজ ফেলে সারা রাত আমার মাথার পাশে বসে থাকতো।

আস্তে আস্তে ওর সঙ্গে সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হচ্ছিল।তখনই খবর পেলাম।নিরুর সাথে নাকি ওর বরের ডিভোর্স হয়ে গেছে।নিরু নাকি দেশে ফিরেছে।ওর কারণে আমার অনেক চোখের জল ঝরেছে।আসলে কাউকে কাঁদিয়ে কেউ কখনো সুখী হতে পারে না। এতো কিছুর পরও কেন জানি নিরুকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব।কিন্তু এটা তো অন্যায়।খুব ডিস্টার্বড ফিল করছিলাম আমি।তখন হাসি হাসি মুখ করে স্বর্ণা বারান্দায় আসে।হাতে দুটো কফির মগ। আমাকে কফি দিয়ে পাশে এসে বসে ও।হাসি মুখ করে বলে আজ আমি বানিয়েছি বুয়া নয়। আমিও হাসি মুখ করে বললাম,এর জন্যই চিনি বেশি হইছে।

ভেবেছিলাম ওর মুখটা কালো হয়ে যাবে একথা শুনে কিন্তু হলো না।বরং আরেকটু হাসি দিয়ে বললো,তোমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে আমার লজ্জা লাগবে।কারণ আমি হিসাব করে দেখেছি তুমি আমার থেকে এক বছর দুই মাস বারো দিনের ছোট ।কিন্তু তবুও সালাম করবো। আমি কিছু বলার আগেই ও সালাম করে ফেললো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কোনো উপলক্ষ্য আছে? ও লজ্জা পেলো। সত্যি কথা বলতে কি ওর মতো মেয়েকে লজ্জা পেতে দেখে আমি নিজেই লজ্জায় পরে গেছিলাম। ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি ও সারি পরেছে।যদিও সারি পরা ভালো মতো হয়নি।তাই আমি একটু ঠিক করে দিচ্ছিলাম।হঠাৎ ও আমার কানের কাছে এসে বললো,আমাদের একটা বেবি আসবে।তুমি বাবা হবা।

বলেই দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে ছিটকিনি দিয়ে দিলো।আমার কি যে ভালো লাগছিল।এতো আনন্দ মনে হয় জীবনে হয়নি।দরজায় কড়া নাড়লাম।স্বর্ণা ভিতর থেকে বললো ওর নাকি দরজা খুলতে লজ্জা লাগছে।আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।একটু পর ও নিজেই দরজা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেক দিন পার হয়েছে।আর কিছুদিন বাদেই ডেলিভারির ডেইট।স্বর্ণা ছুটি কাটাচ্ছে।আমার ছুটি নেই বলে বাড়ি যেতে পারছিনা।স্বর্ণা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বাদ দিয়ে বাবুর নাম ঠিক করে সারাক্ষণ।এমতবস্থায় একদিন বাড়ি এসে দেখি,নিরু এসেছে। নিরু আমার কাছে এসে বললো,আমি চলে গেছিলাম বলে আর কোনো সুন্দরী মেয়ে পেলে না? স্বর্ণা নিরুর ব্যাপারে কিছু জানেনা।

অনেক বছর পর নিরুকে সামনাসামনি দেখে আমার ঠিক কিরূপ অনুভূতি হয়েছে আমি তা নিজেও বুঝতে পারিনি।নিরু অাগের মতোই সুন্দরী রয়েছে।বরং এখন অাধুনিকতার ছোঁয়ায় আরো বেশি স্মার্ট হয়ে গেছে।নিরু আমাকে প্রথমেই যে কথাটি বললো তা হলো,’আমি চলে যাওয়ার পর আর কোনো সুন্দর মেয়ে পেলি না?’প্রশ্নটা শুনে খানিকটা রাগ হলেও আমার কেন জানি খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো,কেন চলে গেলি আমাকে ফেলে? কিন্তু একথাটা বলা হয়ে উঠলো না কারণ সেসময় ড্রইং রুমে স্বর্ণা আসলো।হাতে ট্রে নিয়ে।আমি বললাম তুমি আবার এই সময়ে এসব করতে গেলে কেনো?বুয়া নেই? স্বর্ণা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,তোমার এতো সুন্দর একটা কাজিন আছে আগে তো বলোনি?

আমি চুপ করে রইলাম।নিরু ট্রেটার দিকে তাকিয়ে বললো,কি স্বর্ণা ভাবী এতো সব খাবার?একবার সব খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করে দিতে চাইছেন বুঝি?আমি কিন্তু এতো সহজে যাচ্ছি না।বলেই হাসলো নিরু। সে হাসি মিষ্টি নয়;মায়াবী নয় বড়ই অদ্ভুদ। স্বর্ণা বললো,ছি: ছি: এ কেমন কথা?তোমার ভাইয়ের বাড়ি তোমার যতদিন খুশি থাকবে। এবার নিরু আবার হাসলো।বললো,কি যে বলেন না ভাবী ,ও বুঝি আমার ভাই?একটা সময় আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে কত…যাই হোক সে গল্প আপনাকে আমি পরে বলবো। আমি স্বর্ণার দিকে তাকালাম।ওর চোখে পানি টলটল করছে। রাতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম ,তুমি কি নিরুর কথায় মন খারাপ করেছো? স্বর্ণা হাসি মুখে বললো,একদমই না।ওরম সুন্দরী কাজিন থাকলে প্রেমে পরাটাই স্বাভাবিক।ওসব কথা ছাড়ো।আচ্ছা টিউলিপ নামটা কেমন?

আমি কিছু বলার আগেই স্বর্ণা নিজে থেকেই বলে উঠলো,না না টিউলিপ রাখা যাবেনা।আমার মেয়েকে সবাই টিউবলাইট বলে ক্ষেপাবে। আমি স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।দিন দিন ওর মধ্যে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বাচ্চাদের মতো খাটের উপর পা তুলে বসে খাতার মধ্যে বিভিন্ন নাম লিখছে।হঠাৎ আমার মনে হলো খাটের উপর স্বর্ণা না নিরু বসে আছে।পরে বুঝলাম ওটা আমার চোখের ভুল।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নিরু নাস্তা বানিয়েছে।সব আমার পছন্দের খাবার।স্বর্ণা অবাক হয়ে বললো,তুমি কেনো কষ্ট করতে গেলে?বুয়া কি আজকেও আসেনি?
নিরু বললো,এসেছিল ।কিন্তু আমি বিদায় করে দিয়েছি।এখন থেকে আমিই রান্না করবো।

স্বর্ণা আর আমি আপত্তি জানালাম কিন্তু নিরু কোনো কথাই শুনলো না।খেতে বসে নিরুর কথার প্রসঙ্গে স্বর্ণা জিজ্ঞেস করলো,তোমার বুঝি স্যান্ডউইচ এতো পছন্দ? আমি কিছু বলার আগেই নিরু বলে উঠলো,ওমা সেকি আপনি জানেন না?কেমন বউরে তোর তানবীন? অফিস যাওয়ার সময় নিরু বললো,অফিস থেকে ফিরে যেনো ওকে নিয়ে ঘুরতে যাই।আমি রাজি হলাম না। শেষে বিকালে অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি নিরু দাঁড়িয়ে আছে।পড়নে নীল রঙের একটা শাড়ি।নীল আমার খুব প্রিয় রং ছিলো।একবার কলেজ লাইফে বাবার আলমারি থেকে টাকা চুরি করে নিরুকে একটা নীল শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম।কি তুলকালাম কাণ্ডই না বেঁধে ছিল এই কারণে।

আমি নিরুর এখানে আসার কারণ জানতে চাইলাম।ও বললো,ওকে নিয়ে শপিং করতে যেতে হবে। না যাওয়ার জন্য আমি বললাম,আমার কাছে টাকা নেই।কিন্তু ও বললো ও টাকা নিয়ে এসেছে।অগ্যতা আমাকে যেতেই হলো।অনেকদিন পর দুজন রিকশায় উঠেছি।নিরু হঠাৎ আমার হাত ধরলো।আমি হাত সরিয়ে নিতে চাইলে ও আরো শক্ত করে ধরলো।বললো,চিন্তা করিস না।সারা জীবনের জন্য তো আর ধরতে দিচ্ছিস না। আমি বললাম,সারা জীবনের জন্যই তো ধরতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই তো দিলি না। নিরু বললো,এখন ধর। আমি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলাম। নিরু শব্দ করে হাসলো।আর বললো,মজা করেছি বুদ্ধু।তোর তো দেখি বউয়ের জন্য খুব মায়া হয়ে গেছে।এতোই ভাল্লাগে ওকে?আমার তো একটুও ভাল লাগলো না।কেমন বুড়ি বুড়ি দেখতে।

– চুপ কর নিরু।
– কেন?তোর কষ্ট হচ্ছে বুঝি?বাট এটা তো সত্যি।ওকে একদমই ভালো লাগে না।

এবার আমি নিরুকে খানিকটা জোরেই ধমক দিলাম।ও দেখি কান্না করে দিয়েছে। আমি স্যরি বললাম।চোখের পানি মুছে নিরু বললো,তুই কেনো স্যরি বলছিস?দোষ তো আমার।আমি অন্যায় করেছি।আর সেই অন্যায়ের ফল ভুগছি এখন।

– থাক না এসব কথা।
– কেনো থাকবে ?আমি খুব খারাপ খুব।টাকার জন্য তোকে ছেড়েছি।আজ দেখ কত কষ্ট পাচ্ছি।আমি ভুল করেছি তানবীন।

ওর কান্নায় আমার চোখের কোনেও পানি জমলো। ও আবার বললো,তুই ভাবিস না।আমি তোর সংসার ভাঙ্গার জন্য আসিনি।কটা দিন তোর কাছে থাকতে দে প্লিজ।আমি তোদের সব কাজ করে দিবো।তোদের ঘরের কোণায় পরে থাকবো।তবুও তাড়িয়ে দিস না।বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না।ওখানে সবাই আমাকে খুব কথা শোনায়।আমার কষ্ট হয় খুব। আমি নিরুকে বললাম,তোর যতদিন খুশি ততদিন থাকিস।কোনো প্রবলেম নেই। নিরু বললো,কিন্তু তোর বউ যদি…..

– আরে নাহ! স্বর্ণা খুব ভালো।

নিরু অনেক কিছু কিনেছে শপিং মল থেকে।কিন্তু সবই আমার ,স্বর্ণার আর বাবুর জন্য।শেষে আমিই ওকে শাড়ি কিনে দিলাম। স্বর্ণা প্রথমে গিফট গুলো খুব খুশি হলো।কিন্তু যখন শুনলো এগুলো নিরু কিনেছে তখনই ওর মুখটা কালচে হয়ে গেলো।আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,তোমার কাছে বুঝি টাকা ছিলো না? ওর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।এটা আবার কেমন কথা ?নিরু শখ করে কিনে এনেছে। অল্প কদিনের মধ্যেই স্বর্ণার ব্যবহার কেমন বদলে যাচ্ছিলো।ও নিরুর সাথে ভালো করে কথাও বলে না। একদিন সকালে দেখি ,নিরু কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গুছাচ্ছে।আমি কারণ জিজ্ঞেস করায় নিরু বললো,স্বর্ণা নাকি আমার মা’কে ফোন করে নিরুর কথা বলেছে।তাই মা নিরুকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। আমি রেগে গিয়ে স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলাম এসব কি? ও বললো,যা করেছি আমাদের সংসার বাঁচাতে করেছি। আমার এতো রাগ উঠলো….

– মানে কি?নিরু থাকলে আমাদের সংসার ভাঙবে?
-হুম।নিজের সংসার নষ্ট করে আমার টা নষ্ট করতে এসেছে।
– স্বর্ণা।আরেকটা বাজে কথা বলবে না।নিরু তুই কোথাও যাবিনা।

স্বর্ণা আমাকে বললো,রুমে এসো।আমি আলাদা করে তোমার সাথে কথা বলবো। কিন্তু সে সময় রেগে থাকার কারনে আমি ওকে আরো দু চার কথা শুনিয়ে দিলাম।স্বর্ণাও নিরুকে যা নয় তাই বলছিল। এক পর্যায়ে রাগের মাথায় বলে ফেললাম,নিরুর তো তোমার সাথে থাকতে সমস্যা হচ্ছে না।তাহলে তোমার হচ্ছে কেনো?যার সমস্যা হবে সে চলে যাবে।

আমার একথাটা বলা উচিৎ হয় নি।স্বর্ণা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো আমার এইরকম আচরণে।আমি আসলে ওকে কষ্ট দিতে চাই নি।কিন্তু সেদিন অফিস থেকে ফিরে শুনি স্বর্ণা চলে গেছে।আমি মাকে ফোন করে জানলাম ,ও আমাদের বাড়ি যায়নি।পরে সাথে সাথেই নিরুকে বাসায় রেখে আমি স্বর্ণাদের বাসায় গেলাম। স্বর্ণার বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,ওর আর আমার মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে কিনা?আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না।স্বর্ণার রুমে গিয়ে দেখি ও বসে বসে ছবি অাঁকছে।আমি বললাম,এসব কি স্বর্ণা? ও বললো,এতো রাগ হয়েছিল না তোমার উপর।তুমি নিরুর পক্ষ নিয়ে কথা বলছিলে তাই!কিন্তু এখন যে তুমি নিরুকে ফেলে চলে এসেছো আমার অনেক ভালো লাগছে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না।এর দুইদিন পর ওর পেইন উঠলো।সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পরলাম।তখনই হঠাৎ নিরুর কল এলো।নিরু নাকি খুব অসুস্থ।আমি ওর ভয়েস শুনে বুঝলাম আসলেই ও অসুস্থ।নিরু খুব কান্নাকাটি করছিল।
অবশেষে,আমি ঢাকা চলে আসি।এই কারণে আমার মা -বাবা দুজনেই আমাকে খুব বকাবকি করে।কারণ বাচ্চা হওয়ার সময় আমি স্বর্ণার পাশে থাকিনি।পরে ঐ দিনই নিরুকে নিয়ে বাড়ি ফিরি।ওকে একা রেখে আসতে ভরসা হচ্ছিল না আবার যদি অসুস্থ হয়ে যায়। বাড়ি আসার পর স্বর্ণা আমার সাথে একটাও কথা বলেনি।ইভেন,আমার ধারে কাছেও আসছিলো না।

আমাদের বাড়িতে আবার একটা ঝামেলা বাঁধলো।নিরুর বাবার সাথে আমার বাবার।আমার বাবা নিরুদের অনেক অপমান করলো।আমারও স্বর্ণার সাথে বেশ কয়েকবার ঝগড়া হলো।বাবা হওয়ার আনন্দ টা যেনো কিসের নিচে চাপা পরে গেলো। আমি নিরুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম।তবুও স্বর্ণা আমাকে সন্দেহ করতো।সবকিছু বিরক্ত লাগছিল।মনে হচ্ছিল ,সব ছেড়ে যদি পালাতে পারতাম! এভাবেই দিন কাটছিলো।হঠাৎ পাড়ার একটা বাচ্চা এসে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেলো।নিরুর লেখা।চিঠীর সারমর্ম এই যে নিরু সুইসাইড করবে। আমি তারাতারি নিরুদের বাসায় গেলাম।দাদির কাছে শুনলাম ও নাকি আমাদের পুরানো বাড়িতে গেছে।ওখানে পৌঁছুতেই দেখি ও গলায় দড়ি দিচ্ছে।আমি সময় মতো না আসলে হয় তো স্বর্ণাকে যখন নিরুর সুইসাইড এর ব্যাপার টা বললাম ও খুব অদ্ভুদ ভাবে হেসে উঠলো। বললো,আসলেই তুমি বোকা।

– মানে?কি বলতে চাও তুমি?
– ওগুলো সব নিরুর চালাকি।

ও যদি সত্যিই মরতে চাইতো তাহলে বুঝি তোমাকে চিঠী লিখতো।আর দাদিকেও বলে যেতো যে ও কোথায় যাচ্ছে?ওর এই সামান্য নাটকটা তুমি ধরতে পারছো না?না ধরতে চাইছো না? আমার খুব রাগ লাগলো স্বর্ণার কথা শুনে।একটা মানুষের মরণ নিয়েও ওর সন্দেহ? স্বর্ণা আবার বলে উঠলো,নিরু আস্ত শয়তান একটা।তোমার মা যে সিরিয়াল দেখে সেই সিরিয়ালের ভিলেনদের পার করে গেছে ও। বলেই হাসতে লাগলো স্বর্ণা।

– তোমাকে কিচ্ছু বলবো না আর তানবীন।সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম।

দেখি কে জিতে;আমার ভালোবাসা না নিরুর ষড়যন্ত্র আমার স্বর্ণার প্রলাপ শুনতে ভালো লাগছিলো না।আগে তো ও এমন লেইম ছিলো না। বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে।স্বর্ণা ওর বাবার বাড়ি চলে গেছে।মা -বাবা কেউই আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে না।আমি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আরো কিছু দিন আগে রোজকার মতোই স্বর্ণার সাথে ঝগড়া হচ্ছিল।স্বর্ণা আমাকে সারাক্ষণ নিরুকে নিয়ে কথা শোনায়।এক পর্যায় সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলো স্বর্ণা।তাই রাগের মাথায় ওকে একটা চড় দিয়ে ফেলেছিলাম।আমি মানছি আমি অন্যায় করেছি।কিন্তু তার জন্য ক্ষমাও তো চেয়েছি।কিন্তু স্বর্ণা জেদ করেই গেলো।

আসলে কত টাকা বেতন পায় সে।হয়তো এ জন্যই অহংকার দেখাচ্ছে।তবে আমার মন ওকে এরকম ভাবতে একদমই নারাজ।কাল ফোন করায় ও বলেছে আমাকে নাকি ওর লাগবে না নিরুও সারাক্ষণ স্বর্ণার নামে আজে বাজে কথা আমাকে বলতে থাকে।কখনো কখনো মনে হয় নিরুই ঠিক। এরপর একদিন নিরু আর আমি ঘুরতে বেরিয়েছি।ও হঠাৎ বললো,তোকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে রে! জানিনা কেনো আমি ওকে এলাউ করলাম।কিন্তু ওকে জড়িয়ে ধরার পর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আমার।স্বর্ণার চুলের ঘ্রাণ খুব মিস করছিলাম। আমি নিরুকে ছেড়ে দিলাম।কিন্তু ও আমার পিছনে পরেই রইলো।সারাক্ষন বলছে ,ওর পাশে যেনো সবসময় থাকি।

আমি বুঝলাম সে ইনডিরেক্টলি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। খুব দোটানায় পরে গেলাম আমি।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।নিরু আমায় সময় দিলো ,চিন্তা করার আমি ওর সাথে থাকবো কিনা। এরপর অনেক চিন্তা করে ঠিক করলাম নিরুর কাছে ফিরবো।কিন্তু মা,বাবা,আমার মেয়ে? স্বর্ণা কিছুতেই আমার মেয়েকে দিবে না।আর ও নিজেও ফিরবে না। নিরুকে জানাবো ,আমি ওর প্রস্তাবে রাজি এই কারণেই ফোন হাতে নিলাম। ঠিক সে সময় স্বর্ণা কল করলো।বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠলো।ফোন ধরার পর স্বর্ণা কিছু ক্ষন চুপ থাকলো।

– স্বর্ণা….
– শোনো বর্না(আমার মেয়ে)না আজ প্রথম কথা বললো।আর ও বাবা ডাকলো।সারাদিনই বাবা বাবা করছে।তুমি একটু আসবে ?

দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।কি অন্যায় টাই না করতে যাচ্ছিলাম! নিজের উপর খুব রাগ হলো। নিরুকে না সূচক উত্তর লিখলাম ম্যাসেজ এ।এরপর স্বর্ণাদের বাসায় গেলাম।দেখলাম ও পুরো পাকা গিন্নি হয়ে গেছে।একদম ব্যস্ত গৃহিণীদের মতো শাড়ি পরে আঁচল কোমরে গুজে রেখেছে।চুল গুলো চূড়া করে বাঁধা।কিন্তু অবাধ্য কিছু চুল বারবার মুখের সামনে আসছে।ও একদম ঘেমে টেমে অস্থির হয়ে আছে।ওর মা জানালো ,আজকের সব রান্না ও নিজে করেছে।বর্ণাকে কোলে নিলাম।আসলেই অস্ফুট স্বরে বা..বা..বা..বা বলছে সে।আনন্দে কান্না করে দিলাম।একটা ছেলের কাছে এর থেকে খুশির আর কি হতে পারে। স্বর্ণা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।বললো,তোমার মেয়ে তুমি নিয়ে যাও।স্বার্থপর মেয়ে একটা।নয় মাস পেটে ধরলাম আমি আর উনি একবারো মা বললো না খালি বাবা ..বাবা হুহ! আমি স্বর্ণার থেকে চোখ ফিরাতে পারছিলাম।এতো সুন্দর কেনো লাগছে ওকে বুঝলাম না।মনে হচ্ছে এই মেয়েটার থেকে সুন্দর বুঝি আর পৃথিবীতে কেউ নেই।

আমি স্বর্ণাকে বললাম,হুম মেয়ে যেহেতু আমার নিয়ে তো যেতে হবেই।সাথে মেয়ের মা টাকেও নিয়ে যাবো। এরপর বর্ণাকে বললাম,মামণি তোমার সামনে কথা দিচ্ছি তোমাকে আর তোমার রোবট মাকে আমি আর কক্ষনো কষ্ট দেবো না। স্বর্ণা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।একহাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে রেখেছি আর অন্য হাতে স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরলাম।এর থেকে বেশি আর কি লাগে? আমরা বাড়ি ফিরলাম।পথে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের থেকে স্বর্ণাকে ফুল পেরে দিলাম।ওর চুলে পরিয়ে দিলাম।তখন ফোনে একটা এসএমএস আসলো।নিরু লিখেছে,বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেই তোকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম।ভেবেছি তুই ফিরিয়ে দিলে চলে যাবো।আর তুই ফিরিয়েই দিলি আমি কোনো রিপ্লাই দিলাম না।

অনেক বছর পার হয়েছে।আমাদের মেয়েটা বড় হয়ে গেছে।সেদিন তিনজন বাড়ি এসে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়েছিলাম।সেটাও বড় হয়েছে। স্বর্ণা গাছটাকে দেখে রোজই বলে,কি গাঢ় লাল রং না? আমি বলি,আমাদের ভালোবাসার থেকে কম। ও হেসে ফেলে।এখনো ওকে ফুল পেরে দিই।কিন্তু লাঠি দিয়ে।গাছে ওঠার বয়স শেষ করে ফেলেছি আমি। খুব ভালো আছি আমরা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত