ক্ষনিকের আশ্রয়

ক্ষনিকের আশ্রয়

জীবনের ২৫ টা বসন্ত কাটানোর পর ছাব্বিশতম বসন্তে আমার যুগলে আবদ্ধ হউয়ার লগ্ন এসেছে।একসময় ঠিক যতটা ভাবতাম পাশের মানুষটা কেমন হবে এখন ঠিক ততটায় গা এলিয়ে বেড়ায়।একটা বয়সের পর হয়তো কেমন হবে কি হবে এসব কিছুই প্রভাব ফেলে না বরং কারো উপস্থিতিটায় জরুরি হয়ে যায়।

আমি নীরা.. আমার নীড় খোজা হয়েছিল প্রায় ১০কিলো দূরের দোতালা বাসভবনের দোতালায়।বাবা মা ছেলে দেখতে গিয়েছিলো,ছেলের বাবা মা কেউ নেই, আছে বলতে দুটো ভাইবোন আমার ধারণা একপ্রকার মায়ায় জড়িয়েই তারা হ্যা বলে চলে এসেছে,প্রযুক্তি এতটা এগিয়ে গেলেও এই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ফ্লেভারটাকে নষ্ট করবো না বিধায় আমি তার সাথে ফোনালাপ অবধি করিনি তাতেই বিয়ের দিন পড়ে গেলো

২৬শে বসন্ত,আমার বিয়ে।লাল বেনারসি, ভারী কিছু গয়না,পায়ে হাতে আলতা,চোখে আইকনিক কাজল, মাথায় গাজড়া পরে নিজের মত করে বৌ সেজেছিলাম,নিখিল কে প্রথম দেখে আমি কিছু ক্ষনের জন্য বেশ হতভম্ব হয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম,ওর গাম্ভীর্যতা দেখে ঠিক আমি মুগ্ধ নাকি চিন্তিত বুঝতে পারছিলাম না। মাথায় ঘুরছিল আসলেই এই মানুষটার হাত ধরে জীবনের বাকিটা পথ চলতে পারবো?? গাড়িতে উঠে যাওয়ার পর গুলিয়ে ফেলছিলাম অচেনা চেনার মেলবন্ধন গুলো কে।হিসাব কষছিলাম কতটুক অচেনা কে চেনা করতে হবে আর কতটুক চেনা কে অচেনা,শেষবারের মত আমার মাথায় রাখা বাবার হাতের স্পর্শ টা খানিক বাদে বাদে গলায় দলা পাকিয়ে দিচ্ছিলো।কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিলো চলতে থাকুক গাড়িটা না থামুক কোনো বাড়ির সামনে,এসব ভাবতে ভাবতে সেদিন পুরো রাস্তায় অঝোরে কেঁদেছিলাম

বিকেল নাগাদ গাড়ি পৌছে গেলো,গাড়ি থেকে নামতেই কিছু মানুষ এসে আমাকে ঘরে তুলে নিলো,দোতালা বাসা নিচ তালায় আমাকে মধ্যে বসিয়ে সবাই ঘেরাও করে রেখেছে,কেউ ছবি তুলছে কেউ তাকিয়ে আছে,মূহুর্তের মাঝে দম আটকে যাচ্ছিলো।নিখিলের ছোট বোন সায়মা এসে আমাক দোতালার একটা ঘরে নিয়ে গেল ফুল দিয়ে সাজানো খাট থরে থরে সাজানো ক্যান্ডেল আর চারপাশে একটা মিষ্টি সুগন্ধ,দক্ষিন পাশে একটু খোলা ছাদ,তার সামনে হাইওয়ে হাইওয়ের সামনে ঝাকে ঝাকে কৃষ্ণচূড়া ফুলে নুইয়ে পড়া গাছ।ছাদে এক কোনায় একটা দোলনা সব মিলিয়ে খুব গোছানো একটা সংসার,নিখিল মানুষটায় হয়তোবা গোছালো, এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল,আমায় গুছিয়ে রাখতে পারবে তো!

তখন প্রায় সাড়ে ১২,সময়ের হিসেব তখন ও নেই মাথায় ঘুড়ছে ২৫ টা বছর যাদের বাসায় দিন রাত কেটে যেতো তারা আজ পর,আজ এই অচেনা বাড়িতে আমার রাত পার করতে হবে তাও একটা অচেনা মানুষের সাথে,ভাবলেও দম বন্ধ হয়ে আসছিল।হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন কফির গ্লাস টা হাতে ধরিয়ে বললো, চুমুক দিয়ে দেখেন তো এই অধমের কফির স্বাদ আপনার মুখে রুচবে কিনা আমি চমকে গেলাম।ঠিক যতটা সহজ করে বললে আমার সব দোটানা ঘুচে যায় ঠিক ততটা সহজ মুখের বুলি আর সাথে একটা মানান সই হাসি।কফিটা সেদিন ব্ল্যাক কফি হট কফির মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিল কি জানি কি করে পুরোটাশেষ করেছিলাম।

আমাকে চমকে দিয়ে বললো, নীরা,অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের আগাগোড়া সবটায় বড়দের হাতে ছিল আমরা ছিলাম ননীর পুতুল না জানতাম খাবারের মেন্যু না জানতাম আয়োজনের আড়ম্বরতা,কিন্তু আজ রাত থেকে তো আর সেই বাঁধা ধরা নেই।আমরা সদ্যবিবাহিত স্বামী স্ত্রী এবার শুরু আমাদের অধ্যায়, চলোনা নিজেদের মত গুছিয়ে নেই  কিছুটা থেমে উনি বললো,চলেন আজ রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়,সারারাত ঢাকা শহর ঘুরবো সকাল হতে হতে যেকোনো একটা বাস এ সাজেক আমি বললাম,কিন্তু বাড়ি ভরতি যে মানুষ! উনি বললো,২ টায় সবাই ঘুমাবে আমি বললাম,কাল যে বৌভাত..!

বিয়ে কিন্তু ওই দোয়া পড়ে কবুল বলাটায় বৌভাত গায়ে হলুদ এসব মনুষ্য আয়োজন। বৌভাত না হলে বিয়ে হয়না এমন কিছু আমি শুনিনি তবু একটা’কিন্তু’থেকে গেছিলো বাড়ির বড় বৌ আমি,সংসারটার দায়িত্ব আমার।প্রথম দিন ই দায়িত্বের হেরফের।তারপর সমাজের কিছু মানুষ নিখিল ভাবনার মাঝে দাড়ি দিয়ে বললো লোকে কী বলছে সেটা দিয়ে চললে কীভাবে হবে বলেন…!

হাতটা ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেলো কবুলের কিছু একটা বিশেষ জোর আছে,নিখিলের অধিকারবোধের প্রতি আমার সেদিন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। আরো অবাক হলাম যখন দেখলাম প্যাকিং ওর করায় আছে,মনে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু ইতস্তত বোধ টা কাটিয়ে উঠে মুখ অব্ধি আসছে না কিছুই বিয়েবাড়ি সিড়িতে মেঝেতে চারদিকে গিজগিজিয়ে মানুষ ঘুমোচ্ছে,কারো কোনো হুশ জ্ঞ্যান নেই কয়দিনের ধকলে বেশ ক্লান্ত,আমি আর নিখিল ২ টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।দুইতিনটে কুকুর ছাড়া রাস্তার আনাচে কানাচে কেউ নেই।

চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছি দুজন,প্রায় সোয়া এক ঘন্টা পার করে প্রথম বুলি ফুটলো, বললাম এই যে প্যাকিং করে রেখেছিলেন যদি রাজি না হতাম নিখিল বললো, আমি মেয়েটার চোখের গভীরতা পাসপোর্ট সাইজের ছবি থেকে টুকে নিয়েছিলাম এ নিয়ে কোনো দ্বন্দ ছিল না আমার  ইতস্তত বোধটা প্রায় কেটে গেছে আমি বললাম এই যে বাড়িটার নাম ক্ষনিকের আশ্রয়,তবে আমার আশ্রয় টুকু কি ক্ষনিকেই সীমিত..! সময় কী বুঝে,ক্ষনিক কতটুকু..!আপনি সময় টাকে নিজ দায়িত্বে বাড়িয়ে সেটাকেই ক্ষনিক বানিয়ে নিবেন

আমি বললাম ভাবা যায়,যেই মানুষটাকে দেখলে মনেই হয় না সে কথা বলে,সে এত কথা জানে..! উনি বললো, ধরে নিন,এই গম্ভীর ধরনের মানুষটা এতদিন ভাবতো এমন কেউ থাকুক তার কথা শোনার শ্রোতা হিসেবে সেই রাতে নিশ্চুপ নগরীতে শক্ত করে ধরার মত একটা হাত আবিষ্কার করেছিলাম।বিশ্বাস করার মত একটা মানুষ আবিষ্কার করেছিলাম সব আবিষ্কৃত জিনিষকে এলোথেলো করে হঠাৎ একদল পুলিশ সামনে এসে বললো,এত রাতে রাস্তায় প্রেম করস??

আমি জানতাম নিখিল ফোন ঘুরালেই এরা স্যার স্যার বলে পথ ছেড়ে দিবে কিন্তু ও নিয়ম মেনে পুলিশ স্টেশন অব্ধি গিয়ে কাগজপত্র দেখিয়ে মাথা উচু করে আমায় নিয়ে বের হলো..প্রায় সকাল, তখন ও ক্লান্তি ছুয়ে উঠেনি আমাদের। হেঁটে চলেছি আমরা,অক্লান্ত পথ হাটার স্বপ্ন দেখছি। ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, এই যে একবলাতে নিজের জীবনের এত বড় একটা রাতে আপনি আমার হাত ধরে চলে আসলেন,একটা অচেনা মানুষকে এতটা বিশ্বাস করে সারাটারাত হেঁটে চললেন,পুলিশের আগমনেও আপনার অটল বিশ্বাসে আঁচ পড়লোনা,ঠিক আপনার মত একটা মানুষের প্রেমে বুঝি রাতারাতি পড়ে যাওয়া যায়,তাই না??

আসলেই প্রেমটা রাতারাতি হয়ে গেছিলো।সেদিন সকালে আমার কাছে সে আর অচেনা ছিলোনা বরং আমার একটা আলাদা জগৎ হয়ে গিয়েছিল..সেদিন আমি এক প্রেমিক পুরুষের সাথে সাজেক গিয়েছিলাম,সেই তো কেবল শুরু আমাদের প্রণয় এর। তারপর কত রাত গায়েব হয়ে এদিক সেদিক ভ্রমন করে চলে এসেছি ততদিনে পুলিশ ও জেনে গেছে এরা দুইটা আস্ত উন্মাদ।চোখের পলকে সেই রাত থেকে আজ ২২ বছর পার করে এই রাত চলে এলো।

ছাদের কিনার ধরে দ্বাড়িয়ে আছি,প্রচন্ড বাতাসে সব ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে।বাইশটা বসন্ত পার করে এসেও এই রাতটাতে এসে আমি প্রতি বসন্তে থমকে যায়,১১ টা বসন্তে সুখের প্রচ্ছদ কাটিয়ে কেন যেন নিখিল অন্য মায়ায় জড়িয়ে পড়লো।রাতারাতি যেমন বিশ্বাস করেছিলাম ঠিক রাতারাতি বিশ্বাসটাকে ভেঙে দিয়েছিলো ১২ তম বসন্তের রাতে নিখিল আর ফিরে আসেনি,শুনেছি নতুন অর্ধাঙ্গিনীর সাথে নতুন সংসার জুটিয়েছে।চিরকুট এসেছিল একবার..লেখা ছিল,

নীরু,
নতুন করে মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি,ভালবেসেছি অন্য এক তিলোত্তমাকে।তোমাকে হয়তো বিধাতা অন্য কারো রঙে রাঙাতে চেয়েছেন..! আমাদের ১১ বছরের সংসারের পর নিখিলের মনে হয়েছিলো আমাকে বিধাতা অন্য কারো রঙে রাঙাতে চেয়েছেন..কি আশ্চর্য ভাবে আমি একটা ভুল মানুষে মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম ভাবলে প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু লাগে না।

তবে একদিন বুঝেছি বিধাতা আসলেই আমার জন্য অন্য কিছু রেখেছিলেন সেরাত অপেক্ষা করছিলাম তোমার তোমাকে আমার অনেকটা গল্প বলার ছিল,তুমি অব্ধি গল্পটা পৌছায়নি বলেই হয়তো আমাদের না হয়ে,অনামিকা শুধু আমার মেয়ে হয়ে বড় হয়েছে।শুধু অনামিকার অজুহাতে তোমাকে ফিরিয়ে আনলে হয়তোবা ভালবাসাটা হারিয়ে যেত, মানুষটায় থাকতো তার চেয়ে বরং আমার কাছে ভালবাসাটুকু থাকুক,,

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত