কেউ কিছুই জানে না

কেউ কিছুই জানে না

ক্রাশের আইডিতে ভয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাইনি। রাস্তাঘাটে,ক্যাম্পাসে যেমন দূর থেকে তাকে দেখি তেমনি ফেসবুকে ও দূর থেকেই দেখি। ক্রাশের কয়েকটা প্রোফাইল পিক আর কভার ফটোই পাবলিক করা। আমার এক বান্ধবীর সাথে তার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে বান্ধবীর সাথে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ালাম। বান্ধবীর নাম রুম্পা। ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে পারলাম ক্রাশ মহাশয় ফেবুতে খুবই একটিভ।

প্রায় ই অনেক স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন। আমার দুর্ভাগ্য! সেসব দেখতে পারি না কারণ সব স্ট্যাটাস বা ছবি আপলোড করে প্রাইভেসি অপশন ফ্রেন্ডস দিয়ে। তবে ওই পাবলিক করা ছবি গুলোই সারাক্ষণ দেখি। কপালে একটা বসন্তের দাগ তার। দাগটার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকি। আর যেটা করি সেটা হলো কোনো মেয়ে ক্রাশের ছবিতে লাভ কিংবা ওয়াও রিয়েক্ট দিলে তাকে কথা শুনিয়ে ব্লক করে দিই। মাঝেমধ্যে বলে দিই আমার বফের ছবিতে লাভ রিয়েক্ট দিবা না। মেয়েগুলোও খুব কম যায় না। কয়েকদিন আগেও একটাকে টেক্সট করলাম,

-“এই মেয়ে এই, লজ্জা শরম নেই পর পুরুষের ছবিতে লাভ রিয়েক্ট দাও। অসভ্য কোথাকার!” মেয়েটা রিপ্লে দিলো,

-“who the hell are you? Amar jamai hoy tai dei. Tumi ke bolar?”

মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। ক্রাশের বাচ্চার জিএফ ও আছে নাকি আবার । বিয়ে করেনি শিওর তবে গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে জানিনা। জানাটাও সম্ভব না। সব ছেলে তো আর পাবলিকলি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না বা ফেবু কিংবা ইন্সটাতে ছবি টবি আপ দেয় না। কি জানি! মন খারাপ করে রিপ্লে দিলাম,

-“আমি তোর সতিন হই রে বদমাইশী!”

বলেই ব্লক করে দিলাম। এরপর থেকে ক্রাশের গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে তাহলে আমার কি হবে? হায় খোদা! এ বিষয়ে হেল্প করতে পারে রুম্পা। রুম্পাকে যা বলার সরাসরি বলতে হবে। আর তার জন্য ভার্সিটিতে দেখা করা লাগবে রুম্পার সাথে। এসব ভেবেই আবারো ক্রাশের প্রোফাইলে ঢু মারলাম। প্রো পিক চেঞ্জ করেছে। মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। ছবিটা জুম করে অনেকক্ষণ দেখলাম। এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি আরেক পাহাড়ের সাথে আকাশ মিলিত হয়েছে সেদিকে তিনি তাকিয়ে আছেন। আগের ছবিটা থেকে এটা ভালো হয়েছে। ছবিটায় ক্যাপশন দিয়েছেন, কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে চোখ ভাঙ্গা ঘুমে তুমি খুঁজো না আমায় আশেপাশে আমি আর নেই।

– অনুপম রায়”

বাপরে! ছবিটা যাস্ট আপলোড দিলো আর এতসব কমেন্টস! মনে হয় সেলিব্রেটি একদম! ছ্যাঁছড়া মেয়ে গুলোর ও ছ্যাঁছড়ামি শুরু হয়ে গেছে। গা জ্বলে যায় একেবারে। একটা মেয়ের কমেন্ট দেখলাম সাথে সাথে ইনবক্সে নক করলাম। “এই অসভ্য মেয়ে! হ্যান্ডসাম কোনো ছেলের ছবি দেখলেই কমেন্ট করতে হবে? তোদের কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই নাকি রে? অসহ্য মেয়েরা যে কোত্থেকে আসে।” মেয়েটাও প্রায় সাথেসাথেই রিপ্লে দিলো,

-“এক্সকিউজ মি! বুঝলাম না।”
-“আহারে আমার অবুঝ শিশুটা। “অনিক হাসান” এর ছবিতে তুমি কেন কমেন্ট করেছো? বেয়াদব নির্লজ্জ মেয়ে!”
-” আশ্চর্য! এই যে তুমি কোথাকার কোন সভ্য যে আমাকে সভ্যতা শেখাতে এসেছো? তোমার নিজের লজ্জা করে না? স্টুপিড! ও আমার ভাই হয় বুঝেছো? আগে নিজে বেয়াদবী ছাড়ো।”

আমি যাস্ট বোকা বনে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে মেয়েটাকে ব্লক করলাম৷ এটা কি করে ফেললাম আমি! যদি ক্রাশকে বলে দেয়! আমার কি হবে! কি করব না করব ভেবে আইডিটাই ডিএক্টিভেট করে ফেললাম। সারারাত ঘুম হলো না। সকালের দিকে ঘুম এলো কিন্তু ক্লাসের জন্য ঘুমাতে পারলাম না। ভার্সিটিতে গিয়েই রুম্পাকে পেয়ে গেলাম। টেনে একটু আড়ালে নিয়ে রুম্পাকে সব বলে দিলাম ক্রাশের কথা। বেচারি মনে হয় মন খারাপ করলো। ওই রাক্ষুসী আবার অনিককে পছন্দ করে ফেলেনি তো! নাহলে মন খারাপ করবে কেন? জিজ্ঞেস করবো না করবো না ভেবে করেই ফেললাম,

-“কিরে বান্ধবী তুই আবার অনিককে পছন্দ করিস না তো?” রুম্পা মন খারাপ করে বললো,
-“করতাম।” রুম্পার এই কথা শোনে আমি পুরো বোকা বনে গেছি। হায় কপাল! হায় খোদা! কাকে আমি গুপ্তচর বানাতে চাচ্ছিলাম! কোনো মতে বললাম,

-“মানে!”  আমাকে অবাক করে দিয়ে রুম্পা বললো,

-“তোর অনেক আগেই আমি অনিক ভাইয়াকে পছন্দ করতামরে নিশু। তুই তখন অনিক ভাইয়ার উপরে ক্রাশ খাওয়া তো দূর তাকে চিনতিও না। আমি এডমিশনে থাকতে ভাইয়া আমাদের ব্যাচে ক্যালকুলাস ক্লাস নিতো। ভার্সিটিতে চান্স হওয়ার পরই আমি ভাইয়াকে ভালো লাগার কথা জানাই কিন্তু ভাইয়া সেদিনই আমাকে রিজেক্ট করে।
রুম্পা এত টুকু বলেই থামলো। আরও কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু আমি কান্না শুরু করে দিলাম। আমার ভেঙে পড়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। রুম্পার রূপের কাছে তো আমি কিছুই না। ওকেই যদি রিজেক্ট করে তাহলে তো আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। কি হবে আমার! রুম্পা আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বললো,

-“নিশু তুই এতটুকু শোনেই কাঁদছিস? আর আমাকে পুরো ক্যাম্পাস ভর্তি ছেলেমেয়ের সামনে রিজেক্ট তো করেছে তার সাথে এতটুকুও বলেছে যে আমরা মেয়েরা নাকি স্মার্ট, হ্যান্ডসাম কোনো ছেলে দেখলেই তাদের পিছু নিতে শুরু করে দিই।” আমি কান্না থামিয়ে রুম্পার দিকে তাকালাম। অনিক এর বিহেইভিয়ার এমন হতে পারে? ছিহ! মেয়েদের প্রতি ওর এত ঘৃণা? কিন্তু কেন?

-“শোন নিশু এত কান্নাকাটির কিছু নেই। আমার আগেই বুঝা উচিত ছিলো যখন তুই আমাকে অনিক ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতি। আমি ভেবেছিলাম এমনিতেই হয়তো জিজ্ঞেস করছিস। নয়তো আগেই বলে দিতাম তোকে। এই ছেলে কোনো মেয়েকেই সহ্য করতে পারে না। তেমন কোনো মেয়ে ফ্রেন্ডস ও নেই। সিনিয়র ব্যাচ তো, ক্যাম্পাসের অনেক সুন্দরী মেয়ে ই ওকে পছন্দ করে, কেউ কেউ ওকে ভালোলাগার কথা জানায়। কিন্তু অপমানই হয় মেয়েগুলো। তুই কি কান্না থামাবি নিশু?”

-“আমি কি করবো রুম্পা। আমাকে তো একদম ধুয়েই দিবে। আমি তো তোদের মতো এত সুন্দরী না রে!”
-“ঢং করিস না তো! এর থেকেও ভালো ছেলে পাবি তুই। বুঝেছিস? আর আমিও রাহাত কে নিয়ে অনেক হ্যাপি। রাহাত অন্তত ওই লোকের মতো ন্যারো মাইন্ডেড নাহ। বেয়াদব ছেলে! রূপের অহংকারে যেন বাঁচে না! খোঁজ নিয়ে দেখ না হয়তো ছ্যাঁকা ট্যাঁকা খেয়ে বসে আছে তাইতো এত মেয়ে বিদ্বেষ। ঢং! শোন ফর গড সেক, তুই কান্না থামা। ক্লাসে লেট হচ্ছে আমি গেলাম।”

চোখমুখ মুছে আর ক্লাসে গেলাম না। একদম হলে চলে এলাম। মাথা ধরে গেছে। রুমে এসে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। অনিকের প্রতি আমি খুব বেশিই দূর্বল হয়ে গেছি। এর আগেও আমার দুইজন ক্রাশ ছিলো, কিন্তু সেগুলো এতোটাও ডীপলি ভাবায় নি আমাকে। তাদের চেহারা ভালো করেও দেখিনি আমি। কিন্তু অনিকের চেহারা আমার মুখস্থ! এটাকে কি ভালোবাসা বলে? এটা কোনোভাবেই ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি আর ভাবছি আমি অনিকের সামনে দাড়াতে পারবো তো! আর দাড়ালেও পরিস্থিতি টা কেমন হবে! বেস্টফ্রেন্ডহীন আমি আমার রুমমেট জিনিয়ার সাথেই একটু একটু ক্লোজ। অনিকের কথাটা জিনিয়ার সাথে শেয়ারই করে ফেললাম। সবটা শুনে ভাবলেশহীন ভাবে জিনিয়া বললো,

-“ওই স্বপ্ন দেখা থেকে সরে যা নিশু যেই স্বপ্ন নিজেই তোকে ধ্বংস করে দিবে।”

প্রত্যুত্তরে কিছু না বলেই চলে বারান্দায় গেলাম। কি করবো কিছুই মাথায় আসছে না। বারান্দায় দাড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনিকের রুমের দিকে। এইচএস হল আমাদের লেডিস হলের বরাবরই দীর্ঘ সাততলা বিল্ডিং যদিও বেশ খানিকটা দূরে। যার পঞ্চম তলার পশ্চিমের একদম শেষ রুমের বাসিন্দা অনিক। রাত চারটা অব্দি তার রুমে আলো জ্বলছিলো। পড়াশোনা করে নাকি কি করে কে জানে! সারারাত নির্ঘুম কাটলো আমার। সকালে একটু তাড়াতাড়িই ভার্সিটিতে চলে গেলাম। ক্যাম্পাসে দৌড়ের উপর ছেলে মেয়ে ক্লাসের দিকে ছুটছে! সকাল ৮টায় কারই বা ক্লাস করতে মন চায়। ভাবতে ভাবতে আনমনে হাটছিলাম আর হঠাৎই কেউ একজনের গলা শুনলাম,

-“ওই অনিক্কা”

হার্টবিট বেড়ে গেলো আমার। আশেপাশে তাকালাম কেউ নেই। পিছনে ফিরে দেখি ক্রাশসাহেব হাসিহাসি মুখে তার বন্ধুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে তাদের দেখছিলাম। হুট করেই ক্রাশকে ডাক দিয়ে বসলাম,

-“অনিক ভাইয়া” সে বিরক্ত হয়েছে মনে হলো। বন্ধুর সাথে কথা বন্ধ করে বিরক্ত সুরে বললো,
-“কিছু বলবে? ”
-“ভাইয়া একটু এদিকে আসুন না!” এগিয়ে এসে বললো,
-“কি ব্যাপার? ”

আমি নিজেই ভুলে গেলাম কেন তাকে ডাকলাম। কি বলবো এখন! মাথাটা পুরোই উলটপালট হয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে আজকেই সব ক্লিয়ার করে দিব। যা হয় হবে। গালি দিবে? বকা দিবে? থাপ্পড় দিবে? দিক! আমি ও তার পিছু ছাড়বো না। আমার নিরবতা দেখে সে বললো, “ফাজলামি হচ্ছে? কোন ইয়ার?”

-“ফার্স্ট ইয়ার!”
-“আই সী! ডেকেছো কেন?” আমতা আমতা করে আমি বললাম,
-“আসলে ভাইয়া…” সে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-“আসলে?”
-“আই লাভ ইউ!”

বলেই দিলাম এক দৌড়। একদম ক্লাসে এসে চেয়ারে বসে হাফাতে হাফাতে শুরু করলাম। হার্ট খুব ফাস্ট বীট করছে। চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। কানে আসলো,

-” এইযে! চেয়ার নং ৩,১! ইউ লেডি! স্ট্যান্ড আপ!”

চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি স্যার বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। শুধু স্যার নয় পুরো ক্লাসই আমার দিকে তাকিয়ে। দাড়ালাম। স্যার বললেন,

-” ইজ ইট আ সিনেমা হল? আর ইউ ফরগট দ্যা রুলস?” আমি হাফাতে হাফাতে কোনো মতে বললাম,
-“অ্যাম সরি স্যার! একচুয়েলি লেট হয়ে গেছে!”
-“গেট লস্ট ফ্রম দ্যা ক্লাস!”

মাথা নিচু করে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। এই স্যার জীবনেও ক্লাসটা করার পারমিশন দিবে না। অগত্যা রিকুয়েস্ট করারও মানে হয় না। আমার অপরাধও গুরুতর সেটা বুঝতে পারলাম। ক্লাসে আসা যাওয়া নিঃশব্দে হবে। স্যারকে কিছু বলা যাবে না। এতে কনসেনট্রেশান নষ্ট হয়। আর আমি যেভাবে দৌড়ে ক্লাসে ঢুকেছি আবার ধপাস করে চেয়ারে বসেছি!

একঘন্টা ক্যাফেতে কাটিয়ে দিলাম। আজ আর ক্লাস মিস করা যাবে না । পরের ক্লাসটা ক্যামিস্ট্রি ল্যাব ক্লাস। আট তলায়। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলাম একাডেমিক বিল্ডিং এ। গার্লস লিফটের সামনে দাড়াতেই দেখলাম বয়েজ লিফট থেকে অনিক বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখেই আর লিফটের জন্য ওয়েট না করে সিড়ি দিয়ে উঠা শুরু করলাম। আটতলায় সিড়ি বেয়ে উঠা যে কি কষ্ট! তিনঘন্টার ল্যাব ক্লাস শেষে লাঞ্চ ব্রেক। ঘড়িতে ১টা বাজে। যে যার মতো হলের দিকে দৌড়াচ্ছে কারণ ৪৫ মিনিটের মধ্যে গোসল, খাওয়া, নামাজ। ভার্সিটিতে প্রতিটি স্টুডেন্টকে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয় প্রতিনিয়ত। একাডেমিক বিল্ডিং থেকে বের হয়েই আমার চক্ষু চড়কগাছ! ব্যাডমিন্টন কোর্টের ওখানে অনিক ও তার বন্ধুরা এইদিকেই তাকিয়ে আছে। সকালের ঘটনার জন্য আমাকে আজ কি খেসারত দিতে হবে কে জানে! ওদের না দেখার ভান করে আস্তে আস্তে এগুতে লাগলাম তখনই ডাক পড়লো আমার। তাকাতেই দেখলাম অনিক ইশারা করে ডাকছে। মাঘ মাসের শীতেও আমি ঘামতে শুরু করলাম তার উপর পুরো শরীর কাঁপছে।

-“নাম কি?”
-“নিশু সামিহা”
-“থাপ্পড় চেনো?” মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর অনিক আবারো বললো,

-“নিজেকে কি সিনেমার হিরোইন মনে হয়? সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত। ক্লাস টাইম হলে ক্লাসে যাবে। নাও স্টার্ট! তাকাও সূর্যের দিকে! অসহায়ের মতো অনিকের দিকে তাকালাম। চশমার গ্লাসের পিছনে তার দু’চোখে অজস্র ঘৃণার প্রতিচ্ছবি! চশমা পড়া ছেলেরা রুক্ষ হয় না! তাদের চেহারা মায়াভরা, কিন্তু অনিক রুক্ষ! খুব রুক্ষ! ভয়ানক রুক্ষ! তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে কড়াভাবে বললো,

-“চোখ সরিয়েছো তো পানিশমেন্ট দিগুন হবে। মাইন্ড ইট!” আশেপাশে কেউ আছে কিনা কিছুই বুঝতে পারছিনা। মাথার অসহ্য যন্ত্রনায় মনে হলো এই বুঝি মাথা ফেটে আমি মারা যাবো। ক্ষনিকের জন্যে মনে হলো, পৃথিবীতে আমি খুব একা। আমার কেউ নেই। কেউ না। ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আমার হলের রুমে আবিষ্কার করলাম। আমি তো ক্যাম্পাসে ছিলাম, রুমে আসলাম কিভাবে? অসহ্য মাথার যন্ত্রনায় ভালো করে তাকাতেও পারছিনা। মাথায় কে যেনো পানি ঢালছে। হয়তো জিনিয়া। পৃথিবীটা কতো অদ্ভুত! আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে হয়তো শুধু ঘৃণাই করে। ভালোবাসা কি এমনই হয়? রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর এলো। জিনিয়া মনে হলো অনেকক্ষণ কপালে জলপট্টি দিয়েছে। হল লাইফে রুমমেটের থেকে বিন্দু পরিমান সেবাও যেন এক সমুদ্রের সমতুল্য!

আমার জ্বরের সপ্তম দিন মনে হলো আমি জীবিত আছি। আমার জীবনে এমন ভয়াবহ জ্বর কখনো হয়নি। কাল পর্যন্ত নাকি ১০৪ এবং ১০৩ এ উঠানামা করছিলো। গতরাতে মনে হলো কমেছে কিছুটা। আজকে সকালের দিকে নিজেই মাপলাম ১০১ এর একটু বেশি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম তেমন কোনো ফোনকল কিংবা এসএমএস ও আসে নি। কল নেই কারণ জিনিয়া রিসিভ করেছিলো। আর আজকে একটা কল শুধু ভাইয়ার নাম্বার থেকে।

কয়েকটা এসএমএস আসছে যেগুলো সিম কোম্পানির। আচ্ছা আমার বাবা মা এমন কেন! আশ্চর্য! আমি অসুস্থ জেনেও কেন তারা আসলো না? আমি যে হলে খুব ভালো আছি তা আমার বাবা মা শতভাগ নিশ্চিত! সত্যি কি বাবা মায়ের থেকে দূরে ভালো থাকে কোনো সন্তান? ব্যস্ত মা বাবার সন্তান হওয়ার থেকে কষ্টের কি আর কিছু আছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা বালিশের কাছে রাখলাম। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষ তাদের জীবন খুব সুন্দর করে উপভোগ করতে পারে। আমার মতো অভাগার কাছে প্রিয় মানুষের সাথে মাত্র কিছু সময় কাটানোই যথেষ্ট মন খুলে হাসার জন্য! অনিককে নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় এতদিন না থাকলেও এখন থেকে অনিক শব্দটা আবারও মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে। কে জানে কি আছে শেষে! বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। সন্ধ্যে হয়েছে সবে। জিনিয়া বারান্দায় হাটাহাটি করছিলো। আমাকে দেখে বললো,

-“আজকে কেমন লাগছে? জ্বর সেরেছে?”
-“হ্যা”
-“ক্লাসে কবে যাবি? পুরো দেড় সপ্তাহ ক্লাস করছিস না। সেমিস্টার ফাইনালের ও আর দেরি নাই”
-“দেখি কাল থেকে যাবো”
-” ওইদিন সূর্যের দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?

অনেকে বলাবলি করছিলো অনিক ভাইয়া আর তার বন্ধুরা নাকি তোকে কি কি বলেছিল তারপর তুই সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলে। আশ্চর্য! তুই কি পাগল নাকি নিশু? ওইদিন তোর চোখদুটো দেখে কি পরিমাণ ভয় পেয়েছি কিভাবে বুঝাবো তোকে। আমার মনে হয়, তুই অনিককে প্রপোজ করেছিস আর সে তোকে এই পানিশমেন্ট দিয়েছে। তাই না?” আমি কিছুই বললাম না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলাম। জিনিয়া আবারো বললো,

-“আচ্ছা সে অন্য মেয়েরা প্রপোজ করলে দু’চারটা কথা শোনায় কিন্তু তোমার সাথে কেন এমন করেছে সেটাই বুঝলাম না আমি।” আশ্চর্য আমাকেও এ বিষয়টা ভাবায়নি। ভালোবাসার কথা বললে পানিশমেন্ট পেতে হবে? এরপর কেটে গেলো পুরো একটা মাস। অনিকের সাথেও এরমাঝে প্রায়ই দেখা হয়েছে। আমিও হাল ছাড়িনি। স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে মেশার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। অনেক দিন নিজে যেচে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। বিনিময়ে হয় সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে চলে গিয়েছে নয়তো সবার সামনে নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে বলে সম্বোধন করেছে। একদিন তো সে বলেই বসলো,

– “এই পর্যন্ত অনেক মেয়েই আমাকে ভালোবেসেছে কিন্তু কেউ তোমার মতো ছ্যাঁছড়ামি করে নি। রিজেক্ট হওয়ার পর চলে গিয়েছে। তুমি কেন এখনো আমার পিছনে পড়ে আছো?” আমি একটুও রাগ অভিমান না করে বললাম,

-“কারণ আমি অন্যরা না। আমি নিশু আপনাকে ভালোবাসি, ভালোবেসেছি, ভালোবেসেই যাবো।”
-“যত্তসব”

এরকম চলতেই লাগলো। আমি অবাক হলাম এই ছেলে একদিন আমাকে পানিশমেন্ট দিয়ে শান্ত হয়নি। আরও অনেক পানিশমেন্ট দিয়েছে তার মধ্যে দু’একটা যা আমি জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি। সেদিন ছিলো র‍্যাগ ডে। রঙ এ পুরো মাখামাখি আমরা সবাই। হঠাৎ আমাকে অনিক ডাকলো। আমি খুশিতে লাফিয়ে গেলাম ওর কাছে। ওর কাছে যেতেই অনিক আমার হাতে একটা থালা ধরিয়ে বললো,

-” যাও গিয়ে ক্যাম্পাসের সবার কাছে ভিক্ষে চাও” আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,
-“মানে?”
-“যা বলছি তাই। যদি একটুও চালাকি করো তবে এরচেয়ে খুব খারাপ র‍্যাগ দিবো তোমাকে।”

আমি অসহায়ের মতো কাঁদতে লাগলাম। অবাক করা বিষয় এতে সবার কি হাসি। নিজেকে সার্কাসের কোনো জন্ত মনে হচ্ছিলো আমার। যেন আমি সবাইকে মজা দেখাচ্ছি। আমি কি সত্যিই জোকার?

রাগে অভিমানে এরপর অনেকদিন ভার্সিটিতে যাইনি। মাঝে একদিন শুধু গিয়েছিলাম বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। তাও অনিককেই দেখার জন্য। ভালো লাগার ব্যাপার অনিক সেদিন আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ বা র‍্যাগ দেয় নি। আবার তেমন কথাও বলেনি। শুধু আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছেন উত্তরে একটা হাসি দিয়ে বললো ভালো। কি জাদুকরী তার হাসি। তার এই হাসিটাই আমাকে খুন করার জন্য যথেষ্ট! এই হাসিটার জন্যই শুধুমাত্র ক্ষনিকের জন্য আমি একটু আশা খুঁজে পেয়েছিলাম। সময়, দিনগুলো চলতেই থাকলো। আমি তেমন একটা ক্লাস করতাম না ভার্সিটিতে যেতাম তাকে দেখার জন্য। মাঝেমধ্যে দেখা হতো বেশিরভাগ দিনই দেখা হতো না। আমি ক্যাম্পাসে হাটতাম আর তার কথাই ভাবতাম। ক্লাস করলেও কন্সেনট্রেশান ছিলো না। পড়াশোনা একদম অসহ্য লাগত আমার।

ভেবেছিলাম পরীক্ষার সময় হয়তো ভার্সিটিতে শেষ বারের মতো অনিকের সাথে দেখা হবে তাও হলো না। সব গুলো এক্সামই খুব বাজে দিলাম। এক্সামের পর সেমিস্টার ব্রেকে বাসায় গেলাম। বাসায় এসে আরও একাকিত্ব বোধ করছিলাম আমি। আমাদের ব্যস্ত পরিবারের আমরা চার সদস্য। আমি বাবা মা আর ভাইয়া। ভাইয়ার সাথে আমার খুব কম দেখা হয় কারণ সে চট্টগ্রামে বনবিভাগে জব করে। আর সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি বাবা মা অফিসে। আমার এই জীবনে আমি খুব একা। বাবা মায়ের অঢেল টাকা থাকায় শুধু মাত্র এই টাকা জিনিসটাই না চাইতেই পেয়েছি আমি। কিন্তু যা চাই তা পাওয়া হয়ে উঠে না। একটু ভালোবাসা, একটু সময় চেয়েছিলাম সেটা আর পেলাম না তাদের ব্যস্ত কর্মমুখী জীবনযাপনের কারনে। ছুটি কাটিয়ে হলে আসার পরপরই রেজাল্ট দিলো। আমি খুব বাজে রেজাল্ট করলাম। জিপিএ ৩ পয়েন্ট ও আসে নি। অনিকের খোজ নিয়ে জানলাম তার সিজিপিএ ৩.৯+। আমার যে কি খুশি, নিজে এত বাজে রেজাল্ট করলাম তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাই নেই।

নতুন সেমিস্টারের ক্লাস পুরোদমে চলতে লাগলো। আমি তখনও অনিকের স্বপ্নে বিভোর। পার্থক্য একটাই আগে ভয়ে থাকতাম সে কখন কি করে বসে আর এখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তার সাথে আমার দেখাই হয় না। আমি ও অপেক্ষা করে থাকি তার, হয়তো একদিন সে আসবে। আমাকে অনুভব করবে। হয়তো একদিন সে নিজে আমাকে খুজবে। আমি অপেক্ষায়ই থাকি। আমার একটু হলেও বিশ্বাস হতো আমি আমার ভালোবাসার যুদ্ধে বিজয়ী হবো। এই সেমিস্টারের শেষের দিকে অনিককে ভার্সিটিতে দেখলাম। সেই ফর্সা চেহারা, মাথাভর্তি খাড়া খাড়া চুল, ছোট ছোট চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। চশমার গ্লাসটা আগের চেয়েও ঘোলা। চোখের সমস্যা বেড়েছে হয়তো। এতদিন পর তাকে দেখেই কিভাবে যেন ছুটে চলে গেলাম তার সামনে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি আমি। একদম তার কাছে গিয়েই বললাম,

-“এতদিন পর আসলেন তাহলে?” আমাকে দেখে তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-“কেন কথা ছিলো নাকি আসার?”
-“আপনার কি একটুও মনে হয় না যে কেউ একজন আপনার অপেক্ষায় থাকে?”
-“না!”

কথাটা বলেই সে হনহন করে চলে গেলো। আমি স্থির দাড়িয়ে রইলাম। চোখের পানি টলমল করছে। এতোটাই কি নগন্য আমি? যাকে একটু ভালোবাসা যায় না, একটু ভালো ব্যবহার করা যায় না, একটু সময় দেয়া যায় না? আশ্চর্য! শালা তোরে আমি একবার পাই, ইগনোর করা শেখাবো! আমার অবস্থা পুরোই বেগতিক। আমি এত চঞ্চল, হাসিখুশি একটা মানুষ ছিলাম। সারাদিন কত হেসেখেলে বেড়াতাম! আর এখন! কয়দিন, কয়মাস যাবৎ প্রান খুলে হাসি না কে জানে। নিজেকেই যেন আমি বুঝতে পারি না। কেন এমন হয়ে যাচ্ছি আমি? কেন এতোকিছু সহ্য করছি? এতোটা অবহেলা, এত তাচ্ছিল্যের পরও আমি তার পিছু ছাড়তে পারবো না আমি শিওর। কেন আমি জানিনা। ভালোবাসতে যেমন কারণ লাগে নি, এখনও কোনো কারণ নেই। আমার রুমমেট জিনিয়া, বান্ধবী রুম্পা, ডিপার্টমেন্ট এর ফ্রেন্ডসরা পর্যন্ত আমাকে কত বুঝায়। নিজের ভালোটা বুঝে নিতে বলে। অথচ আমার ভালো থাকার সম্বল একটা মানুষই, আর সে অনিক।

এরপর কেটে গেলো প্রায় একটা বছর। এর মাঝে অনিকের সাথে দেখা হওয়ার কোন চান্সই পেলাম না। সে এমএসসি করছে অন্য ইউনিভার্সিটিতে। অনেক চেষ্টা করেও ইউনিভার্সিটির নাম পর্যন্ত জানতে পারলাম না। জানার কোনো সোর্স ও নেই। ফেসবুক থেকেও আমাকে ব্লক করেছে। অবশ্য ফেইক আইডি খুলে তাকে ফলো করতাম। কিন্তু তাতে লাভ ও হতো না। দূরে গেলে নাকি ভালোবাসা কমে যায়, আর আমার না পাওয়া ভালোবাসা দূরে গিয়ে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। কত অদ্ভুত ব্যাপার। আমি প্রায় একপ্রকার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আগে তাও পড়াশোনা করতাম একটু আধটু। এখন টোটালি অফ। বইয়ের কাছেও যাইনা। পড়ালেখা একদম ছেড়ে দিয়েছি। রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার করে শুয়ে থাকি সারাক্ষণ।

খাওয়াদাওয়ার ও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। হলে আমার জন্য রুমমেটের প্রবলেম হচ্ছে তাই বাসায় চলে এসেছি। সন্ধ্যায় বাবা মা বাসায় এসে আমাকে প্রতিদিন সারাক্ষণ রুম বন্ধ করে থাকতে দেখে তাদের চিন্তা বেড়ে গেলো। কাজের লোক যারা আছে তারাও বাবা মাকে বলেছে আমার কথা। বাবা মা পনেরো দিনের ছুটি নিলেন আমায় সময় দেয়ার জন্য। এতবছর পরে এসে হয়তো তাদের মনে হয়েছে আমাকে সময় দেয়ার কথা। বাবা প্রতিদিন এসে বলেন চলো মা এইখানে ঘুরতে যাই, ওইখানে যাই, ওইদেশে যাই। তোমার ভালো লাগবে। আমি স্রেফ না করে দেই আমি যাবো না। মা সারাক্ষণ আমার পাশে বসে থাকেন তার জীবনের বিভিন্ন গল্প, অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন। আমি অন্যসময় হলে হয়তো অবাক হতাম যে আমার মা এত কথা বলতে পারে? কিন্তু এখনের সময়ে এসে আমাকে কিছুই ভাবায় না। হুট করেই আমি বিরক্ত হয়ে মাকে বলি,

-“মা তোমার কথায় আমার মাথাব্যথা ধরে গেছে। প্লিজ যাও আমি ঘুমাবো। তখন আমি মায়ের দিকে তাকাই না। হয়তো তাকালেই দেখবো দুটো চোখ ছলছল করছে। টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়বে এক্ষুণি। আমার দুশ্চিন্তায় বাবার ডায়াবেটিস আরো বেড়ে গেলো। বাবা মা দুজনেই চাকুরী জীবনের ইতি টানলেন। পুরো পরিবারটাই থমকে গেছে যেন। বাবা হাল না ছেড়ে সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাথে কনসাল্ট করলেন। একবার না, অনেকবার। অ্যাপয়েন্টমেন্ট কনফার্ম করলেন। মীট করার সময় আমি আর গেলাম না।

এর মাঝে ভাইয়া বাসায় আসলো। বাবা মা ভাইয়াকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। ভাবীর নাম জাহিন। চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। পাকিস্তানিদের মতো খাড়া নাক। এই নাকের জন্যই ভাবীকে বাঙ্গালী মনে হয় না। আমি খেয়াল করলাম বিয়ের দুইদিনের মধ্যেই ভাবী আমাকে আপন করে নিলো। যেন আমি তার কত চেনা, নিজের আপন বোন। ভাইয়ার বিয়ের চতুর্থ দিনের দিন কনফার্ম হলো আমাদের ফেমিলির সবাই নেদারল্যান্ডস যাচ্ছি বেড়াতে। আমি কোনো ভাবেই আমার যাওয়া ক্যান্সেল করতে পারলাম না, ভাবি কসম দিয়ে দিলো যেতেই হবে। অগত্যা ১৫দিনের জন্য দেশ ছাড়লাম আমার পরিবারের সবাই।

আর্মস্টারডাম সিটিতে পৌছেই আমার মনে হলো ঢাকা শহরের জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানোর কাছে এই শহরটা যেন স্বপ্নপূরী। যদিও আমার দেশও কম সুন্দর না। নেদারল্যান্ডস সফরের তৃতীয় দিনে স্বপরিবারে সী বীচে গেলাম আমরা। সমুদ্রের পানিতে নেমেই আমার সে কি উল্লাস। অনেক দিন পর প্রাণ খুলে হাসলাম। প্রায় এক বা দেড় বছর পর। আমাকে এতো প্রফুল্ল দেখে আমার পরিবারের সে কি খুশি। এই আমিটাকেই হয়তো খুজছিলো তারা। সমুদ্রের ঢেউ একটু পর পর ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায়। চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতে লাগলাম।

এভাবেই অনেকক্ষণ কাটার পর ভাবী এসে টানতে টানতে পারে নিয়ে গেলো হোটেলে ব্যাক করার জন্য। আমি নাছোড়বান্দা। এখনই ফিরবো না। হঠাৎই খেয়াল করলাম ভাবী পিছনে অনেকটা দূরে নেভী ব্লু টিশার্ট পড়া কেউ কোমড় সমান পানিতে দাড়িয়ে ডুবে যাওয়া সূর্যের পানে চেয়ে আছে। আমার হাত থেকে ভাবীর হাত ছাড়িয়ে আমি ছুটে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঝাপটে ধরলাম মানুষটাকে। এই যে আমার প্রাণ ভোমরা। একে ছাড়া আমি নিঃশ্বাস নিতে পারিনা। পুরো শরীর কাঁপছে আমার। মূহুর্তেই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলো সে প্রায়। পড়ে যাওয়ার আগেই আবার ধরে ফেললো। আমি তার দিকেই তাকিয়ে আছি। সেই চিরচেনা মুখ যা দেখে আমি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি।

-“হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস?” অনিকের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ভেসে ওঠেছে। আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
-“আআপনি কেকেন আআমার সাথে এএমন ককরেন?”
-” যাস্ট শাট আপ! কেনো আমার পিছনে পড়ে আছো? তোমার জন্য কি আমি মরেও শান্তি পাবো না? ”

আমি কাঁদতে কাঁদতে আবারো তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কোনো ভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। সে আমাকে ছাড়িয়ে সজোরে আমার গালে চড় বসিয়ে দিলো। কারো উপরে আছড়ে পড়লাম মনে হলো। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া। রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। ভাইয়া কিছু বলার আগেই ভাবী অনিককে সরিটরি বলে বিদায় করে দিলো। ভাইয়া ভাবীর সাথে রাগ দেখিয়ে আমাকে নিয়ে পারে উঠে আসলো। আমি যাস্ট ওই মূহুর্তটাতেই ডুবে আছি। মা আমার কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করেই চলেছেন, ওই ছেলেটা কে? তুই ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছিলে কেন? আশ্চর্য তো? কে ও! আরও কত প্রশ! আমি কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না তখন। রাতে আমার জ্বর আসলো। প্রথমবার নির্লজ্জের মতো বাবার কাছে অনিককে চাইলাম। বাবা মা দুজনেই হতভম্ব। একটা ছেলের জন্য আমি এমন উন্মাদের মতো হয়ে যাবো সেটা হয়তো কেউই ভাবেন নি। তাদের এই স্ট্রং মেয়েটার থেকে হয়তো এটা আশা করেন নি! আমি এমন ধাচের মেয়েই ছিলাম না। অথচ!

বাবা আমাকে নিশ্চিত করলেন আমাকে তিনি যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও অনিককে এনে দিবেন। বাবা অনেক খোজ খবর নিয়েও আর্মস্টার্ডাম শহরে অনিককে পেলেন না। কিন্তু এয়ারলাইন্স থেকে খোজ পেলেন গতরাতের ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে ট্যুরে আসা ছয় সদস্যের টীম চলে গিয়েছে। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, বাংলাদেশ খুব ছোট্ট একটা দেশ মা। আমি তোমাকে খুজে এনে দিবোই। আমার অবস্থা আরও খারাপ হলো। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি একদম। সারাদিন রাত কান্নাকাটি করতে থাকি। আমার অবস্থা এরকম হওয়ায় ইমার্জেন্সিলি বাবা বাংলাদেশ এ নিয়ে আসলেন আমাকে। বাসায় আসার পর অবস্থার আরো অবনতি হলো। কাউকেই চিনতে পারিনা। আমার ট্রীটমেন্ট চলতে লাগলো।

এভাবেই কেটে গেলো আরো কয়েকটা মাস। আমি একদম রুমে বন্ধী হয়েই থাকতাম। খাওয়াদাওয়া সবই নিজের রুমে। পুরোপুরি স্বাভাবিক আমি হতেই পারিনি। এরমধ্যে একজন পঁচিশ কি ছাব্বিশ বয়সী ভদ্রলোক আমার সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসতেন। ভাবীর কলেজ ফ্রেন্ড নাকি। এত হতাশা আর ডিপ্রেশনের মাঝেও তার সাথে কথা বললে একটু হলেও হালকা লাগতো নিজেকে। এর মাঝে আমি একদিন রাতে ডাইনিং এ খেতে গেলাম। কতদিন পর আমি ওই রুমটা থেকে বের হয়েছি কে জানে। আমাকে দেখে মা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি খেতে পারলাম না। অনেক দিন নিজের হাতে খাইনি। বাবা খাইয়ে দিচ্ছেন। আমার খাওয়ায় মনযোগ নেই। তা দেখে খাওয়ার মধ্যে বাবা বললেন,

-“অনিক হাসান

বাবার নামঃ সায়েদ আল হাসান

বাসাঃ উত্তরা ১১ নং সেক্টর। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে মাস তিনেক আগে। দুইভাই একবোন। ছেলেটা সবার বড়। ওরা কুমিল্লার হলেও ঢাকায় আছে ছেলের জন্মের আগে থেকেই।” আমি যাস্ট থমকে গেলাম। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আই লাভ ইউ বাবা। বাবা বললেন,

-“তোমার এই খুশিভরা মুখটাই দেখতে চেয়েছিলাম মা।”

এরপর থেকে শুরু হয়ে গেলো আমার উপর সবার অত্যাচার। একদম স্ট্রেইট চিপায় রেখে দিয়েছে আমাকে। আমি যতদিন না পর্যন্ত স্বাভাবিক হচ্ছি ততদিন পর্যন্ত বাবা অনিকের বাসায় প্রপোজাল পাঠাবেন না। কোনো বাবা মা তার ছেলের গলায় নিশ্চয়ই হাফ মেন্টাল মেয়ে ঝুলিয়ে দিবেন না! ভাবীর সাথেও এই কদিনে আরো ক্লোজ হয়ে গেলাম। কত গল্প যে আমরা করতাম সারাক্ষণ। প্রায়ই ঘুরতে যেতাম, লাঞ্চ করতাম বাহিরে, শপিং এ যেতাম, কখনো বাসার সবাই মিলে উইকেন্ডে ট্যুর দিতাম শুধু আমার স্বাভাবিক জীবনটা ফিরে পাওয়ার জন্য।

মি. ফারহান ইমতিয়াজ এর সাথে কয়েকদিনের আলাপে উপলব্ধি করলাম জীবনের অন্তিম মূহুর্তেও হাল ছাড়তে নেই। মি. ফারহান ইমতিয়াজ হলো ভাবীর সেই কলেজ বন্ধু। পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট, সেই হিসেবেই তিনি এখন আমার পরিচিত। আমার সম্পর্কে মি. ফারহান শুধু এটুকুই জানতেন অনিক নামে এক ছেলের জন্য আমার এই অবস্থা সে আমাকে ভালোবাসছে না ব্লা ব্লা ব্লা। মি. ফারহানকে আমি অনিকের ব্যাপারে সব বললাম। এ টু জেড। অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে শুনে তিনি চুপ করে রইলেন। আমার বিরক্তির শেষ নেই। এই মানুষটা বাহিরের হলেও তার সাপোর্ট নিজের লোকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই যে ইদানীং আমি সারাক্ষণ হাসি, গল্প করি তার পিছনে এই লোকটার ও তো বড় অবদান আছে। আর এখন সে চুপ করে আছে? তাকে চুপ করে থাকার জন্য আমি এসব বলেছি?

-“নিশু!”
-“হুমম” মি. ফারহান হাসলেন। আবার হাসি থামিয়ে বললেন,

-” মন দিয়ে শুনবে নিশু। আমি একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করি। পছন্দ করার কারণ অবশ্য নেই। তবু পছন্দ করি। বলতে পারো ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালোবাসতো। ভালোবাসতো বলছি কারণ এখন তার ধারণা আমাকে পছন্দ করে না। সে নাকি এতদিন ভালোবাসে নি যাস্ট ওর ভালো লাগতো। এখন ওর মনে হচ্ছে ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে অনেক ডিফারেন্স। জোর করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। আর যদি হয় এটা একতরফা তাহলে তো সেই সম্পর্কের কোনো মানে নেই। অবশ্য আমিও জোর করি নি কারণ সংসার কিংবা সম্পর্ক এটা হলো মাটির পুতুলের মতো। যত্নে তৈরি করা থেকে শুরু করে সবসময় যত্নে রাখতে হয়। হাত ফসকে গেলেই শেষ। সম্পর্ক ও এমন। আমি চাচ্ছি সে সময় নিক বুঝুক, নিজে কি চায় তা খুজুক। আমি অবশ্যই ওর অপেক্ষা করছি।”

-“নাম কি মেয়েটার?”
-“আলিনা।”
-“ভালোই তো।”
-“হ্যা ভালোই। তোমাকে এই ঘটনাটা কেন বলেছি জানো?”
-“কেনো?”
-” আচ্ছা আরেকটা বিষয় বলি।

আমাদের জীবনটা বিবাহ বহির্ভূত প্রেম ভালোবাসায় আবদ্ধ আমরা নিজেরাই করতে চাই। অথচ দেখো এর বাহিরেও একটা সুন্দর জীবন কিন্তু আছে। কি নেই আমাদের জীবনে? সবই আছে। আবার একটার বদলে পরিপূরক অপরটা আছে। কিন্তু আমরা তা উপভোগ করতে পারি না কারণ সেটা আমাদের কাছে পানিভাত হয়ে গিয়েছে। আমরা চাই অসাধারণত্ব, সাধারণ কোনো কিছুই আমরা উপভোগ করতে পারি না। সেজনই আমরা কেয়ারিং, ভালোবাসা চাই। কিন্তু সেটাও যেন অতিরিক্ত কিছু না হয়ে যায়। তরকারিতে অতিরিক্ত লবন দিলে পুরো তরকারিটাই অখাদ্য হয়ে যায়।

বাস্তবিক কিছু কিছু ব্যাপার ও এরকমই। এজন্যই আমরা বলি অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয়। অতিরিক্ত ভালোবাসা , কেয়ারিং , চাওয়া কোনোটাই আমাদের জন্য ভালো না। এভ্রিথিং হেজ এ লিমিটেশন। দেখো নিশু, অনিককে তুমি ভালোবেসেছো ঠিক আছে। কিন্তু কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে সেটা হয়ে গিয়েছে অতিরিক্ত। আবার অনিক তোমাকে ভালোবাসে না। এটা অন্তত তুমি ডিজার্ব করো না। এটাও তোমার ভাবা উচিত। একতরফা কোনো কিছুই তো হয় না তাই না? এমনও তো হতে পারে যে সে বিয়ে সম্পর্ক জড়াতে চাচ্ছেই না। এত ঘটনা শুনে আমার সেটাই মনে হয়। এরমাঝে বিয়ের সম্মন্ধ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আংকেল এরও সম্মানহানি হতে পারে। কারণ এটা স্পষ্ট অনিক তোমাকে ভালোবাসে না। ” আমার মনে হলো মি. ফারহান আসলেই পাগল হয়ে গিয়েছে। কি বলে এসব! গাধা!

-“সেটা সময় হলেই বুঝা যাবে”
-“আচ্ছা বাদ দাও এসব। নিশু ধরো আই মীন যাস্ট ইমাজিনেশন, আমি আলিনাকে খুব পছন্দ করি এবং সেও আমাকে পছন্দ করে। তারপর আমরা চুটিয়ে প্রেম করতে শুরু করলাম। আমাদের কত স্বপ্ন, কত লক্ষ্য! হটাৎ আমার শরীর খারাপ হলো। ভয়ানক খারাপ। আমি পরিবারের কাউকে জানিয়ে ডক্টরের কাছে গেলাম এবং কিছু টেস্ট ফেস্ট করে আমার ক্যান্সার ধরা পড়লো। যেই ডিজিজের আসল নাম লিউকোমিয়া।” মি. ফারহান একটু থামলেন। আমি বললাম,

-“কফিটা ঠান্ডা হচ্ছে।” তিনি কফির মগ হাতে নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,

-” আমার রোগের কথা শুনে আমার সব স্বপ্ন, লক্ষ্য, উপলক্ষ্য গুলো যাস্ট আমি ভুলে গেলাম। তবে আমার  বিন্দুমাত্রও খারাপ লাগা বা কষ্ট হলো না কারন আমরা মানুষ মাত্রই মরনশীল। একদিন তো মারা যাবোই। আমার ভয় শুধু আমার বাবা, মা, আমার ভাই-বোন এবং আলিনাকে নিয়ে। তারা ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে কখনো নিতে পারবে না। আমি ট্রিটমেন্ট চালিয়ে গেলাম। রোগ যখন হয়েছে, চিকিৎসা তো করতেই হবে তাই না! কিন্তু ধীরে ধীরে আমি আরো বেশি দূর্বল হতে লাগলাম। আমার রোগটা আরও প্রশস্ত হলো। চিকিৎসার কারনে অনেক পেশেন্ট সুস্থ্য হয় আবার অনেকেই হয় না। সবটাই যেহেতু ভাগ্য আর হায়াতের উপর নির্ভরশীল তাও আমি চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। এরমধ্যে একটা ব্যাপার হলো আলিনা আমার কাছে সময় চায়, দেখা করতে চায়, সবসময় পাশে চায়। কিন্তু তা দিতে আমি অপারগ। তাতে আলিনা রেগে যায়, পাগলামি করে। ওকে শান্তু করার জন্য আমি সবটা ওকে বলে দিলাম। এখন নিশু তুমি বলো তো, ওই পরিস্থিতিতে আলিনার কি করা উচিত? ” আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,

-“সিচুয়েশান না ফেস করে কোনো কিছুই বুঝা বা বলা যায় না।” আমি লক্ষ্য করলাম মি. ফারহান এর চোখ ভিজে আসছে। মূহুর্তেই সেটা মুছে ফেলে তিনি মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“নিশু তুমি জানো, তোমার ঠোঁটের নিচে যে তিলটা আছে সেটাই তোমার সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা তোমাকে দেখে যথেষ্ট ম্যাচিওর এবং খুব বুদ্ধিমতী মনে হয়। কিন্তু তুমি খুব বুদ্ধিমতী না। সামান্য বুদ্ধিমতী। আমার একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে বুঝলে আমি এখন বেরোবো। সী ইউ” মি. ফারহান চলে গেলেন। ওনার কথাগুলোর ধারে কাছেও আমি যেতে পারছি না। কি বললো! আমি ভাবীর রুমে গেলাম। ভাবী উপন্যাস পড়ছে। আমাকে দেখে বই বন্ধ করে বললো,

-“রায়বাঘিনী ননদিনী, মুখ শুকনো কেন হুম?”
-“ভাবী, তোমার বন্ধুটা একটা স্ট্র্যাঞ্জ মানুষ। কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলে। আমার কাছে এখন সত্যিই উনার মাথায় সমস্যা মনে হয়।” ভাবী হেসে বললেন,
-“এতদিন মনে হয় নি?”
-“এতদিন তো ভালোই কথাটথা বলতো ইদানীং এমন সব কথা বলে যা শুনে আমি হতাশ হয়ে যাই।”
-“কেন কি বলে ফারহান?”
-” আজকে বললো, তার নাকি লিউকোমিয়া হয়েছে।” ভাবী চিৎকার করে বললেন,
-” ওহ মাই গড, কি বলছিস নিশু? কবে হলো?” আমি ভ্যাংচিয়ে বললাম,

-” হয় নি। এমনিতেই যাস্ট উদাহরণ দিয়ে বলেছে”
-” শীট! নিশু শোনো, তুমি এত দিন সুস্থ ছিলে না তাই ওর কথা তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে আর ও তোমাকে স্বাভাবিক করার জন্য বিভিন্ন ট্রিকস খাটিয়েছে। এখন তুমি স্বাভাবিক হয়েছো তাই হয়তো ও তোমাকে কিছু বাস্তবধর্মী কথা বলেছে যাতে তুমি ওগুলো উপলব্ধি করতে পারো। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও স্ট্রং থাকতে পারো।”

-” ভাবী তুমি আমাকে তুমি তুমি করে কথা বলছো কেন হঠাৎ? ”
ভাবী পাত্তা না দিয়ে বললেন,
-” আচ্ছা নিশু তুই পড়াশোনা আবার শুরু কর। ইয়ার লস হতেই পারে। তাই বলে টোটালি অফ তো করতে পারিস না। এই যুগে পড়াশোনা ছাড়া ভাত নেই। অবশ্য তোর অনিক না চাইলে সেটা অন্য ব্যাপার।”
-“আমার পক্ষে কিছুতেই আর পড়াশোনা সম্ভব না ভাবী। একদম মন উঠে গিয়েছে ।”
ভাবী কপাল চাপড়ে বললেন,
-“হায় খোদা, পুরো মনটাই একটা ছেলেকে দিয়ে বসে আছে যে। আচ্ছা নিশুমনি তুই বিয়ের পর সারাদিন রাত অনিকের দিকে তাকিয়ে থাকিস। সংসার করা লাগবে না। মন তো ওইখানেই।”
-“কি যে বলো না গো!”
-” ওহ মাই গড! নিশুউউ তুই তো ব্লাশিং করছিসরে। আয়নায় দেখ দেখ। হাহাহা”

ভাবী হাসতে লাগলেন। আমি ও হেসে ছাদে চলে এলাম। বাসার ছাদে আমি খুব একটা যেতাম না। কিন্তু ইদানিং খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে হয়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছাদে এসে সূর্যোদয় দেখতে ইচ্ছে হয় আবার সন্ধে হওয়ার আগে সূর্যাস্ত দেখতে ইচ্ছে হয়। ইদানীং সবই ভাল্লাগে, সব। মায়ের কাধে মাথা রেখে ঘুমাতে ভাল্লাগে, মায়ের জীবনের গল্পগুলো শুনতে ভাল্লাগে। বাবার সাথে দাবা খেলতে তো আমি এক পায়ে খাড়া। যদিও বারবার বাবার সাথে হেরে যাই আমি। একদিনই জিতেছিলাম তবে সেই খেলায় আমাকে সাপোর্ট করেছে মা, ভাবী আর মি. ফারহান। হিহিহি
রাত ঠিক বারোটায় আমার ফোনে আননোন নাম্বার থেকে টেক্সট আসলো। টেক্সটটা এরকম, “তুমি জানবে না, একখণ্ড মেঘের জন্যে কী বিশাল মরুভুমি , অভ্যন্তরে তুমুল সাইমুমে বিশটি চৈত্রের নিচে পুড়ে যায়, অক্ষম ক্ষোভে! শুভ জন্মদিন এন আই এস এইচ ইউ এস এ এম আই এইচ এ…. সব কথা শেষ হলে করাঘাত জাগাবে তোমায়, তুমি এসে খুলবে দুয়োর- দেখা হবে না।”

আজকে আমার জন্মদিন? আজকে কয় তারিখ? এটা কি ধরনের বার্থডে উইশ? অদ্ভুত! কে পাঠালো এটা? আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঠিক সকালেও এরকম আরেক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মেইন ডোর খুলে দেখি কেউ নেই। ফ্লোরে একটা বক্স। বক্সটা নিয়ে খুলে দেখলাম ভিতরে কেক এবং চিরকুট। আমি চিরকুটটা নিয়ে রুমে চলে এলাম। তাতে গুটি গুটি অক্ষরে কিছু কবিতাংশ লিখা, “‘দুয়ার বন্ধ করলেই আমি ফিরে যাবো নির্বিকার, অস্বীকার করো মেনে নেবো। এলবামে স্মৃতি নেই বলে আদৌ দুঃখ করি না, সোনালি নিসঙ্গতায় আমার বিচিত্র দুঃখের সমাবেশ সঞ্চয় । ব্যথা দাও,বুকে রাখবো ব্যথায় ভাঙবে না বুক বুকে ব্যথা আছে।’ ‘স্বপ্ন ডুবিয়ে নির্ভার হতে চেয়ে ডুবছি এখন স্বপ্নের বোঝা ব’য়ে..’ ‘নিঃসঙ্গতাই ব্যার্থতা নয়- প্রচলিত সামাজিক প্রানী জেনে রাখো একা থাকা মানে অন্ধ পরাজয় নয়, পরাজয় ভিন্ন কিছু।’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কে পাঠিয়েছে? আমাকে এসব লিখার মতো কে থাকতে পারে। আমি এটা শিওর রাতের টেক্সট আর এখনের পার্সেল একই ব্যক্তির পাঠানো। বাই এনি চান্স, অনিক পাঠায়নি তো? তাহলে কি সে লিখছে এসব? সাথে সাথেই আমি অনিকের নাম্বারে ডায়াল করলাম। কিন্তু নাম্বার বিজি, আমি এখনও ব্লকড!

অনিকের মা বাবা আমাকে দেখে গিয়েছিলেন দিন তিনেক আগে। উনারা বলেছিলেন উনাদের ছেলের সাথে কথা বলে জানাবেন। কিন্তু তিনদিন পার হওয়ার পর ও নিজে থেকে উনারা কিছুই জানালেন না। আমার জোড়াজুড়িতে বাবা সলিম আংকেলকে দিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। সলিম আংকেল আমার বাবার কলিগ। আংকেল জানালো, তারা আমাকে রিজেক্ট করেছে। তারা নয় রিজেক্ট করেছে অনিক কারণ আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করিনি। সোজা কথায় আমি একজন পিএইচডি করা ইঞ্জিনিয়ারের অযোগ্য! অথচ বাবা নিজে অনিকের বাবা মাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। রিজেক্ট হওয়ার পর যতটা না কষ্ট পেয়েছি আমি তারচেয়ে বেশি পেয়েছি বাবার পরাজিত মুখটা দেখে। প্রথমবার আমার বাবাকে দেখে মনে হলো বাবা যেন কোনো এক যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। আমার চেয়ে যেন বাবাই বেশি আশাহত হয়েছেন।

সেদিনই বাবা স্ট্রোক করেন। বাবার শরীরের পুরো বাম দিকটাই প্যারালাইজড হয়ে গেলো। হুইলচেয়ার আর বিছানার মধ্যেই বাবার জীবন চলতে লাগলো। আমার জন্য বাবার এই হাল মেনে নিতে পারছিলাম না। নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হতো। আমার নিজের জীবনের প্রতি আমারই বিরক্ত এসে গিয়েছে। এর জন্য পরিবারের মানুষগুলো আমাকে কোনোরকম দোষারোপ করেনি। মা মাঝেমধ্যে বলতেন, একটা কোথাকার ছেলের জন্য আমার পুরো সংসার ধবংস হয়ে গেলো।

বাবার কন্ডিশন আগের থেকে অনেকটা বেটার। এর মাঝে রুম্পা জানালো অনিকের বিয়ে। এবার আমি আরো ভেঙে পড়লাম। আমি কি সত্যিই তার অযোগ্য? সেই সময়ও মি. ফারহান পাশে দাড়ালেন। অনিকের বিয়ের কথা শুনে তিনি পুরো হতভম্ব হয়ে গেলেন৷ আমাকে উপদেশ সূচক বক্কর চক্কর কি সব বললেন। আমি সবটাই অগ্রাহ্য করলাম। এই লোকটার মাথা খারাপ! একদিন আমি সোজা অনিকের অফিসে চলে গেলাম। তার কাছ থেকে আমার অনেক কিছু জানার বাকী। আমাকে দেখেই বললো,

-“তুমি কেন এসেছো?” আমি ছুটে গিয়ে তার কলার চেপে ধরে বললাম,
-“কেন আমাকে বিয়ে করা যায় না? কেন আমাকে ভালোবাসা যায় না? কেন?” অনিক আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কলার ঠিক করে বললো,
-“কোন চীপ মেন্টালিটির মেয়ের দিকে আমি ভুলেও তাকাই না”
-“মানে?”

অনিক হাসলো। ফোন বের করে আমার চোখের সামনে ধরলো। আমার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেলো মনে হলো। অনেকগুলো স্ক্রিনশট যেগুলো আমার আইডি থেকে বিভিন্ন সময়ে অনিকের ফ্রেন্ডলিষ্টে থাকা মেয়েদের পাঠানো মেসেজ। অনেককে গালি দিয়েছি, অনেককে আজেবাজে কথা শুনিয়েছি। আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি এই সামান্য বিষয় আমার জীবনে কাল হয়ে দাড়াবে। মাত্র সামান্য একটা বিষয়ের জন্য আমার, আমার পরিবারের এই অবস্থা! প্রায় তিনটা বছর ধরে কষ্ট পাচ্ছি আমি। “এই গল্পের লেখিকা নীলাদ্রি নীরা। গল্পটা অনেকেই চুরি করছে। অন্য কারো নামে দেখলে অবশ্যই প্রতিবাদ জানাবেন প্লিজ” আমি অনিকের পা ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। অনিক আমাকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বললো,

-” কি ভেবেছো পা ধরে কাঁদবে আর আমি সব ভুলে গিয়ে তোমাকে কাছে টেনে নিবো? তবে তুমি এখনও স্বপ্ন দেখছো। এমনটা হওয়ার হলে আমি অনেক আগেই তোমাকে নিজের করে নিতাম। একটা ব্যাপার জানো তো, আমার জীবনে আমাকে অনেকেই ভালোবেসেছে। আমি রিজেক্ট করেছি তো চলে গিয়েছে। শুধু তুমি যাও নি। সেই হিসেবে তুমি ট্রু লাভ করেছো তাই না?” অনিক থামলো। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি না।

-” নিশু তোমার কি মনে হয় তুমি ট্রু লাভ করেছো? একটা সম্পর্ক তৈরি হয় বিশ্বাস থেকে আর টিকেও থাকে বিশ্বাসের উপর। তুমি যখন প্রথমবার আমাকে দেখলে, তোমার ভালো লাগলো। তুমি কি করলে? আমার আইডি খুজে আমার লিস্টের ফিমেল ফ্রেন্ডদের গালিগালাজ করতে শুরু করে দিলে। অনেককে বলেছো তুমি আমার বউ, আমার গার্লফ্রেন্ড। তোমার কি একবারও মনে হয় নি এদের মধ্যে কেউ আমার বোন কিংবা সম্পর্কে ভাতিজি কিংবা ভাগ্নীও হতে পারে? তোমার মনে হয় নি এসবের কারনে আমাকে কতটা কালার হতে হবে সবার কাছে? তুমি একবারও ভাবো নি কতটা নীচ একটা কাজ তুমি করে যাচ্ছো দিনের পর দিন। তোমার ভাবার সময় হয় নি কারণ তুমি মোহে মোহিত হয়েছিলে।

তুমি সব ভুলে গিয়ে শুরু করলে বিশ্রি একটা খেলা। আমার নিজের বোনকেও তুমি বাদ দাও নি। তাকে পর্যন্ত বিশ্রী কথা শুনিয়েছো। ওয়াজ ইট ট্রু লাভ নিশু? ভার্সিটিতে আমি প্রথম তোমাকে ওই যে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলেছিলাম কেন জানো? তোমার এই জঘন্য খেলার জন্য। তোমাকে আমি এরপর যতবার অপদস্থ করেছি এই কাজের জন্যই। আর এখনও তোমাকে ঘৃণা করি তোমার এই কাজের জন্যই। শুধু আমি নই আমার পুরো পরিবার তোমাকে ঘৃণা করে। ভালো হয় তুমি সবকিছু ভুলে গিয়ে সুন্দর স্বাভাবিক একটা জীবন লীড করো। তোমার সাথে চঞ্চলতা মানায়, তোমাকে হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগে। তোমার বিদ্ধস্ত চেহারাটা দেখলে আমার নিজেকে দায়ী মনে হয়, কিন্তু দেখো তাতে আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো জানি আমার জায়গা থেকে আমি রাইট।”

আমি কতদিন পর চিৎকার করে কেঁদেছি আমি জানি না। বাসায় ফিরে দেখলাম পুরো বাসায় লোকজন ভর্তি। মা পাগলের মতো করছেন। আমাকে দেখে তেড়ে আসলেন। কারা যেনো মাকে আটকালো। মা বলতে লাগলেন, অলক্ষী বেঈমান মেয়ে! নিজের বাবাকে শেষ করলি ডাইনী। তুই আমার নিজের মেয়ে না। ভাইয়া ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বাবা মারা গিয়েছেন। বাবার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। একমাত্র আমি। সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা সহ্য করার মত ক্ষমতা আমার নেই। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি। আমার ঘুম দরকার, গভীর ঘুম।

টপটপ করে চোখের জল গড়িয়ে পড়লো ডাইরীতে লিখা শেষ পৃষ্ঠায়। আলিনা ডায়েরীটার শেষ পৃষ্ঠায় লিখলো, “একটা তিক্ত সত্য না জেনেই নিজের জীবনটা শেষ করে দিলে তুমি। তুমি নিজে জানলেও না আমার ভাইটা তোমাকে বহু আগেই ক্ষমা করে দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলো। শুধু তুমি কেন? আমরা কেউই জানতাম না। তোমার জীবনটা সে নষ্ট করতে চায়নি বলেই তোমাকে দূরে রেখে দিয়েছে। এতোটা ভালোবাসা, এতো পাগলামি কি এড়িয়ে যাওয়া যায় নিশু? ক্ষমা না করে কি থাকা যায়? কেউ তোমাকে ঘৃণা করতো না, সবাই ভালোবাসতো। তুমি এই সত্যিটা জানলে না। জানতাম না আমরাও। জানতো শুধু ফারহান। ভাইয়া তাকে জানিয়েছিলো তোমাকে সাপোর্ট করার জন্য। তুমি কিছুই বুঝলে না। এতো বোকা কেন তুমি?

বোকা তো আমরাও। একটা মানুষ ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে গেলো আমরা কেউ টেরই পেলাম না। ভাইয়ার প্ল্যান অনুযায়ী তোমাকে জানানো হয় বিয়ের কথা। যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। শুধু মাত্র তুমি সব ভুলে নিজেকে সুখে রাখো এই আশায় হয়তো বলেছিলো। আচ্ছা বাদ দাও, আমার খুব জানার ইচ্ছে তোমরা দুজনে কেমন আছো? একসাথে আছো তো? আমার অনেক ইচ্ছে হয় তোমাকে ভাবী ডাকতে। নিয়তি এমন কেন বলো তো? কেন এত খেলে?
চোখ দুটো আবারও ঝাপসা হয়ে আসছে আলিনার। আলিনাকে ডায়েরিটা দিয়েছে ওর স্বামী ফারহান ইমতিয়াজ। ডায়েরিটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে সে। আফসোস ভাইয়ের ডায়েরিটা পায় নি। কারণ সেটা অনিক পুড়িয়ে ফেলেছিলো। ফারহান আলিনাকে ডায়েরি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে দেখে বললো,

-“আলু আর কত ডায়েরিটা পড়বে? প্রতিদিন এটা পড়ো আর কান্না করো। তোমার এই অবস্থায় এসব কি ঠিক হচ্ছে?” আলিনা নাক টানতে টানতে অভিমানের সুরে বললো,

-” তুমি নিশুর ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানো। কিন্তু আমাকে বলছো না। না বললে আমি প্রতিদিনই পড়ব আর খুজে বের করবো ব্যাপারটা কি!”

-“অনেক বারই তো চেষ্টা করলে। বের করতে পেরেছো?”
-” তাহলে তুমিই বলে দিতে পারো। আমার কাছে লুকানোর কি আছে?”
-” আমি কখন লুকিয়েছি? ইনফ্যাক্ট আমি তোমাকে কিছুই বলিইনি, তুমি যতটুকু বুঝেছো সেটা ডায়েরি পড়ে আর বাস্তবের সাক্ষী হয়ে। আলু আমার দেখা একটা অন্যরকম কেস ছিলো নিশুর গল্পটা। আমি নিজেও পুরোপুরি হিসেব মেলাতে পারছিনা।”

-” কিসের হিসাব? আজকে অন্তত বলো?”
-” কি যে বলবো। আচ্ছা তুমি ডায়েরিতে অনেকগুলো লেখায় মার্ক করা খেয়াল করেছো?”
-” হুম। বিরক্তও হয়েছি এর জন্য”
-” আচ্ছা দেখো, নিশু প্রথমে লিখেছে তাকে অনিক র‍্যাগ দিয়েছে + প্রপোজের জন্যও পানিশমেন্ট দিয়েছে।

সেগুলো যেমন তেমন ছিলো না। তার জন্য ওকে ভার্সিটিতেও অনেকের হাসির খোরাক হতে হয়েছে। তবু নিশু সেটা সহ্য করেছে। ভালোবাসা মানে সবকিছু সহ্য করা না। আমি যদি তোমার সাথে এমন করতাম, তুমি মেনে নিতে?”

-“অবশ্যই না।”
-” কিন্তু নিশু দেখো। টু শব্দও করেনি আবার অনিকের প্রতি ভালোবাসাও কমায় নি।”
-” হ্যা ব্যাপারটায় আমি খুব অবাক হয়েছি।”
-” তারচেয়ে বড় কথা ও ছোটবেলা থেকে স্নেহ ভালোবাসা খুব কম পেয়েছে।

আংকেল আন্টি দুজনেই জব করতেন। সেই হিসেবে ও তাদের থেকে সময়, স্নেহ, ভালোবাসা খুব কম পেয়েছে সেটাও ও লিখেছে। ও একটু কেয়ার, ভালোবাসা চাইতো উনাদের কাছে। ব্যাপারটা দাঁড়ায় ও এই অভাববোধের কারনেই এত কিছু টলারেট করেছে, সহ্য করেছে। কিন্তু তাই বলে এতো সেটাও মানা যায় না। আমি যেদিন জাহিনের থেকে নিশুর কথা শুনি তখনই মনে হয়েছে নিশু ছোটবেলা থেকেই মেন্টালি উইক।

ও একা থাকতে থাকতে ওরকম হয়েছ নাকি সেটা কেয়ারিং এর অভাবে নাকি অন্যকিছু আই ডোন্ট নো। আমি স্টীল ক্লিয়ার হতে পারিনি। আর নিশুর সাথে আলাপ যখন হয় তখন তো ও পুরোপুরি এবনরমাল ছিলো। ও যখন সুস্থ্য হয় তখন আমি অনিকের ব্যাপারটা ইনডিরেক্টলি বলেছি। কিন্তু ও বুঝেনি। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স অনেক ভালো। ও আইডিয়া করতে পারতো ব্যাপারটা কি দাড়াবে কিন্তু ও কিছুই বুঝলো না ইভেন এগুলো নিয়ে ভাবলোও না। ওর বার্থডেতে অনিক যে টেক্সট গুলো দেয় সেগুলো নিয়েও ও ভাবেনি। উল্টো আমাকে মাথা খারাপ বানিয়ে দিয়েছে! ও যদি আমার কথাগুলো প্লাস অনিকের পাঠানো টেক্সট গুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতো তাহলে দুই এ দুই এ চার মেলাতেই পারতো।”

-” স্ট্র‍্যাঞ্জ। আমি হলেও পুরো ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলতাম। ও যে কেন এত বোকামি করলো।”
-” আচ্ছা বাদ দাও এসব। পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে যেগুলো আমরা ভাবতেও পারিনা। এটাও ওরকম।”

পরিশিষ্টঃ নিশু যেদিন আত্মহত্যা করে একই দিনে দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর লিউকোমিয়ায় তিলে তিলে শেষ হয়ে মারা যায় অনিক। সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে সরাসরি রুমে গিয়ে রুম বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে সে। এই ঘুম গভীর ঘুম, শান্তির ঘুম, চিরতরে ঘুম। দুজনের কেউই কারো মৃত্যুর খবর জানলো না, জানার সময়টুকু পেলো না। কেউ কিছুই জানলো না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত