গত দুদিন আমার চোখে একটা কালো কাপড় বাঁধা ছিল। ধুলোয় ধুলোয় আমার সাদা কামিজটা ধূসর আর চোখে বাঁধা কালো কাপড়টা ছাই বর্ণ ধারণ করেছে।ঠোঁটের কোনায় জমাট বাঁধা রক্তের নোনা স্বাদ। আমার কাছে নিজেকে হাত- পা আর অনুভূতিবিহীন একজন মানুষ লাগছে।
অবশ্য আমাকে এভাবে কোরবানির গরুর মতো কষ্ট করে বেঁধে না রাখলেও আমি কোথাও পালাতে পারতামনা। শক্তি নেই। এই দুদিনে আমাকে প্রতিবেলা খাবার দিতে এসে তারা আমার সামনেই অনেক জল্পনা কল্পনা করছে আমাকে নিয়ে। কিন্তু কেন যেন তারা কিছু ঠিক করতে পারছেনা । একবার বলছে মেরে নদীতে ফেলে দেবে, একবার বলছে কেটে কুকুরকে দিয়ে দেবে, আরেকবার বলছে মাথা ফাটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখবে। কথা বলার সুযোগ থাকলে তাদেরকে বলতাম যা করার তাড়াতাড়ি করতে। এভাবে কোনোকিছুর স্বাদ পাচ্ছিনা। না ব্যথা,না কষ্ট,না খাবার,না শ্বাস- প্রশ্বাস এ। কোনোকিছুতেই স্বাদ নেই,তাই মৃত্যুর স্বাদ পেতে মন চাচ্ছে। এই দুই-দিনে তেমন কেউ আমার কাছে আসেনি। প্রথম রাতে সবাই এসেছিলো। একের পর এক। দেখতে আসেনি অবশ্য,স্বাদ নিতে এসেছিল।
কিন্তু প্রতিদিন একজন মানুষ কেবল এই অন্ধকার রুমটায় কেবল মুখের ওপর শ্বাস ফেলে চলে যেত। মানুষটার ঘ্রাণ আমার খুব চেনা। আমার কেন জানি মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছা করে ভীষণ।অনুমান করছি এই মানুষটার জন্যই আমি এখনো বেঁচে আছি। নয়তো প্রথম রাতেই আমি ওই বিশাল নালায় পড়ে থাকতাম। আজ সকালে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এসে আমার চোখের কালো কাপড়টা খুলে দুটো লাথি মারলেন। আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না। ভীষণ আলোয় চোখগুলোতে প্রথম ব্যথা অনুভব করলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখের উপর এক বালতি পানি দিয়ে কে যেন চিৎকার করে উঠলো, “উঠ শালী !” এক ঘন্টার মধ্যে আমার হাত-পায়ের ক্ষতগুলোতে স্যাভলনের ঘষায় আর পানির ধাক্কায় যেন পুরো শরীর নাড়া দিয়ে গেলো। জমে থাকা ব্যথা গুলো আস্তে আস্তে মাথায় বারি দিচ্ছিল।
থাপ্পড়ের জোরে আমি দুটো শুকনো রুটি খেলাম। খাওয়ার সময় আমি চোখ খুলে চার পাঁচজনের ভিড়ে মানুষটাকে খুঁজছিলাম।খুঁজে পাইনি। এরপর চোখে আবার সেই কালো কাপড় বেঁধে একটা গাড়িতে উঠানো হলো আমাকে। মানুষগুলোর কথা শুনে ধারণা করছি বেশ্যা পল্লীতে নেয়া হবে। অনেকদিন পর সেই ছোটবেলার মতো আমি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পার্থক্য শুধু বাবার কাঁধটা ছিলোনা। ঘুমের ঘোরে কে যেন আমার মাথায় হাত রাখলো। চিরচেনা সেই ঘ্রাণটা যেন নাকে এসে লাগলো। আমি আরো গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো একটা বিড়ালের ডাকে। চোখ – হাত পা বাঁধা অবস্থায় কোথায় যেন তারা ফেলে রেখেছে আমাকে। কানের একদম কাছেই সম্ভবত একটা বিড়াল বসে আছে। বাম পায়ের রানে প্রচন্ড ব্যথা। ইচ্ছা করছে পা টা কেটে ফেলতে। আশেপাশে কিছু মেয়েদের কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু কানে আসছে না। শুয়ে শুয়ে আমার মিনির কথা ভাবতে লাগলাম। মিনির ডাক পাশের বিড়ালটার মতো এত ভারী না। মিনি চিকন কণ্ঠে মিয়াও মিয়াও করতো।
একটা ফাল্গুনের বিকেলে অন্ময় গাছ থেকে মিনিকে ধরে এনেছিলো। আমরা দুজন তখন কলেজে। হাঁটতে বের হয়ে দেখি একটা গাছের উপর মিনি চিকন কণ্ঠে ডাকছে। ছোট্ট ধবধবে একটা বিড়াল ছানা। অথচ এই ছোট্ট মায়াবী প্রাণীটাকে বাঁচাতে গিয়ে অন্ময়কে দু-তিনটে খামচি খেতে হয়েছে। পরবর্তীতে অন্ময় মিনিকে দেখতে পারতোনা। মিনি নাকি তার জন্য আমার বরাদ্দ সময় আর আদরের অনেকটুকু কেড়ে নিয়েছিল। কথাটা মনে পড়তেই আমি হেসে উঠলাম। সাথে সাথে কে যেন লাথি মেরে চিৎকার করে উঠলো, ” মাইয়া তো হাসতেছে মুরব্বি । ফাগল ধরায় দিলনি?” একটা বৃদ্ধ ভরাট কণ্ঠ ভেসে উঠলো কানে,” ফাগল হইলে রাস্তায় ফালায় দিমুনে। টেকা তো দেইনাই এর লাইগ্গা। ফিরি মাল।জোর জবরদোস্তিতে রাখছি। যা হওয়ার হইবো।”
” সাবধানে রাখবেন। কিছু যেন না হয়। পলিটিকাল মামলা। কিছু হইলে আগুন ধরায় দিমু।”, ভারী কণ্ঠে একজন উত্তর দিলো। খাঁটি আঞ্চলিক টানের আওয়াজটা চিনতে আমার অসুবিধা হলোনা। সালেহীন এর আওয়াজ। ” তো ফাইভস্টার হোটেলে নিয়া রাখেন। এখানে আনছেন কেন? আমরা কইছি রাখমু?”,বৃদ্ধ লোকটা চেঁচিয়ে উঠলো। “চুপ একদম শালা ! যা বলছি কর”,সালেহীনের ধমকে সব শান্ত হয়ে গেল। পাঁচমিনিট পরে আমাকে উঠানো হলো। চোখের কালো কাপড় খোলার আগে কাছ থেকে আবার সেই চিরচেনাঘ্রাণ পেলাম। কেমন যেন গা শিরশির করে উঠলো। এরপর পরই আমার জায়গা পরিবর্তন হলো।হাতমুখ,চোখ খুলে একটা রুমে রাখলো আমাকে তারা। নড়াচড়ার শক্তি আমার নেই। তারপরও উঠে বসলাম।
জরাজীর্ণ একটা রুম । একটা হলুদ বাল্ব খুব কষ্টে মিটমিট করে জ্বলছে। বাল্বের আলোতে রুমটা আরো অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। খাটের এক পাশে জোড়াতালি মারা একটা মশারি আধা টাঙানো। খাটের ডানপাশে একটা পুরনো কাঠের টেবিল। বামপাশের দেয়ালে একটা কাঠের খুপরি জানালা। জানালার পাশে বিশাল বড় একটা কাঁঠাল গাছ। বাইরে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রুমের ঠিক সামনে জানালা দিয়ে আরেকটা বিল্ডিং দেখা যায়। দেখলাম মেয়েরা বেশ সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিং এর আনাচে কানাচে।
গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল হঠাৎ। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের চিৎকার এর আওয়াজ শুনলাম। ঘাড় নাড়তে কষ্ট হচ্ছিল আমার। কষ্ট করে নিচে তাকিয়ে দেখি , একটা কালো গাড়িতে সালেহীন এর সাথে অন্ময় উঠলো। পিছনে কালো ধোঁয়া ছেড়ে গাড়িটা চলে গেল। চোখ বেয়ে মনের অজান্তে একফোঁটা নোনা জল বেয়ে পড়লো। এ জায়গা কি আমার নির্দিষ্ট স্থান? কেন মেরে ফেললো না তারা আমাকে? কোনো এক বর্ষার বিকেলে মা ,বাবার সাথে খুব ঝগড়া করে যখন সব গুছিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলেন ,জানালা দিয়ে একটা বিশাল বড় কালো গাড়ি দেখলাম আমি। গাড়ি থেকে নীল পাঞ্জাবিতে একজন চল্লিশ- পঁয়তাল্লিশের ভদ্রলোক নেমে আসলেন। মা কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠে গেলেন।
আমার বাবা বেশ খামখেয়ালি মানুষ। বেশিরভাগ লেখকদের কখনো সংসারের হিসাব থাকেনা। বাবা বলতেন, “সাহিত্যের ব্যবসা করলে সংসার টিকে, সাহিত্য টেকেনা।” বাবার কাছে জীবন মানে এক কাপ চায়ের সাথে সকাল সকাল আমাকে নিয়ে গল্প করা ছিল। বর্ষাকালে মার সাথে ঝগড়া করলে তার জন্য বাবা একটা গ্লাসে বৃষ্টির পানি জমাতেন, গরমকালে রাস্তার উত্তপ্ত বালু নিয়ে আসতেন, শীত আর ফাল্গুনে বারান্দার অযত্নে ফোটা ফুল । বাবার এসব খামখেয়ালিপনা মা মেনে নিতেন। কিন্তু খামখেয়ালির সংসার গুছাতে গিয়ে মা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। মার সেই ক্লান্তি দূর করার জন্য বাবার বৃষ্টির পানিতে বানানো চা যথেষ্ঠ ছিলোনা। একগুচ্ছ বেলিফুলও যথেষ্ঠ ছিলোনা। বাবার কাছে কখনো মার টাকার আবদার ছিলোনা, দায়িত্ব পালনের আবদার ছিল। বাথরুমের কল নষ্ট হয়ে গেলে মা ঠিক করানোর মানুষ খুঁজে পেতেন না। বারান্দার সিলিং বেয়ে বর্ষার আশীর্বাদ নেমে এলে মা নীচে হাঁড়ি পাতিল দিয়ে রাখতেন। রান্নার সময় হঠাৎ তেলের ভান্ডার খালি হয়ে গেলে মা রান্না বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকতেন।
প্রতিটা জিনিসে বাবার খামখেয়ালি ছিল। কিন্তু বাবা খামখেয়ালি গুলোকে রঙিন করে ফেলতে পারতেন।বাবা ভালোবাসতেন কিনা জানিনা ,কিন্তু কথাগুলো ভালোবাসা দিয়ে বলতেন। কিন্তু খামখেয়ালির জোরে শেষ পর্যন্ত আমার ভীষণ রূপবতী মা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাবা আটকালেন না। আমি আমার বাবার মতই ছিলাম। বাবার মতো ছোট ছোট জিনিসগুলোয় ভীষণ আনন্দ পেতাম। আমার দিন কাটতো বাবার অযত্নে রাখা ছিন্ন কাগজগুলো পড়ে।ভোর বেলা বাবা আমাকে নিয়ে হাঁটতে যেতেন। কাঠগোলাপ আর শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতাম আমি। কখনো সাদা পানিতে ভাসাতাম ,কখনো বই এর ভাঁজে রেখে দিতাম।
মাঝে মাঝে আমাকে নেয়ার জন্য কালো গাড়ি আসতো। আমি সেদিন চুলে লম্বা বেনি করতাম। চোখে কাজল দিতাম। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। আমার সৎবাবার নাম ফজলুল করিম। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় তিনি মাকে বিয়ে করেন। এই নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা হয় সব জায়গায়। নামকরা একজন লেখকের স্ত্রী তাকে ছেড়ে একজন নেতাকে বিয়ে করেছেন,সমালোচনা হবারই কথা। আমার সৎ বাবার বাসায় বেড়াতে গিয়ে আমি তার ছয় বছরের ছোট ছেলেটার সাথে খেলা ছাড়া আর কিছুই করতাম না। তখন আমি সবে মাত্র কিশোরী। অন্ময়কে আমি সেই বাসাতেই চিনেছিলাম। ফজলুল করিমের বন্ধুর ছেলে।
সেই বাসাতেই থাকতো। তার ভীষণ সুন্দর একটা ওয়াচ গ্লাস ভেঙে ফেলেছিলাম। ভেঙ্গে চুপচাপ বসে নিজেই কাঁদছিলাম। অবশ্য আমার কান্না দেখে সেদিন অন্ময় ইচ্ছামতো হেসেছিলো। অদ্ভুত লেগেছিল, ছেলেটা আমাকে একটুও শান্তনা দেয়নি। শুধু পাগলের হাসি হাসছিল। যেদিন অন্ময় প্রথম আমার হাত ধরলো সেদিন থেকেই আমার ভেতরের পরিবর্তনটা বাবা ধরতে পেরেছিলেন। একদিন খুব ভোরে বাবা আমাকে নিয়ে হাঁটতে যাওয়ার পর একটা চিরকুট দিলেন। আমার হাতভর্তি তখন শিউলি ফুল। গাছের গোড়ায় বসে কোলের উপর শিউলি ফুল নিয়ে আমি চিরকুট খুলে দেখলাম বাবা লিখেছেন-“একমুঠো কাঠ গোলাপের মায়ায় ভাসাও সাগরমনে রেখো তার রাজ্যে তুমি ছোট্ট একটা নগর” বাবা প্রত্যেকদিন এরপর একটা করে চিরকুট লিখতেন। আমি সেগুলো অন্ময়কে দেখাতাম। অন্ময় কেবল হাসতো।
জীবনটা স্বপ্নের মতো যাচ্ছিল। শুধু মা সহ্য করতে পারতেন না কোনোকিছুই। তারপরও কিছু বলতেন না। আমি বুঝতে পারতাম সব। কিন্তু মাথা ঘামাতাম না। একদিন একদিন করে একবছর কেটে যাওয়ার পর রোজ সকালের মতো আমি আর বাবা হাঁটতে বের হলাম। আমার জীবনের প্রত্যেকটা হিসাব অন্ময় এর জানা ছিল। কখন কোথায় যাই, কি করি। সবসময়ের মত বাবা আমাকে শিউলি তলায় একটা চিরকুট দিলেন। চিরকুট খোলার আগেই ভোরের কুয়াশায় কে যেন বাবাকে গুলি করলো।
বাবার কাছে দৌড়ে গেলাম। পাখিগুলো উড়ে গেল। আর শিউলিতলায় ফুলের ভিড়ে বাবার শেষ চিরকুটটা হাহাকারের সাথে পড়ে রইলো। সকাল সকাল জানালার পাশের গাছটায় দুটো শালিক বসে আছে।রাতে ব্যথায় ঘুমোতে পারিনি। কেন যেন বাবার কথা মনে পড়ছে। সেদিন বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম। তারা বাবাকে ফোন দিতে বলেছিল। আমি আমার সৎ বাবাকে ফোন না দিয়ে আসল বাবাকে ফোন দিয়ে ফেললাম। একজন মহিলা খুব যত্ন করে বললেন এই নাম্বারটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। আমার সৎ বাবা,ফজলুল করিমের নাম্বার আমার মুখস্ত নেই। সে জন্য আরেকদফা অত্যাচার সহ্য করতে হলো। পরে তারা নিজেরাই তাকে ফোন দিলো।
ফজলুল করিমের সাথে তাদের কি কথা হয়েছে জানিনা ।দেনা পাওনা বলতে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। আমি মনে মনে হাসলাম। আমার জন্য ফজলুল করিম ক্ষমতা ছাড়বে এটা বিশ্বাস করাটা হাস্যকর। জোড়া ভেঙে একটা শালিক উড়াল দিলো। অন্য শালিকটা কিছুক্ষন এদিক সেদিক তাকিয়ে পিছন পিছন উড়ে গেল। অন্ময় পাখিদের এসব কান্ড অনেক খেয়াল করতো। আমাকে বলতো পাখিরাও মানুষের মতো প্রেমে পড়ে। আমি কেবল হাসতাম। মেয়েরা কারো মধ্যে সাহিত্যের ছোঁয়া দেখলে খুব সহজে প্রেমে পড়ে। আমি প্রথমবার আমার বাবার প্রেমে পড়েছি। এরপর অন্ময় এর। বিকেল পর্যন্ত আমি না খেয়েই রইলাম। বিছানার পাশে টেবিলটায় সকালের নাস্তা , দুপুরের খাবার পড়ে আছে।
সন্ধে নাগাদ একজন মধ্যবয়স্ক মহিলার সাথে একজন তরুণী ঢুকলো। তরুণীর ঠোঁটে কড়া গোলাপি লিপস্টিক। আমাকে কিছুক্ষন বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখার পর টেবিলে তাকিয়ে বললো,”খেয়ে নে। কাস্টমার আইলে রং বুঝবি।”
মধ্যবয়স্কা মুখে পান চিবাতে চিবাতে বললেন, “এটা কাস্টুমার এর মাল না গো রেহানা। কাস্টুমার এর অইলে তুমি দেখতে আইতানা।” তাকিয়ে দেখলাম রেহানা নামের মেয়েটি আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। আমি হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “অন্ময় আসে এখানে?” তারা দুইজন উত্তর না দিয়ে উঠে বের হয়ে গেল। ঈষৎ হাসলাম আমি। গল্প উপন্যাসের কাহিনী। এখানেও সাহিত্য। প্রেমিক বেশ্যা পল্লীতে আসে। তার প্রতি একজন ভালো মনের বেশ্যা দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু প্রেমিকের মন পড়ে থাকে প্রেমিকার কাছে। এই দুইজনের জন্য অসহায় বেশ্যা মেয়েটা জান দিতেও প্রস্তুত থাকে। কেন যেন হাসি আসলো।
রাতের বেলা বিছানায় বসে আমি নিজেই খেয়ে নিলাম। মোটা চালের ভাত ,কি যেন একটা মাছের তরকারি আর ডাল। আমার খেতে কোনো অসুবিধা হলোনা। ওরকম কোনো বিলাসী মানুষ না আমি। বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে কুমড়ো ফুলের বড়া খেয়েছি, দুপুরে গাছের নিচে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে শুধু শাক দিয়েই তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে উঠে গেছি। বাবা সবসময় নতুন নতুন জিনিস খুঁজে বেড়াতেন। একবার বাজার থেকে কুঁচো চিংড়ি ,টেংরা, মলা, পুটি আরো কি কি ছোট ছোট মাছ এনে সব একসাথে দিয়ে একটা তরকারি রাঁধলেন। অদ্ভুতভাবে বেশ মজা নিয়ে খেয়েছিলাম। লোকে বাবাকে পাগল বলতো, আবার অনেকে লেখকের ঢং বলে সম্বোধন করতো। বাবার লাশটা কি এখনো শিউলি তলায়ই পড়ে আছে কিনা কে জানে। হয়তো ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে এতক্ষনে। পত্রিকা পেলে ভালো হতো। খবরে এসেছে নিশ্চই। মা কি গিয়েছেন? যেতেও পারেন, না ও যেতে পারেন। মা হচ্ছেন রহস্যময়ী নারী। আমি বাবাকে বুঝতে শিখলেও মাকে কখনো পড়তে পারিনি।
খাওয়ার পর কিচ্ছুক্ষন জানালার পাশে বসে রইলাম। পায়ের দিকে থেকে সব ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। খোদা তায়ালা মনে হয় নারী জাতিকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েই পাঠিয়েছেন। কিভাবে যেন সামলে ওঠে সব। আমিও বেশ সামলে নিয়েছি।
বাঁচা আর মরার মাঝখানে থেকে সামলে নেয়াটাই স্বাভাবিক। “আমি কি আদৌ বেঁচে আছি? “, বিছানায় শুয়ে নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলাম। নাহ,মনে হয় বেঁচে নেই। মানুষ বেঁচে থাকে প্রিয় মানুষের মাঝখানে। নিজের জন্য যারা বাঁচে তারা মানুষ হয়না, তারা শক্ত ইট হয়।তাদের প্রাণ থাকেনা। আমার কাছে আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন বাবা আর অন্ময়। বাবা মারা গেছেন, অন্ময় আমার মাঝে নেই। সে হিসেবে বলা যায় আমি মরে গেছি। চোখের পাতা আস্তে আস্তে ভারী হয়ে আসলো। কেমন যেন গভীর প্রশান্তিতে তলিয়ে গেলাম। নিশ্চুপ ,নিস্তব্ধে..
-“কেমন আছো?”
প্রশ্নটা করে আমি রেনুর চোখের দিকে তাকালাম। রেণু ভ্রূক্ষেপ না করে হাঁটছে। সকালের বাতাসে চারদিকে কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। রাস্তায় লাল রঙের অসংখ্য ফুল আর পাতা ছড়িয়ে আছে। তার মাঝখানে আমি আর রেনু হাঁটছি। ভোরের পাখিগুলোর কিচিরমিচির এখনো থামেনি। রেনুর ঘুম ভাঙার আগেই আমি বসে ছিলাম। বেশ্যা পল্লীর চার দেয়ালের রুমটায় মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন নিজের প্রতি ঘেন্না হচ্ছিল।
রেনুর মুখে অনেকদিন নিজের নামটা শুনিনা। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে লম্বা বেনি করা কাজল চোখদুটো নাড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমার কাছে এসে মেয়েটা বলতো,”অন্ময় ! বলতো শিউলি ফুল এত সুন্দর কেন?” আমি হাসতাম। গতকাল ফজলুল করিমকে ফোন দিয়েছিলাম। কোনো দাবি তিনি মানবেন না। হাতের মুঠোয় ক্ষমতা রাখবেন। সামনে ইলেকশন। দুদিন ধরে রেণুকে নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা গুমের মামলা হিসেবে ধরছে। কোনো কোনো পত্রিকা রেনুর বাবা হত্যার সাথে সবকিছু জড়াচ্ছে। সবকিছু ধোঁয়াশার মধ্যে । ইলেকশন এর আর পাঁচমাস বাকি। রেণুকে ওখান থেকে বের করা যাবে না। দলের বাকি লোকেরা আজ রাতে তাকে মেরে ফেলবে। তাহলে মার্কেট আরো গরম হবে। জানিনা কি হবে। নির্লজ্জের মতো তাকে বাঁচাতে চাচ্ছি। পারছিনা।
মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিলাম ফজলুল করিমের বাসায়। বাবার বন্ধু হিসেবে তার বাসায় আসা যাওয়া হতো যে তা না,বরং ফজলুল করিম আমাকে হাতে রাখতে চাইতেন। বিরোধী দলের মানুষকে কাছে টানার প্রবণতা কখনো ভালো হয়না। ফজলুল করিম এখন টের পাচ্ছেন কিনা কে জানে। আমার মনে হয় তিনি পাচ্ছেন না। তিনি গন্ডার চামড়ার মানুষ। রেনু তার আপন মেয়ে না, সৎ মেয়ে। তাকে দিয়ে তার কিছুই আসে যাবেনা। দলের বাকীদেরকে আমি তাই বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম ,কিন্তু বুঝলাম ঘটনার মার-প্যাচ অন্যদিকে। মেয়েটার বাবা একজন নামকরা লেখক, মাকে নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কাহিনী হয়েছে। মেয়েটাকে আর তার বাবাকে নিয়ে কাহিনী করাই দলের সবার উদ্দেশ্য। রাজনীতি বড় খারাপ জিনিস। রেণুকে আমি বাঁচাতে পারবো না। তা আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। হয়তো নিজেকে শান্তনা দেয়ার জন্য এসব করছি। এটাই হয়তো আমাদের শেষ হাঁটা।
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। লাল ফুলের সমাহার আগেই শেষ হয়ে গেছে। একটা ছোট্ট গলি পাড় হয়ে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম দুজন। বিশাল বড় শিউলিতলা। তাকিয়ে দেখলাম রেনুর চোখ দুটো বাচ্চাদের মতো চকচক করছে। মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে শিউলি ফুল কুঁড়োতে শুরু করলো। ঠিকমতো দৌঁড়তে পারছে না । হয়তো ব্যথায়। আমি গাছের নিচে বসে রইলাম। চারিদিকে ঝিরঝিরে বাতাস।আকাশ কিছুটা মেঘলা। রেনুর লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসে উড়ছে। চোখের চাঞ্চল্য কেমন যেন চেহারার ক্লান্তিটুকু ঢেকে দিয়েছে। চোখের নিচের কালিগুলোও সুন্দর লাগছে। হঠাৎ ফুল কুড়ানো থামিয়ে আমার কাছে এসে বসলো রেনু। চেহারার মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেছে তার।
আমি পকেটে হাত দিয়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলাম। একটা চিরকুট। রেনুর কোলের উপর ছড়ানো শিউলি ফুলের মাঝে চিরকুটটা রেখে দিলাম। কাঁপা হাতে চিরকুটটা নিলো রেনু। আমি তখনো তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। বরাবর এক ফোঁটা পানি রেনুর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল। আমি একটা শিউলি ফুল তার চুলে গুঁজে দিলাম। ভোরের ঝিরঝিরে বাতাসে দুটো গুলির আওয়াজ মিশে গেলো। বাতাসে শিউলির ঘ্রাণে রক্তের গন্ধ মিলিয়ে গেল চুপ করে।