গোশত

গোশত

অনাকাঙ্খিত ভাবে আমি আমার মায়ের গর্ভে চলে এসেছিলাম। আমি যাতে পৃথিবীর আলো দেখতে না পারি তার জন্য কম চেষ্টা করে নি আমার আব্বা আম্মা, কিন্তু তবুও নির্লজ্জর মতো পৃথিবীতে আসি আমি। আমার বড়ো ভাইয়া -ভাবির প্রথম সন্তান তখন হামাগুড়ি দেয় আর মেজো ভাইয়া নতুন বিয়ে করে ঘরে বউ আনছেন। এসব কারনে আমি পৃথিবীতে আসি সেটা চায়নি তারা, একটা লোকলজ্জার ভয়ে।

প্রকৃতির নিয়মে আমার জন্ম হয়নি, পেট কেটে পৃথিবীতে আনা হয়েছিল আমাকে আম্মার অবস্থা অনেক খারাপ ছিলো বলে। সন্তান জন্মের এই পদ্ধতি কে তখন আমাদের গ্রামে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমার জন্মের পর থেকেই আম্মা নানা রকম অসুখে ভুগতে শুরু করে, বাচ্চা জন্মের এই পদ্ধতি নাকি পাপ এর ছিলো তার জন্য আম্মা নাকি অসুস্থ হয় প্রায় পাড়া প্রতিবেশী সেই কথাই বলতো।

একে তো শরীর ভালো যায় না আম্মার তার উপর আব্বার অত্যাচার, আব্বার ভয়ে আম্মা সবসময় নিঝুম হয়ে থাকেন কখন যে কোন ভুলে ঝামেলার সূচনা করেন কেউ বুঝতে পারে না। উনিশ থেকে বিশ কিংবা বিশ থেকেই উনিশ হলে আগে মাইর খাইতো আম্মা, আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতাম কিভাবে আম্মা বোবা মানুষের মতো মার সহ্য করতো।
আব্বা আম্মা কে মারলে ঘরে মারতো যাতে কেউ বুঝতে না পারে, কিন্তু আমি ছোট জন্য আব্বা আমাকে তোয়াক্কা করতো না। আমি শুধু দেখতাম আর ভাবতাম কোন দিন আর একটু বড়ো হয়ে আব্বার হাত থেকে তার লাঠি টা কেড়ে নিতে পারবো!

আমি তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর এ পড়ি তখন আমার বড়ো বোন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় শহরের কোনো এক ছেলের সাথে। আমাদের দোকান ছিল বাজারে তখন একটা, আব্বা অসময়ে দোকান থেকে বাড়ি ফিরে এসেই সবার সামনে আম্মা কে মারা শুরু করেন আর মেয়ে পালানোর সমস্ত দোষ আম্মা কে দেয় সেদিন আম্মা জোরে জোরে কাঁদছিল। একদিকে বড়ো মেয়ে নিখোঁজ তার চিন্তা অন্যদিকে আব্বার মাইর সহ্য করতে পারে নাই আম্মা সেদিন। ভাইয়া ভাবি সবাই আব্বা কে ধরে শান্ত করায় বুঝায় এতে আম্মার কোনো দোষ নাই আর তাছাড়া আম্মা বড় আপার এই ব্যাপারে নাকি কিচ্ছু জানতেন না। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো সবাইকে।

বয়স বেড়ে গেছে আব্বার রাগও সমানুপাতিক হারে বাড়ছে তার কিন্তু আম্মা কে আগের মতো মারে না। এতো মাইর ঝগড়ার পরেও আব্বা আম্মা কিছু সময় পরে এক হয়ে যাইতো মিল মহব্বত ছিলো অনেক দুজনের। ছোট বেলায় আমিও আব্বার মাইর খাইছি অনেক ছোট ছোট ভুল এর জন্য। ছোট ভাইয়া এইচএসসি পরীক্ষার পর কোথায় যেনো চলে গেছে, তার সন্ধান পাই নাই আমরা। আম্মা ছোট ভাইয়া আর বড় আপার জন্য সবসময় চিন্তা করেন। ছোট ভাইয়া আমাকে অনেক আদর করতো। ভাইয়ার আদর, দুষ্টামি গুলো খুব মনে পড়ে আমার। ভাইয়া আবার যেনো বাড়িতে ফিরে আসে।

আব্বার মাঝে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখি যখন মেজো আপা কে দুলাভাই অনেক মারধর করে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গেছিলো। মেজো আপার বিয়ে আব্বাই পছন্দ করে দিছেন। এ জন্য আব্বা অনেক চিন্তিত। আব্বা মেজো আপা কে বাড়িতে নিয়ে আসে। মেজো আপা আব্বাকে বলে, আপনি এতোদিন মানুষের মেয়ের উপর অত্যাচার করছেন এখন মানুষ আপনার মেয়ের উপর। একথা শুনে আব্বার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছিলো। ছয় মাস এর মতো বাড়িতে থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে দুলাভাই এর বাড়িতে যায় আপা। এক লাখ টাকা চাইছিলো দুলাভাই কিন্তু আব্বার সেই সাম্যর্থ নাই।

নিজের দোকান টা মেজো ভাই কে দিয়ে দেয় পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে, আর প্রতি মাসে বাজার খরচ এর টাকাটা মেজো ভাইয়া দিবে আমাদের এই চুক্তিতে। আর বড় ভাই ভাত খাওয়ার জন্য চাল দিবে। আব্বার বয়স হয়ে গেছে জমাজমি দেখাশুনা করতে পারে না, ভাইয়া দের বিয়ের পর পরেই তাদের আলাদা করে দিয়ে কিছু জমি দেন আবাদ করে খাওয়ার জন্য এবং ফসলের কিছু অংশ আব্বা কে দেওয়ার জন্য। অনেকদিন এভাবে কেটে গেছে আব্বা আর একদিনো আম্মার গায়ে হাত তুলেনি। শুনেছি আম্মার কাছে আব্বা তার অতীতের আচরণ এর জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এখন আব্বা সবসময় আম্মার কাছে কাছে থাকেন। ছোট থেকে আব্বার আচরণ এর জন্য আব্বাকে ততটা ভালোবাসতাম না আমি। কিন্তু যতো বড় হই আব্বার প্রতি ভালোবাসা ততো বেড়ে যায় আমার।

সবকিছু ভালোই চলছিল, আম্মার পেটের ব্যাথা ছিলো অনেক দিন থেকে সেই ব্যাথা দিন দিন বাড়তেই থাকে। আব্বা আম্মাকে নিয়ে বড় ডাক্তার এর কাছে যায় ডাক্তার পরীক্ষা নীরিক্ষার ফলাফল দেখে বলে জরায়ুতে ক্যান্সার হয়েছে আম্মার। অবস্হা অনেক খারাপ খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে না হলে আম্মাকে বাঁচানো যাবে না। আব্বা আম্মা কে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। অপারেশন, হাসপাতালে থাকা খাওয়া ঔষধ সবমিলিয়ে লাখ টাকার মতো লাগবে। এতো টাকা কই পাবো আমরা। শেষে আব্বা মেজো ভাইয়া কে দেয়া জমির এক অংশ ভাইয়া কে না বলে বিক্রি করে দেয় আম্মার অপারেশন এর জন্য।

আম্মার অপারেশন হয়ে গেছে বাড়িতে চলে আসছি আমরা। কিন্তু বড় আর মেজো ভাইয়া কে না জানায় আব্বা জমি বিক্রি করছেন এটার জন্য অনেক ঝগড়া হয় ভাইয়া ভাবিদের সাথে। আব্বাকে একলা পেয়ে অনেক কটু কথা শুনায় সবাই, আমার জমি আমি বিক্রি করছি তাতে কার কি এই বলে আব্বা বাড়ির ভিতরে চলে আসে। এরপর শুরু হয় আমাদের জীবনের কঠিন সময়। কোনো ভাইয়াও ঠিক মতো সংসার চলানোর জন্য আমাদের আর সাহায্য করেন না। সবসময় ঝগড়াই করে জমি নিয়ে।

তখন ছোট ভাইয়া বাড়িতে আসে আম্মাকে দেখার জন্য। ভাবছিলাম ভাইয়া এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন কিন্তু কয়দিন থেকে চলে যায়। আমার পড়াশুনার খরচ আর আম্মার ঔষধ ছোট ভাইয়া পাঠায় দিবে এখন থেকে যাওয়ার সময় বলে যায়। ফজরের আজান দিচ্ছে মসজিদে, পুরো রাত পার হয়ে গেছে বুঝতে পারি নাই। আজ মনটা অনেক খারাপ আমার, তাই কোচিং এর পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পর যে ডাইরিটা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম তাতে জীবনের গল্প লিখলাম যা মনে আসছে সব।

কাল বিকেলে আব্বা নামাজ থেকে এসে ডাকছে মা ইতি (আমি) আমার চশমাটা দিয়ে যা তো। আমি ঘর থেকে চশমা আনার সময় বেখেয়ালে চশমাটা ভেঙ্গে ফেলি। আব্বা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে এই দুঃসময় চশমাটাও ভেঙ্গে ফেল্লিরে মা! আমি সেখানে কিছু বলতে পারি নাই। শুধু যন্ত্রণায় পূর্ণ আব্বার মুখটা দেখছিলাম, আমার পুরো শরীরে একটা হাহাকার এর বাতাস লাগে। আব্বাকে ভালো করে দেখছিলাম বয়সের তুলনায় অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, চুল দাড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। বয়স সত্তর না হলেও আশি বয়সের বৃদ্ধের মতো লাগছে, আব্বাকে আগে কখনো এভাবে দেখি নাই। আব্বার জন্য ভিতরটা কেঁদে উঠলো, ওখানে থাকতে পারলাম না ঘরে এসে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। আর রাতের খাওয়ার পর ডাইরি লিখতে বসছি।

আজ আর ঘুম হলো না আমার, সকালে উঠে পানি বসায় দিলাম চুলাতে ভাত রান্না করবো বলে। চালের বাক্সে দেখি চাল অনেক কম আর দুই তিন দিন এর হবে। আম্মার অপারেশন এর পর ছোট ভাই ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য পাইনাই। সে ছোট ভাইয়াও এখন ঠিক মতো খোঁজ নেয়না। বড় আর মেজো ভাইয়া এখন শুধু ঝগড়া করার জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময় আব্বা কে মারতে পর্যন্ত আসছিল বাড়িতে। আব্বা সেদিন খুব কান্না করছে ওনার ছেলে দের আচরণে।

এখন একবেলা খেয়ে দুবেলা পানি খেয়ে কাটাতে হয় আম্মা আর আমাকে, কিন্তু আব্বাকে ঠিকি খেতে দিই। আব্বার আচরণ দিন দিন ছোট বাচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছে। আজকাল খাওয়ার প্রতি আব্বার বড়োই আবেগ সৃষ্টি হইছে। অনেক কিছু খাইতে চায় কিন্তু পায় না, কোথায় পাবে নিজে অসুস্থ সবকিছু ছেলেদের দিয়ে দিছে বাকি যা ছিল ছেলে দুজন জোর করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

আমি ভাবি আজ যদি আব্বার দুই কি একজন সন্তান থাকতো তাহলে এমন কষ্টের দিন আসতো না। আজ অনেকদিন থেকে আব্বা গোশত খেতে চাচ্ছে , দুপুরে খাওয়ার সময় বলছে আমার যদি একটা গবাদি পশু থাকতো তাহলে সেটা জবাই করে হলেও একটু গোশত খেতাম রাহেলা (আম্মা) । আব্বা কে আম্মা বলে চুপ করেন, আল্লাহ যা রিজিক এ রাখছেন তাই খান। আমি আর একটা ভাতও খাইতে পারলাম না। বার বার আব্বার গোশত খাওয়ার কথা মনে হচ্ছে। আমি মেয়ে হয়ে নিজের বাপকে একটু গোশত খাওয়াতে পারছি না, এরচেয়ে বড়ো দুঃখ আর কি হতে পারে?

দুদিন পর আবার বলছিলেন গোশতের স্বাদ কেমন তা নাকি আব্বা ভুলে গেছে। কবে গোশত খাইছেন ওনার মনে নাই। আমার মন চাইছে নিজের শরীরের গোশত কলিজা কেটে রান্না করে আব্বাকে খাওয়াই তবুও আব্বার এই মায়া ভারা কষ্টের মুখটা আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে এবার, টিউশনি করাতে চাই আব্বা নিষেধ করে দিছেন মেয়ে বলে। এখন আব্বা প্রায় বড় আপার কথা বলে কই আছে কেমন আছে ওনার নাকি দেখতে মন চায়। সব রাগ অভিমান ভুলে যান আব্বা।

কয়েকদিন পার হয়ে গেছে আব্বাকে গোশত খাওয়াতে পারি নাই আমরা। আব্বা এখনো গোশতের কথা বলে। ছোট ভাইয়া এখন আর কোনো টাকা দেয়না আমাদের, মানুষের কাছে অনেক টাকা ঋণ হয়ে আছে, তা শোধ করতে হবে চড়া সুদে। আর এখন কেউ টাকা ধার দেয়না আমাদের সঠিক সময়ে শোধ করতে পারি না বলে। আমি চুপ করে দুটা টিউশনি শুরু করছি কলেজ থেকে ফেরার পথে আব্বা আম্মা কে না জানায়। দেরি করে ফিরি জন্য প্রতিদিন নানান মিথ্যা কথা বলতে হয়। আজ টিউশনি তে ছাত্রী কে বলে মাসের অর্ধেক টাকা নিই টাকার জন্য আজ কিছু সময় বেশি পড়াই তাদের।

একটা মুরগী আর তেল,মসলা কিনে খুশি মনে বাড়িতে যেতে থাকি আজ আব্বা গোশত খেতে পারবে বলে। আমার জীবনে এতো খুশি আনন্দ আর মনে হয় কখনো আসবে না এতো খুশি হইছি। রাস্তায় যেতে যেতে কতো কথা ভাবছি আব্বা কি বলবে, ওনার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠবে মুরগী দেখে আর বলবে কোথায় পাইলি রে মা । তখন আমি আব্বার অভিভাবক এর মতো করে বড়ো গলায় বলবো এবার সংসার এর কিছু দায়িত্ব আমায় দেও আমি অর্থ উপার্জন করবো। আব্বা তখন আম্মা কে ডেকে বলবে দেখো রাহেলা তোমার ছোট্ট ইতি আজ কতো বড়ো হয়ে গেছে। আব্বা কি খুশি না হবে, কল্পনায় আব্বার মুখটা দেখছিলাম।

ভাবতে ভাবতে বাড়ির পাশে এসে পড়ি। কিন্তু বাড়িতে অনেক লোকজন এলাকার আর কান্নার আওয়াজ পাই আম্মার। আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠে আবার আমার ভাইরা মিলে আব্বাকে মারতে আসলো নাকি, যদি তাই হয় তাহলে আমিও আজ তাদের ছাড়বো না। শক্ত করে হাতে মুরগী টা ধরে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে গেলাম। কিন্তু একি বাড়ির আঙ্গিনায় চটিতে চোখ বুজে আব্বা শুয়ে আছে আম্মা বসে চিৎকার করছে গোশত গোশত আর কাঁদছে,,,,,,,,,

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত