২০০৮ সাল, বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্লাশ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিলো জেদ্দা থেকে আসার আঁতেল টাইপের ছেলে আলীর সাথে।
পরিচয়ের প্রথম দিনই হাত বাড়িয়ে দিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে সে বলেছিলো-“হেই আমি আলী।”
আমি কিছুটা গম্ভীর ভাব নিয়ে, চোখের চশমাটা তর্জনি দিয়ে ঠিক করতে করতে, ভ্রুকুটি করে বলেছিলাম-
“অপরিচিত কারও সাথে আমি হাত মিলাই না। আর তোমার নাম আলী নাকি অ্যাঁলী?”
আলী যারপর নাই বিরক্ত হয়ে বলেছিলো কারও নাম নিয়ে মজাক করা ঠিক না। তারপর ঘুরে উলটা পথে হনহন করে হাঁটা দিয়েছিল।
বলা বাহুল্য প্রথম দর্শনে আলীকে আমার বিন্দু পরিমাণেও পছন্দ হয় নি বিধায় আমি ওকে আলী না বলে নাকি স্বরে অ্যাঁলী ডাকা শুরু করেছিলাম।
ক্লাশে, ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে আমার মুখ থেকে “এই অ্যাঁলী, ওই অ্যাঁলী” শুনতে শুনতে ওর কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল।
পৃথিবীতে দেখা যায় যে কিছু মানুষকে পছন্দ করার জন্যে কোন কারণ লাগে না, একইভাবে কিছু কিছু মানুষকে অপছন্দ করারও কোন কারণ লাগে না।
আমার কাছে আলী ছিল দ্বিতীয় দলের মানুষ।
ওর আঁতেল আঁতেল ভাব, মোটা কাঁচের চশমা, ওর ব্যাগ, ওর গলার স্বরসহ মানুষ আলীকেও আমি ভীষণ রকম অপছন্দ করতাম।
আমার ওকে সহ্যই হত না।
এরমাঝে দেখতে দেখতে পরীক্ষা চলে এল। বাউন্ডুলে আমি পরীক্ষার দোরগোড়ায় এসে আবিস্কার করলাম আমার পড়ালেখার অবস্থা বেহাল।
কী করি? কী উপায় ভাবছি, এমন সময় আমার বান্ধবী রাফিয়া বলল-
-“চল, অ্যাঁলীর সাথে গ্রুপ স্টাডি করি। ও তো আস্ত আঁতেল, সবই পারে। আমাদেরকে হেল্প করবে”।
-“ইহ জনমে আমি অ্যালীর সাথে গ্রুপ স্টাডি করব না।
কিছুদিন আগেই ও আমার ব্যাপারে এক ক্লাসমেটকে বলেছে, মেয়েদের মাঝে নমনীয়তা থাকতে হয়।
আর আমার মাঝে নাকি নমনীয়তার “ন” ও নেই। আমি নাকি ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি”।
“এত্ত বড় কথার পর ওর সাথে গ্রুপ স্টাডি! নেভার এভার!” দৃঢ় গলায় বললাম আমি।
-“আচ্ছা তুই তাহলে পরীক্ষায় ডাব্বা মার। আমি ঠিকই ওকে রিডিং পার্টনার বানাব”। রাফিয়ার সাফ কথা।
-“যা ইচ্ছে কর”। আমিও সটান মেজাজ দেখিয়ে চলে এলাম।
পরদিন থেকেই আমার সামনে রাফিয়া আর আলী লাইব্রেরীতে বসে, ক্লাশের শেষে একসাথে পড়তে শুরু করল।
আমি ওদের দেখি আর মনমরা হয়ে ঘুর বেড়াই। মাঝে মধ্যে রাফিয়াকে মনে মনে কষে গালাগালি করে বলি, মেয়েটা কী স্বার্থপর।
বাসায় এসে নিজেই একা একা অনেক পড়ালেখা করার চেষ্টা করি। অনেক কিছু বুঝতে পারি না, অযথাই মাথা চুলকাই।
এভাবে বেশ কয়েকদিন যাবার পর এক দুপুরে রাফিয়া আমার হাত চেপে ধরে বলে,
-“আর কত নখরা দেখাবি? চল আজকে লাঞ্চের পর একসাথে পড়তে বসি”।
-“উঁহু। আমি একলাই পড়বো। তোর আর কী? যা গিয়ে অ্যাঁলীর সাথে পড়তে বস”। একগুঁয়ের মত বলি আমি।
-“চল না তিনজন একসাথে গ্রুপ করে আলোচনা করে পড়ি, পাল্লা দিয়ে পড়লে অনেক আগানো যাবে।
আর তোকে ছাড়া পড়তে আমারও ভালো লাগে না”।
এইকথা শুনে মন নরম হয়ে আসে আমার। কিছুক্ষণ ভেবে বলি,
-“আচ্ছা একদিন পড়ে দেখি। যদি ভালো না লাগে তাহলে আর গ্রুপ স্টাডি করব না”।
রাফিয়া আমার কথা শুনে সম্মতি জানায়। আমাদের তিনজনের গ্রুপ স্টাডি শুরু হয়।
পড়ালেখার পাশাপাশি চলে চা পান, একটু আধটু আড্ডা।
আলী চমৎকার ম্যাথ বোঝায়, আমি আর রাফিয়া সুবোধ বালিকার মত পড়ালেখা করি। পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে।
আমি পরিক্ষা দিয়ে বুঝতে পারি আমার পরীক্ষা যতটুকু ভালো হয়েছে তাতে আমার শ্রম ও রাফিয়ার চেষ্টা তো আছেই,
সেই সাথে আছে আলীর প্ররিশ্রম অনেক অবদান।
আমি অনুভব করতে পারি আলী ছেলেটা বেশ অল্প ক’দিনেই আমাদের কেমন বন্ধু হয়ে গিয়েছে।
এর কিছুদিন পর আমরা বেশ ক’জন বন্ধু মিলে হুল্লোড় করে ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে সদস্য হয়ে আসি।
ক্লাশ না থাকার দিনগুলো আমাদের কাটে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরী আর ক্যাফেতে।
অন্যান্য সবার সাথে আড্ডার সাথে সাথে আলাদাভাবে আমি রাফিয়া আর আলী যেন একটু বেশিই ভালো বন্ধু হয়ে যাই।
বন্ধু হর পরেও আমি আলীকে “এই অ্যাঁলী” “ওই অ্যাঁলী” ডাকে বিরক্ত করা থামাই না।
মাঝে কিছু দিন ও জেদ্দা গিয়ে ওর পরিবারের সাথে দেখা করে আসে।
আসার সময় আমাদের জন্যে অনেক অনেক বাদাম, খেজুর, আর চকলেট নিয়ে আসে। বছর শেষ হতে থাকে।
কুয়াশা পড়া শীতের সকালে আমরা ফোঁস ফোঁস করে নাক টানতে টানতে ফুলার রোড ধরে হেঁটে যাই আর গুজগুজ করে গল্প করি।
একদিন জানতে পারি, জেদ্দায় আলী লায়লা নামের এক সুন্দরীকে পছন্দ করে।
আর তখন আমাদের পায় কে? কারণে অকারণে আলীর কাছের কাছে “লায়লা…লায়লা…” বলে ডাকাডাকি ওর কান ঝালাপালা করে দেই।
পথে চলতে গেলে হয়ত রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে আমি বাজখাই গলায় বলে উঠি, “ওই যে লায়লা”।
আলী থতমত খেয়ে চমকে তাকিয়ে বুঝতে পারে আমি অযথাই ওকে জ্বালাচ্ছি।
ওর থতমত খাওয়া চেহারা দেখে আমরা হাসতে হাসতে কুটি কুটি হয়ে যাই।
একদিন বাড়ি ফেরার পথে আলী আমাকে বলল, “তুমি আজকে “ধুম টু” তে করে বাসায় যাবে?”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, . “ধুম টু আবার কী?
আমি তো জানি ধুম টু নামে একটা মুভি আছে সেখানেই একটা ছাগল মার্কা চরিত্রের নাম থাকে আলী”।
আলী চোখ পাকিয়ে বলল, “চলো আগে, নিজেই বুঝবে”।
এরপরের কাহিনী অবিশ্বাস্য! আলী নীলক্ষেত থেকে বেছে বেছে আমাকে একটা ট্যাম্পুর সামনের সিটে বসিয়ে দেয়।
তারপর ভীষণ ভাব নিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে বলে, “যখন ট্যাম্পু ড্রাইভার ভোঁ করে দুর্দান্ত স্পীডে ট্যাম্পু চালাবে,
সিটে বসে সামনে তাকিয়ে তোমার মনে হবে তুমি নিজেই বুঝি বাইক চালাচ্ছ। দারুন অনুভূতি হবে তখন তোমার।
আর ভালো হত যদি একটা হেলমেট পরতে পারতে, পুরাই রিয়েল অনুভূতি পেতে তখন”।
আমি কৎ করে ঢোঁক গিলে বলি- “আচ্ছা”।
আলী এত বিশ্বাস নিয়ে বলেছে বলেই কিনা জানি না।
আমি ট্যাম্পুতে ড্রাইভারের পাশে বসে হা করে রাস্তা দিকে তাকিয়ে থাকলাম আর আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকল উত্তেজনায়।
আমি কল্পনা করতে থাকলাম আমি নিজেই মাথায় হেলমেট পরে ধুম টু চালাচ্ছি।
সাঁই সাঁই করে ট্যাম্পুর পাশ দিয়ে বাস আর প্রাইভেট কার চলে যেতে থাকলো আমি হা কয়ে তাকিয়েই থাকলাম,
কখন যে পথ ফুরিয়ে গিয়েছে টেরও পেলাম না।
সেদিন বাসায় ফিরলাম ফুরফুরে অনুভূতি নিয়ে।
বয়সে যতই বড় হয়ে যাই না কেন, জীবনে নানা ছেলেমানুষি করে প্রচণ্ড আনন্দ পাওয়া যায় সেদিন আমি নতুন করে বুঝলাম।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আলী চলে গেলো জেদ্দায়। ওর পরিবার চায় ও বাকি পড়ালেখা জেদ্দা থেকেই করবে।
আলী চলে যাবার সময় একটু একটু করে ঘনিয়ে এলো আর আমি এবং রাফিয়া ছটফট করতে থাকলাম।
আমাদের মনে হল আমরা চমৎকার একজন বন্ধু হারাতে যাচ্ছি। আলী চলে যাবে আর ধীরে ধীরে ভুলে যাবে আমাদের।
মাইলের দুরত্ব যে সম্পর্কের দুরত্বও বাড়িয়ে দেয়। আলী চলে যাবার আগে আমাদের নিয়ে জম্পেশ একটা খাওয়া দাওয়ার ট্রিট দিল।
আমরা সেই জম্পেশ ট্রিট শেষে বিশাল বিশাল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করলাম আর বিষণ্ণ হয়ে থাকলাম।
আমাদের কে স্বাভাবিক করার অনেক চেষ্টা করল আলী, কিন্তু পারলো না।
আমাকে অনেক বার বললো, “হেই অ্যাঁলী” বলে ডাকতে। আমি ডাকলাম না।
মুখ মেঘাচ্ছন্ন করে থাকলাম, আর নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম আলী ফিরে যাচ্ছে ওর পরিবারের কাছে, যেখানে ও বড় হয়েছে।
যেখানে ওর সব বন্ধুরা আছে। আমাদের সাথে ওর পথ চলা হয়ত এতটুকুই ছিলো… এতটুকুই…
আলীকে একটা ছোট্ট উইন্ড চাইম উপহার দিয়েছিলাম।
আলী জেদ্দা ফিরে গিয়ে মেইল করল এবং ছবি পাঠাল, সে উইন্ড চাইমটা ওর ঘরের জানালার পাশে ঝুলিয়েছে।
বাতাসে যখন উইন্ড চাইমটা টুন টুন রুন ঝুন করে বেজে ওঠে তখন নাকি আলীর আমাদের কথা মনে পরে।
আলী ফুলার রোডের বাঁকানো পথটুকু খুব মিস করে।
জেদ্দায় থাকতে ওর ভালোলাগে কিন্তু তারপরেও মাঝে মাঝেই ওর ছুটে বাংলাদেশে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।
মাইলের দুরত্ব আমাদের বন্ধুদের একত্রে কাটানো সময়গুলোকে সীমিত করে ফেললেও শেষপর্যন্ত আমাদের অনুভুতিকে আটকে রাখতে পারে নি।
আলী সময় পেলে মেইল করে আমাকে, আমিও ওকে মেইল দেই।- মেইলে লেখা থাকে…
হাবিবি,
তোমাদের অনেক মনে পড়ে। তোমাদের জন্যে একটা সুসংবাদ এবং একটা দুঃসংবাদ আছে। সুসংবাদ হল লায়লার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
আর দুঃসংবাদ হল বরটা আমি নই। কতগুলো বছর হয়ে গেলো তোমাদের দেখি না।
আমার এখনও আমাদের তিনজনের সেই গ্রুপ স্টাডির কথা মনে পরে। আমার মনে পরে তুমি আমাকে কতটা জ্বালিয়েছ।
আমি বাংলাদেশে আবার আসব হাবিবি। তোমার আর রাফিয়ার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দিও।
আমি তোমাদের বরকে জানাতে আসব তারা কত অসাধারণ দুজন মানুষকে তাদের পাশে পেতে যাচ্ছে।
তোমরা আমাকে ভুলে যেও না।
ইতি
অ্যাঁলী
আমি লিখি-
তুমি জলদি জলদি দেশে চলে এস। আমাদের বিয়ের আগেই তুমি বিয়ে করে তোমার বউকে নিয়ে দেশে এস।
আমি আর রাফিয়াও তাকে বলতে চাই লায়লার কাহিনী। খিক খিক খিক।
*** আচ্ছা আলী হাবিবি অর্থ কী? হাবিবি শব্দটা খুবই মজাদার লেগেছে আমার।
ইতি
আমি
আলীর উত্তর আসার আগে আমি নিজেই গুগল থেকে খুঁজে বের করি “হাবিবি” অর্থ প্রিয় বন্ধু। আমি নস্টালজিক হয়ে যাই।
খুঁজে খুঁজে মুখবই থেকে বের করি আমাদের পুরান দিনের ছবিগুলো আর ফিরে যাই ২০০৮ সালে।
আমি বুঝতে পারি আমার অনেক অনেক প্রিয় মানুষদের মাঝে কিছু মানুষ এমনও আছে যারা নিয়ত আমার ভালো চেয়ে যায়।
আমি বুঝতে পারি এই বড্ড হিসেব নিকেশ করা কঠিন পৃথিবীতে কিছু মানুষের ভালোবাসা কখনই কমে না।
বরং দিন দিন বাড়ে…কেবলই বাড়ে…