ছায়াবীথি

ছায়াবীথি

“ও মা মাংস কী কম ফড়বো? আরও আনায় লমু?  আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে তাকালাম।
“বাবা আপনি আবার আসছেন?
“লোক ত মেলা… তুমি সামলাইতে পারবা?”
“বুঝছি ত মেলা লোক আমি সামলে ফেলব ইনশাআল্লাহ ”

বাবা তার শনের মতো চুল হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “নিচের থন কাউরে ডাক দিমু? তুমি পুলাপান মানুষ হাতহুত পুড়াইলাইবা!” “পুড়াইলে পুড়ামু আপনি যান ত বাবা, মেহমান ফালায় এখানে আসছেন, ঘ্যানঘ্যান করেন খালি!” বাবা মুখ কালো করে চলে গেলেন। এই মানুষটার চোখে এখনো আমি নতুন বউ,আদরের দুলারি যে রান্না করতে হাত টাত পুড়িয়ে ফেলব।

“ও মা ” বাবা আবার কী মনে করে ফিরে এসেছেন। “জি বাবা! ” “পায়েস কি আছে? কাল যে বানাইলা? ” “জি বাবা আছে ভাতের পরেই দিব ” “আলহামদুলিল্লাহ! তুমার পায়েস হয়ও সেই রকম ফার্স্টক্লাস! এক্কেরে তুমার শাশুড়ীর হাতের মতন। ” প্রচন্ড ব্যাস্ততা আর বিরক্তিতেও হাসি আসতো উনার ডায়বেটিস ছিল, পায়েস নিষেধ, তবুও কাল খেয়েছেন সামান্য। এখন ফুসলে ফাসলে আরও খাওয়ার ধান্ধা আর কি ! এই মানুষটার শেষের দিকের সন্তান হলো আমার সাহেব। বয়সকালের সন্তানের জন্য এমনিতেই মায়ায় ভরা মন, সেই সন্তানের বধূ আরও যত্নের জিনিস। সত্যিই কী যত্নেই না রাখতেন বাবা।

মনে আছে যখন বিয়ে করে এলাম পুরান ঢাকার গোড়া, রক্ষণশীল পরিবার, ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন চাল চলন আমাদের বাড়ি থেকে একেবারে আলাদা। তার উপর এরেঞ্জমেরেজ টিপিকাল শ্বশুরবাড়ির সব ধ্যান ধারণা এক ফুয়ে উড়িয়ে দিলেন আমার শ্বশুর। যেটা শুরু হলো সকালের নাস্তাকে কেন্দ্র করে। হয়েছিলো কী, বিয়ের পরে সকালের নাস্তায় রাজ্যের খাবার সাজানো থাকতো টেবিলে। আমি চরম অস্বস্তি নিয়ে এই সময়টা পার করতাম, কিছুই খাইনা এটা ওটা ছিড়ে ছুড়ে সামান্য মুখ দিয়েই উঠে যাই। নাস্তা শেষে একদিন পড়লাম শ্বশুরের জেরায় “ছোট বউ সত্যি একখান কথা কও, আমারে বাপ মনে কইরা কইবা। তুমি সকালে তোমার বাপের বাড়িতে কি খাইতা?

আমি পড়লাম মহা ফাপরে কি উত্তর দেব, সারাটা জীবন এই অভ্যাসটার জন্য আম্মুর কম বকা খাইনি। বাবার বাড়িতেও রাজ্যের খাবার ফলমূল সকালবেলা নাস্তায় থাকতো কিন্তু আমার পছন্দ ছিল পরাটা চা দিয়ে ভিজিয়ে খাওয়া। আম্মু একা এত বকাঝকা করত,” যে কি বাজে অভ্যাস হয়েছে এই অভ্যাস না গেলে বিয়ের পরে শাশুড়ির কথা শুনতে হবে,” কিন্তু তাতেও এই অভ্যাস যেন কাটেনি। আমি বলতাম শাশুড়ি ছাড়া বাড়িতে বিয়ে করব শাশুড়ি কিছু বলতেও পারবেনা। শাশুড়ি ছাড়া বাড়িতে এসেও আমার শ্বশুরের নেক নজরে পড়েই গেলাম এবং জেরার মুখে। কাচুমাচু করে এদিক সেদিক কথা বলে অবশেষে ঘটনা স্বীকার করেই গেলাম আসলে সকালে আমার কী খেলে প্রাণ জুড়ায়।

আমার শ্বশুর বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।বিস্মিত হয়ে বললেন “চায়ের লগে ভিজাইন্যা পরোটা মানুষ কেমনে খায়? এত আইটেম থাকতে তোমার এই দুইটা জিনিস খাওন পছন্দ, কও কী? ”
“না, বাবা আমার অভ্যাস হয়ে যাবে আস্তে আস্তে আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। “কোন অভ্যাস পাল্টনির দরকার নাই, যেমন তোমার খাওয়ানের শখ তেমনি তুমি খাইবা। কাইল থাইক্যা সকাল বেলা তোমার চা পরোটার ব্যাবস্থা হবে।”

“না, বাদ দেন বাবা সবাই হাসবে” “কেডা হাসব? আমি থাকতে! থাব্রা মাইরা সবার দাঁত ফালায় দিমু না ? ইটস মাই অর্ডার ” বাবার দৃঢ় ঘোষণা। অবশেষে শুরু হলো আমার বাপের বাড়ির মতই চায়ে ভেজানো পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা করা। শ্বশুর সাহেব সবাইকেই আগে ধমকে ধামকে চুপ করিয়ে রেখেছিলেন। আমার সাহেব আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন না, মুখে হাসি চেপে অনেক কষ্টে নাস্তা শেষ করছিলেন। বাবার ভয়ে সবাই চুপচাপ নিজের মত খেয়ে যাচ্ছিল। আমি খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল করলাম কেউ কুটকুট করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। তাকিয়ে দেখি স্বয়ং আমার শ্বশুর।

“আমার এই বউই আমার খরচ কমায় দিব এত খাওন-দাওনের মইধ্যে হের খালি পছন্দ চা দিয়া ভিজাইন্যা রুটি হিহিহিহিহি। ” মানুষটার হাসিতে আমি লজ্জার থেকে বেশি সাহস পেয়েছিলাম আর পেয়েছিলাম অসামান্য স্নেহের পরিচয়। মনে আছে, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় যখন গর্ভে সন্তান আসলো, বিনা কারণে শরীর খুব অস্থির করতো। ঘরের মধ্যে থাকতে মন চাইতো না । ছাদে চলে গিয়েছিলাম একদিন খোলা বাতাসে হাঁটতে। উনি ধমকে ছাদের থেকে ঘরে নিয়ে আসলেন।

এমন লাল পোশাকে বাইরে যাইয়া এমনি হাঁটবা না, খারাপ বাতাস লাগতে পারে মা তোমার শরীরটা নরম। ”
আমার মনে হলো সংস্কার শুধু কু বা সু নয় স্নেহেরও হয়। প্রতিদিন আমার সাহেবের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যেত, আমি অপেক্ষায় অস্থির না হই, এজন্য উনি এশার নামাজের পরে আমায় তার ঘরে বসিয়ে তেলাওয়াত করতেন। তার তেলাওয়াত শুনতে শুনতে কখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতো জানি না। ঘুম হতে উঠতাম আমার সাহেবের ডাকে, বাবা আমার গায়ে ততক্ষণে চাদর টেনে উনার আরামকেদারায় বসে আছেন চুপচাপ । “মাস্টারস পরিক্ষাডা ভালো মতো দেওন লাগবো মা, বিয়ার সময় তোমার বাপরে কথা দিছি, মাস্টার্সে যেন খারাপ রেজাল্ট না করো তাইলে কইলাম তোমার বাপে আমার বদনাম দিব। ”

আমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। পড়াশোনা নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান বাপের বাড়ি থেকে চলে আসার পর ভেবেছিলাম থামবে, তবে পরে আবিষ্কার করেছিলাম আমার শ্বশুর এই বিষয়ে বিশিষ্ট মহারথী । ওই বাড়িতে আম্মু ঘ্যানঘ্যান করত এই বাড়িতে আমার শ্বশুর সাহেব পড়াশোনা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করেন। শুধু পড়ায় উৎসাহই নয় এই মানুষটার কাছ থেকেই শিখেছি সংসার ধর্মের জ্ঞান, কিছু নীতি, কিছু রাজনীতি, কিছু কুটনীতি।।

হয়তো শেষ বিকেলে কোন বই নিয়ে বসেছি নিচতলা থেকে বাবার ফোন “ও বউ, মেহমান আইসে ঝামেলার মেহমান বড়বউ ঘরে নাই একটু নিচে আসো এরা কাউরে না পাইলে বদনাম করব। এগো লগে কিচ্ছু কথা কওন লাগব না চুপচাপ সামনে যাইয়া বইবা, এরা হুদা কথা ধরে সত্যি বাবা তার দুই পুত্রবধূকে এমন ভাবে আগলে রাখতেন যেন পরের বাড়ির কোন দামী আমানত। যার সামান্যতম ক্ষতি উনি থাকতে হতে দেবেন না। ওনার আদর-যত্নের অতিশয্যে কখনো কখনো নিজেকে ধন্য মনে করতাম কখনো হতাম বিরক্ত কখনও আতঙ্কিত। সংসার শুরুর দিকে পরম শ্রদ্ধেয় যত্নবান একজন মানুষটা শারীরিক বিধিনিষেধের মাঝে ধীরে ধীরে কিভাবে যেন শিশুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছিলেন।

শেষের দিকে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছিল, পিউরিন বেড়ে যাচ্ছিল লিভারের সমস্যা ছিল। যথেষ্ট পরিমাণে আরামে থাকার দরকার ছিল কিন্তু তিনি ঘরে আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করতেন না। এত প্রহরায় এদিকে ওদিকে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে যেতেন। সংসারের দশটা কাজে, ব্যস্ততায় সবসময় আমার খেয়াল থাকত না,। যখন হঠাৎ করেই কোন কাজের মেয়ে যদি দৌড়ে এসে বলত” ও ছোটমামী নানারে তো পাইনা” শুনে আমার আত্মা উড়ে যেত, “এই শরীর নিয়ে আবার কোথায় গেছে?” দ্রুত দারোয়ানকে পাঠাতাম তাকে খুঁজে বের করতে। দারোয়ান আর কাজের মেয়ে বাবাকে হয়তো কোন চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে ধরে নিয়ে আসতো বাসায়।

মজলিসি এই মানুষটার পাড়ার বন্ধুর অভাব ছিল না। তাঁদের মধ্যেই কারো মৃত্যু সংবাদ মাইকে কানে গেলেই হলো, তিনি সারাদিন বিমর্ষ থাকতেন। কিছুতেই মুখে ভাত তোলা যেতো না। আমার কাচাহাতের সামান্য রান্না খেয়ে খুশি হয়ে যাওয়া মানুষটা শেষের দিকে খাবারের বেলায় বড় জেদ করতেন। বাচ্চাদের মতো বলতেন, “এভাবে খাব না সেভাবে খাব, এমন করে খাব না তেমন করে খাব মানুষটার প্রেশার ডায়বেটিস ইউরিক এসিডের সমস্যা ছিল। সব খেতে চাইলেও দেওয়া যেত না ।বাবা তবুও বড় অবুঝ হয়ে যেতেন।

আমার সব সময় যে ধৈর্য কুলাতো তাও নয় তবুও এই মানুষটার উদারতার কারণেই নির্বিঘ্ন হয়েছিল আমার পড়াশোনা, আমার কর্মজীবন, দাম্পত্য সর্বোপরি নতুন একটা পরিবারে আমার অস্তিত্ব আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার কারনে ধৈর্য ধরে তার কথাগুলো শোনার চেষ্টা করতাম। অসংখ্যবার ধৈর্য ধরে শোনা লাগতো তার প্রথম যৌবনে আমার শাশুড়ির সাথে ঘটে যাওয়া টক-মিষ্টি গল্পগুলো। গল্পগুলো কমসে-কম বিশবার শুনেছি দাড়ি কমা সহ মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তবুও আবার নতুন করে শুনতাম। মনের মধ্যে আশা জাগতো স্ত্রীর প্রতি একনিষ্ঠ এই প্রেমিকপুরুষ মানুষটার কনিষ্ঠ পুত্রকে বিয়ে করেছি বাবার গুণের কিছু তিনিও হয়তো পাবেন। আরও একটা কারণে আমি শুনে যেতাম তার গল্প কারণ জীবন সায়াহ্নের দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটার কথা শুনার মত আক্ষরিক অর্থে কেউ ছিলনা।

অসুস্থতায় অনেকদিন আবদ্ধ থাকার পরে একদিন সত্যি সত্যি এই মানুষটি হেঁটে গাড়িতে উঠলেন। কী খুশি সেদিন বাবা। আমার বড় ছেলে তারা যাবার পথ আঁগলে ধরল,” ‘দাদাজান কই যাও? “এইতো দাদাভাই হসপিটালে যাই, হসপিটালে কয়টা টেস্ট আছে এই ধর সাতদিন এরপর আইয়া পড়মু ইনশাআল্লাহ, ভালো মতো থাইকো দাদাভাই কেমন?” “আল্লাহ ভরসা বাবা পৌঁছে ফোন দিয়েন” বলতে বলতে আমার গলা কেমন কেঁপে গিয়েছিল।

-“তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ মা ” যাবার আগে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন তারপর গাড়িতে চেপে বসলেন। আমার বুকটা হু হু করে উঠলো। কেন যেন চাপা ভয় হলো। মনে হলো যে ছায়াবীথির তলে এতদিন নির্ঝঞ্ঝাট ছিলাম সেটা যেন আমার মাথা থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল। তবে ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি সত্যিই সরে যাবে। হসপিটাল যাওয়ার ছয় দিনের মাথায় ঘুমের ঘোরে বাবা চলে গেলেন পরপারে। তার একদিন আগেও কত গল্প কত হাসি ঠাট্টা প্রদীপ নেভার আগেই যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠেছিল। মনে আছে যাবার আগের বিকালেই হসপিটালের ডাক্তার আর ওয়ার্ড বয়কে ডেকে আমাকে দেখিয়ে আঙ্গুল তুলে বলছিলেন “আমার ছোট বউ ইনভার্সিটি ফার্স্ট ক্লাস স্কলারশিপ পাইসিল লেকচারার হইছিল তবু চাকরি করলো না। ”

আমার লজ্জা লাগত, অস্বস্তি হতো, বাবা আমার গল্পগুলো এমন করে মানুষকে বলতেন যেন নিজের মেয়ে।একজন অতিসাধারণ পুত্রবধূকে নিয়ে এত বেশি গর্বিত আমি খুব কম মানুষকে দেখেছিলাম। সেই মায়াভরা স্নেহশীল মানুষটা সেই দিন রাতেই গেলেন যেদিন তিনি যেতে চেয়েছিলেন, ঠিক সাতাশ রোজার রাতে । বিয়ের পর থেকে দেখেছি প্রতি বছর এই দিনটাতে কি সুর করে যে তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন, সারাদিন মোনাজাত করতেন। আমি সত্যিই হতভম্ব হয়ে গেলাম, আল্লাহ তার বান্দাদের কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু খুব কম দেন তবে যখন দেন এটা ঘোষণা করেই দেন যে সে বান্দা তার কতটা প্রিয় ছিলো। তিনি চলে গেলেন শতশত মানুষ হা-হুতাশ করতে ঘরে জমায়েত হলো। কত কথা কত মিষ্টি স্মৃতি নিজের মতো সবাই আউড়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে পছন্দ করতো না এমন মানুষ ছিল না।আমার জানাশোনা প্রত্যেকটা মানুষ ভালোবাসতো তাকে।

আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম মানুষ হঠাৎ মারা গেলে তার অভাববোধ সাথে সাথে বোঝা যায় না। বোঝা যায় ধীরে ধীরে যখন সবাই শোক বার্তা আফসোসের পালা গুটিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। দিয়া নিভে যাওয়ার পরে খালি প্রদীপ যেমন আর হাহাকার করে। আমার গোটা বাড়িতেই তেমন একটা হাহাকার জন্ম নিল। তেমন কিছু নয় দৈনন্দিন জীবনযাপনের হঠাৎ করেই একটা ধাক্কার মতো অনুভব হতো যে মানুষটা আর নেই। যেমন হঠাৎই বাইরের জন্য বেরোচ্ছি, অভ্যাস বশত বৈঠকখানায় বাবার আরামকেদারার সামনে চপল পায়ে এসে বললাম, ” বাবা একটু বেরোচ্ছি….” আমি থেমে যেতাম।

আজ বৈঠকখানায় আরামকেদারাটা আছে তবে সেখানে কেউ বসে নেই, শুধু আছে তার তজবিহ কোরানশরিফ আর ভাঁজ করা জায়নামাজের পাটিটা । আমার ছোট্ট ছেলেটা টুকটুক করে হেঁটে হয়তোবা দাদাজানের ঘরে গেছে, লুকোচুরি খেলার সাথী দাদাজানকে খুঁজে না পেয়ে গাল ফুলিয়ে চলে আসতো আমার কাছে। তার অভিযোগ দাদাজান তাকে না নিয়েই নাকি বেড়াতে চলে গেছে। ” দাদুবাই দুত্তু কলেতে আসলে বকা দিবা” ” আচ্ছা বাবা অনেক বকা দিবো” চোখের পানি লুকিয়ে আমিও ছেলেকে প্রবোধ দিতাম।

আমার বড় ছেলেটা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল তার প্রতিদিনকার লড়াই ঝগড়া খুনসুটির মানুষটার হঠাৎ করে ফাকি দিয়ে চলে যাওয়া সে নিতেই পারছিল না। হয়তোবা অনেক মেহমান একসাথে ঝাঁক বেঁধে এসেছে আমি ব্যস্ত হয়ে উনুন সামলাচ্ছি। পাকের ঘরের দরজার কাছে এসে কেউ আজ জিজ্ঞেস করছে না “ও মা কি রান্না করো,এতো লোক পারবা তো? ” আজ কেউ জানতে চায় না আমি হাত পুড়িয়ে ফেলব কিনা আমি সামাল দিতে পারব কিনা। একবুক মায়াভরা এক বৃদ্ধ যে পরের বাড়ির একটা মেয়েকে এনে নিজের কন্যার স্থান দিয়েছিলেন। সে বটবৃক্ষের ছায়ার থেকে আমি সরে গেছি অনেক দূরে।তবু জানি আমার থামা যাবে না এগিয়ে যেতে হবে তার আশীর্বাদ, আর তার স্মৃতিগুলোকে বুকে নিয়ে।

প্রিয় পাঠক লেখালেখির জন্য আমি আমার ব্যাক্তিগত জীবনের ঘটনা ব্যবহার করি না। কখনো প্রয়োজনই পড়েনি । তবে আজ লেখলাম কারণ লেখাটার পেছনে আছে একটা সচেতনতার বার্তা । এভাবেই আমাদের মাথা থেকে সরে যাচ্ছে আমাদের পরিবারের বটবৃক্ষগুলো। এমন মায়াময় ছায়াবিথি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর কত কত পরিবার তাদের ভেতর জন্ম নিচ্ছে প্রিয়জনের অভাববোধের তীব্র যন্ত্রণা । চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে একটা গোটা পুরাতন স্নেহময় প্রজন্ম যাদের হাত দিয়ে একদিন এসেছিল সভ্যতার নতুন সূর্য। তাই সবাইকে অনুরোধ একটু সচেতন হোন, পরিচ্ছন্ন থাকুন পরিচ্ছন্ন রাখুন আর যত্ন নিন আমাদের পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের। কারণ তাদের স্নেহ তাদের মায়া যত পাবো ততই যে আমাদের জন্য কম। সবার জন্য দোয়ায়…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত