অন্ধকার নামার আগে

অন্ধকার নামার আগে

তখনো সন্ধ্যা,তবে ঘোর অন্ধকার নামেনি।একজন মাঝবয়সী রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম,দুটা চালের বস্তাসহ আমায় নিয়ে চকবাজার থেকে কাপাসগোলা যাবে কিনা?

রিকশাওয়ালা ভ্রূ কুঁচকিয়ে জানতে চাইলেন কত টাকা দিবো। চকবাজার থেকে রিকশায় যেতে যে ভাড়া নেয় তা এবং দুটা চালের বস্তার দাম সহ ষাট টাকা দিব, বললাম। রিকশাওয়ালা রাজি হয়ে গেলেন।উনি বস্তা দুটো দোকান থেকে কাঁধে করে এনে রিকশায় তুললেন।অথচ আমি উনার চেয়ে যোয়ান। বয়সে যেমন টগবগে যুবক তেমন শক্তিতেও তার চেয়ে এগিয়ে অনেক।আমি চাইলে বস্তা দুটো নিজ কাঁধে চড়িয়ে আনতে পারতাম।নাহয় একটা বস্তা দু’জন দু’প্রান্ত ধরে রিকশায় তুলতে পারতাম।তবে উনি এসবতো আর ফ্রি করছেন না,কাজের বিনিময়ে টাকাতো দিবো। উনার কষ্ট দেখে শুধু কষ্টভোগ করে বললাম,আহারে বউ বাচ্চার জন্য কতোই কষ্ট না করছেন বৃদ্ধ।

বৃদ্ধ রিকশা চালাচ্ছেন আর ঘাম মুছছেন।একটু এগুতে উনার ফোন বেজে উঠলেন,ঘামে ভেজা শার্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে উনি কথা বলা শুরু করলেন।সাংসারিক কথাবার্তা সব, হ্যালো,হ্যা হ্যা শুনছি মা।ডাল,আলু,তেল আর পেঁয়াজ হলেইতো হবে।দোয়া করো মা জান।রাস্তাঘাট পাকা।তেমন লোকজন নাই।তাও দেখি,কতো কামাই হয়।চিন্তা করতে বলোনা তোমার মাকে।চালের বস্তা! সেতো হাজার দুয়েকের মামলা মাজান।তাও দেখি। বুড়ো ফিকে হেসে বললেন, এসব বড় লোকের হয় মা,আমাদের গরীবেরতো সংসার সামলাতে ইমানে ভরসা, আচ্ছা রাখি মা জান। বুঝলাম উনার সংসারের মা অথবা মেয়ে কেউ একজন উনাকে নিয়ে চিন্তিত এবং সাথে প্রয়োজনের কথা ভেবেও তা নিয়ে যেতে বলেছিলেন।

কথা বলা শেষে ঘাড় ফিরিয়ে উনি আমায় প্রশ্ন করলেন, বাপজান,শুনেছি কোন ভাইরাসের আতঙ্কে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবে।রাস্তায় কেউ বেরোতে পারবেনা।পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। আমি সোজা উত্তরে বললাম, হয়তো চাচা। উনি একটু চুপ থেকে আবার বললেন, আমাদের কি হবে বাপজান,ঘরে অসুস্থ বিবি,মেয়েটার স্বামী মারা গেলো বছর দুয়েক হলো।তারো তিনটা বাচ্চা।যদি রিকশা চালাইতে না পারি বউ বাচ্চা আর নাতি নিয়ে উপোস মরব।

বৃদ্ধার কথাটা আমার খুব লাগলো।উনি সত্যিই তো বলছেন এরকমতো অনেক পরিবার আছে যারা দিনে এনে দিনে খায়।একদিন কাজ না পায়লে গোটা পরিবার অনহারে কাঁটায়।বৃদ্ধকে বললাম,চাচা বেশিদিনতো না, কয়েকদিনের জন্য যা দরকার হয় তা কারো কাছ থেকে ধার দেনা করে হলেও কিনে রাখতে পারেন।তারপর না হয় পরিস্থিতি একটু ভালো হলে রিকশা নিয়ে নামবেন। রিকশাওয়ালা চাচা একটু হেসে বললেন,আমাদের মতো গরিব লোকদের কে দিবেগু ধার দেনা।যদি ভাইরাসে ধরেতো মরেই যাবো।না মরলেও কেউতো দেওয়ার সাহস পাবেনা।বয়স হয়েছে, প্যাডেল ঘোরাতে কষ্ট হয়ে যায় বাপজান।তাও কষ্ট করে যেদিন তিনশো-চারশো তুলতে পারি সেদিন আর চালাই না।

এইটুকু বলে উনি কাশতে শুরু করলেন।এই আতংক অবস্থায় এভাবে যাত্রী নিয়ে কাশাকাশি কিন্তু ভয়ংকর অপরাধ।কাশলেও টিস্যু ব্যবহারের কথা বলছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা।এই খেটে খাওয়া খাওয়া মানুষগুলোকে এসব সচেতনতার কথা বলা যেমন নিরর্থক, তেমন উনারা বুঝেনা দেশে দেশে এখন কাশিরও শিষ্টাচার শিখাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।না মানলে জরিমানা মাশুল গুণতে হচ্ছে মাঝেমধ্যে। কাশি থামিয়ে উনি আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছি চালের দাম বেড়ে গেছে,সবাই চাল,ডাল দুই-তিন মাসের জন্য মজুদ করছে।তো বাপজান আপনি কয়দিনের জন্য মজুদ করছেন?

আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের এক বছরের বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি।এরকম চালের বস্তা কোনদিন কিনিনি।যখন কিনি পাঁচ কেজি না হয় দশ কেজি কেনা হয়।দশ কেজি চালও আমাদের বিশ দিন চলে যায়।গ্রাম থেকে বাবা ফোন করে বললেন দেশের যে পরিস্থিতি তাতে কম করে হলেও এক মাসের খাবার কিনে রাখতে।পরিস্থিতি খারাপ হলে যাতে মাস কয়েক নিশ্চিন্তে ঘরে বসে খেতে পারি।রিকশাওয়ালা চাচাকে বললাম,এইতো চাচা দুইটা মিলে মাস দেড়েক কেটে যাবে।

বৃদ্ধ চাচা আর কিছু বললেন না। রিকশাটা একটানা চালিয়ে বাসার গেইটের সামনে এনে থামালেন। বুঝলাম চাচার অনেক তাড়া।সামনের বিপদ কেটে উঠা অব্ধি উনার সঞ্চয় করতে হবে কিছুটা।তাই যতো পারে টানতে হবে রিকশা।
রিকশা থেকে উনি বস্তা দুটো নামিয়ে দিয়ে আবার টান দিতে প্রস্তুত। চাচা ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।সন্ধ্যার পর উনি নাকি আর রিকশা চালায় না।কিন্তু আজ চালাবে।উনার দশ কেজি চাল কেনার টাকা হলেও রিকশা টেনে মানুষের কাছ থেকে উসুল করতে হবে।পকেট থেকে বের করে পাঁচশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলাম।আসলে আমার জানতে ইচ্ছে হলো,আমার বাবার বয়সী বুড়ো চাচা একদিন ওভার রিকশা চালিয়েও কতো টাকা ইনকাম করছেন। চাচা টাকা দেখে একটু বিরক্তির সুরে বললেন,ভাঙতি নাই।

–চাচা দেখেন না কতো টাকা আছে।

উনি লুঙ্গির ভাঁজে এবং পকেটের কোণায় ভাজ করে রাখা সব টাকা একত্রে করে টাকা পাইলেন তিনশো পঁয়ষট্টি টাকা।টাকা গুণা শেষে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,শহরে লোকজন কমেগেছেতো বাপজান, তাই ইনকামটা আজ খুব কমই হলো।

একটু অবাক হলাম,এতো কম টাকা দিয়ে উনি চাল,ডাল,তেল নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।দ্রব্যের যে দাম উঠেছে এতো কিছু কেনা কি এই অল্প টাকায় কেনা সম্ভব? যে দাম বেড়েছে তা দিয়েতো উনি একদিনের খাবার জোগাড় করতে পারবে কিনা সন্দেহ,সেখানে উনি উনার পরিবারকে দশ দিনের খাবার কিনে নিবে কথা দিয়েছেন। বললাম,চাচা তাহলে এটা আপনি রেখে দিন। চাচা প্রথমে নিতে রাজি না হলেও পরে কি ভেবে নিয়ে নিলেন। খুশি হয়ে উনি আমার বস্তা বহন করে পাঁচ তলা বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি তা করতে দিলাম না।বললাম দারোয়ান নিয়ে যাবে। দুই বস্তা থেকে একটা বস্তা নামিয়ে আরেকটা বস্তা আমি রিকশায় রেখে দিলাম।চাচা এটা নিতে চায়নি মোটেও,তাও দিলাম।চাচাকে বললাম, আমারতো একটা বস্তায় মাস দেড়েক কেটে যাবে। আরেকটা অপ্রয়োজনে রেখেছিলাম।দুটা বস্তা লাগবেনা আমাদের।

উনার চোখজোড়া ছলছল করছিল তখন। ভাবলাম আমার দুইজনের পরিবারে একটা চালের বস্তায় যদি মাস দেড়েক কেটে যায়, উনার ছয় জনের পরিবারেতো তা যাবে পনেরো-বিশ দিন।আমরা অপ্রয়োজনেও দ্রব্য কিনে করে করছিটা কি? দ্রব্যের দাম বাড়াচ্ছি।ব্যাবসায়ীর পেট ফোলাচ্ছি। আর গরিবের পেটের ক্ষুধা মেটাতে হিমশিম খাওয়াচ্ছি। চাচা ছলছল চোখে রিকশার প্যাডেল ঘুরাইলেন।ঘোর অন্ধকার নেমে গেছে তখন।একটু পথ এগুতে উনি রিকশা সহ নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত