একটি অতৃপ্তি ভালোবাসার গল্প ! আমি কলেজের ক্যাম্পাসে হাটছিলাম! হাটতে হাাটতে কলেজের পিছনে বাগানের দিকে ভুলবশত চলে যায়। গিয়ে দেখি একটা মেয়ে চোখ বন্ধ করে কি যেনো বলছে! একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি মেয়েটির চোখে অশ্রু।বাম হাত টা আগানো আর ডান হাতে একটি ব্লেড। বুঝতে পারলাম মেয়েটা খুবই ডিপ্রেসড। ৫মিনিট দাঁড়িয়ে দেখলাম মেয়েটি কোনো আঘাত করেনা। নিজে নিজে মুচকি হেসে বললাম হয়তো সাহস নেই কাটবেনা হাত। এই বলেই ঘুরলাম সেখান থেকে যাওয়ার জন্য। পরক্ষণেই মেয়েটার চিৎকার শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি ব্লেডটা হাত থেকে পড়ছে আর মেয়েটা ও হেলে দুলে পড়তেছে। দৌড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই মেয়েটাকে নিজের বাহুতে জড়ালাম! রক্ত যেনো পিনকি দিয়ে বের হচ্ছে। কি করবো বুঝতে পারছিলামনা! মেয়েটা মুখে জড়তা নিয়ে বললো তাকে বলো আসতে।বললাম আসবে সে! আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন প্লিজ।
মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেলো। হাতের ক্ষতটা দেখার চেষ্টা করলাম কতটুকু! মেয়েটা হাতের ধমনীটাই কেটে ফেলেছে।শীগগির রুমাল দিয়ে হাতটা কোনোমতে বেধে কোলে নিলাম।নাস্তানাবুদ হয়ে ছুটতে লাগলাম মেয়েটিকে নিয়ে। রুমাল ভেদ করেও টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে। ধূসর রং এর প্যান্টটা রক্তে খয়েরী রং এ রুপান্তরিত হয়েছে। বুঝতে দেরী হলোনা হাতে বেশী সময় নেই!তড়ি হড়ি করে কলেজের মেইন গেইট থেকে একটা সিএনজি নিলাম ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১ঘন্টা হয়ে গেছে আমরা সিনজিতে। রক্ত অনবরত ঝরেই পড়ছে।সিনএজির মেঝেটা লাল হয়ে গেলো। খুব চিন্তা হচ্ছিলো কেন জানিনা!চিন্তা তখন একটাই মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে। ব্যস্ত রাস্তার ট্রাফিক ছেড়ে আসতে আসতে অনেক রক্তক্ষরণ হলো। ২ঘন্টা পর ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সী গেইটে পৌঁছালাম। পাশেই কমলা কালারের শার্টে ওয়ার্ড বয়রা দাঁড়িয়ে আছে। আমার চেহারা দেখেই এগিয়ে এলো ছেলেটা স্ট্রেচার ঠেলে।কোলে নিয়ে স্ট্রেচারে শোয়ালাম মেয়েটাকে।
ইমারজেন্সী ভর্তির একটা টিকেট নিয়েই স্ট্রেচারটা ঠেলতে শুরু করলাম। ক্ষণিক ঠেলার পরেই মেয়েটার চোখ খুলতে দেখলাম।কি যেনো বলতে চাচ্ছে! ডান হাতটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে।আমি কানটা মুখে এগিয়ে দিতেই ভাঙ্গা কন্ঠে বললো ‘সে এসেছে তাইনা!যদি না আসে তাকে বলো আসতে!’ এই বলে আবার ও নিশ্চুপ!তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আবার জ্ঞান হারিয়েছে।আমি কোনোকিছু না ভেবেই আবার স্ট্রেচার ঠেলতে শুরু করলাম। আমার মন তখন ভাবেনি কে সে!কে আসেনি? আমি তো মেয়েটাকে চিনি’ই ন!কেমন করে জানবো কার কথা বলছে!ঠেলতে ঠেলতে টিকেটের দেয়া ওয়ার্ড নাম্বার পৌঁছালাম। রুমে ঢুকতেই কয়েকজন নার্স ছুটে আসলো। স্ট্রেচার থেকে নামিয়ে বেডে রাখলাম মেয়েটাকে। অবশেষে সেই ওয়ার্ডের দায়িত্বরত ডাক্তার এসে মেয়েটিকে দেখেই বললো কীভাবে হলো? বললাম ব্লেড দিয়ে নিজেই করেছে।
ডাক্তার:ওর অবস্থা খুবই খারাপ!তবে এটা পুলিশ কেইস।আইনি ব্যাবস্থা ছাড়া আমরা কীভাবে ট্রিটমেন্ট করবো?
– আগে যেটা প্রয়োজন সেটা করুন প্লিজ! পরে না হয় পুলিশ কেইস করা যাবে।
ডাক্তার:সুইসাইডাল কেইসগুলো অনেক জটিল হয়!যদি চিকিৎসাকালীন মারা যায় তবে এর দায়ভার তো আর আমরা নিতে পারিনা।
-প্লিজ এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে।কিছু একটা করুন দয়া করে।
ডাক্তার: দেখুন আমার পক্ষে সম্ভব নাহ।
আমি যেনো থম খেয়ে গেলাম। নিজেকে কেনো জানি অপরাধি মনে হচ্ছিলো? মন প্রশ্ন ছুড়ে মারছে মস্তিষ্কে!তুই কি মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবিনা? এসব ভাবতেই যেনো মাগরিবের আযান পড়লো। দৌড়ে গেলাম মেয়েটির দেহ শায়িত বেডের কাছে।মলিন হয়ে আছে মুখখান!এখন ও রক্তটা রুমাল চুঁইয়ে পড়ছে!নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। না জানি মেয়েটার নাম অথবা ঠিকানা!পরক্ষণেই চোখ পড়লো মেয়েটির গলায় ঝুলে থাকা আইডি কার্ডে। আইডি কার্ডটা খুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহেদকে ফোন দিয়ে মেয়েটির আইডি কার্ডের বৃত্তান্ত দিলাম। ইমারজেন্সী ঠিকানাটা বের করে দিতে বললাম। ফোন রেখেই ছুটে গেলাম মেয়েটির কাছে। সময় যেনো মেয়েটিকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে।
দেহটা যেনো নিথর এবং নিশ্চুপ। আমি যেনো অচেতন হয়ে পড়লাম ভাবনার। এই অপেক্ষা কার জন্য!কার জন্যই বা চোখে মুখে মেয়েটার এতো মায়া! রহস্যের রস যেনো মাথাটা খেয়ে নিচ্ছে। ৩০ মিনিট পর রাশেদ ফোন দিলো। অনেক কষ্টে ডিপার্টমেন্টের কর্মরত একজনের থেকে মেয়েটার অভিবাবকের নাম্বার সংগ্রহ করেছে বন্ধুটা। নাম্বারটা নিয়ে ফোন কেটে দিলাম। আইডি কার্ড পকেট থেকে বের করে দেখলাম মেয়েটির নাম অবন্তী। দেরী না করে ফোন দিলাম!ওপাশ থেকে চিন্তিত কন্ঠে একজন ভদ্র মহিলার হ্যালো শুনতে পেলাম। বুঝে গেলাম অবন্তী না ফেরায় এতক্ষণে খোজাখুজি শুরু হয়ে গেছে বাড়িতে।
~অবন্তীর কে হন আপনি?
– আমি অবন্তীর মা বলছি!কে আপনি?
~আমার পরিচয়টা পরে ও নেয়া যাবে। অবন্তীর একসিডেন্ট হয়েছে।আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেল আসেন।
-কী হয়েছে আমার অবন্তীর(কাঁদো কন্ঠে)?
~ সেটা পরে শুনবেন! হাতে সময় খুব কম।যত দ্রুত সম্ভব আপনি চলে আসুন প্লিজ।
এই বলে কেটে দিয়ে ছুটে গেলাম অবন্তীর কাছে! তখন ও যেনো ক্ষণিক পর পরই এক ফোটা করে রক্ত ঝরছে। নার্সকে বললাম আপু আপনারা ওকে প্লিজ নরমালি কিছু ট্রিটমেন্ট দেন, যাতে রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়! নার্সের মনে দয়া হলো বললো আপনি বাহিরে যান আমি দেখছি কি করা যায়! বাইরে বেরিয়ে হাসপাতালের করিডোরে ঘর্মাক্ত শরীরটা হেলে বসে পড়লাম। জানিনা কি মায়ায় জড়িয়ে গেলাম! নিজের মধ্যে কেবলই অস্থিরতা বিরাজ করছে। মনের কোল জুড়ে একটাই চিন্তা,আল্লাহ মেয়েটি যেনো সুস্থ হয়ে যায়। ভালো লাগছিলোনা তাই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ছোট দোকান থেকে একটি গোল্ডলিফ সিগারেট নিলাম। সকলের চোখ যেনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘামে শার্ট ভিজে মাঝে মাঝে দু এক ফোটা রক্ত।প্যান্ট টাও ভিজে চুপসে আছে রক্তে। পাগল প্রায় হয়ে পিছডালা পথে আনমনে হাঁটছি আর ধোয়া নির্গত করছিলাম বাতাসে।
চারিপাশের প্রজ্জলিত আলো এবং মানুষের গিজ গিজ শব্দের মধ্যে ও আমি যেনো ভাবনার জগতে হারানো। সিগারেট ফুঁকতে ফুকতে আবার হাসপাতালের দিকে গেলাম। ওয়ার্ডের ভিতর গিয়ে দেখি হাতে ব্যান্ডেজ করা। ডান হাতে একটি স্যালাইন চলছে। অবন্তীর তো কোনো হুশ নেই! এক গোছা চুল মেয়েটির মুখের এক পাশ ডেকে রেখেছে। চুলগুলো নিজ হাতে সরিয়ে দিলাম। আহ! মায়া যেনো মেয়েটির মুখ থেকে উপচে পড়ছে। হঠাৎ অবন্তী চোখ খুললো! আমার দিকে তাকিয়ে আছে পলকবিহীন। ভিরভির করে কি যেনো বলছে! অবন্তীর দিকে ঝুকে কি বলছে শোনার চেষ্টা করলাম।
~আপনার সাথে কি আমার রক্তের সম্পর্ক আছে! আপনি কেন আমার জন্য সময় ব্যায় করছেন?
-আপনি চুপ করুন তো! একদম কথা বলবেন নাহ।
~ কি লাভ এসব করে যদি না বাঁচতে পারি!
-অলক্ষুণে কথা বলবেন নাহ! কিচ্ছু হয়নি আপনার। আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।
~গল্প শুনাচ্ছেন? আচ্ছা অয়ন আসেনি?
– অয়ন কে? আমি ছাড়া কেউ আসেনি এখানে।
~অয়ন! সে তো আমার জীবনের একটা পার্ট ছিলো। ভেবেছিলাম অয়ন আসবে! কই আসেনি তো!
-ভালোবাসে-ভালোবাসেন অয়নকে?
~বাসতাম!তবে রক্তের স্রোতের সাথে যেন ভালোবাসাটা ও কমে যাচ্ছে।
-আপনি ধৈর্য্যহারা হবেন না!অয়ন আসবেই।
~হয়তো আসবে!তাকে বলেন নি আসতে?
আবার ও জ্ঞান হারালো! বাহির থেকে একটা চিল্লানি দিয়ে কারা যেনো আসছে।রুমের গেইটে আসতেই দেখলাম কয়েকটা ছলছল চোখ ধেয়ে আসছে। বুঝার বাকি রইলোনা এরাই অবন্তীর আপনজন। এসেই হুড়িমুড়ি খেয়ে অবন্তীকে ধরতে চাইলো। কিন্তু নার্স বললো প্লিজ আপনারা বাইরে যান। গোলমাল হলে রোগীদের প্রবলেম হবে। ভদ্র মহিলার কান্নার ডং দেখে বুঝলাম ইনিই অবন্তীর মা। নার্স বললো আপনারা শীঘ্রই রোগীর ট্রিটমেন্টের ব্যাবস্থা করুন ডাক্তারের সাথে কথা বলে। অবন্তীর মা আমার গায়ে মাখা রক্ত দেখে বললো বাবা কীভাবে হলো এসব!সংক্ষেপে দুই মিনিট বলে শেষ করলাম। আন্টিকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে গেলাম অবন্তীর বাবাসহ।
ডাক্তারের কক্ষে ঢুকতেই বললো পুলিশ কেইস করেছেন? অবন্তীর বাবা ছিলেন উত্তরা থানার একজন কর্মরত পুলিশ। তিনি ডাক্তারের সাথে কথা বলে খুব সহজেই মানিয়ে নিলেন। ডাক্তার প্রস্তুতি নিয়ে ওয়ার্ডে অবন্তীর কাছে গেলেন। আমাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। রাত তখন প্রায় ১১টা! সবার মুখেই যেনো এক অস্থিরতার চাপ। অবন্তীর মা এসে বললো বাবা তুমি অনেক কষ্ট করেছো। এখন তোমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। তুমি বাড়ি যাও,কাল সকালে আবার এসো। আমি বললাম ডাক্তার বের হলেই আমি চলে যাবো। ঠিক আছে বাবা। আসলে অবন্তীকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছিলোনা! চিন্তায় ঘুম ও আসবেনা জানি। বোধহয় মেয়েটার মায়ায় পরে গেলাম। ২০ মিনিট পর ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললো অবন্তী এখন মোটামুটি ঠিক আছে, পরে অবস্থা খারাপ হতে পারে। অবন্তী নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমি ভিতরে ঢুকে অবন্তীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম!
অবন্তী:বসুন!
-চুপচাপ বসে পড়লাম।
অবন্তী: এখনো বাসাই যান নি?
-আপনি ঠিক হলেই চলে যাবো।
অবন্তী:যদি না ঠিক হই সারাজীবন কি এখানেই থাকবেন?
-চুপ করুন তো! আপনি এখন ও অসুস্থ(এড়িয়ে গেলাম কথাটা)।
অবন্তী: না আছে রক্তের সম্পর্ক,না আপনি আমার বন্ধু অথবা পরিচিত! এখন ও বাড়ি ফিরছেন না যে!
-আমার কথা না ভাবলেও চলবে।
অবন্তী:বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ বলুন, আমার যে আর বেশী সময় নেই।
-ডাক্তার বলেছে আপনি ঠিক হয়ে যাবেন, শুধুই শুধুই বাজে বকছেন।
অবন্তী: আচ্ছা ছাড়ুন সময় কথা বলবেই।
-হুম! অয়নের কথা জিজ্ঞেস করলেন না যে একবার ও?
অবন্তী: বলেছিলাম নাহ সময়ের সাথে সাথে তাকে ভুলে যাবো! রক্তের স্রোতে সে ও ভেসে গেছে জীবন থেকে।
-হয়তো কোনো বিপদে আছেন,তাই আসতে পারে নি। ভুল ও তো বুঝতে পারেন!
অবন্তী: ভুল ২-১ বার করে কিন্তু এই নিয়ে হাজারটা ভুল হয়ে গেছে। সে বদলানোর নয়।
-ওহ!
অবন্তী:হুম! আপনার কোনো প্রিয় মানুষ নেই?
-নাহ! তেমন কেউ আসেনি।
অবন্তী: দায়িত্বশীল মানুষগুলোকে কি আর ভাগ্যবতীরা পায়! যদি দেখা হতো আগে আপনার সাথে!
-এখন তো হলো!
অবন্তী:অনেক দেরীতে নয় কি?
-কতই বা দেরি হয়েছে!
অবন্তী: বাদ দেন! মাকে আসতে বলুন ভিতরে।
-আচ্ছা। অবন্তী: আপনি এক্ষুণি বাড়ি ফিরুন! কাল একবার আসিয়েন প্লিজ।
– হ্যাঁ আসবো। আপনি বিশ্রাম নেন। অবন্তী:দেখে শুনে ফিরবেন,আল্লাহ হাফেজ।
-ঠিক আছে! বিদায়।
বাহিরে গিয়ে অবন্তীর মা কে ভিতরে যেতে বললাম। বের হয়ে গেলাম হাসপাতাল থেকে। বড় রাস্তা ধরে হেটে যাচ্ছি। একটি সিগারেটই চলার পথে সাথি। মনের শূন্যতা ঘিরেই যে অবন্তী। চারিপাশের ঝিকঝাক আলো আমার ভাবনাকে বেশামাল করতে পারেনা। মন যেনো যেতেই চাচ্ছেনা বাড়ি ফিরে। ইচ্ছে করছে ছুটে যায় অবন্তীর কাছে।ওর মায়ার শিকলে নিজেকে বেঁধে ফেলতে! অনেকটা পথ হাঁটার পর ফোনটা বেজে উঠলো! অবন্তীর মা ফোন দিয়েছে। অবন্তীর অবস্থা নাকি খুব খারাপ! ৬ ব্যাগ রক্ত লাগবে ইমারজেন্সী। রক্তটা হাসপাতাল থেকে কিনে নিতে বললাম। এতো রাতে রক্ত ব্যাবস্থা করতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। কালো মেঘে ছেয়ে গেলো আমার মনের আকাশ। কি এমন আজন্ম পরিচয়! কেন এতো অস্থিরতা অবন্তীর জন্যে! দিক বিদিক হারিয়ে মনটা ধরে নিলো ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। ছুটলাম বড় রাস্তা ধরে। আবার ও ফোন অবন্তীর মা’য়ের। ছুটতে ছুটতে রিসিভ করলাম ফোনটা! অবন্তীর মা: বাবা তুমি কোথায়?
– আমি রাস্তা পার হয়েই আসতিছি!
অবন্তীর মা: অবন্তী তোমার সাথে কথা বলতে চায়,একটু তাড়াতাড়ি।
বিকট শব্দের পর ফোনটা কেটে গেলো।যাওয়া হলোনা আর অবন্তীর কাছে! ট্রাকটা যে নীলকে ছিটকে ফেলে দিলো রাস্তার ওইপ্রান্তে।বলা হলোনা অবন্তীর জন্য জন্মানো সদ্য ভালোবাসা! অবন্তীর ডাকে সাড়া দেওয়া হলোনা আর। পড়ে থাকা নির্মম দেহটা তুলে নিলো কয়েকজন পথচারী। তাকে ও নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকা মেডিকেলে।
কিছুক্ষণ আগে যে কারো প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলো,তারই এখন জীবন নিয়ে হিমশিম। স্ট্রেচার ঠেলে রক্তাক্ত দেহটা ভিতরে নিচ্ছে ওয়ার্ড বয়। অবন্তীর ওয়ার্ডেই নীলকে নিলো। গুরুতর আহত শুনে কর্মরত ডাক্তার ছুটে আসে। এসেই দেখে রাইয়ান আর দুনিয়ায় নেই। পরিচিত লোক যে তার কাছে লাশটা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করুন বলে, লাশটাকে সাদা কাপনে ডেকে হাসপাতালের বেলকুনিতে রেখে দেয়। লাশটার পাশেই অবন্তীর মা দাঁড়িয়ে আফসোস করে বলছে “কোন মায়ের বুক খালি হলো”। না জানি ছেলেটার ওপর কত দায়িত্ব!
নার্স এসে অবন্তীর মাকে এসে বললো “অবন্তী ডাকছে। ছুটে গেলো অবন্তীর বেডে। রক্ত পুষ হচ্ছে অবন্তীর দেহে। হাসপাতাল থেকে রক্ত কিনে নিয়েছে অবন্তীর বাবা।
অবন্তী:মা ছেলেটি এসেছে ?
-নাহ মা! এখন কেমন লাগছে?
অবন্তী: মোটামুটি ভালো লাগছে! আর ফোন দেন নি?
-ফোনটা সুইচড অফ দেখাচ্ছে।হয়তো ফোনে চার্জ নেই!
অবন্তী: ছেলেটি আমাকে নিয়ে আজ অনেক পেরেশানির মধ্যে ছিলো! রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বেশী কিছু করে গেছে আমার জন্য।
-চিন্তা করিস না মা! সকালে আসবে বলেছে তো! অবন্তী: ওহ!
-হুম! তুই বিশ্রাম নে আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
অবন্তী:ঠিক আছে। অবন্তীর মা চলে গেলেন। অবন্তীর জলছাপের মন নীলকে নিয়ে ভাবছে! মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনছে। বেঈমান ছেড়ে আপন খুঁজে পেয়েছে অবন্তী। অবন্তী ও মনস্থির করলো বাকি জীবনটা নীলের সাথে কাটাবে। আচ্ছা ছেলেটা রাজি হবে তো? অবন্তী কখনোই ভাবেনি সে দ্বিতীয় কারো মায়ার জালে ফেসে যাবে।গল্পের মোড় যে এভাবে নিবে ভাবেনি অবন্তী। সকালের অপেক্ষায় অবন্তী। এদিকে ডাক্তার এসে অবন্তীর মাকে বললেন, ” অবন্তী আউট অফ ডেন্জার” দুই একদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। চাইলে কাল বাসায় ও নিয়ে যেতে পারবেন।
সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অবন্তীর মা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। সবার মুখেই হাসির ছাপ।ঠিক তক্ষুণি একজন নার্স এসে বললো অবন্তীকে নিয়ে আসা ছেলেটি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। অবন্তীর বাবা মা বেশ বড় একটা ঝটকা খেলো! অবন্তী তখন ঘুমোচ্ছে। ফজরের আযান পড়েছে। অবন্তীর ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখ খুলেই মাকে দেখতে পায়! মা ছেলেটা এসেছে? মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তালাবদ্ধ মুখে মা কি জবাব দেবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। মা তাকে বলো আসতে! মায়ের চোখের কোণ বেয়ে জল পড়ছে! বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা। ছেলেটা আসেনি মা?
-এসেছে মা! কোথায়?
-বারান্দায় আছে তো! তাকে বলো আসতে মা!
-সে আসতে পারবেনা!
অবন্তী স্যালাইনের ব্যাগটা বাম হাতে নিয়ে উঠলো! গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় এসে দেখলো বারান্দায় একটা ট্রলিতে লাশ পড়ে অাছে। আর তো কেউ নেই। মা কোথায়?
– ঔইতো ট্রলিতে।
মায়ের কথা শুনে অবন্তী একটু বিচলিত হলো! এগিয়ে গেলো আপাদমস্তক শায়িত দেহের কাছে। সাদা কাপড়টা সরাতেই অবন্তীর শরীর ছেড়ে দিলো! নিথর দেহটার বড় বড় চোখ যেনো অবন্তীর দিকে তাকিয়ে আছে। বড় আক্ষেপ রয়ে গেছে ঔই চাহনিতে।অবন্তী র মুখে কোনো শব্দ নেই। মুহূর্তের মধ্যেই যেনো মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কি সেই ছেলেটা! যে আমাকে বাঁচাতে ছুটছিলো! গল্পের মোড় কি এভাবেই নেয়ার কথা ছিলো! ভাগ্য কি আমার এতোই খারাপ?মৃত্যুটা কেবল নীলই হয়নি মৃত্যুটা অবন্তীর ও হয়েছে। স্বপ্ন বোনা জালে মাকড়সড়সার বাসা আজ। হবারান্দার দেয়াল ঘেসে বসে পড়লো। অচেতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অবন্তী।
কথা ছিলো দুজন দুজনকে না বলা কথা বলার! কথা ছিলো নীল আসবে! ভাবেনি নীল এভাবে আসবে। অবন্তী নিঃশ্চুপ হয়ে গেছে। আজ নীল নেই এক বছর পূর্তি হলো! এতোদিন বাদে ও অবন্তী ঢাকা মেডিকেলের সেই বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে। জানে নীল কখনোই ফিরে আসবেনা! তবুও এই অতৃপ্ত অপেক্ষার জন্য তৃপ্তি মিটেনা। তৈরি হওয়া ঘরে পা রাখতেই ভেঙ্গে গেলো। জীবনের এই ভাঙ্গন অবন্তীর বুকে বেশ একটা ক্ষত হয়ে আছে আজ ও। এ ক্ষত বোধহয় থাকবেই কিন্তু নীল আর আসবেনা।