বিশ্বাসের ফ্রেমে অবিশ্বাসের গল্প

বিশ্বাসের ফ্রেমে অবিশ্বাসের গল্প

– ‘অনুলতা! আমার একটা বদ অভ্যাস আছে, জানো?’
– ‘নাহ!’
– ‘আমি যেখানে যত সুন্দর মেয়ে দেখি তাদেরকে নিজের

বউ বউ মনে হয়।’ তিতাসের কথা শুনে ফিক ফিক করে হেসে দিলো অনু। নাম তার অনন্যা। তিতাস আদর করে ডাকে অনু, কখনো আবার অনুলতা । ট্রেনের কামড়ায় বসে জানালায় মুখ দিয়ে এতক্ষণ বাইরের আকাশ দেখছিলো অনু। তিতাসের কথা শুনে হেসে দিয়ে তার মুখোমুখি চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো সে।

– ‘কি! হাসলে?’
– (খিলখিলিয়ে হেসে বললো অনু) ‘আপনি না আস্ত বোকাএকটা!’

– ‘সত্যি কথা বলতে আমার কোন সংকোচ নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই ঠকাতে চাই না কখনো।’
– ‘দেখুন না বাইরে মেঘ করেছে!’

কথা ঘুরিয়ে বললো অনু। কারণ এ বিষয় নিয়ে কোন কথাই এখন বলতে ইচ্ছে করছে না তার। তবুও তিতাস এই বিষয় নিয়ে আরও কথা বলতে চাইছে অনুর সাথে। ভীষণ নাছোড়বান্দা! দু’ মাস আগেও একবার বিশ্বস্ততার গল্প নিয়ে তর্ক হয়েছিলো অনুলতা আর তিতাসের মাঝে। তারপরে হঠাৎ এক সকালে খবর এলো অনুলতার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তার বাবা-মা। তখনই বের হয়ে এলো। অনুলতার হাত ধরে নিয়ে এলো ‘কাঞ্চননগর রেলস্টেশন’। দু’টি টিকেটে ট্রেনে চড়ে দূরের দেশে পাড়ি দেবে তারা।

অজানা জায়গায় নিজেদের নিবাস গড়ে নেবে। ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন তাদের চোখে। তাই যাত্রা শুরুর পথেই তিতাসের মুখে এমন অলক্ষুণে কথা শুনতে চায় না অনুলতা। অনুলতা জানালা দিয়ে দূরে থাকা কালো মেঘের আকাশ দেখছে। আর তিতাসের চোখ দু’টি ডুবে আছে অনুলতার নেকাবের আঁড়ালে কাজল আঁকা দু’ চোখের সমুদ্রে। খানিক-ক্ষণ পরে ট্রেন থামলো একটা অচেনা স্টেশনে। বাইরে ‘চা…চা…’ বলে ডাকছে ছোট্ট এক বালক। হাতে তার চায়ের ফ্লাস্ক। অনুলতা সেদিকে তাকিয়ে আছে। চা খাবে কি না তা বুঝতে পারছে না তিতাস। নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো-‘চা খাবে?’ অনু ঘাড় একদিকে কাত করে সম্মতি দিলো। তিতাস দু’ কাপ চা নিলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অনু তাকালো তিতাসের দিকে। তারপরে তাকে লক্ষ্য করে অন্য দিকে তাকিয়েবললো-‘আমার কিন্তু তবে অনেক গুলো সতীন হবে।’অনুর কথায় তার দিকে তাকালো তিতাস।

অনু আবার বললো-‘আমার কিন্তু ভালোই হবে। সব ক’জন সতীন মিলে আপনাকে ভালোবাসবো। ইলিশ মাছ রান্নাকরে মাথাটা আপনার প্লেটে তুলে দেবো। মাঝে মাঝে আপনাকে আমি নিজ হাতে খাইয়ে দেবো। তারপরে খাওয়া শেষে সতীনদের নিয়ে পান খাবো আর আপনাকেও পান বানিয়ে দেবো। তারপরে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে আমরা একে অন্যের মাথার উকুন বেছে দেবো।’ এতক্ষণে ওদের চা শেষ। ট্রেন ছেড়ে দেবে এমন সময় অনু আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরলো। ট্রেন থেকে নেমে দু’টা আইসক্রিম ঝটপট নিয়ে এলো। বগিতে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো, এক মেয়ে দৌঁড়ে আসছে একটা লাগেজ হাতে করে। ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে বৈকি! মেয়েটা দৌঁড়তে পারছিলো না বলে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো এক পলকে তাকিয়ে থাকা তিতাসের দিকে। তিতাস হাত দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে অবশেষেবাড়িয়ে দিলো হাত। তিতাসের হাতে হাত রেখেদৌঁড়চ্ছে মেয়েটি।

আর তিতাস এদিকে ভাবছে- ‘যে হাত ধরেছি মাবুদ, সে হাত যেন কভু ছুটে না যায় আর!’বগিতে উঠে এসে মেয়েটি হাঁপাতে লাগলো কিছুক্ষণ। তারপরে তিতাসকে একটা ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে সরেগেলো। ওদিকে আইসক্রিমের অপেক্ষায় ছটফটাচ্ছে অনু। অনুর সামনে একটি আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে অন্যটিকামড়ে খেতে লাগলো তিতাস।অনু বললো-‘আমি তো মনেকরেছিলাম আপনি আসার আগেই ট্রেন ছেড়ে দেবে।’ তার কথা শুনে হাসতে শুরু করলো তিতাস। তিতাস তখন বাইরের দৃশ্য দেখছে। একটা মেয়ের কন্ঠেশোনা গেলো-‘আপনাদের এখানে একটু বসা যাবে।কোথাও বসার মত একটা জায়গা পেলাম না।’

তিতাস তাকিয়ে সেই মেয়েটির মুখ দেখতে পেলো যার হাত কিছুক্ষণ আগে ছুঁয়েছিলো সে। তিতাস মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়েই রইলো। অনু মেয়েটিকে তার পাশে বসার জায়গা করে দিলো। তিতাস কেমন লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটির সামনে! জানালা দিয়ে তাই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণে মেয়েটির সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে অনু। আর এসব কথা চুপিচুপি শুনছে বাইরে তাকিয়ে থাকা তিতাস। এতক্ষণে জানতে পারলো তিতাস মেয়েটির নাম হিয়া। রাত নেমে এসেছে। বৃষ্টিও হচ্ছে সমানে। কিছু খাওয়া-দাওয়া করার পরে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসলো অনু। উপন্যাসটার কাহিনী নিয়ে হিয়া নামের মেয়েটির কাছে গল্প শুরু করলো সে। হঠাৎ কথার ফাঁকে হিয়া কানে কানে জিজ্ঞেস করলো-

– ‘আচ্ছা, উনি কী হন আপনার?’
– ‘উনি! উনি আমার এক জনমের আলো-আশা।’
– ‘পালিয়ে এসেছেন! ভয় করে নি একটুও?’
– ‘আলো-আঁধারির খেলা ভুবনে।’

অনুর কথা কিছু বুঝলো কি না তা বলা যায় না। তবেমেয়েটি আর কোন কথা বললো না। এতক্ষণ যেভাবেতাকাচ্ছিলো সেভাবে তাকানো তো দূরের কথা মোটেইতাকালো না। ভোর সকালে ট্রেন এলো অভয়নগরে।এখানে নেমে যেতে হবে তিতাসদের। অনুকে বললো যে এখানেই তার পরিচিত একজন নিতে আসবে। তাই অনু তাকে তাড়া করছিল জলদি নামার জন্যে।

তবে তিতাস কোন এক বাহানা দিয়ে আরও কিছুক্ষণ থেকে সামনের স্টেশনে নামতে চাইলো। কে জানে তার হয়তো চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও কোন কাজ হলো না। নামতেই হলো এখানে। নেমে গেলো। মন পড়ে রইলো ট্রেনের সেই হিয়া নামের মেয়েটির কাছে। কে জানে! কত দিন পর্যন্ত এই প্রভাব, এই আবেগ তাকে তাড়া করে বেড়াবে। স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে তিতাস ও অনু। একজন এসে তিতাসকে ডেকে একটু কাছে নিলো। অনু তাকিয়ে আছে সেদিকে। শুনতে পেলো ওই লোকটি বলছে-‘আর কত মেয়েকে নিয়ে খেলবি এভাবে?’ কথাটা শুনার পরে অনুর বুকে ধড়ফড় করে উঠলো। তাকিয়ে রইলো তিতাসের দিকে। ‘এতটা বিশ্বাস করে সব ছেড়ে এসেছি যার কথায়, তবে কি সেই তিতাসই ঠকালো আমায়?’ এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মাথায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত