রাশেদ বলল, ‘দোস্ত তোরে তো আজ জোশ লাগতাছে। পুরাই আগুন’। আমি বললাম ‘পানি ঢেলে আগুন নিভায়ে দে’ রাশেদ চুপ করে গেল। আসিফ যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তোরে দেইখ্যা যদি মেয়ে না পটে সে তো মাইনষের বাচ্চা না।সে এলিয়েনের বাচ্চা’। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম, ‘তাই নাকি?’ আসিফ আগের মত চেহারায় অংক টিচার টাইপ সিরিয়াস ভাব এনে বলল , ‘অবশ্যই’।
আমার বুক কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠল। আধঘন্টা লেট করে গেলাম রেস্টুরেন্টে। লেট করে যাওয়াটা নাকি এলিটদের কাজ। নিজেকে একজন এলিট, হ্যান্ডসাম, গুডলুকিং প্রমাণ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। মাথার চুল কেটেছি। চেহারায় সিরিয়াস সিরিয়াস একটা ভাব নিয়ে এসেছি। এই ব্যাপারটা নাকি মেয়ে দেখতে যাওয়ার সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ বলেন সিরিয়াস ছেলেদের মেয়েরা নাকি খুব পছন্দ করে। হাতে ঘড়ি দিয়েছি । ঘড়িতে এখন ১২:৩০ বাজে। পায়ে জুতা আছে। খুবই দামী জুতা। জুতোর গায়ে দাম লিখে দেওয়া আছে ১০,০০০ টাকা। দুর্ভাগ্যবশত জুতোর যে অংশে মূল্য লেখা থাকে সেটা পায়ের নিচে থাকে। এটা উপরে থাকলে ভালো হতো। আমি যে এলিট জাতীয় জীব এটা প্রকাশ পেতো।
রেস্টুরেন্টের একটি সুন্দর কক্ষে আমার অপেক্ষায় অপেক্ষমান মেয়েটি রূপবতী। চোখগুলো সুন্দর। হাসি দেওয়ার মূহুর্তে আরও সুন্দর লাগে। মেয়েটার নাম পারু। বললাম, কেমন আছো? মেয়েটা হাসলো। ভাবখানা এমন যেন এমন তুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়না। কথার পিঠে কথা বলা আমার ধাতে নেই। কি বলব কি বলব ভাবতে ভাবতে কেটে গেল দশ মিনিট। ওয়েটার এসে অর্ডার জানতে চাইলো। পারু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অর্ডার করুন’। আমি বললাম, ‘তুমি করো’। পারু একটু ভেবে বলল, ‘ঝাল করে চ্যাপা শুটকির ভর্তা দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। আপনাদের হোটেলে আছে?’
ওয়েটার যথেষ্ট নম্র ভাবে রোবটের মত করে বলল, ‘সরি আপু, এখানে শুঁটকি জাতীয় কিছু রান্না হয় না। চাইনিজ, জাপানিজ ফুড পাবেন কিন্তু শুঁটকি পাবেন না’। পারু খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ‘তাইলে কবুতরের স্যুপ দেন’। ওয়েটার এবারো ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বলল, ‘আপু! কবুতরের স্যুপ নেই এখানে। অন্য কিছু অর্ডার করুন’।পারু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি দুইটা চিকেন ফ্রাইয়ের অর্ডার করলাম। সামনে বসে থাকা আশ্চর্য রহস্যময়ী মেয়েটিকে বুঝতে চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারার আগেই পারু বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? এভাবে তাকিয়ে থাকে নতুন প্রেমে পড়া সদ্য দাঁড়ি গোঁফ উঠা কিশোরেরা। আপনি তো কিশোর না।বেশ যুবক’।
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম কি সাংঘাতিক কথাবার্তা মেয়ের! আমি একটু চুপ থেকে বললাম, ‘কিশোর প্রেমিকদের ব্যাপারে তোমার দেখি ভাল জ্ঞান’। পারু বলল, ‘এটা প্রেম বিষয়ক জেনারেল নলেজ। টেইক ইট ইজি’। আমি ইজি ভাবে নিতেই চেষ্টা করছি। বললাম, ‘প্রেমে তোমার দেখি ভালো অভিজ্ঞতা’! পারু বলল, ‘প্রেমে নয় প্রেম দেখে অভিজ্ঞতা হয়েছে একটু। এরচে’বেশি কিছু না’।আলোচনা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। এরমধ্যে ওয়েটার অর্ডার নিয়ে আসছে। খেতে খেতে ইচ্ছে হলো পারুকে একটু খাইয়ে দিতে।পারু খুব মন দিয়ে খাচ্ছে। বললাম, ‘পারু!’ পারু খেতে খেতে বলল, ‘কিছু বলবেন’? আমি বললাম, ‘একটু খাইয়ে দেই তোমাকে’? পারু মনে হয় লজ্জা পেল খানিকটা। আমি খাবার মুখে তুলে দিলাম।
বাসায় আসতেই সবাই ঘিরে ফেলল।এই ঘিরে ফেলার প্রক্রিয়া এর আগে আরও ১৭ বার হইছে।এটা ১৮তম প্রক্রিয়া। সবার চোখে মুখে আগের মতোই উৎকণ্ঠা। মা খুব নরম করে বললেন সেই আগের মতই, ‘বাবা! মেয়ে কেমন দেখলি’? আমি বললাম, ‘ভালো দেখেছি মা’। ছোট বোন চোখ সরু করে বলল, ‘এবারো পছন্দ হয়নি’? আমি কিছু না বলে আমার রুমে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর পুরো বাড়ি জুড়ে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হুল্লোড় শুনছি মায়ের।কিশোরীদের মতো চিৎকার করছেন।যেন তার স্বর্গলাভ হয়েছে। ঘটনা কি জানার জন্য আশপাশের মহিলারা জড়ো হয়েছেন। মা তাদের মাঝে ভাষণ দিচ্ছেন। তার ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে। ছেলে মেয়ে দুজনই দুজনকে পছন্দ করেছে।একটু আগে মেয়ের মা ফোন করে জানিয়েছেন। মেয়ের এক মামা জাতীসংঘে কাজ করে ,এক চাচা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। খুবই ধনী ঘরের মেয়ে। ইতোমধ্যে আত্মীয় স্বজন সবাইকে জানানো হয়েছে।সবাই ফোন করে কংগ্রেচুলেশন করছেন। আমার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে যে এতো আংকেল আন্টি,ভাইয়া ভাবী আছেন তা আমার জানা ছিলো না। বিয়ের কথাবার্তা পাকা করার জন্য পারুদের বাড়িতে যেতে হবে। মুরুব্বিরা ও যাবে।
বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে বুড়োদের বেশ জ্ঞান কপচাতে দেখা যায় । অতি আহ্লাদী কোন কোন বুড়ো আবার বাসর নিয়েও খোলামেলা কথা বলতে শুরু করেন। মুরুব্বি হিসেবে দুজন চললেন। একজন আমার মামা আমিরুজ্জামান অন্যজন ফুফা । ফুফার নামটা খুবই কঠিন তাই মনে রাখতে পারিনা। উনার নামের মত উনার কথাবার্তাও কঠিন। পথে উনার ভারি ভারি জ্ঞানমূলক কথায় সবাই খুবই বিরক্ত। তবে কেউ বিরক্তি ভাব প্রকাশ করিনি। উনার সব কথায় জি জি বলি। এতে ইনি খুব খুশি। ভাবেন উনার কথা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি। যদিও এই মুহূর্তে আমি অন্য কিছু ভাবছি। খুবই ব্যক্তিগত কিছু ব্যাপার। পারু কি শাড়ি পড়বে আজকে? শাড়ি পরলে কেমন লাগে ওকে? কি রঙের শাড়িতে ওকে মানাবে! আচ্ছা পারু কি আমাকে নিয়ে ভাবছে এখন? কি জানি।
বিয়ে হয়ে গেল।বর হিসেবে যা করার তার সবটা করেছি। হাসিমুখেই করেছি। যেমন সবার সাথে অতি আন্তরিক ভাব রেখে কথা বলেছি। মুরুব্বিদের চূড়ান্ত আদব দেখিয়েছি। কেউ ছবি তুলতে এলে হাসিমুখে পোজ দিয়েছি। কাজী সাহেব কবুল বলতে অনুরোধ করায় কোন রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই কবুল বলে দিয়েছি। কোন ধরনের কান্না কাটি করি নি।সবশেষ শশুর শাশুড়ির হাত থেকে তাদের মেয়েকে বুঝে নিয়ে গাড়িতে চড়েছি।যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় পারুর হাউ মাউ চিৎকার শুনে ওকে সান্ত্বনা দিয়েছি। সান্ত্বনা কোন কাজে আসে নি। ওর কাঁদার ভলিউম বেড়েছে। আমি বিরক্ত হয়ে কানে কানে বললাম, ‘দয়া করে সাইলেন্ট হয়ে কাঁদো নয়তো মানুষ ভাববে তোমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি’। এই কথায় কাজ হলো,পারু চুপ হয়ে গেল। আমি কুল হয়ে একটু বসলাম। বেশিক্ষণ কুল থাকা গেল না।
গাড়ি বাড়ির কাছে আসছে। সবাই নেমেছে। নতুন বউকে হেঁটে বাড়ি নেয়ার কোন নিয়ম নেই। যতটুকু পথ বাকি তা কোন সামর্থবান আত্মীয় পুরুষ পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাবে এটাই নাকি নিয়ম। পারু এই নিয়ম শুনে বলল, ‘নিয়মের কপালে লাত্থি দেই। আমি অন্য কোন পুরুষের কোলে কেন উঠবো? হোক সে কোন আত্মীয়। আমি কারো কোলে উঠছি না। যদি একান্তই উঠতে হয় আমার স্বামীর কোলে উঠে যাবো’। সবাই হতবাক। আমি কোন কথা না বলে কোলে নিলাম পারুকে। সকলে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলো। পারু বলল,’কষ্ট দিচ্ছি খুব তাই না’? আমি বললাম, ‘এমন কষ্ট সারাজীবন করে যেতে চাই’।