মাস দু’য়েক আগে ভাইয়ার বিয়ে হয়।কিন্তু ভাইয়ার বিয়েতে সব চেয়ে বেশি ভুক্ত ভোগী আমি।জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেছে। জনি ভাইয়া আর আমার বয়সের ব্যবধান বড় জোর ৫ বছর হবে। আমার নাম আখিঁ।জনি ভাইয়া আমাকে আখুঁ বলেই ডাকে।কখনোবা পিচ্চি বলে ডাকে। আবার মাঝে মাঝে মশকরা করে মোটু বলেও ডাকে।ইদানীং ডাকটা শুনলে ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে।চোখে পানি চলে আসে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক হয়ে নিজেকে দেখতে থাকি”আসলেই কি আমি মোটা?”। না,আমি মোটা না।হালকা স্বাস্থ্যবান। কিন্তু ভাইয়ের বিয়ের পর শুকিয়ে শুটকি হয়ে গেছি।ভাইয়ার বিয়ের পর ভেবেছিলাম,মিষ্টি একটা ভাবি পাবো।কিন্তু কে জানতো সে একজন শুঁটকিখোর।তার ফেসবুক টাইমলাইন ঘাটলে হাজার হাজার খাবারের ছবি পাওয়া যাবে।যার সব গুলায় শুঁটকির রেসিপি।
মাঝে মাঝে খাবারের মেনু দেখে কাঁদতে থাকি।আর বিড়বিড় করে বলি,ওনার মা কি ওনারে শুঁটকি ছাড়া আর কোনো রান্না শেখায় নাই??শুঁটকি খাদক মহিলা কোথাকার। ভাইয়ার তেমন স্বাস্থ্য নেই। ভাইয়া বরাবরই বেছে বেছে খেত।যেই সেই খাবার মুখে দিতো না।প্রথমে ভেবেছিলাম,ভাবির এই অমানুষিক নির্যাতনে ভাইয়া হয়তো অতিষ্ট।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে জনি ভাইয়া গদ গদ করে এসব খেয়ে বউয়ের গুনগানে পঞ্চমুখ।আমি তার কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকি।এভাবেই আমার দিন চলছে।নিজেকে এখন আয়নার সামনে নিলে শুঁটকির চেহারা ভেসে ওঠে।ভাবির সাথে ব্যক্তিগত বিরোধ না থাকলেও এখন ওই মানুষটার ওপর প্রচন্ডরকমের বিরক্ত চলে এসেছে।
–আখিঁ খেতে চল।
—দেখ মা, আমাকে বিরক্ত করো না।আমার খিদে নেই।
—-খিদে নেই মানে কি?
—-রোজ রোজ একই খাবার খেতে কার ভালো লাগে বলো?বেশ ঝাঁঝের সাথেই বললাম।
—-আজকে তোর ফেভারিট মুরগির মাংস রান্না হইছে শুটকি দিয়ে। আর লইট্টা শুটকি দিয়ে কাঠালের বিচি চচ্চড়ি।
কথাটা শুনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। হায় আল্লাহ এ কোন মসিবতে পড়লাম।
প্রতিদিন শুটকির রেসিপি।শুটকির ভর্তা,চ্যাপা শুঁটকি দিয়ে লতি,শুটকি দিয়ে খাসির কালিয়া,চিংড়ির শুটকি দিয়ে ঢেড়শ ভাজি,চিংড়ি শুটকি দিয়ে বরবটি, তরমুজের খোসা দিয়ে শুটকি,মুলা দিয়ে শুঁটকি, লাউপাতা দিয়ে ছুড়ি শুঁটকি,পুই শাক দিয়ে বাঁশপাতা শুটকি ভুনা, রুপচাদা শুঁটকির ভুনা,কাচকি শুঁটকি ভুনা, শুঁটকির বড়া,শুঁটকির বালাচাও এসব আমাদের বাৎসরিক খাবারের মেনু।শুটকি বাড়ি বানাই ফেলছে।ভাবি আশার পর যে কতো না খেয়ে থাকছি আল্লাহ জানে।বিরিয়ানির স্বাদ প্রায় ভুলেই গেছি। এর কিছুদিন পর আমার বিয়ের কথা চলতে থাকে।মনে মনে লাড্ডূ ফাটলো।ভাবলাম,আর যাই হোক ভাবির নিত্যদিনের অত্যাচার থেকে বাচবো এই ভেবেই খুশি।
যথারীতি একদিন আমাকে দেখতে আসলো।ভাবি স্পেশাল আদর আপ্যায়ন করতে লাগলো।ছেলের বাড়ি থেকে ছেলে, ছেলের বোন আর মামা এসেছে।আমাকে দেখে বললো,মেয়েতো দেখতে মাশাল্লা। মনে মনে খুশিই হলাম।কিন্তু পরক্ষনেই খুশি হাওয়ায় মিশে গেলো।ভেবেছিলাম আজ অন্তত ভালো কিছু রান্না হবে।কিন্তু না,ভাবি আজ রান্না করছে শুটকির বিরিয়ানি আর শুটকির আরো কিছু ঐতিহ্যবাহী পদ।
—ছেলের বোন জিজ্ঞাসা করে, এসব কে রান্না করেছে?
—-এসব আখিঁ রান্না করছে।ওর রান্নার হাত খুব ভালো। ভাবির এ কথা শুনে হা হয়ে বসে রইলাম।বিয়ের বারোটা বোধহয় বেজেই যাবে আজ।ভাবতেই বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠলো।খাওয়া দাওয়া করে সবাই বিদায় নিলো।
—ভাবি,তোমাকে ওইসব কে বলতে বলেছে?বেশ বিরক্ত নিয়ে কথাটা বললাম।
—আমিতো তোমারই প্রশংসা করলাম আর তোমার গায়ে লাগলো?
—-আমি এরকম প্রশংসা চাই না।আর কখনো এসব বলবা না।
রাতে ভাবি জানালো,ছেলেপক্ষ ফোন করেছিল,তাদের নাকি আমাকে খুব পছন্দ হইছে।কিন্তু কিভাবে সম্ভব।কিছুতেই হিসেব মিলছিল না।
—ওরাও শুঁটকি প্রিয় আমাদের মতো।আমার কাছে শুটকির রেসিপি চাইছে।ভাবির একথা শুনে মাথাটা ভো ভো করে ওঠে।মাথা রীতিমত ঘুড়ছে।মনে হচ্ছে বেশিদিন বাচবো না।তারপর আর কিছু মনে নেই। কোন কিছুর বিকট গন্ধে চোখ মেলে তাকালাম।অনেক গুলো চিন্তিত মুখ।আম্মুর চোখে পানি।জনি ভাইয়ার মুখ শুকিয়ে আছে,আমার মাথায় পানি ঢালছে সে।আর ভাবি শুঁটকি হাতে আমার মাথার কাছে বসে আছে।
—আখিঁ,আমি তোমাকে ইলিশের শুটকি রান্না করে দেবো রাগ করো না বোন। এ মানুষটা কখনো পরিবর্তন হবে না।ভাবির এসব আজাইরা কথা শুনে বেশিক্ষন জ্ঞান ধরে রাখতে পারি নি।আমি আবারও অজ্ঞান হয়ে গেলাম। এর ঠিক দুই দিন পর চুপিচুপি ভাইয়ার কাছে গেলাম।
—-ভাইয়া হেল্প লাগবে?
—-ভাইয়া ফোন টিপতে টিপতে বললো,কি বলবি বল।
—ওই পরিবারও দেখছি শুটকি খাদক।কবে জানি আমাকেই কেটে কুটে খেয়ে ফেলে। ভাইয়া যেভাবেই হোক বিয়েটা ভাঙ।
—ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,ধুর পাগলি, কি বলিস।ওরা খুব ভালো। এখানেই তোর বিয়ে হবে।ভাইয়া চলে গেলো। মনে মনে ভাইয়াকে গালাগালি করলাম,বজ্জাত জনি,খবিশ, খাটাশ জনির বাচ্চা।আমারে সাহায্য করলো না। এর আগে ভাইয়া আমার কথামতো অনেক গুলো বিয়ে ভাঙছে।আর এখন সকলে মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।তাই বিয়ের দু’দিন আগেই বাসা থেকে পালাচ্ছি জামাই খুজতে।কিন্তু খুজেই পাচ্ছি না,কোথায় যে একটা জামাই পায়!