গত ৫বছর আগের কথা। অরুকে এবরশন করতে সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। অরু একজন দ্বীনদার মেয়ে ছিলো। দুজনই বসে রইলাম হাসপাতালে। আমিই ছিলাম অরুর একজন ভালো বন্ধু। বন্ধুত্বটা ভার্সিটির ভিতর সীমাবদ্ধ। অনেক সময় নোট নেওয়া এটা সেটা দরকার হলে অরু আমাকেই খুঁজতো। আমিই ছিলাম তার বন্ধু কাছের। দুজনই একে অপরকে অনেক সম্মান করে চলতাম। ভাই বোন যতটা আপন মনে করে একজনকে অপরজন ততটা। অরু সবসময়ই নামাজ পড়তো। পর্দা করেই চলতো।
আমরা দুজন একই ডিপার্টমেন্টর ছিলাম। সপ্তাহে দুদিন আমরা পথ শিশুদের পড়াতাম। একদিন বিকালে আমরা পড়িয়ে চললাম বাসায়। আমাদের দুজনের বাসা ছিলো উল্টো দিকে দুজনের। আমি চলে গেলাম বাসায়। সে দিন সন্ধ্যায় ধমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। বৈশাখ মাসের শেষের দিকে। তাই ঝড় বৃষ্টি হওয়ার কারণ বেশি। বাসায় গিয়ে আমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে। ছোট ভাই-বোনদের পড়াতে বসলাম। বাসায় ফিরে কয়েকবার অরুকে কল দেই বাসায় গিয়েছে কিনা। তার নাম্বারটা বন্ধ পেলাম। ভাবলাম চার্জ শেষ পরে কল দিবে। সেই রাতে আর অরুর সাথে যোগাযোগ হয়নি। রাত তখন ৭টার কাছাকাছি। অরু কল দিয়ে বলে রানা আমি রাস্তার পাশে পরে আছি। আমাকে বাঁচা!
আমার উপর দিয়ে কি হয়ে গেলো জানি না। ঝড় বৃষ্টির ভিতর বাসা থেকে বের হয়ে ছুটলাম। অরুদের বাসা যাওয়ার রাস্তায় দৌড়াচ্ছি। আমাকে বলে ছিলো রাস্তা পাশের তেঁতুল গাছের কাছে। আমি সেখানে গিয়ে যা দেখি তাতে মন চাইলো। চিৎকার করে কান্না করি। অরু প্রায় নগ্ন হয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি অরুরকে তুলে। কাপড় গুলো কুড়িয়ে পরিয়ে দিলাম। বোরকাটা সামনে দিয়ে মনে হয় এক হাত ছিঁড়ে গেছে। বোরকটা পরিয়ে দিলাম। ওড়না দিয়ে ভালো করে পেছিয়ে দিলাম। যাতে বাসায় কেউ কিছু না বুঝে। অরুকে বাসায় দিয়ে আসলাম। অরুর মা আমাকে বসতে বললো আমি কিছুই না বলে চলে আসি। সারারাত দু-চোঁখ এক করে ঘুমাতে পারি নাই। নরপশু গুলো কি করলো একটা মেয়েকে একা পেয়ে। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় মানুষ ছিলো না,এটাই সুযোগ করে নিলো পশু গুলো।
সেইদিনের টেনশনে আমার জ্বর হলো দুদিন হাসপাতালে ছিলাম। অরুও এসেছে হাসপাতালে দেখতে। অরুর মুখে কোন কাটাছিড়া যায়নি তাই হয়তো কেউ তার জীবনের খারাপ সময় গুলোর কথা জানলো না। আমি সুস্থ হয়ে অরুকে বলি চল আমরা মামলা করি। অরু বললো এটা করলে আমার ছবি বা ঘটনা পত্রিকায় আসবে। এতে আমার পরিবারের মান সম্মান চলে যাবে।
সেই ঘটনা থেকে ২-৩সপ্তাহ পর একদিন, ভার্সিটি শেষ হলে ক্যাম্পাসে বসে রইলাম। অরু চোঁখের পানি ছেড়ে বলে রানা একটা কথা বলবো। আমি তখন জানতে চাইলাম কথা তার। সে বলে তার নাকি গর্ভবতী মেয়ের সব নমনা হচ্ছে। আমি তাকে নিয়ে একটা হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করে জানতে পারলাম অরু মা হবে। বাসায় চলে গেলাম কি করবো ভেবে পেলাম না। ভাবলাম আমিই তাকে বিয়ে করবো বলি। তারপরের দিন ভার্সিটিতে গেলে। অরুকে নিয়ে একটা গাছের নিচে বসলাম। আর বললাম অরু আমি জানি তুমি ভালো মেয়ে। যা হলো তা হয়তো কোন পুরুষ নামক নরপশু দ্বারা এটা হলা। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। অরু বললো আমি চাই না এসব। সে বলে এবরশন করবে। তাই হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
ডাঃ সিরিনা এবরশন করবে তবে মেয়ের স্বামীর স্বাক্ষর লাগবে কিছু কাগজে। আমি স্বামী হয়ে সব কাগজে স্বাক্ষর করবো বললাম। অরু কি ভাবলো কে জানে। আমাকে বলে এই সন্তানের কোন দোষ নাই। আর আমি কোন খারাপ কাজ করি নাই যে আল্লাহ শাস্তি দেবে। নরপশুরা অপরাধ করছে। বাচ্চাটা অপরাধ করে নাই। আল্লাহ যা করে করুক। এইটা নিষ্পাপ বাচ্চা। আমি তখন বললাম এটাই আমি বলি তাই বিয়ে করে ফেলি। সে রাজি হয়নি। আমাকে হাসপাতালে রেখেই চলে আসে। একটু পর কল দিলাম নাম্বার বন্ধ। অনেকক্ষণ হাসপাতালে বসে থেকে বাসায় চলে যাই।
সে দিন কেমন জানি নিজেকে একা একা মনে হলো। তাই আরো কয়েকবার অরুকে কল দিলাম পেলাম না। তারপর আমার বাসা থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে অরুদের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি অরুর পরিবার উদাস মনে বসে আছে। আমাকে দেখে অরুর মা বলে, রানা অরু কোথায় জানো? আমি কিছু বলতে গেলে অরুর বোন আমাকে একটা চিরকুট দিলো তাতে লেখা ” আমি আমার পথে চলে গেলাম। আমাকে খুঁজো না। আর কারো কাছে কারণ জানতেও চেয়েও না কেউ ” আমি বুঝতে পেরেছি অরু এই তিনটি কথায় কি বুঝালো। আমিও সেদিন অরুর সাথে ঘটে যাওয়া কারণটা বলতে পারিনি। আমার চোঁখ বেয়ে পানি পরছে। একটা বন্ধু হারানোর কষ্ট এটা। অনেক কিছু ত্যাগ করে তাকে রাখতে চাইলাম সে থাকলো না। সেও আমাকে নিয়ে হয়তো অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৫বছর কেটে গেলো। এখন আমি চাকুরী করি, অরুর খুঁজ পাইনি। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট আসলাম আজকে দুদিন চাকুরীর কারনে বদলী হয়ে। আজকে সকালে একটা রেষ্টুরেন্টে বসে ছিলাম তখনই অরুর সাথে দেখা। ৫বছরে কিছুই বদলায় নি তার। আমাকে দেখে অনেক খুশী হলো। আমিও খুশী। অরুর সাথে একটা ৫বছরের বয়সের ছেলে দেখলাম। ছেলেটা পাঞ্জাবি পরা মনে হলো হাফেজী মাদ্রাসায় পড়ে। অরুর কাছে জানতে চাইলে বলে তার ছেলে। আর তার স্বামী একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। কি করে কি হলো জানতে খুব ইচ্ছে হলো।
অরু বলে এই ছেলেটা সে, যাকে নিয়ে আমি নাকি বিয়ে করতে চাইছি। যার জন্মের আগে আমি মারতে হাসপাতাল গেছিলাম তার সাথে। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। তখন চট্রগ্রাম থেকে সিলেট এসে একটা কিন্ডারগার্টেন চাকুরী নেয়। ছেলেটার জন্ম হয়। তারপরের সব কিছু তার স্বামী দেখে। সেও একসাথে চাকুরী করতো। সব সত্যিই বলে। দুজনে বিয়ে করে। বিয়ের পরই তার স্বামীর চাকুরী হয়ে যায় সরকারিভাবে মাদ্রাসায়।
আমার কথা জানতে চাইলে বললাম বিয়ে করিনি। চাকুরী করি বিয়ে করবো কিছুদিনের ভিতর। অরুর নাম্বার ঠিকানা নিয়ে, অরুর থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।বিয়ে করিনি এ জন্য আমি ৫বছর অরুকে খুঁজেছি। তার অবস্থা না জেনে বিয়ে করবো না। আল্লাহর রহমতে ভালোই আছে অরু। আমি অনেক খুশী। এবার বিয়ে করতে পারবো। অরুর বন্ধু হয়ে এখনো থাকবো, যেহেতু দুজনই এখন সিলেট আছি।