নির্ভাবনায় নির্জনালয়

নির্ভাবনায় নির্জনালয়

দুপুর বেলা খাওয়ার পর সুযোগ পেলেই তন্দ্রা বিলাস আমার অভ্যেস। সেটা আঁধাঘণ্টা হোক আর মিনিট বিশেকের। আর এই ঘুমে যদি কেউ ব্যাঘাত ঘটায় তবে তার চেয়ে বেয়াড়া আর কাউকে মনে হয় না। সেদিনও আমি ঘুমাচ্ছিলাম। কিন্তু হায়! আমার এ কী হল? আমার এই অর্ধঘুমের মধ্যেই ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠতে হল?
সালাম কালাম পর্ব শেষে আপনি কি আলিফ ভাইয়া বলছেন?

– জ্বী, আপনি আলিফ ভাইয়ের সাথেই কথা বলছেন।
– সরি ভাইয়া। আপনাকে বোধয় ডিস্টার্ব করলাম।
– বিরক্ত যা করার তা তো করেই ফেলেছেন। এখন দরকার টা কি বলুন?
– জ্বী, মানে আপনি আমাকে পড়ানোর কথা ছিল। আমরা তো আউট অফ চিটাগং ছিলাম তাই বলতে পারিনি। আপনি যদি আজকে সন্ধ্যায় আসতে পারতেন এজন্যে কল দিলাম। ঠিকানা নিয়ে চলে গেলাম সিডিএ তে।

যদিও আমার তেমন গুরুত্ব ছিল না তবুও গেলাম। কলিং বেল বাজাতেই বয়স তিরিশেকের এক আপাদমস্তক ভদ্র লোক দরজা খুলল। বুঝে নিলাম আমার নয়া ছাত্রীর ভাইগোছের কেউ হবেন।কিছুক্ষণ বাদেই আমার ছাত্রী চলে আসল। কথা হল। আলাপ হল কারিকুলামের ইতিবৃত্ত নিয়ে। এভাবেই চলল কয়েক মাস। বলে রাখা ভাল আমার ছাত্রীর বর্ণনা আমি দিব না। সে এখনও পর্যন্ত আমার মেয়ে ছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র। বাঙালী সংসারী মেয়ে বলতে যা বোঝায় আর কি। আমার পড়ানো কালীন সময়ে ওর সাথে জীবনমুখী অনেক আলাপ হতো। সে এদেশ কে নিয়ে কিভাবে? আমাদের অনুন্নতির ব্যাকওয়ার্ড গুলো কেমন? সে কি হতে চাই? তাতে দেশের মানুষের কি উপকার হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি না না কথা।

এই পড়ানোর সময়ে একটা বিষয় খেয়াল করলাম ওদের বাসার ফুটফরমাস খাটা মেয়েটির তৈরি নাস্তা ঐ প্রথম ভদ্রলোক যার নাম আনিচ সাহেব উনিই নিয়ে আসতেন। আর আমার ছাত্রী কোনদিন কামিজ আর কোন কোনদিন শাড়িও পড়তো। তাছাড়া আমার শাড়ি পড়ুয়া মেয়েদের ভালই লাগতো বলে আমিও তেমন কিছুই আঁচ করতাম না। তো তখন আমার ছাত্রী ভালভাবেই টেস্টে পাস করে ফেলল। এইচ এস সি পরীক্ষা দিবে সামনে এমন একটা দিন দেখলাম আনিচ সাহেব আর নাস্তা নিয়ে আসেন না। যিনি আসেন তিনি কাজের মহিলা। যদিও স্টুডেন্টদের পারিবারিক ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম তবুও একদিন জিজ্ঞাসা করে ফেললাম

– তোমার ভাইয়া কোথায়?
– আমার ভাইরা তো সীতাকুণ্ড থাকেন।
– ঐ যে আমার সাথে তোমার ব্যাপারে প্রায়ই যার কথা হয় উনাকে তো দেখছি না।
– ভাইয়া উনি তো অফিসে। উনি আমার ভাইয়া নন…
– লজ্জায় আটখানা মেয়ে টা আরও লজ্জা পেয়ে কি রকম অমায়িক হয়ে গেল। এদিকে আমার ও মাথায় হাত দেখে বলল-
– ভাইয়া, আমি যে শাড়ি পড়তাম, চুড়ি হাতে, নাকে নাকফুল এগুলো খেয়াল করেন নি?

আমি আর উত্তর না পেয়ে কথা আগালাম না।। এরপর থেকে মেয়েটার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে গিয়েছিল আমার। পাশা পাশি তার স্বামী আনিচ সাহেবের প্রতিও। বাঙালী মেয়ে রা বিয়ের পরে সংসার করবে, ঘর গুছাবে, বাসন মাজবে আর কৃষক পরিবারে বিয়ে হলে গরুর গোয়াল পরিষ্কার করবে এটাই যেখানে স্বাভাবিক মনে করা হয় সেখানে এই লোকটি তার অর্ধাঙ্গীর পড়ার ব্যাপারে কতটা আগ্রহী!

আর এই যে মেয়েটা, যে কেবল তার কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখবে সে? কী সুন্দর করে সংসার টাকে আগলে রাখছে! ভাবা যায়? আবার পড়াশুনায় কোনদিন অমনোযোগী হতে দেখিনি। আর কথা বার্তায় এতটা মার্জিত আচরণ পাওয়া ভার। এভাবেই একদিন তার পরীক্ষা শেষ হলো। বলেছিল একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। নির্জনালয়ে গত অর্থমাস ধরে বন্দী আছি। সবদেশে সবনাগরিকেরই একই হাল। কেউ কেউ ঘরে বসে প্রোডাকটিভ কাজও করছেন দেখলাম। আমি সব সময়ই আনপ্রোডাক্টিভ। গুগল ড্রাইভ, ফেইস বুকের স্থিরচিত্র গুলো আমার স্মৃতিকে রোমন্থন করে। আমি অত্যন্ত স্মৃতি কাতর। বই, পত্রিকা পড়া আর বুয়ার রান্না খেতেও আর এখন ভাল লাগছে না। মানুষের জীবনে সময়ের মুল্য আর স্বর্ণের মূল্য একই।

কেউ আপনাকে পাঁচশত টাকা দিতে পারবে কিন্তু তার সময় থেকে একটু সময় বের করে আপনাকে দিতে অপারগতা প্রকাশ করবে অক্লেশে। এই দেখুন না, প্রতিদিন ক্লাস, টিউশন, মিটিং ফিটিং এসব শেষ করে আমাকে রাত সাড়ে এগারোটায় বাসায় আসতে হত। প্রায়ই কেয়ার টেকার গেট আটকে দিত। কিন্তু এখন! এখন তো একদম বেকার বনে গেছি। কাছের – অকাছের দেশ -বিদেশ থেকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন অনেকেই। এই লেখাটা যখন লিখছি তার একটু আগে। আমি বহুতল এই ভবনের বারান্দায় বসে যখন শহরের প্রতিটা ছাদে, বিল্ডিংয়ের বারান্দায় কি হচ্ছে দেখছি আর দক্ষিণের বাতাসে বিভোর তখন ফোন আসল।

– ভাইয়া কেমন আছেন?
– যেমন সুস্থতা তোমরা কামনা করেছো। তোমরা?
– এইতো বেশ আছি।

জানতে পারলাম মেয়েটা এখন গ্রাজুয়েশন পর্বের মাঝামাঝি। একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে ওদের। স্বামী সংসার নিয়ে ভালই আছে বুঝা গেল। বিপত্তি ঘটল তখনই, যখন বলল

– ভাইয়া আপু কেমন আছে?
– আমি মৃদু হেসে(এটা আমার অভ্যাস) বললাম কোন আপু?
– ভাইয়া আমি সবই খেয়াল করতাম।
– কী খেয়াল করতে? আর তোমার আপুই বা এলো কোথা থেকে?
– আপনি আমাকে হিসাব বিজ্ঞানেই পাকা ভাবেন ভাইয়া। কিন্তু আমি প্রেম বিজ্ঞানেও দক্ষ।

আমাকে ম্যাথ করতে দিয়ে আপনি যার ছবি ফোন স্ক্রীনে প্রায়ই দেখতেন সেই আপুটার কথায় বলেছি। এরপর আবার সেই হালকা অনুভূতিজাত কথা বার্তা। যা আমাকে আমার হতে দেয় না। আমি আবার হারিয়ে যায় অপেক্ষার মাঝে। আমাকে টেনে রাখে, পিছিয়ে দেয় হাজার মাইল।

এই রাফিকা মেয়েগুলো সংসারেরই উন্নতি করবে না, এরা নির্ভেজাল কতগুলো মানুষও তৈরি করবে। এরা বোধয় প্রেমিকা হিসেবেও অনেক এগিয়ে থাকবে কাল থেকে কালান্তরে। অনেকেই তো নিজের সুখটা অন্যের হাতে তুলে দেয়। অপর প্রান্তের সুখে নিজে সুখ খুঁজে পায়। আবার অনেককেই দেখেছি সুখ খুজে নিতে এই ডাল থেকে ও ডালে, এই গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে বেড়াতে। উড়বেই তো। উড়ে বেড়ানোটাই পাখির অভ্যাস। রবীন্দ্রনাথ তো একবার লিখছেনও- ‘ওরা সুখের লাগি প্রেম চাহে, প্রেম মেলে না। শুধু সুখ চলে যায়।’ আকাশে এখন ভয়ংকর নীরবতা। আচ্ছা করোনা কি একাকীত্বের চেয়েও বিষাদের?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত