ভয়ংকর আসামী

ভয়ংকর আসামী

এই গল্পটার শুরু শুক্রবার রাতে। রাশেদের বাসায় কেউ ছিলো না। বাচ্চাদের নিয়ে বউ গেছে বাপের বাড়ি বেড়াতে। রাশেদ একা একা ভাবলো চা বানিয়ে খাবে। রান্নাঘরে গিয়ে শুরুতে চাপাতা খুজে পেল না কোনোভাবেই। দোকান থেকে কিনে এনে দেখে গ্যাস নেই। বিরক্ত হয়ে ছাদে গিয়ে পত্রিকায় আগুন ধরিয়ে চা বানালো। ঘরে এসে কোথাও চিনি খুজে পেল না।

চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর চিনি পেল। আবার ছাদে গিয়ে গরম করে এনে চিনি মিশিয়ে চুমুক দিয়ে দেখে ওটা লবন ছিলো। প্রচন্ড রাগে চায়ের কাপ আছাড়া দিয়ে ভেঙে ফেললো রাশেদ। অন্য কিছু খাওয়ার আশায় ফ্রিজ খুলতে গিয়ে দেখে তালা দেয়া। বউএর কাছে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘চাবি কোথায়?’ বউ যে কয় জায়গার কথা বললো তার কোথাও চাবি পেল না রাশেদ। টিভি দেখতে গিয়ে দেখে রিমোটের ব্যাটারি নষ্ট। একটা চ্যানেল চালু হয়ে আছে টিভিতে। দুই বিরক্তিকর ছেলেমেয়ে টাকে চুল গজানোর ঔষধ বিক্রি করার চেষ্টা করছে। দোকান থেকে রিমোটের ব্যাটারি কিনে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করার সাথে সাথেই কারেন্ট চলে গেল।

রাশেদ চার্জার লাইট জ্বালাতে গিয়ে দেখে চার্জ করে রাখা হয়নাই জিনিসটা। সে অন্ধকারে বসে একা একা রাগে ফুসতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কারেন্ট আসলো এবং রাশেদ কোথাও টিভির রিমোট খুজে পেল না। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে সোফার ওপরেই রাখছিলো একটু আগে। সিগারেটের তৃষ্ণা পেল কিন্তু তখন কোথাও দিয়াশলাই নাই। চা বানানোর জন্য ছাদে রেখে আসছে মেবি। ছাদে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতে গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে লক হয়ে গেছে৷ আধাঘন্টা খুজেও চাবি না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে রাশেদ এক গ্লাস পানি খেল। অর্ধেক পানি খাওয়ার পর খেয়াল হলো গ্লাসের মধ্যে মরা একটা পোকা ভেসে আছে।

সে আর নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। রাগে কাপতে কাপতে পানির গ্লাসটা ফেলে দিয়ে বিছানার নীচ থেকে হকিস্টিক এনে সর্বশক্তি দিয়ে ঘরের আসবাবপত্র ভেঙে গুড়োগুড়ো করে ফেললো। টিভি, ফ্রিজ, টেবিল, চেয়ার, বাসন, চুলা, আলমারি, শোকেস কিছুই রেহাই পেল না। পরদিন সকালে রাশেদের রিয়েলাইজ হলো সর্বনাশ হয়ে গেছে। তার সব শেষ। সে নিজ হাতে নিজের সবকিছু শেষ করে ফেলেছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে ট্রাক্টর চালিয়ে কেউ আসবাবপত্র চষে রেখে দিয়েছে। রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেল রাশেদের। সে ভাবলো এই কাজ যে করেছে তার কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। সে যেই হোক। রাশেদ নিজে হলেও কোনো মাফ নাই। তার এতোবড় সর্বনাশের শাস্তি সে যেভাবেই হোক দিয়েই ছাড়বে।

ঘরে টাকাপয়সা যা ছিলো সব পকেটে নিয়ে বের হলো রাশেদ। পুলিশ স্টেশনে গিয়ে মামলা করে দিলো। ওসি সাহেব আসামীর নাম জিজ্ঞেস করায় রাশেদ বললো, ‘লিখেন, রাশেদুল হক, পিতা আফজাল হক, দৌলতপুর, খুলনা। ডাকাতি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হত্যাচেষ্টা সহ যত কেস আসে সব দিবেন। টাকাপয়সা ব্যাপার না। কিন্তু আসামী যেন কোনোভাবে বাঁচতে না পারে। আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা, কেস দেয়ার আগে কঠিন মাইর দিবেন। হাত পা ভেঙে দিতে পারলে সবচাইতে ভালো হয়। শালা লোক চিনেনাই। আমার ঘরে ভাঙচুর করে।’ ওসি সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা দেখছি, কি করা যায়।’ রাশেদ পকেট থেকে বিশ হাজার টাকা বের করে ওসির হাতে দিয়ে বললো, ‘দেখতেছি না, এক্ষুনি ফোর্স পাঠান। বিকালের মধ্যে আমি ঐ হারামজাদার হাড্ডি মাংস আলাদা দেখতে চাই।’

টাকা পেয়ে ওসি সাহেব গদগদ হয়ে গেলেন খুশিতে। বললেন, ‘আপনার শত্রু মানে আমারো শত্রু। দাড়ান দেখাইতেছি পুলিশ কি জিনিস। আপনি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দেন। আমি ঐ লোককে হাসপাতালে পাঠায়ে আপনাকে খবর দিব। এসআই মতিন থানায় আসার সাথে সাথে ফোর্স পাঠাচ্ছি।’ রাশেদ বাসায় আসার চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলো। এসআই মতিন এসেছে ধরতে। জিজ্ঞেস করলো, ‘রাশেদুল হক, পিতা আফজাল হক, কি আপনি?’ রাশেদ হ্যা বলার সাথে সাথে এসআই মতিন প্রচন্ড এক থাপ্পড় দিয়ে রাশেদকে নীচে ফেলে দিলো। একই সাথে একের পর এক লাথি। দশমিনিট প্রচন্ড মার খেয়ে রাশেদের মনে হলো নিজের নামে কেস করার ব্যাপারটা খুব বাজে ডিসিশন হয়েছে। কেস তুলে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু সব শুনে ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনার সমস্যা কি ভাই? আপনি কি পাগল? নিজের নামে কেস কে করে?’

– আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে বাঁচান।
– কিন্তু কেস লেখা হয়ে গেছে। এখন এভাবে তুলে ফেলা সম্ভব না৷ এটা কোর্টে উঠবে। কোর্ট ডিসিশন নিবে আপনি অপরাধী কি না।

রাশেদ কেস বন্ধ করার জন্য দিলো আরো ত্রিশ হাজার। ওসি সাহেব আবারো গদগদ গলায় বললেন, ‘আপনি বাসায় যান, আর কোনো সমস্যা নেই।’ এদিকে বাসায় এসে ঘরের অবস্থা দেখে পুনরায় রাশেদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে কি করবে ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া পেল। কয়েকজন সাংবাদিক ডেকে এনে প্রেস ক্লাবে গিয়ে এই মর্মে সংবাদ সম্মেলন করে ফেললো যে, ‘ওসি আশরাফ টাকা নিয়ে তার কেস বন্ধ করে দিয়েছে। সে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চায়। সে দেশের নিরীহ একজন নাগরিক, তার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা, সে কারো সাতে পাচে নেই, অথচ তার বাসাতেই ভাঙচুর? কিন্তু পুলিশ টাকা খেয়ে আসামীকে ছেড়ে দিল। এই কি দেশের বিচার ব্যবস্থা? এভাবে চললে দেশের জনগন তাদের সাথে অবিচারের জন্য কার কাছে যাবে।’এহেন ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচন্ড ভাইরাল হয়ে যাওয়াতে রাত দশটার মধ্যে রাশেদকে আবার বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল পুলিশ। ওসি আশরাফকে সাময়িক সাসপেন্ড করা হলো।

ভারপ্রাপ্ত ওসি সাহেব বললেন, ‘উপর থেকে চাপ আসছে। কেস আবার ওপেন করতে হবে। বাকি ফায়সালা কোর্টে।’
সারারাত থানায় থেকে মশার কামড় খেয়ে রাশেদের মনে হলো সংবাদ সম্মেলন করা ঠিক হয়নাই। যথেষ্ট ভুল হইছে। কিন্তু এবার ওসি সাহেব টাকা নিয়েও কেস তুলতে রাজি হলেন না। বললেন, ‘বিষয়টা মিডিয়াতে আসার কারণে এখন আর আমার হাতে নাই। আপনাকে ছেড়ে দিলে আগের ওসির মত আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।’ রাশেদ আমতা আমতা করে বললো, ‘কিন্তু স্যার কেস তো আমি নিজেই করেছি। আমি তুলতে পারবো না?’ ওসি সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললো, ‘না, পারবেন না। কারণ আসামীও তো আপনি। আপনি যে ফাইজলামি শুরু করেছেন এটা আপনার হাত থেকে বের হয়ে গেছে। এমনকি আমারও কিছু করার নেই।’

– তাহলে এখন আমি কি করব?

ভারপ্রাপ্ত ওসি সাহেব উদাস গলায় বললেন, ‘জানি না।’ পরদিন সকালে রাশেদকে জেলখানায় চালান করে দেয়া হলো। নিজের বাসা নিজে ভেঙে নিজে কেস করে সেই কেসে নিজেই জেলে যাওয়া পৃথিবীর একমাত্র মানুষ বোধহয় রাশেদ। রাশেদের বউ খবর পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে চলে আসলো। জেললখানায় এসে দেখা করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ওগো, আমাদের ঘর কে ভেঙেছে?’ রাশেদ শান্ত গলায় বললো, ‘আমিই ভাঙছি।’

– মানে কি? তোমার নামে কেস করলো কে তাহলে?
– আমি নিজেই করেছি।

রাশেদের বউ কাঁদতেও ভুলে গেল। কি বলবে বুঝছে না। ভাষা হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা খুব সম্ভবত এটাকেই বলে। সপ্তাহখানেক বাদে কেস কোর্টে উঠলো। রাশেদের বউ তার পক্ষে উকিল ঠিক করেছে। অন্যদিকে রাশেদের আগের পক্ষে মানে সে কেস করেছে সেই পক্ষে উকিল দিয়েছে সরকার। রাশেদের উকিল বললো, ‘আমার ক্লায়েন্ট সম্পূর্ণ নির্দোষ। সে কোনো ভাঙচুর করেনি। তার ঘরে একটা পানির গ্লাস ছাড়া আর কিছু ভাঙা নেই। সব সুন্দরভাবে সাজানো।’ এটা শুনে রাশেদ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। চিৎকার দিয়ে বললো, ‘মিথ্যা কথা। আমি নিজ হাতে টিভি ফ্রিজ ওভেন সোফা বেসিন সব ভেঙেছি। উকিল মিথ্যা বলছে।’ জজ সাহেব প্রশ্ন করলেন, কার বাসা ভেঙেছো? রাশেদ বললো, ‘আমার নিজের বাসা।’

– কেস কে করেছে?
– আমি নিজেই।
– আসামী কে?
– আমিই।
– পুলিশকে টাকা দিয়েছে কে?
– আমি দিছি।
– পুলিশ টাকা খেয়ে আসামী ছেড়েছে এই মর্মে সংবাদ সম্মেলন করেছে কে?
– সেটাও আমিই।

দেখা গেল জজ সাহেব দুই গ্লাস পানি খেলেন। আরদালিকে ডেকে বললেন, ‘আমার মাথা ঘুরছে।’ তিনি মামলার শোনানির ডেট দিলেন একসপ্তাহ পর। একসপ্তাহ পর কোর্টে হাজিরা দিতে হবে মর্মে রাশেদকে সাময়িক জামিনও দিলেন। তারপর নিজের রুমে গিয়ে দ্রুত প্রেশার আর মাথাব্যথার ঔষধ খেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। রাশেদ বের হয়েই আরেক উকিল ঠিক করলো বেশি টাকা দিয়ে। যে কোর্টে প্রমাণ করবে রাশেদই ভেঙেছে সব। সরকারি উকিল দিয়ে কাজ হবেনা।

রাশেদের বউ এসে আবার কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তুমি যে পাগল হয়ে গেছ, এটা তুমি জানো?’ রাশেদ রাগান্বিত গলায় বললো, ‘আমি কিছু জানিনা, কিন্তু আমি এর শেষ দেখেই ছাড়বো।’ কয়েকদিন পর অবশ্য রাশেদের মনে হলো কাজটা ঠিক হয়নাই। সুতরাং সে একসপ্তাহ পর কোর্টে হাজিরা না দিয়ে পালায়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা চলে গেল। রাশেদের নামে ওয়ারেন্ট বের হলো। পুলিশ খুজছে তাকে। গ্রামের বাসায় রাতে খাওয়াদাওয়ার পর কেউ একজন টিভি ছাড়ার সাথে সাথে রাশেদের মনে পড়লো, তার নিজেরও এরকম একটা টিভি ছিলো। সে তখনই পুলিশকে ফোন দিয়ে বললো, ‘আপনাদের আসামী কুমিল্লার চরপাড়া গ্রামে রিয়াজ মুন্সির বাড়িতে লুকিয়ে আছে।’

কিছুক্ষণ পর পুলিশ বাসা ঘিরে ফেললে রাশেদ পেছনের দরজা দিয়ে দৌড় দিলো। পিছু নিলো পুলিশ। রাশেদ দোড়ে নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে আবার ফোন দিয়ে বললো, ‘ডানদিকে কি করেন। আসামী বায়ে ধানক্ষেতের ভেতর লুকানো।’
পুলিশ ধানক্ষেতে আসা মাত্রই রাশেদ দৌড়ে উত্তরপাড়ার বিলে নেমে গিয়ে ফোন দিয়ে বললো, ধানক্ষেতে না খুজে উত্তরপাড়া বিলে আসেন। বিলে পুলিশ আসলে আবার দৌড় দিলো রাশেদ। প্রচন্ড ক্লান্ত সে, পা আর চলেনা। তারপরও পালাতে সক্ষম হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না৷ আরো ঘন্টাদুই পরে পাশের গ্রাম থেকে রাশেদের ফোন পেয়ে পুলিশ গিয়ে রাশেদকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল।

কনস্টেবল ওসিকে বললো, ‘স্যার, আসামী বারবার পালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু কেউ একজন ভালো লোক আমাদের ফোন করে জানাচ্ছিলো কোথায় লুকাচ্ছে সে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন স্যার, সেই ফোন নাম্বারওয়ালা মোবাইল আসামীর কাছেই পাওয়া গেছে।’ওসি সাহেব থমথমে গলায় বললেন, ‘ফোন অন্য কেউ করেনাই, ঐ হারামজাদা আসামী নিজেই করেছে।’ কনস্টেবল অবাক হয়ে বললো, ‘আপনি কিভাবে জানলেন?’ ওসি আশরাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ‘ঐ হারামীকে আমি চিনতে পেরেছি। ওর জন্যই আমাকে খুলনা থেকে সাসপেন্ড করে পরে কুমিল্লা পাঠিয়ে দিয়েছে। ঐ লোক অনেক ভয়ংকর। যত দ্রুত সম্ভব ওকে খুলনা পাঠানোর ব্যবস্থা করো।’

কিছুক্ষণ পর হঠ্যাৎ থানায় হইচই শুরু হলো। ওসি সাহেব খবর পেলেন আসামী কন্সটেবলের মাথায় বাড়ি দিয়ে পালিয়ে গেছে। ওসি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘ঐ লোক একটা পাগল। সে পালাইছে ভালো হইছে আর খোজাখুজি করার কোনো দরকার নাই। উপর থেকে ফোন আসলে বলবা, খোজা হয়েছে কিন্তু পাওয়া যায়নি।’ তবে এটার অবশ্য দরকার পড়লো না। সকালে রাশেদ নিজে এসে ধরা দিলো। এবং বললো, ‘পুলিশ কাস্টডি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সে নিজেকে অপরাধী মনে করছে। সে নিজের নামে ডিউটিরত পুলিশকে আঘাত ও জেল পালানোর দায়ে মামলা করতে ইচ্ছুক।’

ওসি সাহেব বললেন, ‘প্লিজ, পাগলামী করবেন না। অনেক হইছে। আপনার কোনো মামলা আর নিচ্ছিনা আমরা।’ ততদিনে অদ্ভুত এই রাশেদ ভার্সেস রাশেদ কেস সারাদেশে ভাইরাল। মিডিয়ার চোখ রাশেদের ওপর। খুলনা এসে কোর্টে আনার পর সাংবাদিকের সামনে আবারো রাশেদ বললো, ‘কুমিল্লার ওসি আশরাফ তার কেস নিতে অসম্মতি জানিয়েছে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে তার কি কেস করার অধিকারও নেই?’ ওসি আশরাফকে আবারো সাময়িক বহিস্কার করা হলো।

এদিকে কোর্টে বিবাদী পক্ষের রাশেদের উকিলের চাইতে বাদী পক্ষের রাশেদের উকিল ভালো ছিলো। সুতরাং ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি ও হত্যাচেষ্টা মামলায় রাশেদের তিন বছরের জেল হলো। রাশেদ বিবাদী পক্ষের উকিলকে ডেকে বললো, ‘হাইকোর্টে আপিল করো। আমি জামিন চাই। জেল খাটতে পারবো না। নিজের বাসা ভাঙার আবার শাস্তি কি।’ বাদী পক্ষের উকিল বললো, ‘আমি কি করবো স্যার?’ রাশেদ শান্ত গলায় বললো, ‘এতোকিছু ভাঙচুরে মাত্র তিন বছরের জেল? তুমি শাস্তি অন্তত দশ বছর করতে হবে এই মর্মে আপিল করবা।’

কোনো আপিলেই কাজ হলো না। জেলখানায় তিন মাস কেটে গেলো। রাশেদ জেল পালানোর চেষ্টা শুরু করলো। একটা অব্যবহৃত বাথরুমের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ খুড়তে লাগলো। দুই মাসের নিয়মিত চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রমের পর সুড়ঙ্গ শেষ হলো। একদিন রাতে সবাই ঘুমানোর পর পালিয়ে গেল রাশেদ। জেল পালানো খুব বড় একটা ব্যাপার। তোলপাড় শুরু হলো সমস্ত দেশে। পুলিশরা খেয়ে না খেয়ে রাশেদকে ধরার জন্য একের পর এক চিরুনি অভিজান চালানো শুরু করলো। যে করেই হোক, ধরতে হবে। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল আইনশৃঙ্খলা বিভাগের।

ওসি আশরাফকে ডিমোশন দেয়া হয়েছে পরপর দুইবার সাসপেন্ডের পর। আজকাল নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আর কোনো আশা নেই তার। নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করেন। আগের মত দাপটও নেই। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না পারতপক্ষে। অফিস করে সকাল সকাল বাসায় এসে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যান। সেদিনও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় ফোন বাজলো। আননোন নাম্বার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলা হলো, ‘স্যার, আপনার জেল পালানো আসামী রাশেদ এই মুহুর্তে শহরের ফুলতলা এলাকার আনসারিয়া হাফেজি মাদ্রাসায় আত্মগোপনে আছে। এখনি ফোর্স পাঠালে গ্রেফতার করা সম্ভব। দ্রুত আসেন স্যার৷ রাশেদের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার। কত বড় সাহস জেল পালায়। এবার যেন যাবজ্জীবন হয় এটা দেখবেন।’ ওসি আশরাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘আপনি কে বলছেন?’

– স্যার আমি রাশেদ।

পরদিন ভোরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে উঠে ওসি সাহেবের স্ত্রী ড্রয়িংরুমের ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত ওসির লাশ আবিস্কার করলেন। টেবিলের ওপর একটা চিরকুট। তাতে লেখা, ‘কোনো কারণ নেই, আমি এমনিই আর এই জীবন রাখতে চাচ্ছি না। এই বালের জীবন রেখে কি লাভ!’

রাশেদ তখন সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই শহরের দেয়ালগুলোতে পোস্টার মেরে বেড়াচ্ছিলো। তার হাতে ছিলো দুইধরনের পোস্টার। একটাতে লেখা- ‘একজন নিরীহ মানুষকে নিজের ঘরে ভাঙচুর করার দায়ে জেলে নিয়ে হয়রানি করছে পুলিশ৷ তার ছোট ছোট দুটো বাচ্চাকে দেখার কেউ নেই। যে আইন সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার জন্য ব্যবহৃত হয় সেই আইন আমরা চাইনা। অবিলম্বে রাশেদের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হোক।’ আরেক পোস্টারে লেখা ছিলো- ‘ভয়ংকর সন্ত্রাসী, জেলপলাতক আসামী রাশেদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই!’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত