আমার কিপ্টে মা

আমার কিপ্টে মা

আমার শাশুড়ি সেই কখন থেকে তরকারিওয়ালার সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছেন। আমি দুতলা থেকে সেটা দেখছি। ৫ টাকা নিয়ে তুমুল ঝগড়া। অবশেষে আমার শাশুড়ি মা বিজয়ী বেশে ফিরলেন। যেন এক রাজ্য জয় করে এসেছেন। ঘরের সব বাজার কিংবা খরচ আমার শাশুড়ির হাত দিয়ে ই হয়। টাকা উনার কাছে ই থাকে এমন না যে উনার কাছে থাকে না। তারপরও এরকম ছোট ছোট বিষয় নিয়ে উনার এত চিল্লানি আমার তেমন একটা ভালো লাগে না।

মাঝে মাঝে যখন বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হই। তখন ই ননদ’কে নিয়ে বেড়িয়ে পরি ফুচকা খেতে বিকেলে। কিন্তু তাও একা না আমার শাশুড়ি সঙ্গে থাকেন। সেখানেও একই সমস্যা ফুচকার দাম নিয়ে। এক প্লেট ৩৫ টাকা বললে উনি ফুচকাওয়ালার গুষ্টি উদ্ধার করে ৩০ দিয়ে ঠিক ই কিনে দেন। আমি তখনো অসহায় দৃষ্টি নিয়ে শাশুড়ি কে দেখতে থাকি। একই সমস্যা শপিং এ গেলে। জুয়েলারি কিংবা বিভিন্ন অর্নামেন্টে কিভাবে কম দামে কিনে আনা যায় তা আমার শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে শিখতে ই হবে। দোকনদাররা শেষমেস আম্মাজান বলে হার মানতে বাধ্য। তবুও কেউ উনাকে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। কারণ আমি খেয়াল করেছি প্রত্যকটা কথায় ই উনার যুক্তি থাকে।

হঠাৎ সকালে জোরে জোরে কথা বলার আওয়াজ পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে ই দেখি রান্নাঘর ভর্তি বাজার। মাছ মাংস সবজি ডিম যা যা দরকার সব তবে পরিমানে অনেক বেশি। আমার স্বামী দেশের বাইরে থাকার কারণে ঘরের বাজার একসাথে ই করে ফেলেন মা। রোজ রোজ বাজার করার মত কেউ নেই। তবে মাত্র ১০ দিন হল সবকিছু আনা হয়েছে তারপর আবার.. জিজ্ঞেস করলাম কেউ আসছেন কিনা। না কোনো আত্মীয় আসছেন না। কিন্তু এখনি রান্নায় লেগে যেতে হবে। কেউ আসবে না আবার এত সব রান্না করা হবে কিছু ই বুঝলাম না যেন। মায়ের কথা মোতাবেক সবকিছু রান্না হল। এতএত রান্নায় আমি হাপিয়ে উঠেছিলাম মনে হয়।

তখনি আমার শাশুড়ি বললেন, গোসল করে একটা ভালো শাড়ি পড়ে আসতে। মাঝে মাঝে আমার বাবার বাড়ি থেকে কেউ আসলে এমন করেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার ছোট বোনটার কাছে ফোন দিলান কথাবার্তায় তো কিছু বুঝা যাবে আমি এসব আগ বাড়িয়ে কিছু বলব না। নাহ, এমন কিছু না। আর কিছু না ভেবে গোসল সেরে শাড়ি পড়ে নিলাম। তখনি মা ডাক দিলেন।রুম থেকে বাইরে গিয়ে তো আমি অবাক। এক প্রকার হা করে দাড়িয়ে আছি। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সী মাঝবয়সী সহ সব এদের কে একটু একটু চিনি। আমার শাশুড়ি আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আবার। আর বললেন এরা ই আমাদের মেহমান। কেন জানি খুব ভালো লাগছিল।

এসব মুখ গুলো দেখতে। যদিও এদের তেমন ভালো জামা কাপড় নেই তারপরও যে যার মত একটু ভালো কাপড় পড়ে দাওয়াতে এসেছে। একটা ছোট্ট ছেলে আমার আচল ধরে টানতে লাগল। পিছনে তাকাতে ই হাত দিয়ে ইশারা দিল। আমি একটু নিচু হতে ই বলল ওর প্যান্টের বোতাম টা ভেঙে পড়ে গেছে কিছু একটা দিয়ে লাগিয়ে দিতে। তখন কেমন জানি মায়া হল এদের প্রতি। জানতে পারলাম বাড়িতে গিয়ে বদলে অন্য প্যান্ট পড়ে আসার মত আর নেই। ওটা নাকি ওর মা এনেছে ওর মা যার বাসায় কাজ করে তারা দিয়েছে। আর ভালো কিছু নেই। এসব কথা শুনে চোখগুলো কেন জানি ঝাপসা হয়ে আসল। ইচ্ছে করছিল যদি পারতাম তাহলে এদের সবাইকে নতুন কাপড় কিনে দিতাম।

তখনি মা ডাকলেন। তাদের খাওয়ানো হল। পেট ভরে খাওয়ানো হল। আমি তখন একদৃষ্টি দিয়ে দেখছিল ঐ ৫ টাকা নিয়ে কার্পণ্য করা মহিলাকে। এদের খাওয়াতে বা দিতে কোনো কার্পণ্যতা নেই আজ। মনে হচ্ছিল যেন সবটুকু উজার করে দিতে পারলে ই বরং খুশি। খাওয়া শেষে এদের প্রত্যকের সাথে আরো খাবার দেওয়া হল তাদের বাবা মার জন্য। সবাইকে তো একসাথে ছোট্ট বাসায় খাওয়ানো সম্ভব না। আনমনে হাসছিলাম আবার চোখ দিয়ে পানিও পড়ছিল যেন। তখনি মা আমার হাত ধরে বললেন, এদেরকে আল্লাহ তা’লা হয়ত দুবলো ভালো ভাবে খেয়ে বেঁচে থাকার অবস্থা দেননি। অনেকে এই বয়সেও অনেক কিছু করে শুধু বেঁচে থাকার জন্য।

কিন্তু আল্লাহ আমাদের তো দিয়েছেন আর আমাদের এসবে একটু হলেও এদের হক আছে। এই হক থেকে এদের থেকে কেঁড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। নিলে এখানে যেমন আটকা থাকব পরকালেও আটকা থাকব ঐ উপরওয়ালার কাছে। আর যখন সংসারের হাল ধরবে তখন বুঝবে টাকা ঠিক ই আসে কিন্তু সব চাহিদা মিটিয়ে টাকা বাঁচিয়ে এসব করতে হিমশিম খেতে হয়। তুমি হয়ত আমাকে কিপ্টে শাশুড়ি মনে কর।আমি তখনি উনাকে জড়িয়ে ধরে সালাম করে কি যেনবুঝতে চাইছিলাম শুধু বুঝতে পারছিলাম এমন চিন্তার মানুষের বুকে মাথা দিয়ে কতটা শান্তি অনুভব করছিলাম তা বুঝাতে পারব না । মা শুধু বলছিলেন,” আর সবার মত তোর শাশুড়িকে কিপ্টে মনে করিস না মা। ”

কথাগুলো শুনে চোখে পানি আসছিল। আরো জোরেজড়িয়ে ধরলাম আমার এই কিপ্টে মা’কে। বলতে ইচ্ছা করছিল সবার সাথে আরো বেশি বেশি ঝগড়া করবেন ৫/১০ টাকার জন্য। আপনি না পারলে আমাকে ডাকবেন আমিও ঝগড়া করব আমার মায়ের সাথে। বেশ কয়দিন পর আজ সবাই জড়ো হয়ে আছে আমাদের বাসার সামনে। আমার কিপ্টে মাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে যেন আমার ভিতরটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছিল। যদি একটি বার কথা বলতেন একটি বার আর কারো সাথে ঝগড়া করতেন। কিন্তু না সেই চুপচাপ নির্মল পবিত্র চেহারা।

আমি কান্না করছিলাম আর দেখছিলাম মায়ের খাটিয়া বহনের জন্য পাড়ার ঐ ছেলে গুলো কেমন কাড়াকাড়ি করছিল। একপাশে আমার স্বামী দেবর আছে অন্যপাশে কে কাঁধে নিবে উনার লাশ। কেউ বলছে আমি আমার বড়মা কে নিয়ে যাব। কেউ বলছে আমি আমার মা কে কাঁধে নিব। এসব কাড়াকাড়ির মধ্যেও ওরা অঝোর ধারায় কাঁদছিল আর একজন আরেকজনের সাথে তর্ক করছিল। তখন বুঝতে পারছিলাম মরে গিয়েও মানুষের মাঝে বেঁচে থাকাটা কতটা সম্মানের আর শ্রদ্ধার। যা আমার ঐ কিপ্টে মা করতে পেরেছিলেন। খুব ইচ্ছে করছিল আমার মায়ের ঝগড়া গুলো আবার দেখতে…!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত