আমার বিয়েটা ছিল মূলত প্রেমের। বাবা-মা’র অমতে নিজের জীবনসঙ্গী নিজে বাছাই করেছিলাম। ভুল করেছিলাম নাকি ঠিক করেছিলাম জানতাম না। বয়স যে খুব অল্প ছিল, মাত্র পনেরো বছর। কিশোরী এই মনটা তখন লাটাই ছাড়া ঘুড়ি ছিল। বাস্তব-অবাস্তব বুঝতামনা। বুঝতাম শুধু আবেগ। পালিয়ে বিয়ে করি। রুপমের সাথে আমার প্রেমটা ছিল সিনেমার মতো। আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। ছোটবেলা থেকে গার্লস স্কুলে পড়ার দরুন ছেলে সম্পর্কে বিশেষ কৌতুহল মনের গোপন কুঠুরে বসবাস করতো সব সময়। রুপমের আমার জন্য অপেক্ষা, বারবার ফিরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে খুব ভাবাত। কখন যে ভাবনা গুলো ভালোবাসায় রূপ নিল বুঝতেও পারি নি। ভালোবেসে ফেলি মনের অবচেতনে। আমরা খুব ঘুরতাম। এদিক সেদিক ছুটে বেড়াতাম ফড়িঙের মতো।
ওকে ছাড়া নিশ্বাস নেওয়াটাই যেন দায় হয়ে পড়তো। প্রজাপতির সাতরঙা সপ্ন বুনতাম কল্পনায়। একদিন রঙিন সেই কল্পনায় ছেদ ধরে। বাবা কিভাবে যেন জানতে পায় আমার অন্য ভুবনের ভুবনেশ্বরী হওয়ার কথা। বাসায় মারধর চলে। সিদ্ধান্ত নেই পালিয়ে যাব। সিদ্ধান্ত আমলে নেই। বয়স বাড়িয়ে বিয়ে পড়ানো হয় আমাদের। রপমের সাথে বাবার রাজ্য ত্যাগ করে পাড়ি জমাই অন্য রাজ্যে। আমার স্বামীর বাড়ি। ওরা আমাকে কিভাবে নিয়েছিল জানি না, তবে ওদের অবস্থা দেখে আমার অন্তর আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। বেড়া আর ছন দিয়ে বাঁধানো বাড়ি, ঘরে ফ্যান পর্যন্ত নেই। পাশ দিয়ে নদী বয়ে গিয়েছে। মানে ওদের এটা স্থানীয় বাসা নয়। নদী পাড়ের মানুষ ওরা। মাথা ঘুরছিল। দাঁড়াতে পারছিলাম না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম,” ভুল কিছু করিনি তো?এসির মধ্যে থেকে বড় হয়েছি। স্কুলে গেছি গাড়ি করে। কোন পরিস্থিতিতে ফেললাম নিজেকে?”
আবার নিজেই নিজেকে বুঝ দিলাম ভালোবাসার দোহাই দিয়ে। বাবা-মা কে যে আমাকে বুঝাতেই হবে, রুপমকে বাছাই করে তাদের মেয়ে ভুল কিছু করেনি। ওদের সংসারে মিশে যেতে চেষ্টা করলাম। বিয়ের তিনমাস পর জানতে পারলাম রুপম বেকার। সংসার চালায় আমার শ্বশুর। প্রেম চলাকালীন সময়ে জানতাম ও খুব ভালো চাকরি করে। এর মধ্যে শাশুড়ি-ননদের ব্যবহারের পরিবর্তন হতে লাগলো। সব কাজ আমাকে দিয়ে করাতে পাড়লে যেন তারা বাঁচে। রুপমকে বললে ও কানেই তুলত না কিছু। খালি বলতো,” আমাদের বিয়েটা আট-দশটা বিয়ের মতো হয় নি। সময় দাও। মা যা বলবে তাই করবা।” শাশুড়ি মা যা বলতো আমি কিন্তু তাই করতাম। কিন্তু তাও মন পাচ্ছিলাম না তাদের।
বিয়ের সাত মাস যখন পূর্ণ হলো, জানতে পারলাম আমার মাঝে অন্য কেউ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। ভাবতেই ভালো লাগছিল একটি তুলতুলে বাবু আসবে আমার মাধ্যমে। ছোট ছিলাম তাও মাতৃত্বের সুখ খুব করে অনুভব করছিলাম। খবরটা জানার পর বাবাকে ফোন দেই। বাবা ঝাড়ি মেরে বলেছিল, “দুঃখিত, আপনি ভুল নাম্বারে ফোন দিয়েছেন। আমাদের কোন মেয়ে নেই। একটি মেয়ে ছিল তবে সাত মাস আগে সে মারা গিয়েছে।” খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। পেটে হাত দিয়ে বাবুকে বলেছিলাম, “একদম মন খারাপ করবে না। তোমার নানুভাই তোমার আম্মুকে খুব ভালোবাসে। দেখো, তোমাকেও খুব ভালোবাসবে।” বাচ্চা পেটে আসার পরও শাশুড়ির ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসলো না। সকল কাজ করতে থাকি অসুস্থ শরীর নিয়ে।
গর্ভাবস্থায় সাত মাসের মাথায় আমার ওজন অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। পা ফুলে যাচ্ছিল, প্রসাবে অ্যালবুমিন দেখা যাচ্ছিল, প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং সেই সাথে চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করি। রুপম একবার জিজ্ঞেস করেছিল আমাকে এরকম অস্বাভাবিক কেন দেখাচ্ছে। শাশুড়ি মা তখন বলেছিল, “এ সময় এমন হয়। তুই ব্যাটা ছেলে এগুলাতে মাথা ঢুকাস ক্যান? তোর বউ কি একলা পোয়াতি হইসে? তাকায়ে দেখ, শরীর কত ফুলসে। মানে গোশত হইসে শরীরে। আনসিলি তো শুঁটকিমাছ।”
এখন হলে বলতে পারতাম রুপম আমি প্রি-এক্লাম্পসিয়াতে ভুগছি। ছোট ছিলাম তো। তাই, যা বুঝাতো বুঝে যেতাম। শরীর খুব খারাপ লাগলেও কাউকে বলতাম না। চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। কারন, শাশুড়ি বলেছিল এসময় শরীর খারাপ লাগলেও কাউকে বলা যাবেনা। এতে বাচ্চার অকল্যাণ হবে। একদিন রাতের খাওয়ার খেয়ে ননদের সাথে উঠানে বসেছিলাম। রুপমকে দেখলাম একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাড়ির সবাই উঠানে জড়ো হয়। মেয়েটা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কি সুন্দর নতুন বউয়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক চৌদ্দমাস আগে আমিও এ ভাবে বউ সাজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাত-পা কাঁপছিল। রুপম সবাইকে জানালো, মেয়েটা তার বিবাহিত স্ত্রী। আচমকা যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। কথাটা নিতে পারি নি।
লেবার পেইন উঠে। সাথে সাথে পাশে থাকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। চার ঘণ্টা নিজের সাথে লড়াই করে জন্ম দেই এক ফুটফুটে শিশুর। যার কান্নার শব্দ বুকে প্রশান্তির শীতল স্রোত তুলেছিল। শরীর দুর্বল থাকায় জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে আমার বাচ্চাকে আমি পাশে পাই নি। ডেলিভারির এক ঘণ্টার মাঝে আমার বাচ্চাটা দম ত্যাগ করে। ডাক্তার বলেছিল, “রিনি তুমি,প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় ভুগছিলা। ভাগ্য ভালো, গুরুতর কিছু হয় নি তোমার। অপুষ্টি আর কম ওজন নিয়ে জন্ম নিয়েছিল বলে তোমার বাচ্চাটা সার্ভাইব করতে পারে নি। আমরা খুব দুঃখিত।” শান্ত গলায় ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আসলেই কি আমার ভাগ্য খুব ভালো ডাক্তার আপা?” রুপম বা তার পরিবারের কাউকে পাই নি পাশে। আমি আবার জ্ঞান হারাই।
তারপরের দিনই মায়ের কাছে ফোন দেই। মাকে কিছু বলতে না দিয়েই আমি বলা শুরু করি, “মা, ওমা। আমার বাচ্চাটা যে বাঁচলোনা। তোমার সন্তান কেড়ে নিয়েছিলাম বলে কি আমার সাথে এমন হলো? মাগো, আমি ভালো নেই মা। তুমি কি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলা, মা? শুনেছিলাম মায়ের অভিশাপ খুব লাগে? তুমি তোমার অভিশাপটা তুলে নাওনা মা। তাইলে আমার বাচ্চাটা বেঁচে উঠবে। তখন আমাকেও মা বলে ডাকবে।” মস্তিষ্কসচল ছিল না সেদিন। কি বলেছিলাম মা কে নিজেও জানিনা। তবে বাবা-মা আমাকে নিতে ঠিক এসেছিলো। আমাকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে উঠি ধীরেধীরে। এর ঠিক ছয় মাস পর রুপমের সাথে ফ্যামিলি কোর্টে আমার ডিভোর্স করিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের সময় যে রেজিস্টার আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল, তাকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়।
পরিশিষ্ট : আমি নূরে মাহবুবা রিনি, ঢাকা মেডিকেলের একজন স্বনামধন্য গাইনী ডাক্তার। নিজের পরিচয় তৈরি করেছি নিজের চেষ্টায়। এ ছিলো আমার জীবনের স্মরণীয় এক অন্ধকার অধ্যায়। বলতে গেলে অপরিণত বয়সের ভুল। যে ভুল আজ অনেক তরুণী প্রতিনিয়ত করেই চলেছে। আজ আমি যা হতে পেরেছি তা সম্পূর্ন আমার মা-বাবার প্রেরণায়। রাস্তায় হাটলে অনেকেই আমার জীবন ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায় গুলো তুলে ধরে। তাদের ভাষ্যে আমার লাড়াই করা উচিত ছিলো, নিজের সংসার ছাড়া উচিত নয়। কিন্তু তারা জানেনা ঘটনার অন্তরালে আরও কিছু ঘটনা থাকে। যা কেউ জানে না, কেউ দেখে না, কেউ বুঝে না।