একজন বাবা ও পরী

একজন বাবা ও পরী

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এ কী দেখছি? আমার ঠিক সামনেই মা-বাবার বেডরুম। সেই রুমে বাবা বসে আছে, ছোটআন্টির ঘাড়ের উপর একটা হাত রেখে, অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে। ছোটআন্টির মুখটা অবশ্য দেখা যাচ্ছে না।

অদ্ভুত একটা অস্বস্তিবোধ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরে চলে আসলাম। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে বিছানার কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি এইমুহূর্তে ওসব দিকে খেয়াল করতেও চাচ্ছি না। জানালার ফাঁক গলে আমার দৃষ্টি গিয়ে পড়ছে ঘরের কিছুটা দূরেই ভিজতে থাকা মায়ের কবরটার উপর। হঠাৎ কী ভেবে বিছানার উপর উঠে এসে জানালার পাশে বসে পড়লাম। অতঃপর বৃষ্টি এসে ভিজাতে থাকে আমার সবুজ কামিজটা। অবাক হয়ে ভাবতে থাকি, এই নতুন কামিজটাও তো মা পরশুদিন বানিয়ে দিলো, কত খুশিই না ছিল মা সেদিন। তারপর এই তো, গতকাল বাবার জন্মদিন ছিল, মা কত কী রান্না করলো সারাদিন। নিজে বসে থেকে আমাদের খাওয়ালো। তারপরই সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আধাঘণ্টা পর বাবা আর ছোটআন্টি মিলে দরজা ভেঙে মায়ের ঝুলন্ত মৃতদেহটা দেখলো। সকলকে ডাকলো। মাকে আর কেউ ডাকলো না কারণ ততক্ষণে মা ঘুমিয়ে পড়েছে।

মায়ের ভেজা কবরটার মতো আমার চোখদুটোও ভিজতে থাকলো। আমি জানি মা স্বাভাবিকভাবে মারা যায়নি, কেউ এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মানবে না। অথচ মায়ের ডেথ সার্টিফিকেটে মায়ের মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে ‘আত্মহত্যা।’ কিন্তু আত্মহত্যা কেন করলো, কে করালো এটা কি কেউ ভেবেছে?

যে তদন্ত করতে এসেছিল সেও তো বাবার বন্ধু! এজন্যই একটা খুনকে ধামাচাপা দিতে বাবার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মায়ের দেহে কিছু আঘাতের চিহ্ন সবার চোখকে ফাঁকি দিলেও আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকলাম।

গতকাল থেকে আমি কোনো হিসাব মিলাতে পারছি না। স্কুলে যখনই প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে কিছু লিখতে বলা হয় আমি এক সেকেন্ড না ভেবে লিখে ফেলি যে, আমার পৃথিবীতে সবচে’ প্রিয় মানুষ আমার বাবা। তারপর বাবাকে নিয়ে অনেক কথা লিখি। প্রথমেই লিখি আমার বাবা আমাকে পরী বলে ডাকে। বাবার চোখে আমি পৃথিবীর সেরা সুন্দরী পরী। আমার লেখা যেন বাবার ভালোবাসার মতো অবাধ্য হয়ে ওঠে। ফুরাতেই চায় না।

আর আজ সেই বাবা?
মাকে অবশ্য কখনো-কখনো রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে দেখেছি। আমি হয়তো তখনও পেঁয়াজের ঝাঁঝ আর অন্তরের ব্যথার পার্থক্যটা বুঝে উঠতে পারিনি। কী হতভাগা সন্তান আমি! আজ বড় আফসোস হচ্ছে। মাকে যদি একটু সময় দিতাম তবে মা হয়তো এভাবে হারিয়ে যেত না।

পরদিন ভোর হতেই স্কুলে চলে আসলাম। আজ আর কেউ টিফিন গুছিয়ে দেয়নি। বাবা আমার খোঁজ না নিয়েই অফিসে চলে গিয়েছে। আমি মায়ের কবরের পাশে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে একটা চাপা অভিমান নিয়ে স্কুলে এসেছি। স্কুলের সবার মুখে আজ একটাই প্রশ্ন, “মনি? তোর মা আত্মহত্যা করলো কেন বল তো?” কেউ-কেউ আবার ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে এটাও প্রশ্ন করছে যে, “তোর মায়ের কোনো চক্কর চলছিল নাকি? ধরা পড়ে আত্মহত্যা করলো?” আমি একবুক ঘৃণা নিয়ে এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছি।

বাসায় আর আগের পরিবেশ নেই। বাবা আর ছোটআন্টি সম্ভবত বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অথচ মা মারা গেছে দশদিনও হয়নি। বাবা আর ছোটআন্টি এক রুমেই থাকে। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া একটা মেয়ে হয়ে এমন একটা অসুস্থ পরিবেশে দিনদিন অক্সিজেন স্বল্পতা অনুভব করতে থাকি।
এখন একটা জিনিস স্পষ্ট। বাবা আর ছোটআন্টি মিলেই মাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে। অথচ এই ছোটআন্টি মায়ের আপন কেউ ছিল না, আমার নানুবাড়ির আশ্রিতা ছিল। একদিন মা আমাকে দেখাশুনার জন্য সোমা আন্টিকে নিয়ে আসলো। মায়ের আর কোনো বোন নেই বলে আমাকে বলল, “আজ থেকে তুই সোমাকে ছোটআন্টি ডাকবি।” তারপর দিনেদিনে সেই সোমা আন্টিই বাবার জীবন থেকে মায়ের জায়গাটা কেড়ে নিলো। আজ স্পষ্ট বুঝতে পারছি মা এমনিতেও মারা যেত। নিঃশ্বাস আটকে মারা যেত।

তার ঠিক সাতদিন পর এক তুমুল বৃষ্টির রাতে বাবা ভিজতে-ভিজতে বাড়িতে ফিরলো। বাবার চোখদুটো ফোলাফোলা মনে হলো। বাবা অফিসের ব্যাগ রেখে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা চিরকুট পেল। তাতে লেখা ছিল, “আমি কিছুতেই তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না হাবিব। আমি আমার প্রেমিকের সাথে চলে যাচ্ছি। ক্ষমা করে দিও।” বাবা গম্ভীর মুখে দরজা আটকে বসে থাকলো।

ঘণ্টাখানেক পর আমি ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজছিলাম। অন্ধকার আকাশের নিচে নিজেকে অশরীরীর মতো মনে হচ্ছিল। ক্ষণে-ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকালে মায়ের কবরটা দেখা যাচ্ছিল। আমি সেটাই দেখছিলাম। আজ আমার মনটা একটু শান্ত লাগছে। হঠাৎ বুঝলাম পাশে কেউ দাঁড়িয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বাবা এসেছে। আমি আগের মতো চুপ করে ভিজতে থাকলাম।
নীরবতা ভেঙে আচমকা বাবা বলল,
“পরী? তোর সোমা আন্টিও চলে গেল।”
কথাটা শুনে আমি হেসে উঠলাম। এই হাসিতে বাবা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। আমি চোখেমুখে ঘৃণা ফুটিয়ে তুলে বললাম, “তোমার ১২ বছর বয়সী মেয়ের সামনে এই কথাটা বলতে বিন্দুমাত্র লজ্জা করছে না?”
বাবা উত্তর দিলো না।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার কথা বলতে শুরু করলো। আমি কথায়-কথায় মায়ের খুনের রহস্যটা জেনে নিলাম। বাবাও কাঁদতে-কাঁদতে সবটা বলে ফেললো। বুঝলাম বাবা অনুশোচনাবোধ করছে। শেষে বাবাকে একটা প্রশ্ন করলাম, “তুমি আমাকে আজও খুব ভালোবাসো তাই না বাবা?”

বাবা উত্তর না দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। পরদিন সকালে বাবা পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমাকে পেল না। আবার একটা চিরকুট পেলো। বাবা বুঝতে পারলো তার মেয়েকে এই জনমের মতো হারিয়ে ফেলেছে।

ডায়রিটা এ পর্যন্তই। পড়া শেষ করে পরী চোখ মুছলো। পাশেই তার ঘুমন্ত মা। একটা বড়োসড়ো এক্সিডেন্ট করে তার মা হাসপাতালে ভর্তি। ঘণ্টাখানেক আগে মা চোখ খুলে তাকে বলেছে যে, “তুই বারবার তোর নানুবাড়ির কথা জিজ্ঞেস করিস, আমি সর্বদা চুপ থাকি। তোকে কিছু বলতে পারি না। এখন তোর ১২ বছর বয়স। তোর বয়সে আমার জীবনটা কেমন ছিল তা তুই জানতেই পারিস। আমার বুকসেলফের একেবারে উপরে ৩ নাম্বার ডায়রিটা বের করে পড়িস।”

পরী মায়ের ডায়রিটা হাতে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছিল। ইচ্ছে ছিল মায়ের জীবন সম্পর্কে সে মায়ের পাশে বসেই জানবে। অথচ এখন তার চোখদুটো বাঁধ মানছে না।

মনি চোখ খুলতেই পরী চোখ মুছে বলল, “আমি পরের ঘটনা শুনতে চাই মামণি। প্লিজ বলো…”
মনি চোখ বুজে ফেলে। তারপর মৃদুস্বরে বলে, সেদিন আমি আমার মায়ের এক দূরসম্পর্কের খালাতো বোনের বাড়িতে চলে এসেছিলাম। বাবা ঐ আন্টিকে চিনতো না। মা একবার আমাকে ঐ আন্টির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। আন্টির কোনো সন্তান ছিল না। মাকে বহুবার বলতো আমাকে তার কাছে রেখে দিতে। সেদিন ফায়জা আন্টি মানে আমার আম্মা আমাকে আশ্রয় না দিলে আমি হয়তো খড়কুটোর মতো ভেসে যেতাম। তারপর খবর পেলাম বাবা আবার বিয়ে করেছে। একটা ছেলে হয়েছে বাবার। আদর, ভালোবাসায় আমার জীবনটাকে ভরিয়ে তুলে আমার আম্মা আমাকে পড়াশুনা করালো, তোর বাবার সাথে বিয়ে দিলো। তবে ভেতরের ক্ষতটা আর সারেনি।”

পরী উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলো, “নানুভাইয়ের সাথে আর তোমার দেখা হয়নি? বাড়িতে যাওনি? খবর নাওনি?”
তখনই পরীর বাবা কেবিনে ঢুকে বলল,
“তোর মা কি সেই রকম মানুষ বল? প্রতি মাসে তার বেতনের টাকার তিনভাগের একভাগ তোর নানার ঠিকানায় পাঠাতো। একমাসও এদিক-ওদিক হয়নি।”
পরী অবাক হয়ে বলল,
“মামণি? তুমি তোমার মায়ের খুনিকে টাকা পাঠাতে?”
মনি মৃদু হেসে বলল,
“রাগছিস কেন সোনা? মানুষটা একটা খুন করে তিনটা খুনের অপরাধ আর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে। আমার মা, সোমা আন্টি আর আমার। কিছু অপরাধের শাস্তি দিতে নেই, প্রকৃতিই তার শাস্তি পূর্ণভাবে বুঝিয়ে দেয়।”
পরীর বাবা বলল,
“তোর মা একদম ঠিক বলেছে। জানিস? কিছু মানুষ চোখের সামনে পৃথিবীর সবচে’ জঘন্য কাজটা করলেও তাকে ঘৃণা করতে মন সাড়া দেয় না। তোর মাও সেরকম বিশ্বাস করে। তোর নানুভাই তোর মাকে আদর করে পরী ডাকতো। তোর মা তোকে পরী ডেকে সেই নামটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেন তা বুঝতে পারিস?”

পরী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো। তার চোখের চেয়ে দ্রুত গতিতে তার মায়ের চোখদুটো ভিজে যাচ্ছে। বাবা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে মায়ের কান্না দেখে বাবাকেও বহুবার কাঁদতে দেখেছে । তার বাবাও সম্ভবত কাঁদছে। কী অদ্ভুত এই মানবজীবন!

সাতদিন পর,
মাঝরাতে, শহুরে রাস্তার বুকচিরে ছুটে চলছে একটা গাড়ি। গাড়িতে পরীর মা, পরী আর পরীর বাবা। ওদের গন্তব্য মনির বাবার বাড়ি। ঘণ্টাখানেক আগে খবর এসেছে পরীর নানুভাই আত্মহত্যা করেছে। পরী আধো অন্ধকারে তার মায়ের মুখের দিকে তাকালো। ঐ মুখে এখন এক পৃথিবীর অন্ধকার জুড়ে বসেছে, শুধুই অন্ধকার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত