আমার বাবা একজন দিনমজুর। উনি মাটি কাটার কাজ করেন। কাজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকের সাথে বড় রাস্তায় বসে থাকেন। মাঝে মাঝে বালুর ট্রাক বা ইটের ট্রাকে করে কন্ট্রাক্টর আসেন। অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকান, স্বাস্থ্যবান ও বা কম বয়সী যারা, তাদেরকে আগে কাজে নিয়ে যান।
বাবা আর করিম চাচার মতো মাঝ বয়সী অনেকেই রোদ অনেক কড়া না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকেন। রোদ্দুরে তাদের ঘাম মাটিতে পড়ে। মাটি কই? এখন ঘচঘচে বালি। তারপর তারা কেউ কোনও কথা বলেন না। বাবা বসে থাকেন চায়ের দোকানের লম্বা বেঞ্চের এক কোণে। চৈত্রের রোদেলা দুপুর বয়ে যায়।
অনেকটা সময় ঘরে আসেন না। হয়তো আমাদের সামনে কাজে না পাওয়া লজ্জিত মুখ দেখাতে চান না।
মা প্রায়ই আমাকে বাজারের দিকে পাঠান। ‘যাওনা ময়না, দেইখা আসো তুমার বাপে কাজে গেছে কী না।’
দু’চারদিন দিন পরপরই মাকে হতাস হতে হয়। বাবা তার মাথাল, ছেনি, আর টুকরি নিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। মায়ের মুখটা আরো একটু রুক্ষ হয়। বহুদিন তেল না দেয়া চুলগুলিকে আরো বেশি খড়খড়ে দেখায়।
মুখ থমথম করে মা ঘরের কাজ সারেন। আমরা জানি আজ দুপুরে রান্না হবে না। তবে বাবাকে কাছে পেয়ে আমরা তিন বোন খুব খুশি থাকি। সেদিন বাবা দক্ষ হাতে মায়ের লাউ বা পুঁইশাকের মাচায় খুঁটি পুতে দেন। মাচানে বাঁধা পুরাতন দড়ি বদলে নতুন দড়ি লাগিয়ে দেন।
আমাদের তিন বোনকে কলপাড়ে নিয়ে ঘাড় ডলে গোসল করান। গোসল সেরে আমাদের ক্ষুধা আরো বাড়ে। মাকে কিছু বলার উপায় নেই। মা পাশের এলাকায় ছুটা বুয়ার কাজ করেন। ততক্ষণে সেখানে চলে গেছেন। বাড়ি আসতে আসতে সেই বিকাল।
খাবার শুণ্য দুপুরটা সেদিন আরো লম্বা হয়ে যায়। সময় যেন কাটতেই চায় না। বাবা বিকেলে চুপিচুপি আমাদের দুই টাকার করে বাদাম কিনে দেন। সারাদিনে এটাই আমাদের উৎসবের খাওয়া । বাবা বাদাম ছিলিয়ে আমাদের মুখে দেন আর হাসেন। বাবার হাসি খুব মিষ্টি।
আমার এই বারো বছরের জীবনে যদিও তাকে হাসতে দেখেছি খুব কম। শুনেছি বাবা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু ওইযে অভাব! প্রথমে ধরলেন লাঙল। তারপর জমি হারিয়ে এখন দিনমজুর ।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেই মা রান্নার যোগাড় করে। ভাত সাথে বেগুন বা শিম ভর্তা সাথে ডাল। আমরা বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়ি। উনি বলেন জোড়ে না পড়লে না-কি পড়া মুখস্থ হয় না। খেতে বসে বাবা প্রায়ই আমাদের একটা গল্প বলেন। গল্পের নাম ‘পণ্ডিত মশাই।’ গ্রামের স্কুলে ইংরেজ ইন্সপেক্টর এসেছেন স্কুলের হাল দেখতে সাথে তিন ঠ্যাঙ বিদেশি কুকুর। ইন্সপেক্টর চলে গেলে পণ্ডিত মশাই ছাত্রদের জিজ্ঞাস করেন। তিন ঠ্যাঙ কুকুরের জন্য মাসে খরচ পঁচাত্তর টাকা। আর আটজনের সংসারে আমি পাই পঁচিশ টাকা। এখন তোমরা বলো। সাহেবের কুকুরের কয়টা ঠ্যাঙের সমান আমার আয়? এই গল্পটা বাবা প্রায়ই বলেন। বলার সময় উনার মুখটা মলিন হয়ে যায়। বাবার মলিন মুখ। আমাকে দ্বিতীয়বার ভাতের ডিশ থেকে ভাত নিতে বাঁধা দেয়।
এই বয়সেও আমি বুঝি। আব্বার আয় কম। আমরা গরিব। আমরা আসলে পাঁচ বোন। বড় দুই বুবুর বিয়ে হয়েছে। তারা দূরের গ্রামে থাকেন। গরিব বাবার ঘরের গরিব মেয়ে, পরেছেন গরিবের সংসারে, তাই বাড়ি আসেন খুব কম। বাবার সাথে একবার মেজো বুবুকে আনতে গিয়েছিলাম। এক ভরি সোনার টাকা পায় বলে তারা আব্বাকে অনেক কথা শোনালো। আব্বা লাজুক মুখে শুধু বললেন। ‘ দিয়া দিমু বিয়াই সাব। এই গরমটা যাইতে দেন। জমি ও তো নাই যে বেইচ্চা দিমু।’
‘হ হ জানি তো। জমি ক্ষেতি নাই আপনের। আগে জানলে এমন ঘরে কুটুম্বিতা করতাম না।’ বাবা চুপচাপ থাকেন। দুপুরে বুবু মুরগি রেঁধে আমাদের ভাত দেন। সেই ভাত বাবার গলা দিয়ে নামতে চাইছে না, আমি জানি। গত পনেরো দিন আম্মা আমাদের শুধু ডাল ভাত বা ভর্তা ভাত খাইয়েছেন। প্রতিদিন একশ টাকা জমান কম কথা না। এর মাঝে তিনদিন বাবা কাজ পাননি। জ্বরে ঘরে ছিলেন দুইদিন। তখন আমরা প্রায় না খেয়ে ছিলাম। বহুত কস্টে জমানো টাকা দিয়ে
গিয়েছিলাম শুধু নিজের বোনটাকে একটু বাড়িতে আনতে।
দুপুরে রওনা হওয়ার আগেই বুবু আমাকে ডেকে বলে।
তামান্না রে…আমারে একটা সুতি কাপড় কিনা দিতে বল আব্বারে। নইলে মনে হয় যাইতে দিবো না।
বুবুর কাপড়ের কথা বলতেই বাবা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেন। সেবারে আপাকে তিনশ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা সুতি শাড়ি কিনে দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন।
আমাদের সব বোনকে একসাথে দেখলে বাবা হাসেন। তার সেই বিখ্যাত হাসি। বাবা হাসলে কই যেন কয়েকটা সাদা কবুতর পতপত করে উড়ে যায়। রোদ থেকে ঝড়ে পরে মিহি গুড়া সোনা।
প্রতিদিন ভোররাতে ঘুম ভাঙে মায়ের। মা, অজু করে, নামাজ পড়েন। তারপরে আমাদের ডেকে তোলেন। বাবাও উঠে নামাজে যান মসজিদে। তবে আজকাল না-কি কী এক অসুখ এসেছে দুনিয়ায়। মসজিদে জামাতে নামাজ না-কি বারণ। কাল রাতে শুয়ে শুয়ে আমি আব্বা আর মায়ের কথায় কিছুটা বুঝতে পারি। আম্মা বুঝায়, ‘কামে যাইতে হইবো না। আপনি ঘরে থাকেন। যদি রোগে ধরে।’ বাবা চুপ থাকেন। হয়তো ভাবেন। যে সংসারে একদিন ঘরে বসে থাকলেই খাবারে টান পড়ে। সেই সংসারে ঘরে থাকা একরকম বিলাসিতা।
মানুষ কতকাল বাঁচে? আয়ুর সুতা কতটা লম্বা মানুষের। এই রোগ যদি আমার বাবাকে ধরে! মেজো বুবুর একভড়ি সোনা কে দেবে! ভালো ছাত্রী বড় বুবুরে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। গহীন গ্রামে। তারে কে দেখতে যাবে? আর আমরা! আমরাই বা কী খাবো! আমার মাথায় আর কিছু খেলে না।
একসময় জীবজগতের সকল প্রাণীই ঘুমায়। ঘুমায় গাছপালা। শুধু জেগে থাকে কিছু কীটপতঙ্গ, রাতচরা পাখি, ঝিঁঝিঁ পোকা। বাবা আর মা শুধু জেগে থাকেন। বিড়বিড় করে তাদের দোয়া পড়ার শব্দ শোনা যায়। আমি ঘুমের মাঝেই প্রতিরাতে বাবা মায়ের দোয়ার ছায়ায় ঘুমাতে যাই।
আজ সকালটা একটু অন্যরকম। মা গুণে গুণে বাবার হাতে চারশ টাকা দেন। প্রায় একমাস কষ্ট করে জমানো টাকা। আর কিছু নেই। অভাবের সংসারে এর বেশি থাকার ও কথা না। বাবাকে পইপই করে বলে দেন,’ চাউল আনবেন পাঁচ সের, আধসের ডাউল আর শুকনা মরিচ। লবণ ও আইনেন অল্প কইরা।’
‘এতো অল্প ট্যাকা!” নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন বাবা । ‘তারপর কী হইবো?’ ‘মায়ের চোখ নিবু নিবু হারিকেনের মতো হয়ে যায়। তেল শেষ। যে কোন সময় দব করে জ্বলে উঠে হয়তো একেবারে নিভে যাবে। গত তিনদিন আমরা কোনমতে চলেছি। এই শাক, লতা পাতা, ভাতের কোণায় শুকনা মরিচ। আব্বা এসব সইতে পারেন না। আমি জানি। চুপচাপ বাজারের দিকে হাঁটেন আব্বা। আজ চাল আসলে তারপর ভাত রান্না হবে।
দুপুরের আগেই কে একজন দৌড়ে এসে একটা খবর দিয়ে যায়। আমরা তাজ্জব বনে থাকি । এও সম্ভব!
আব্বা আর করিম চাচাকে না-কি বাজারের মধ্যে কানে ধরিয়ে দাঁড়া করায়ে রাখছে। ক্যান! ক্যান আমার বাপ চাচাগো এমন শাস্তি? আমি দৌড়ে যেতে চাই পাশের বাড়ির চাচি আমার হাত চেপে ধরেন। ‘ও মাইয়া বাইরে যাওয়া বারণ। গেলে নাকে মুখে মাছ টুপি পইড়া যাইতে হইবো। সেই টুপির দাম পঞ্চাশ টাকা।
আমি তাজ্জব হয়ে শুনি। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। আমার আব্বা। হাহাকার করে কাঁদি আমি।
আমার কান্না দেখে আমার ছোট দুই বোনও ছুটে আসে। ওরাও কাঁদছে। কাঁদছে আমার মা। আমরা হেঁটে হেঁটে বাজারের দিকে আসি।
বাবা আর করিম চাচা সত্যিই কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনকুড়ি বয়স হওয়া আব্বা যেন একটা বটগাছ। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাইছেন। কিন্তু বয়স আর উচ্চতা তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আব্বার ছবি তুলিছে অনেকে। কানাঘুষায় শুনি মাথায় ওড়না পড়া মোবাইল হাতে ওই সরকারি আপা নাকি আমার বাবাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। নাকে মুখে সেই টুপি না পড়ার জন্য।
একসময় বাবা ঘরের দিকে হেঁটে আসতে থাকে।
মহিলা দেখি মোবাইলে কথা বলছে। ‘জি স্যার, দিলাম পানিশমেন্ট। ঘরে না থাকলে কী শাস্তি বুঝুক এবার।’
আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমরা তিনবোন হাতে হাত লাগিয়ে দাঁড়াই। আমাদের দাঁতে দাঁত পেশার শব্দের কাছে সরকারি গাড়ির শব্দ চাপা পড়ে যায়। আমাদের আরো দুটো বোন আছে। আমাদের বড় আপা খুব ভালো ছিলেন পড়াশনায়। পড়ানোর সামর্থ্য থাকলে সেও হয়তো সরকারি মহিলা অফিসার হতো। সেও সরকারি গাড়িতে চড়তো! আচ্ছা তখন কী আমার বড় আপাও এমন হতো? না হতো না। আমার বাবা মা হতে দিতো না। আমার বাবা মা আমাদের শিখিয়েছে কেমন করে বড়দের সম্মান করতে হয়।
বাবা,মা সম্মান করা তো শিখিয়েছেন। সাথে একটু প্রতিবাদ করাও যদি শেখাতেন তাহলে ভালো হতো।
পঞ্চাশ টাকায় সোয়াসের চাউল পাওয়া যায়। যা দিয়ে আমাদের দুইবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়া চলে। এখন সরকারি আপা যদি আমার বাবাকে চাউলের বদলে মুখে দেওয়ার টুপি কিনতে বলেন। তাহলে তো সেই পণ্ডিত মশাইয়ের গল্পই আবার ঘুরেফিরে আসে।
নীল জামা পড়া সেই সরকারি আপার দিকে চেয়ে আমি মনে মনে বলি..
‘আচ্ছা আমরা পাঁচ বোন যদি আমাদের বাবাকে বিনা অপরাধে লজ্জা দেয়ার জন্য আপনাকে কোন শাস্তি দিতাম। কী শাস্তি দিতাম জানেন? আমরা পাঁচ বোন আপনার গায়ে না আপনার সামনে ‘থুঃথুঃ ‘করে মাটিতে থুথু ফেলতাম। সরকারি আপা, আপনি সেই অপমান সইতে পারতেন তো!’