অবসাদ

অবসাদ

এক

“তাহলে আপনি আমাকে সত্যি সত্যিই ডিভোর্স দিতে রাজি হলেন?” আমি মাথা নিচু করে থাকি। সমগ্র কথা গুলো দীবার কাছে যখন বললাম ও একটা বারও হা হুতাশ করলো না। অন্য রুমে চলে গিয়েছিল। আর এখন প্রায় পনেরো মিনিট পর এসে এই ব্যাপারে জানতে চাচ্ছে।আচ্ছা আমার কি তাকে আর কিছু বলার আছে? বুঝানোর আছে? আমি যা বলেছি সে কি বুঝতে পারেনি?

আমি তারপরো ইতস্ততার সহিত বললাম “আমি মানুষটা কেমন জানি তাই না? স্পষ্ট করে বললে আমার মনটা একটা ভাবনার রাজ্য। একটা কথা কি ছোট বেলা আমার মনে যা আসতো আমি মাকে সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করে ফেলতাম, জানতে চাইতাম। আমার মা একটুও বিরক্ত হতো না। কিন্তু যেবার বুবু আত্মহত্যা করলো গলায় ফাস দিয়ে সেবার মা খুব বিরক্ত হয়েছিল। আমার গালে চড় মেরে কান্না করে বলেছিল “এতো জ্বালাস ক্যা? মরতে পারিস না? দুর হ।” কিন্তু কিছুক্ষন পরই আমাকে বুকে নিয়ে বলেছিল “শোভন কষ্ট লাগেরে আব্বু। আমার মেয়েটার সাথে এমন কিছু হয়ে গেলো আমি বুঝতে পারি নাই। আমি কেমন মা হইলামরে?” আমি সেদিনই প্রথম আমার মাকে এমন করে কাঁদতে দেখেছিলাম। বাবাকে কেমন যেন পাথর হয়ে যেতে দেখলাম।আমার বাবা শোকে তিন দিন কারো সাথে কথা বলে নাই।আমার বাবাটা মাঝ রাতে চিৎকার দিয়ে বলে উঠতো “বিন্তি মা তোর বাবা ছিল তো। এমন করলি কেনরে মা? ও মা? বাবার কথা মনে পড়ে নাই একবারো?” আশেপাশের মানুষ কানাকানি করছিল বুবুর সাথে এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। এই সূত্র ধরেই বুবু আত্মহত্যা করেছিল।আমি সম্পর্ক জিনিসটাই বুঝতাম না। পরে জানলাম আমার বুবু অন্তঃসত্ত্বা ছিল।আমার বয়স তখন আট। আচ্ছা সম্পর্ক থাকলেই কি মানুষ আত্মহত্যা করে? আমি অনেক বছর পর বুঝেছিলাম কি পরিমাণ যন্ত্রনা, আর নিজেকে তুচ্ছ ভেবে আমার বুবু আত্মহত্যা করেছিল।সেই বয়স থেকেই আমার শুরু হয় সম্পর্ক, ভালোবাসার অসমতা গুলিয়ে খাওয়ার।আমি স্থির করেছিলাম কখনোই এমন সম্পর্কে জড়াবো না। যে সম্পর্ক মানুষের মন বদলে দেয়। ঠিক তেমনি আমার বুবুর মত যদি আমার জন্য কেউ গলায় ফাস দেয়? একটা মানুষ আরেকটা মানুষের জন্য এমন করে হারিয়ে যাবে। রক্তের বন্ধন ছিন্ন করবে। ব্যাপারটা খুবই ভয়ানক।অদ্ভুত রকমের ভয়ানক।

এইটুকুই বলেই আমি থামি। দীবা আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাস জানান দেয় চারপাশের বিষণ্নতাকে ছোয়ার।আমি জানালার দিকে হেটে যাই। আমার বাসার এই জানালাটা দিয়ে সূর্যের আলোটা আসে না বললেই চলে। কিন্তু মাঝে মাঝে দক্ষিনের বাতাসটা এসে পুরো ঘরটা মেঘাচ্ছন্নের মত করে দেয়। আমি জানালার পাশে গিয়েই দীবার দিকে ফিরে আবার বললাম “আমি যেমন চেয়েছিলাম তেমনই করেছি। কোন সম্পর্কে জড়াইনি। বাবা মায়ের পছন্দেই তোমাকে বিয়ে করলাম। কিন্তু সুখি ছিলাম কি? বলো? আমার কোন ভুল ছিল? তোমাকে আমার সব টুকু দিয়ে ভালোবাসি নাই? আমি বাচ্চাদের মত কাচুমচু করে তোমাকে গল্প শোনাতাম। সেই গল্পে থাকতো আমার ভালোবাসার কথা। যে কথা বহুকাল ধরে নিজের কাছে জমা করে রেখেছিলাম ভালোবাসার মানুষকেই বলবো বলে। কিন্তু তুমি কি করলে? আমার এসব ভালোবাসাকে ন্যাকামো ভাবতে। কথায় কথায় বিরক্ত ভাব দেখাতে। আমি বুঝেও না বুঝার ভান করতাম। অনুধাবন করলাম নিশ্চয় তোমার এই বিয়েতে মত ছিল না। পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছো।এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো বলে বলে একদিন ঠিকি বলে ফেললাম “তোমার অসুবিধার কথা আমাকে বলো।আমাকে যদি অপছন্দ হয় বা যদি মনে করো তোমার সাথে আমার যাচ্ছে না তাও বলো। আমি নিজেকে গুছিয়ে নিব।আমাকে সুযোগটা দাও।” তুমি সেদিন কিছু বলোনি। বলেছো তার কয়েকদিন পর। আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে তোমার একটা সম্পর্ক ছিল এবং পালিয়ে গিয়ে তার সাথে কয়েকদিন থেকে ছিলে।আমি এসব শুনে কয়েকটা দিন ঠিক থাকতে পারিনি।আমি, হ্যাঁ আমি শোভন সারা রাত ঝিম মেরে বসে থেকে কান্না করেছিলাম। পরে ভাবলাম আমিও যদি তোমায় এখন অবহেলা করি তখন তুমি যদি আমার বোনের মত পথ বেছে নাও ব্যাপারটা আরো ভয়ানক হবে। আমি এসব চাইতাম না। আমি নিজেকে স্বাভাবিকে আনলাম। আমার জীবনে যা হবার হয়ে গেছে।তোমাকে আমি আমার মত করেই চাইলাম।কিন্তু তুমি পেরেছো কি? মাস খানিক পার হলো। আমি ভাবলাম তোমার একটু সময় দরকার। নিজেকে এই বিষয়টা থেকে বের করে সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে উঠে দাঁড়ার। তোমার তো কোন দোষ ছিল না। সে তোমার সাথে প্রতারনা করেছে। একজন ভুল করবে, আর প্রতারনা করবে, তার শাস্তি কেন অপর মানুষটা পাবে? আমি তোমাকে সেই সময়টা দিয়েছি। তোমাকে ভালোবেসেছি। কিন্তু হঠাৎ করে যখন গত সাতদিন আগে বললে “আমার মনে হয় আমাদের আলাদা হওয়া দরকার কি বলুন? এভাবে আর কতদিন?” তখন আমার ভিতরটা কেমন করছিল হয়তো তুমি বুঝতে পারোনি।আমি বুঝলাম আমার ব্যর্থতা। আমি তোমাকে ঠিক মত ভালোবাসাটা দিতে পারছি না। আসলেই কি পারছিলাম না? ঠিক করে বলো তো?”

দীবা কাঁদতে থাকে। মাঝে মাঝে ওকে যখন কাঁদতে দেখি আমার কেমন যেন বুকের ভিতর লাগে। অনেক লাগে। আবার ওকে যখন একটু উদ্দীপনায় দেখি আমি বার বার লুকিয়ে লুকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।তারপর এই ছন্নছড়ার বিষণ্নতার ব্যস্ত শহরে আমি অজস্র দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হারিয়ে যাই।এই হারিয়ে যাওয়ার মাঝে আমার কি কোন দায়বদ্ধ ছিল? দীবা চোখের পানি মুছে বললো “শোভন আপনি অনেক ভালো একটা মানুষ। আপনি আমার সব কিছু জেনেও ভালোবেসেছেন।যেটা বিয়ের আগে আপনাকে বলা দরকার ছিল।কিন্তু আমি পারছিলাম না। তার জন্য আমি দুঃখিত।আমার এই বিয়েটা না করাই উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি, আমার পরিবার, সমাজের পরিস্থিতির কাছে আটকে গিয়েছিলাম।বিশ্বাস করুন আপনার ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না। আমি পারছিলাম না এই ভালোবাসার সঠিক মর্যদা দিতে।আমি যখন ঘুমিয়ে থাকতাম আপনি প্রায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন এমনকি আমার চুল কানে গুজে দিতেন। আমি এটা বুঝতাম। আমার না খুব কান্না পেত। এ পৃথিবীর মানুষ গুলো খুবই ভয়াবহ। প্রথমে ভালোবাসা দেখায় তারপর শুরু হয় অবহেলা, অবজ্ঞা করার। এমন কেন মানুষ গুলা? আমার নিজেকে খুব দুর্বল লাগে। আমি অনেক খারাপ একটা মানুষ তাই না? আমাকে তো আপনার ঘৃনা করা উচিৎ। এমন করে ভালোবাসতে গেলেন কেন? এই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার কি আমি রাখি? বলুন রাখি? বলুন?

দুই

রাত এখন আনুমানিক সাড়ে বারোটা বাজে। হাটতে হাটতে মাঝে মাঝে আধপাকা পুরানো জং ধরা কয়েকটা বাড়ি চোখের সামনে পড়ে। আর একটু পরেই আজাদ চাচার বাসা। উনার সাথে আমার পরিচয় হঠাৎ করে। আমি বাসে করে যাচ্ছিলাম মোহাম্মদপুরের দিকে। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পরে আমি উনার ফোনের কল লিস্ট থেকে মুনা নামের একজনকে কল করে উনার বাসা অব্দি পৌছে দিয়েছিলাম।জানলাম মুনা উনার মেয়ে। অনার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল দিবে। এই সামান্য বিষয়টা থেকেই এই মানুষ গুলোর সাথে আমার পরিচয়।তবে একটা বিষয় হলো মুনা উনার নিজ মেয়ে না। পালিত মেয়ে। উনাদের কোন সন্তান হচ্ছিল না। মুনা যে উনাদের পালিত মেয়ে ব্যাপারটা মুনাও জানে।

মুনা আমাকে দেখেই বললো “আপনি মানুষটা সুবিধার না। আপনার আসার কথা ছিল কয়টায়? নয়টায় না? আর এখন কয়টা বাজে? আব্বা আম্মাও ঘুমিয়ে গেছেন অপেক্ষা করতে করতে।” আমি একটু সময় নিয়ে বললাম “আপনার নিশ্চয় অপেক্ষা ব্যাপারটার সাথে পরিচয় এই প্রথম। এই প্রথম কারো জন্য অপেক্ষা করলেন?” আমি বুঝতে পারলাম আমার কথাটা ভালো ভাবে নেয়নি মুনা। মুনা দরজার ভিতরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় এইটুকুই বললো টেবিলে সব কিছু দেওয়া আছে।চলুন খেয়ে নিবেন।রাত কম হয়নি। এমনিতে খাবার অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। না হয় আবার গরম করতে হবে।” যখন টেবিলে বসলাম মুনা প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে ভিতরে চলে যায় আর বলে যায় “খাওয়া শেষ হলে আমাকে ডাক দিয়েন।”

আজকে মুনাদের বাসায় মিলাদ পড়িয়েছিল। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল। মুনা অনেক জোর করেই বলেছিল আসতেই হবে।আজাদ চাচাকে সেদিন বাসায় দিয়ে আসার পর ব্যাপারটা ওখানেই সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানে সমাপ্ত না হয়ে পরিচয়টা আরো লম্বা করেছিল যদি না মুনার সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হতো বই মেলায়। আমি হাটছিলাম আর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম কি কেনা যায়। হঠাৎ করেই একজন মিডিয়ার লোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল “এবারের বই মেলাটা আপনার কাছে কেমন মনে হচ্ছে? আর আপনি কি কি বই কিনতে আসছেন?” হুট করে এসে এমন করে প্রশ্ন করবে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি।পরে আমি ভেবে শুধু বলেছিলাম “মেলার পরিবেশটা ভালোই। দেখি কি কেনা যায়।এখন তো যে পারে সেই লিখে। দু চারটা গল্প কবিতা লিখলো তারপর বই বের করে ফেললো।লেখক আর কবি হওয়া এতো সোজা না। এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার।” এরপর আমাকে যখন বললো “গল্প পড়তে বেশি পছন্দ করেন নাকি কবিতা?” আমি ব্যাটার কাছ থেকে পালাতে চাইছিলাম আর কি না কি প্রশ্ন করে বসে। আমি উনার চোখ বরাবর তাকিয়ে সরাসরিই বলেছিলাম “ভাই অনেক চাপ আসছে।বড় ধরনের চাপ।চাপ সাইড়া আইসা উত্তর দিচ্ছি। বলতে পারেন টয়লেটটা কোনদিকে? মেলায় কি কোন টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে?” কিন্তু মিডিয়ার মানুষের সামনে থেকে রেহাই পাওয়া অনেক কঠিন আমি জানতাম।পালাতে পারিনি।আমি উত্তর দিলাম “দুটোই পছন্দ।যখন যেটা মন চায় পড়ি।” এরপর আমাকে একটা কবিতার কিছু লাইন শোনাতে বলে।আমি বলতে পারছিলাম না “ভাইজান আর লজ্জা দিয়েন না।আমি তেমন একটা গল্প কবিতা পড়িই না।খুব কম পড়ি। বই মেলায় আসলে শুধু আমাকে না, কাউকে কাউকে প্রশ্ন করলে এমনিতেই বলবে “অনেক অনেক বই পড়ি।কিন্তু ফেসবুকে ওদের মধ্যে এই কাউকে কাউকে একটা লেখায় ম্যানশন করলে বলবে “হায় আল্লাহ এতো বড় লেখা পড়বে কে? পড়ার সময় নাই।” আমি তেমন একজন। কিন্তু আমি এসব না বলে ভদ্র ভাবেই আমার পছন্দের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা বললাম…

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি
তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কি মানুষজন্ম?
নাকি শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা!
প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে,
হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত;
আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি-
তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে…

এই কবিতা বলেই মিডিয়ার লোকের কাছ থেকে পালাতে পেরেছিলাম ঠিকি কিন্তু তৎক্ষনাত মুনা আমার সামনে এসে বললো “আপনি তো দেখছি খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। আমি সব শুনেছি। রসিকতাও করতে পারেন বটে। আপনি মানুষটা একটু আলাদা টাইপের আছেন। দেখলে কিন্তু তেমন একটা বুঝা যায় না।” সেই থেকেই মুনার সাথে আমার পরিচয়টা বাড়তে বাড়তে এই অব্দি পৌছালো।

আমি শহরটার দিকে তাকাই। সন্ধ্যার পর এই শহরটা সাজার মাঝে ব্যাস্ত থাকে।তার সাজসজ্জায় ঢাকার এই সৌন্দর্যে নিজেকে এখন অনেকটা ক্ষুদ্র মনে হয়। বাসায় পৌছে আমি বুঝতে পারলাম আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমি দীবার কথা ভাবি।আমি বুঝি না যখনি আমার খারাপ লাগে তখনি খুব বেশি দীবার কথা মনে পড়ে।দীবা আমার থেকে বিদায় নিয়েছে চার বছর হয়ে গেলো। দীবা যেদিন আমার থেকে বিদায় নিবে তার ঠিক দুদিন আগে আমাকে বলেছিল “একটা কথা রাখবেন?” আমি শুধু “হুম” করে একটা শব্দ করেছিলাম।দীবা আরো কিছুক্ষন সময় চুপ করে ছিল। তারপর আমাকে ইতস্ততার সহিত বললো “আজকে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? বুকে নিয়ে ঘুমাবেন?” আমি কিছুই বুঝতে পারিনি কেন দীবা এমন করে বললো।আমি বলেছিলাম “অনেক খারাপ লাগছে? আমাকে বলো। খারাপ লাগছে কি অনেক?” দীবা কান্না করে দিয়ে বলেছিল “বলেন নাহ, আমাকে আজকে একটু জড়িয়ে নিবেন? বুকে নিয়ে ঘুমাবেন?” আমি সাথে সাথেই ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম।আমার তখন মনে হয়েছিল সমগ্র দুনিয়া একদিকে আর ও একদিকে। আমি বলেতে চাইলাম “দীবা এই কয়েক মাসে তুমি আমার ভিতর কেমন টগবগে ভালোবাসা জন্ম দিয়েছো তা তুমি হয়তো জানো না।আমি মানুষটাকে একা রেখে কোথাও যেও না।” দীবা আমাকে জড়িয়ে থেকেই বলছিল “জানেন আমি বার বার হেরে যাচ্ছি।আমি দিন দিন নিজের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি।আমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছি।এই বিশাল একটা পৃথিবীর মাঝে আমি অনেক ক্ষুদ্র একটা মানুষ। এই ক্ষুদ্র মানুষটা এই পৃথিবীর বিশালত্ব থেকে আড়াল হলে পৃথিবীর কি কোন ক্ষতি হবে বলুন? আমি অনেক আগেই পচে গেছি। আপনাকে ভালোবাসা দেওয়ার মত কিছু নেই। আমার খুব খারাপ লাগে। কেন এমন করে ভালোবাসতে গেলেন আমায়?” দীবার কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে আসছিল। কিন্তু আমি ওর মত শব্দ করে কাঁদতে পারছিলাম না।আমি শুধু বলেছিলাম “তুমি ক্ষুদ্রই থাকো।আমার বিশালতা দরকার নেই। তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার খারাপ লাগে।একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।তুমি দেইখো।”

কিন্তু ঠিক হয়নি। কিছুই ঠিক হয়নি।তার ঠিক দুদিন পর দীবা আত্মহত্যা করলো।আত্মহত্যা করার আগে আমাকে শুধু এইটুকুই লিখে গিয়েছিল “আপনাকে ঠিক মত ভালোবাসাটাও দিতে পারলাম না। মাফ করবেন” আমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। কান্না করতাম আর শুধু বলতাম আমায় একা করলে কেন? একা করলে কেন? আমি মাফ করবো না তোমায়।” আমি যদি জানতাম ও এমন করে হারিয়ে যাবে আল্লাহর কসম আমি ওকে মরতে দিতাম না। আমার ভালোবাসাটা খুব দরকার ছিল কি? তার থেকে হাজার গুন দরকার ছিল তোমাকে। অন্তত আমার চোখে চোখে তোমাকে রাখতে পারতাম। যখন ইচ্ছা হতো আমি কাচুমচু করে একটু কথা বলতে পারতাম। তোমার চুল কানে গুজে দিতে পারতাম ঘুমের মাঝে। এর বেশি কি চাওয়া ছিল আমার? আমার কষ্ট পায় খুব কষ্ট পায়।আমি কেমন একটা মানুষ? একটা মানুষকে নিজের কাছে বন্ধি করার ক্ষমতা রাখি না। যোগ্যতা রাখি না।ছিহ।

তিন

মা সারা রাত ধরে আমার পাশে বসে জেগে ছিল। দুইটা দিন ধরে আমার কি জ্বর। আমি জ্বরে চোখ মেলতে পারছিলাম না। এখন একটু একটু মেলতে পারছি। মা আমার মাথায় পানি ঢেলে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে বলে “ও বাবা কি হইলো তোর। আমার সোনা মানিক, জাদু সোনা। মায়ের বুঝি চিন্তা হয় না? তোরে আমি আবার বিয়ে দিবনে, মনের রোগ একদম ঠিক হয়ে যাইবে।” আমি মায়ের হাত শক্ত করে আগলে ধরে রাখি। বললাম “মা আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। শহরটা কেমন যেন। যেদিকে তাকাই আর নিশ্বাস ফেলি সব কিছুতে অবসাদ। তাই মাঝে মাঝে বাবা আর তোমার কাছে চলে আসি। ভালো করি না? তোমাদের কাছে যতদিন থাকি ততদিন শান্তি লাগে। এই যে এখন আগলে ধরে রাখছি মনে হচ্ছে বুকের মাঝ থেকে একটা বড় পাথর নাই হয়ে গেছে।” মা আমার চোখের পাতায় দুইটা চুমু খায় আর বলে “আল্লাহ আমার ছেলেটার সব জ্বর আমারে দিয়া দাও গো। ও বাবা এতো কষ্ট ক্যান তোর বুকের মাইঝে? কষ্ট পালন ভালো না আব্বু। বুকের মাইঝে থেইকে এগুলা ঝাইড়ে ফেলে দিতে হয় তুই জানিস নে?” আমি কিছু বলি না। বুবু আত্মহত্যা করার পর থেকেই মা আমাকে নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করে। একা করতো না। তারপর এই আমি কেমন করে বড় হয়ে পড়ালেখার জন্য শহরে চলে গেলাম। তারপর চাকরি নেওয়ার আগে গ্রামে এসে বিয়ে করেছিলাম দীবাকে। জীবনে এতো কিছু ঘটে যাবে কে জানতো?

সন্ধ্যার নাগাত মুনা আমাকে ফোন করে বললো “আপনি আমাকে সেদিন এমন করে কেন বললেন? অপেক্ষা বিষয়টা নিয়ে আপনি কতটুকু বুঝেন?” আমি বাড়ির উঠোনে বসে দুইটা কাশি দিয়ে বললাম “আমাদের এখানে সন্ধ্যার পর থেকেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়।আর ঢাকার শহরটা আলোর শহর তাই না? কয়েকদিন ধরে আমি অসুস্থ ছিলাম। এখন ভালো আছি। উঠোনে বসে সন্ধ্যার আকাশ দেখি।সেদিন কথাটা বলে আমি কষ্ট দিয়েছি তাই তো? আপনারও কি আমার মত কষ্ট আছে? মা প্রায় বলে কষ্ট নিজের কাছে রাখতে নেই। আচ্ছা বলুন তো কে চায় কষ্ট নিজের কাছে রাখতে? কিন্তু কষ্টরা তো মানুষের মনে বাস করে। এটাই তো তাদের থাকার স্থান। ওখানে না থাকলে তারা কোথায় থাকবে? মা এটা বুঝে না বুঝলেন।আমার মা একটু বোকা আছে।” মুনা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “আপনি এমন করে কথা বলা কোথায় শিখছেন? আমি ভাবছিলাম ফোন করে আপনাকে কিছুক্ষন ঝাড়বো আমাকে সেদিন মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা আর হলো কই? এমন করে কথা বলে আমাকে ইমোশনাল করে ফেলেছেন।এমন আবেগ দিয়ে আর কথা বলবেন না। বুকের মাঝে অনেক লাগে।”

আমি মুনাকে বললাম “কেমন একটা ঝড় আমার মনের মাঝে বইছে আপনাকে তো সবই বলা হয়েছে পরিচয় হওয়ার পর।কিন্তু আপনার মনের ঝড়ের কথা তো কখনো বলেননি।সেদিন যখন রুমের ভিতরে চলে গেলেন তখনি আমি বুঝতে পেরেছিলাম।এতো ঝড় নিয়ে হাসিখুশি থাকেন কি করে? আমি তো পারি না। একটু হলেই ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে দেই।আমি জানি ছেলেদের কান্না করা ভালো না।কিন্তু নিজের চোখকে বুঝাতে পারি না।হারামজাদা চোখ দুইটা খালি পানি ঝড়াতে আনন্দ পায়।”

মুনা আরো একটু সময় নিল তারপর বললো “লোভ কতটা বিধস্ত করে দেয় আমি বুঝতাম না। আমার মনে লোভ হয়েছিল।ভালোবাসার লোভ।অর্ককে আমি খুব চাইতাম।আসলে আমি অন্য রকম হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা মেয়ে বলেই কি এমন চাওয়াটা মনে তৈরি হতে পারে না?জানেন আমাদের পরিচয়টা অনেক পুরানো। কলেজের শুরু থেকে।আমি দেখতে তেমন একটা সুন্দর না। তারউপর আমার ভিতরে সব সময় একটা বিষয় কাজ করতো। কে আমি? আমার আসল পরিচয়টা কি? আমি খুব চাইতাম কারো কবিতা হতে। কেউ আমার জন্য কবিতা লিখুক। কিন্তু কি অদ্ভুত এমন কোন কিছুই অর্কের মাঝে ছিল না। ও শুধু মানুষকে হাসাতো। স্পষ্ট করে বললে খুব মিশুক ছিল। হয়তো এটার জন্যই ওর প্রতি আমার একটা দুর্বলতা কাজ করতো।

তারপর কি হলো জানি না। আমি নিজেই ওর সাথে গিয়ে কথা বলতাম।একদিন অর্ক হঠাৎ করে বললো “এই তোমার লক্ষণ ভালো না। তুমি কি আমার প্রেমে পড়ছো?” জানেন আমার সেদিন খুব লজ্জা লাগছিল। আবার ভালোও লাগছিল। এই যে ব্যাপারটা ও অনুমান করতে পেরেছিল। আমি শুধু বলেছিলাম “আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই তোমার মত লাগাম ছাড়া ছেলের প্রেমে পড়তে যাবো? ছাগল।” ও কোন খাবারটা খেতে পছন্দ করতো তা নোট করে রাখতাম।আমি শিখতে চেষ্টা করতাম। আসলে আমাদের মাঝে ভালোবাসার বিষয় নিয়ে কখনো কথা হয়নি। কিন্তু আমরা খুব কাছের ছিলাম। একে অপরের চাওয়া গুলো বুঝতাম। ওর জন্য অপেক্ষা করতাম কখন ছুটির পর একটু কথা বলতে পারবো। একসাথে হেটে যেতে পারবো। কিন্তু আমার ভয় লাগতো অন্য কিছুতে। বিশ্বাস করেন আমার ভিতরে ওর জন্য এতো অনুভূতি হতো এটা আমি নিজেও প্রথমে বুঝতাম না।তারপর এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির সামনে এসে আমাকে ফোন করে বললো “তোমাকে ভিজাতে আসছি।তোমার ভেজা চোখ গুলোয় ছুয়ে দিতে আসছি।” আমি খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম “বেশরম, দুইটা বছর ধরে তোমার সাথে আছি। ভালোবাসার কথা বলতে পারো না আর আমাকে ভিজাতে আসছো?”

সেদিন ওর সাথে আমি খুব ভিজেছিলাম। এই শহর দেখেছিল। শহরের সন্ধ্যার আকাশটা দেখেছিল।এই সন্ধ্যার আকাশকে স্বাক্ষী রেখে আমি আমার কথা বলেছিলাম। আমি কে? আমার কি পরচয়।” জানেন এর পর কি যেন একটা হলো। ও কেমন যেন বদলে গেলো।আমার সাথে ঠিক মত কথাও বলতো না।আমার ভীষন খারাপ লাগতো। আমি কান্না করতাম। ভাবতাম যে আমাকে জন্ম দিল সে আমাকে তখনি মেরে ফেললো না কেন? আমার তো কোন দোষ ছিল না। বলুন ছিল? একটা কথা কি মানুষ গুলো খুব ভয়াবহ। প্রথমে ভালো লাগা, ভালোবাসা দেখায়। তারপর একটা সময় শুরু হয় অবহেলা, অবজ্ঞা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এসব আমার জন্য না। এরপর থেকে আমি আর এসব ভাবিনি। একটু আগে বললেন না কষ্ট মনে বাস করে। সত্যিই তাই। এগুলো মনে পড়লে খারাপ লাগে।”

মুনাকে আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। মুনার মত দীবাও এই কথাটা আমাকে বলেছিল “এ পৃথিবীর মানুষ গুলো খুবই ভয়াবহ। প্রথমে ভালোবাসা দেখায় তারপর শুরু হয় অবহেলা, অবজ্ঞা করার। এমন কেন মানুষ গুলা?” আমার হঠাৎ করে খারাপ লাগা শুরু হলো। আমি মুনাকে বললাম “পরে কথা বলি হ্যাঁ?” আমি লাইনটা কেটে দেই। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।

চার

জুনায়েদ সাহেব আস্তে আস্তে চোখ মেলে ব্যথায় বলতে লাগলো “উফ, আমাকে এইভাবে কে মারলো? আমার চশমাটা কোথায়?কে আমাকে এই ভাবে বেধেছে?” এটা বলেই জুনায়েদ সাহেব বমি করে দিল।” আমি ফ্রিজ থেকে পানির বোতল এনে উনার মুখের ভিতর দিয়ে বললাম “নেন স্যার পানি দিয়ে গড়গড় করেন তারপর খেয়ে নেন।আপনাকে যে এখন একটু সুস্থ হতে হবে। পুরানো হিসেব নিয়ে বসতে হবে।বহুবছর পর আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি।” তারপর চশমাটা আমার শার্টের কোনা দিয়ে মুছে উনার চোখে পরিয়ে বললাম “এতো বছর পর দেশের কথা মনে পড়ছে স্যার?” পানি খেতে খেতে সে আমার দিকে ভালো করে দেখলো তারপর বললো “কিসের হিসেব? কে আপনি? আমি আপনার কি ক্ষতি করলাম? আমার সাথে কেন এমন করছেন? খুব অভদ্রতা হচ্ছে। আমি পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করবো।”

আমি ওর কাধে হাত রেখে কপালে একটা চুমু খেয়ে বললাম “স্যার আপনি আসলেই একটা বান্দিরপুত। এতো অস্থির হলে হয়? একটু পর আমি সব মনে করিয়ে দিব।মাইন্ড খাইয়েন না, আমি পাগল টাইপের হয়ে গেলে মুখে যা আসে বলে ফেলি।তবে আমার মনটা অনেক ভালো। এই দেখেন মা দুধ চিতই পিঠা বানিয়েছে আজকে। আসার সময় আপনার জন্য নিয়ে আসছি। আমার মা কিন্তু ভালো পিঠা বানায়। এখন বলেন আমি ভালো ছেলে না? ভালো ছেলেদের জন্য কি কেউ কমপ্লেইন করে? কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম তাই দেখা করতে দেরি হয়ে গেলো। খুব স্যরি।”

আমার কথা শুনে ওর চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে গেলো। আমি বুঝলাম সে ভয় পেয়েছে। ভয়ে ভয়েই বললো “আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। আপনার কত টাকা লাগবে বলেন। আমি আপনাকে দিব। আমাকে ছেড়ে দেন।” আমি হেসে দিয়ে বললাম “আমি হিসেবের খাতায় হিসেব মিলাতে আসছি। আপনি ছাড়া হিসেবটা মিলাতে একদম পারছিনা। এতো বছর মাথাটা গোলমাল হয়ে গিয়েছে। অসমাপ্ত হিসেব নিয়ে কেমন করে দিন কেটেছে এক আল্লাহ ভালো জানেন। টাকার জন্য আসি নাই গো স্যার।” এটা বলার পর এবার একটু রাগ করে জোরেই বললাম “তোর অনেক টাকা হইছে না? তোর টাকায় আমি মুতি মাদারচোদ। অনেক বছর আগে বিন্তি নামের একজনের সাথে প্রেম ভালোবাসা ছিল তোর মনে আছে? মেয়েটা তো তোরে অনেক ভালোবাসতো।মেয়েটার সাথে শেষে এমন করলি ক্যান? আমি সেই মেয়েটার একমাত্র ছোট ভাই। আদরের ভাই। আমার বোনটা আমারে শুভু বইলা ডাকতো। এখন আমি আর শুভু ডাকটা শুনি না। আমার ভিতরটা ফাইটা যাইরে।আমার বোনটা তোরে ভালোবাইসা কোন পাপ করছিল শুয়রের বাচ্চা? আজকে তোরে আমি মারমু। কুচি কুচি করমু। আমারে একটু ভয় কর। আমার বোনের আত্মহত্যার পর তুই দেশ ছাইড়া চলে গেছিলি। কত খুঁজছি আমি তুরে।এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলামরে।” এটা বলেই ওর বুকে একটা লাথি দেই। সে চেয়ারসহ মেঝেতে পড়ে কুকড়াতে কুকাড়াতে বলতে লাগলো “তোমাকে আমি আজকে একটা কথা বলবো। তার আগে আমাকে ছাড়ো। তোমার বোন আত্মহত্যা করে নাই।হ্যাঁ আমার ভুল হয়েছে তোমার বোনকে এড়িয়ে চলাতে।আমাকে ছাড়ো তারপর সব বলছি।”

খুব রাতে আমি বাবাকে নিয়ে আম গাছটার সামনে এসে বসে থাকি। জুনায়েদকে আমি মেরেছি তিন চারঘন্টা হয়ে যাবে। আমার ভিতরটা ধক ধক করছে। শরীর কাঁপছে।বাবা আমাকে বলে এতো রাতে তুই আমাকে এখানে নিয়ে আসলি কেন?” আমি কোন উত্তর দেই না। বাবার দিকে তাকিয়ে কান্না করতে থাকি। তারপর বলি “এই গাছটার কথা মনে আছে বাবা? এই গাছটা এখনো মরে নাই। তবুও এই গাছটাকে আমি মৃত গাছ বলি।এই গাছটায় আমার বোনটা গলায় ফাঁস দিয়েছিল না?” বাবা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। আমি কান্না করতে করতে বলি “এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না বাবা। আমি প্রথম যখন স্কুলে গেলাম আমি অনেক কান্না করেছিলাম। মোটা একটা টিচার ছিল আমার খুব ভয় লাগছিল। আমি ক্লাসে কান্না করে দিয়েছিলাম। বার বার বলছিলাম বাড়িত যাবো। এরপর বুবু আমারে প্রতিদিন দুইটা করে চকলেট দিতো যেন কান্না না করি। আমার বুবু তো বিড়ালের কাছে যেতেও ভয় পেতো। আমার এই ভালো বুবুটা কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিল নাকি হত্যা করা হয়েছিল ও বাবা? তুমি মারছিলা না আমার বুবুটারে? তোমার হাত কাঁপে নাই? ক্যান গো বাবা, ও বাবা ক্যান এমন করলা?” আমার বাবা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আমাকে বলে “তুই পাগল হইছিস? তুই কি ছাইপাস খাওয়া শুরু করছোস?” আমি বসে থেকেই নিচের দিকে তাকিয়েই বললাম “বুবু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর তুমি বুবুরে নিয়ে জুনায়েদের কাছে গেছিলা এবং জুনায়েদের বাবা মায়ের কাছেও গেছিলা। তারা সব কিছু অস্বিকার করেছিল। আমরা গরীব বলে তাদের কাছে দাম পাই নাই। তুমি কি করবা ভেবে না পেয়ে সমাজের সামনে কিভাবে মুখ দেখাবে? কাকে কি বলবে এসব ভেবে বুবুরে মেরে এই গাছটায় ঝুলিয়ে দিছিলা তাই না বাবা? সব সমাধান হয়ে গিয়েছিলো? মা আজো এই ব্যাপারটা জানে না। আমি মাকে কিছু বলি নাই। আমার মা মইরা যাবে গো বাবা এসব জানলে।” আমার বাবা দু কদম পিছনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে। তারপর কিছুক্ষন ঝিম মেরে থেকে কান্না করতে থাকে। আমি কান্না করতে করতেই বললাম “জুনায়েদকে আমি তার শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে?” এটা বলেই আমি উঠে চলে আসি। আমার এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।

খুব সকাল বেলা খবর পেলাম আমার বাবা গলায় ফাঁসি খেয়েছে। মা আমার কাছে এসে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকে। আর বলতে থাকে “এই আমার কি হইলো? তার কি এমন দুঃখ ছিল আল্লাগো। এই তুমি আমার কি করলা? ও শোভন তোর বাপের এমন কি কষ্ট ছিল বাজান। ও বাজান আমারে বুঝা। আমি তো শেষ হইয়া গেলামরে।” আমার চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝড়তে থাকে। সারা রাত আমি কেঁদেছি। এতো পানি এই চোখ দিয়ে কেমন করে আসে আমি জানি না।মাকে কিছু বলার ক্ষমতাও আমার নেই। বাবা কি ফাঁসি খেয়ে ভালো করেছে? এই যে আমি ব্যাপারটা জানতে পেরেছি বাবা কি এই মুখটা আমার কাছে দেখাতে পারতো? পারতো কি? আমি মাকে কেমন করে বলবো এসব কথা? এই অবসাদের জীবন আমার আর ভালো লাগে না।

পরিশিষ্ট

ট্রেনে উঠার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সাজিদের মুখে দেওয়া সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললাম “ভাইজান ট্রেনে উঠেই আপনার সাথে পরিচয় হলো। আমার ভয় লাগছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি সাহায্য করলে ভয়ের বাপও আমারে কিছু করতে পারবে না। আপনারে কেন যেন আপন মনে হয়েছে তাই সব কিছু শেয়ার করে ফেলছি। ব্রাক্ষণবাড়িয়া এই নিয়ে চারবার আসছি। প্রেমিকার সাথে দেখা করতে। কিন্তু এবার যাচ্ছি প্রেমিকাকে ভাগাতে। ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। মনে সাহস পাচ্ছি না কিভাবে কি করবো।যদি ধরা পড়ে যাই?” সাজিদ সিগারেটে দুইটা টান দিয়ে হেসে বলে “দুর মিয়া হাসাইলা। প্রেম করছো আর এতো ভয় পেলে চলবো? জীবনে কত মেয়েরে ভাগাইছি।কিন্তু এখন এসব ছেড়ে দিছি। শেষ যারে নিয়ে ভাগছিলাম তারে সত্যি ভালোবাসতাম। কিন্তু পরে বুঝলাম আমরা আসলে কেউ কারো জন্য না। আমরা একে অপরকে বুঝতাম। কিন্তু কি যেন একটা মিলছো না আমাদের মাঝে। পরে আমি ওর জীবন থেকে সরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ও আমাকে ছাড়তে চায়নি। আমার জন্য সব করছিল। ওর পরিবার ছাড়ছিল। ওর বিয়েও হয়েছিল এরপর। কিন্তু শুনছি ও আত্মহত্যা করছিল। একটু খারাপ লাগে। যাক তুমি যখন এই সাজিদের কাছে হেল্প চাইছো আর চিন্তা করতে হবে না।তবে একটা কথা আমি হেল্প করে দিব।ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ছেলে আমি। চা নাস্তার পয়সা এই ধরো তিন চার হাজার টাকা দিলেই হবে। ব্রাক্ষণাবাড়িয়ার মানুষ খুব ডেঞ্জারাস।বুঝোই তো এখনকার যুগ ভালো না। মানুষও ভালো না। হাজারে দুই তিনটা পাবা সৎ মানুষ।

আমি ওর দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকি। ট্রেন চলতে থাকে। আমি বললাম “জ্বি ভাইজান ঠিক বলেছেন।এখনকার মানুষও ভালো তেমন। সবাই একটা মুখোশ পরে থাকে। কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।এই দেশটাতে এখন শুয়োরে ভরে গেছে।” এটা বলেই সাজিদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে আমি একটা টান দিয়ে আকাশে ফু করে ছেড়ে দেই। সিগারেট খাওয়ার আমার অভ্যাস নেই। একটা টান দিতেই খক খক করে কাশতে লাগলাম। ট্রেনটা নদীর কাছে চলে আসে। চারপাশে রাত্রির কালো ছায়া। এবার আমি খুব গম্ভীর হয়ে ওর কাধে হাত রেখে বললাম “ভয়ংকর অন্ধকার ধেয়ে আসছে ভাইজান।হে হে একটু সহজ করে বলি ভালো করে বুঝেন।ঘুম আসলে সব অন্ধকার অন্ধকার লাগে।ঠিক?” সাজিদ আমার দিকে কেমন করে তাকায়। সে নিশ্চয় অবাক হয়েছে ওর কাধে হাত রেখে হঠাৎ এমন করে বলবো বলে। আমি এবার আরো গম্ভীর হয়ে বললাম “একটু আগে না বললাম মানুষগুলো মুখোশ পরে থাকে। কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। আমার কথা গুলো কি বিশ্বাস করার মত ছিল ভাইজান? আপনার মানুষটার নাম দীবা ছিল না?”

সে থতমত খেয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। আমি কাশতে কাশতে সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে বললাম “উহু চুদুর বুদুর করে লাভ নাই। এখন আমি আপনাকে ঘুম পারায় দিব ভাইজান।আপনার অনেক ঘুমের প্রয়োজন। আপনার চোখ কেমন লাল হয়ে আছে আমি বুঝতে পারছি। অনেক ঘুম আপনার চোখে।” এটা বলার পর চোখ বড় বড় করে বললাম “আমি দীবার স্বামী, শুয়রের বাচ্চা। তোরে আমি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছিরে। এতো কষ্ট ক্যান দিলি মেয়েটারে, মাদারচোদ।” তারপরই পিঠের পিছন থেকে ছুরি নিয়ে গলায় একটা টান দিয়েই একটা লাথি দিয়ে ওরে নদীতে ফেলে আমি ট্রেনের মেঝে বসে পড়ি আর কাঁদতে থাকি। আমি অনেক ক্লান্ত। এই অবসাদের জীবনে আমি আসলেই ক্লান্ত। আকাশে থাকা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকি। পাগলের মত সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে আকাশে ধোয়া ছেড়ে হাসতে হাসতেই আর্টসেলের গান গাইতে থাকলাম…

তোমাদের পাথর বাগানের সবুজ ঘাসে
মিশে থাকে কত যুগের নষ্ট গল্প
যত পতাকার রং ধুয়ে যায় অভিশাপে
আকাশের সাদা অনুভূতিতে শুধু ঘৃণা…

তার কিছুক্ষন পর আমার কেন যেন মনে হলো মুনাকে ফোন করা দরকার। ফোন করেই আমি ঝিম মেরে থাকলাম। মুনা আমাকে বলতে লাগলো “কি হলো ফোন করে চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন। ট্রেনের শব্দ কেন? আপনি এখন কোথায়?” আমি এই কথার প্রতিভাষ না দিয়ে বললাম “মুনা, জীবনজুড়ে এই মানুষ গুলোকে স্বাভাবিক মনে হলেও মানুষগুলো স্বাভাবিক থাকে না।আমরা মানুষ গুলো ভিন্ন। কষ্ট গুলোও ভিন্ন। জীবনের স্রোত কাটিয়ে যখন মানুষ গুলো নীল আকাশটা দেখতে পায় তখন মনে হয় আঘাত শুকিয়ে গেছে। আসলে কি আঘাত শুকিয়ে যায়? আমার এখন তাই মনে হচ্ছে। জানেন আমি অনেক ক্লান্ত। আমি আপনার কাছে একটু আসি? অপেক্ষা করতে খারাপ লাগবে না তো?” মুনা চুপ করে থাকে। অনেকক্ষন পর বলে “নতুন করে অপেক্ষা করতে বলছেন?” আমি আবারো এই কথার উত্তর দেই না। শুধু তাকে বললাম “আকাশের রুপালি চাঁদটা একা দেখতে ভালো লাগছে না। একটু দেরি হলেও অপেক্ষা করুন আমি আসছি…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত