শফিক সাহেব করোনা ভাইরাস আর দেশের সার্বিক অবস্থা চিন্তা করে, চার বস্তা চাল, এক বস্তা ডাল, পাঁচ লিটার তেলের দশ-টা ক্যান, আলু বড় এক বস্তা,আটা, ময়দা মিলে বিশ প্যাকেট। এভাবে যতটুকু সম্ভব নিত্য প্রয়োজীয় জিনিস কিনে স্টোর করেছেন, তার বাসার নীচ তলার গ্যারেজের পাশের ছোট রুমটাতে। শফিক সাহেব সব সময়ই আগাম বিপদ বুঝে চলে। তার জিনিস পত্র কেনা দেখে তার স্ত্রী রাহেলা বেগম বলছিলো কি বিষয়, বাজারের সব জিনিস একাই কিনে ফেলবেন নাকি? শফিক সাহেব রাহেলা কে মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলো, আমি তো কম’ই কিনছি অনেকে তো নিজের জন্য কিনছে, আবার বিজনেসের জন্যও কিনছে,তারপর বেশি দাম বাড়লে বিক্রি করে দিবে সেই কারনেও মজুত করছে। রাহেলা তখন বলল, তারা তো ব্যবসায়ী তারা ব্যবসার জন্য কিনছে, আপনি কেন এত কিছু মজুত করবেন? এমন করে সবাই কিনলে’তো দাম আপনেই বাড়বো। আর তখন গরীব মানুষ গুলা কি না খাইয়া মরবো নাকি? শফিক সাহেব তখন বলল তোমার না খেয়ে মারতে যাতে না হয়, তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। সামনে রোজার মাস এমনিতেই জিনিস- পত্রের দাম বেশি থাকবে।
শফিক সাহেবের দুই ছেলে, বড় ছেলে পড়াশোনায় মনোযোগী সব সময় ভালো রেজাল্ট করে। আর ছোট ছেলে কোন রকমে এইচ এইচ সি পাশ করে করে এবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করানো হয় নাই। তাতেও ছেলে খুবই খুশি,করন ছেলের রেজাল্ট দেখে শফিক সাহেব ছেলেকে আর পড়তে হবে না বলেছিলো, আর বলেছিলো এখন থেকে আমার বিজনেস দেখবে।
শফিক সাহেবের বড় ছেলের অনেক আদর বাসায়, ছেলে যখন যা চায় পায় দামি মোবাইল, দামি ল্যাপটপ,কারন একটাই ছেলেটাকে কখনো পড়ালেখার জন্য বলতে হয় না। এত পড়ালেখায় মনোযোগ আর সব সময় রেজাল্ট ভালো করে। সবাই ছেলের প্রসংসা করে। ছলেটা পাড়ার কোন ছেলে পুলেদের সাথে মিশে না। ওর স্কুলে কলেজের পড়াশোনায় ভালো এমন দুই একটা ছেলের সাথে মেশে।
করোনা ভাইরাসের জন্য সব কিছু লক ডাউন হয়ে গেছে। এখন সবাই বাসায় থাকে। বড় ছেলের জন্য ভয় নাই সে কোথাও যাবে না। ছোট টা নিয়ে যত ভয় দেখা গেলো রাস্তায় যেয়ে আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে। শফিক সাহেব তার স্ত্রী রাহেলা কে বলে দেয়, তোমার ছোট ছেলে কে বলবা, বাসার বাহিরে যদি একবারের জন্যও যায়, তবে বাসার বাহিরেরই থাকতে হবে। করোনা কোন ছেলেখেলা না, করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বাসায় থাকা।
রাহেলা বেগমের ছোট ছেলে দু’ দিন থেকে মায়ের সাথে রান্না ঘরের কাজে টুকটাক সাহায্য করে, রাহেলা বেগম হাসে আর ছেলেকে বলে ঘরেই থাক বাবা। ছেলেটা সারাক্ষণ শুধু সংসারের খবর নেয়, জানতে চায় একটা চার জনের সংসারে কত টাকার বাজার লাগে পনেরো দিনের জন্য। ছেলের বেশির ভাগ কথা চাল-ডালের হিসাব নিয়ে। রাহেলা বেগম হেঁসে বলে আমাদের বাসায় যে বাজার করে রেখেছে তোর বাবা, তাতে এমন লক ডাউন ছয় মাস থাকলেও না খেয়ে থাকবি না।
পরের দিন সকাল বেলা শফিক সাহেব দেখতে পায় তার বাসার সদর দরজায় একটা ভ্যান গাড়ি দাঁড়ানো আর তিনটা ছেলে সাথে দুইটা মেয়ে ও দাঁড়ানো। ছেলে আর মেয়ে গুলোর সবাই মুখে মাস্ক পড়া হ্যানড গ্লাভস পড়া ওরা শফিক সাহেবের নীচ তলার গোডাউন থেকে, একটা একটা করে বাজারের ব্যাগের প্যাকেট নিয়ে ভ্যানে রাখছে। শফিক সাহেব কে হঠাৎ দেখতে পেয়ে মেয়ে দু’টো পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। আর বলল আংকেল আপনার মতো মানুষ গুলো আছে বলেই আমাদের দেশের একটা মানুষও না খেয়ে থাকবে না। আংকেল রাফির কত ভাগ্য আপনার মতো একজন মহান মানুষের ছেলে রাফি।
শফিক সাহেব ওদের কিছু বলল না। শুধু বলল খুবই সাবধানে থাকবে। কত প্যাকেট হয়েছে? রাফি এবার আস্তে করে বলল বাবা আপাততঃ ত্রিশ প্যাকেট, ত্রিশটা পরিবার কে দিবো আমরা। আমরা যে সাহায্যের জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি সেখান থেকে যে টাকাটা উঠেছে তা দিয়ে, আর তোমার সাহায্যেের কথা শুনে তোমার, দেখা – দেখি আমাদের পড়ার অনেক বাসা থেকে আমাদের জন্য চাল- ডাল টাকা রাখা আছে আমরা বলেছি সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী যে যা পারবে আমাদের বাসার নীচে রেখে যাবে। আমরা তা প্যাকেট করবো তার পর যাদের ঘরে খাবার থাকবে না তাদের কে দিবো। আমরা পাঁচ জনে ১০০ খেটে খাওয়া পরিবার কে সাত দিনের খাবার পৌঁছে দিবো। খাবার নিতে আসলে অনেক মানুষের ভির হবে তখন করোনা ছড়িয়ে যাবে। আমরা সাবধানে কাজ করবো। বাবা আমরা সব নিয়ম মেনে কাজ করবো।
শফিক সাহেব আস্তে আস্তে উপরে চলে আসলো। ঘরে গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লো,রেহারা ভয়ে ভয়ে শফিক সাহেবের কাছে বসলো আর বলল তুমি চিন্তা করো না আমাদের খাবারের অভাব হবে না, আমি ঠিক ম্যনেজ করে ফেলবো আর রাফি আমাদের জন্য একমাসের বাজার রেখে দিয়েছে। সব দিয়ে দিচ্ছে না।
শফিক সাহেব তখন তার স্ত্রী রেহানা বেগম কে বলল রেহানা রাফি আমার মতোই হয়েছে, আমি রাগ করি নাই, আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবলাম, ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় আমার বয়সও রাফির মতোই ছিলো। তখন আমিও সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে বন্যা কবলিত মানুষের জন্য টাকা তুলতাম, তারপর টি এস সি তে যেতাম রুটি বানানোর জন্য। সারাদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে বন্যার রিলিফের কাজ করতাম। সেই আমি এখন পাল্টে গেছি এখন শুধু আমার পরিবার নিয়ে চিন্তা করি। আজ একটাই দোয়া রাফির জন্য তা হলো রাফি যেন আমার মতো বদলে না যায়।
মানুষ মানুষের জন্য।