স্বপ্ন

স্বপ্ন

আজ বিকেলে আমার শ্বাশুড়ি মা তার ছোট মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরলেন মুখ কাল করে।
আমি বেশ অবাক হলাম, এর পূর্বে আম্মা তার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে হাসি মুখে ফিরে এসেই গর্বিত ভাবে গল্প করতেন,আমার শিলার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা খুব ভাল আমাকে অনেক যত্ন করে সম্মান করে, আর করবেই বা না কেন? আমার দুই মেয়েকে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজে কর্মেও পটু করেছি। অন্য মায়েদের মতো কোন কাজ না শিখিয়ে তো মেয়ে বিয়ে দিইনি।

আমার স্বামীরা তিন ভাইবোন শিলা আপা বড় তারপর শাকিল সবার ছোট শ্রাবণী। চার মাস শ্রাবণীর বিয়ে হয়েছে ওর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা আমাদের তুলনায় অনেক ভাল। আমার শ্বশুর আব্বা দুইবছর
পূর্বে মারা গেছেন আমি অবশ্য উনাকে দেখিনি।

শ্রাবণীর শ্বশুর বাড়ি আর আমাদের বাড়ির দুরত্ব পাঁচ মাইল। শ্রাবণীর বিয়ের পর আম্মা একবার ওর শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলেন।আজ সকালে গেলেন একদিন থাকবেন বলে কিন্তু কি এমন হলো যে আম্মা চলে এসেছেন!

ভয়ে ভয়ে আম্মার ঘরে ঢুকে দেখি আম্মা থমথমে মুখে বসে আছেন চোখ ছলছল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,আম্মা কি হয়েছে? আমাকে কি বলা যায়? আপনি মুখ কাল করে থাকলে আমার খুব খারাপ লাগে।

আমার সহানুভূতিপূর্ণ কথায় আম্মা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বললেন, আজকে শ্রাবণীর শ্বাশুড়ি আমাকে অপমান করেছে।আমি যাওয়াতে একটুও খুশি হয়নি বরং বিরক্ত হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আপনি ঈদে উপহার হিসেবে যে শাড়ি, পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন তা খুবই নিন্মমানের।এত কম দামের জামা কাপড় আমরা পরি না।

কথাটা শুনে লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল বৌমা তারপর শ্রাবণীর সম্পর্কে অনেক নালিশ করলো শ্রাবণী নাকি কোন কাজকর্ম পারে না ঠিকভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে পারে না আরও অনেক নালিশ।আমি যে তাদের বাড়ির মেহমান আমার জন্য তেমন কোন আয়োজন করেনি। ওদের রাতে বিয়ের দাওয়াত আছে তাই দুপুরে ভাল রান্না হয়নি উপস্থিত যা রান্না হয়েছে তাই খেয়েছি তাতে আমার কোন দুঃখ নেই কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে একবার ও আমাকে থাকার কথা বলল না আর শ্রাবণীর নামে এত এত বদনাম করলো! মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছ থেকে মেয়ের নামে নালিশ শোনা যে কত কষ্টের। ফেরার সময় শ্রাবণী আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল,আফসোস করে বলল,আমার মা কে সামান্য একটা ডিম ভাজা করে খাওয়াতে পারলাম না একটা রাত থেকে যেতে বলতে পারলাম না সেই সাহস এবং ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই।

শ্রাবণীর অসহায় মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠছে গো বৌমা বলতে বলতে আম্মা আবার আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরলেন।

হঠাৎ চোখ মুছে আম্মা আমার দুই হাত জড়িয়ে ধরে কাতর গলায় বললেন, শাহনাজ কাল সকালে আমি আর তুমি তোমার বাপের বাড়ি যাবো, তোমার বাবার কাছে ক্ষমা চাইবো আর উনাকে বিশেষ অনুরোধ করবো আমাদের বাড়ি যেন একটিবার আসেন।

আমার বিয়ের একবছর পর আমার বাবা আমার শ্বশুর বাড়ি এসেছিলেন আমাকে দেখতে,এর আগেও দুইবার এসেছিলেন তবে থাকেননি।আমার বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল না। বাবা এক কেজি মিষ্টি নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি আসেন তাই নিয়ে আম্মা আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন।মাত্র এক কেজি মিষ্টি নিয়ে বেয়াই কিভাবে মেয়ের বাড়িতে আসে? আমার পাড়াপ্রতিবেশির বাড়িতে তো মিষ্টি দিতে হবে এতো কম মিষ্টি কিভাবে সবাইকে দেবো?

দুপুরের জন্য আম্মা ফ্রিজ থেকে পোনা মাছ বের করে দিয়ে বললেন,মাছটা ঝোল করো শাক ভাজি আর ডাল করো ফ্রিজে রান্না করা ফার্মের মুরগির মাংস আছে সেটুকু গরম করো।আমার আব্বা ফার্মের মুরগির মাংস পছন্দ করেন না কিন্তু আমি সেকথা আম্মাকে বলতে পারলাম না।ফ্রিজে বড় রুইমাছ আছে আমার খুব ইচ্ছা করছিল বাবার জন্য ঐ মাছ রান্না করতে কিন্তু সাহস করে আম্মাকে বলতে পারলাম না।

আমরা দুই বোন যখন স্কুলে পড়তাম তখন বাবা একদিন রুইমাছ কিনে এনেছিলেন। আমার বাবা সামান্য চাকরি করতেন বড় মাছ কেনার সামর্থ্য ছিল না তিল তিল করে টাকা জমিয়ে মাছটা কিনে আনেন।খাওয়ার সময় মা মাছের মাথাটা বাবার পাতে তুলে দেন কিন্তু আমার বাবা নিজে মাথাটা না খেয়ে আমাদের দুই বোনকে খাইয়ে দেন।

মা হাহাকার করে উঠল,এইটা আপনি কি করলেন! নিজে না খেয়ে সবটুকু মাথা মেয়েদের খাওয়ালেন!
বাবা হৃষ্টচিত্তে বললেন, আমার শাহনাজ আর মেহনাজের শ্বশুর বাড়ি যখন যাবো তখন এর থেকেও বড় মাছের মাথা মেয়েরা আমাকে খাওয়াবে। তাই না রে মা?

আমারা দুই বোন হেসে দিয়ে মাথা কাত করে বলে উঠলাম অবশ্যই খাওয়াবো বাবা। তখন থেকে স্বপ্ন দেখতাম বাবা যখন আমার শ্বশুর বাড়ি আসবেন তখন রুইমাছের মাথার সাথে সাথে আর যেসব খাবার বাবা পছন্দ করেন সব রান্না করে কাছে বসে বাবাকে বেড়ে খাওয়াবো।

সত্যি যখন বাবা আমার শ্বশুর বাড়ি আসলেন তখন কোন কিছু করার স্বাধীনতা আমার নেই। আমার বাবার জন্য কোন বাজার হলো না অথচ শ্বাশুড়ির বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসলে অথবা শিলা আপারা বেড়াতে আসলে তখন বাজার করা রান্না খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।

দুপুরে ভাত খাওয়ার পর খবর আসলো আম্মার দূর সম্পর্কের আত্নীয় মারা গেছেন আমাদের বাড়ি থেকে অল্প দুরে আম্মা মৃত্যু বাড়িতে চলে গেলেন। বিকেলে বাবা কে কিছু একটু নাস্তা দিতে হবে ভাবলাম ভাপা পিঠে তৈরী করি।গরম গরম ভাপা পিঠে বাবা খুব তৃপ্তি করে খেলেন বারবার বললেন, আমার মা তো খুব সুন্দর পিঠে বানানো শিখেছে। বাবার খুশি দেখে আমার আনন্দে চোখ ভিজে উঠেছে।

সন্ধ্যার পর আম্মা বাড়ি ফিরলে কয়েকটা ভাপা পিঠে আম্মার সামনে রাখলাম।
আম্মা অবাক হয়ে বললেন ভাপা পিঠে কোথায় পেলে?
মাথা নিচু করে আস্তে করে বললাম, আম্মা আমি বানিয়েছি।
সাথে সাথে আম্মা রাগী গলায় বললেন, আমার আত্মীয় মারা গেছে আর তুমি ঘরে বসে ভাপা পিঠে বানাচ্ছ! কোন কিছু বানাতে হলে মুরব্বির অনুমতি নিতে হয় সেই শিক্ষাটাও তোমার মা দেয়নি? যার জন্য বানিয়েছো তাকে খাওয়াও আমি এই পিঠে খাবো না।

লজ্জায় আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল মাথা নিচু করে আম্মার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম।

রাতে বাবাকে দুপুরে যা রান্না ছিল তাই দিয়েই ভাত দিলাম।ফ্রিজে অনেক ডিম ছিল মনে করেছিলাম ডিমের তরকারি করবো কিন্তু পিঠে বানানো নিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো তারপর আর ডিম রান্নার সাহস হলো না।

সকালে নাস্তা করে বাবা আম্মার ঘরে গেলেন বিদায় নেওয়ার জন্য। আম্মা কর্কশ কণ্ঠে বাবা কে বললেন, মেয়েকে একটু শিক্ষা দিয়ে যান, সে তো মুরব্বি মানেনা,আমার মুখে মুখে তর্ক করে। ঠিকঠাক ভাবে কাজও তো শিখিনি রান্না ঠিকমতো করতে পারে না।

বাবা আস্তে করে বললেন,কম বয়সী মেয়ে বাড়িতে তেমন কাজ করেনি আপনি দয়া করে একটু শিখিয়ে নেবেন।

মেয়েদের ছোট থেকেই কাজকর্ম শেখাতে হয় বিয়াই,আমি ও তো দুই মেয়ে মানুষ করেছি তারা তো সব কাজ পারে। কাজ শেখাতে গেলে আপনার মেয়ে বিরক্ত হয় আর আপনার মেয়ে খুব মুখরা।
আমি হতভম্ব হয়ে আম্মার কথা শুনছি আড় চোখে তাকিয়ে দেখি লজ্জায় অপমানে বাবার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে।

বাবা আম্মার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি আর কান্না আটকাতে পারলাম না কাঁদতে কাঁদতে বললাম, বাবা বিশ্বাস করো আমি আম্মার কোন কথার উত্তর দিইনা যা বলেন তাই শুনি তারপরও কেন উনি এভাবে তোমার কাছে আমার নামে নালিশ করলেন বুঝতে পারছি না! বাবা তুমি কষ্ট পেওনা।
আমি জানি মা আমার সন্তান কখনো মুরব্বিদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবে না সেই শিক্ষা দিইনি তবে মেয়ের শ্বাশুড়ির মুখ থেকে মেয়ের নামে নিন্দা শুনতে বড় কষ্ট হয় রে মা।

বাবা চোখের পানি মুছতে মুছতে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে বিদায় নিলেন আর কোনদিনও আসেননি।
আম্মার কথায় চমকে উঠলাম, কি হলো শাহনাজ কথা বলছো না কেন? কাল কিন্তু আমরা সকাল সকাল তোমাদের বাড়ি যাবো যদি সম্ভব হয় তাহলে বিয়াইকে সাথে করে নিয়ে আসবো। তোমার বাবাকে যা যা খাওয়াতে ইচ্ছা করে তুমি শুধু আমাকে বলবে আমি সব কেনার ব্যাবস্হ্যা করবো।তোমার বাবার প্রতি আমি খুব অন্যায় করেছিলাম আজ আমি বুঝতে পারছি তোমার বাবা এবং তুমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলে। আমি তোমার বাবার হাত ধরে বলবো শাহনাজের মতো গুণী ভাল মেয়ে দ্বিতীয়টি হয় না আপনারা সুশিক্ষা দিয়ে সন্তান মানুষ করেছেন।

আম্মার কথা শুনে আমার যে কি আনন্দ লাগছে! আগামীকাল বাবাকে ঠিক সাথে করে নিয়ে আসবো। কালই বড় রুইমাছ কিনে বাবাকে পাশে বসিয়ে মাছের মাথা খাওয়াবো আমার ছোটবেলার দেখা স্বপ্ন এবার বাস্তবে রূপ নেবে। বাবা হাঁসের মাংস দিয়ে চালের গুড়োর রুটি খুব পছন্দ করেন আম্মাকে বলবো হাঁস কিনে দিতে।

রাতে সবাই খেতে বসেছি হঠাৎ ফোনের শব্দ, মা ফোন করেছে।হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্তে মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,শাহনাজ তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে আমরা হাসপাতালে অবস্থা খুব খারাপ।

আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে তক্ষুনি বাবার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু এত রাতে তো বাস পাওয়া যাবে না শাকিল প্রাইভেট কার ভাড়া করার জন্য বেরিয়ে পড়লো বসে বসে কেঁদে দোয়া করছি বাবা যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন রাত এগারোটায় মেহনাজ ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল আপা রে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আমার হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ল, আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলাম এটা কিছুতেই হতে পারে না।আমার স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যেতে পারে না।

আম্মা আহাজারি করে উঠলেন,বেয়াই এর কাছে মাফ চাওয়ার সুযোগ টুকুও পেলাম না!
যখন আমার,বাবাকে যত্ন করে ভালমন্দ রান্না করে খাওয়ানোর সুযোগ ছিল না তখন বাবাকে কাছে পেয়েছি আর আজ যখন যত্ন করার সুযোগ পেলাম তখন বাবা কে আর পাবো না।
আমার চোখের সামনে বাবার কান্না ভেজা লজ্জিত মুখটা বারবার ভেসে ওঠছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত