এক.
ইবনাতের সাথে আমার রিলেশন থাকার পরেও ও অন্য আরেকজনের সাথে ভাব বিনিময় করতো এটা আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম তখন মনে হলো আমি হারিয়ে গিয়েছি অদুর সমুদ্রে।দুনিয়াটায় পুরো অন্ধকারে ছেপে গেছে। পালটে গেছে।আমার তাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ কেন তুমি এমন করলা? আমার ভালোবাসায় কোন ভুল ছিল? তুমি আমাকে আর ভালোবাসতে পারছো না সেটা আমাকে বলোনি কেন? আমাকে বললেই পারতে। আমি নিজেই তোমার লাইফ থেকে সরে যেতাম।
কিন্তু আমি তাকে এসবের কিছুই বলিনি। বলার শক্তিটা আমার কাছে নেই। নিজেকে ছোট লাগে। তাকে কষ্ট দিতে চাই না। ছোট বেলায় মা বলতো “আব্বু অনেক রাত হইছে। আসো তোমারে খাওয়াই দেই। তোমার বাবা আসতে আরো অনেক রাত হবে।” আমি না খেয়ে বলতাম “বাবাকে ছাড়া খাব না। বাবা এতো রাত করে আসে কেন আম্মু?” আমার মা আমাকে এই সেই বুঝিয়ে বলতো “তুমি এখন না ঘুমাইলে সকালে উঠবা কেমন করে? সকালে মাদ্রাসায় যাইতে হবে না? পড়া লেখা করতে হইবে না? তোমাকে না অনেক বড় হইতে হবে আব্বু।” আমি তারপরও জেগে থাকতাম। বাবা না আসা পর্যন্ত ঘুমাতাম না। উলটো মাকে বলতাম “তুমি ঘুমাও। আজকে আমি তোমাকে ঘুম পারায় দেই? ঘুমানোর আগে বাবা যে গল্প শোনায় না? সেখান থেকে তোমাকে একটা আজকে শোনায় দিবনে। বাবা আসলে বাপ ছেলে মিলে খেয়ে ঘুমায় যাবো হ্যাঁ? আজকে তেমার ছুটি।” মা ফিক করে হেসে দিয়ে বলেছিল “আমার ছেলেটা অনেক বড় হইতেছে।আমি কি করে ঘুমাই? তোমার আব্বু না আসলে ঘুমাতে পারি? ঘুম আসলেও যে জেগে থাকতে হয়। আপন মানুষদের জন্য সব কিছু সহ্য করতে হয়। বুঝতে হয়। ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট বুঝতে দিতে হয় না। শত কষ্ট থাকলেও নিজের মাঝে রেখে দিতে হয়।তারপর একদিন সব ঠিক হয়ে যায়। আকাশের মত। মেঘের মত।”
মায়ের কথা গুলো আমার বেশ মনে আছে।আমি জানি আমার ভিতরে যে অসীম ভয়াবহ আকাশটা কেপে উঠছে সেই কেপে উঠার শব্দটা ইবনাত শুনবে না। হয়তো কখনো বুঝবেও না। এসবের কোন কিছুই আমি তাকে বলতে চাই না। আমি অপেক্ষা করি সে কখন নিজে থেকে আমাকে বলবে। আমাকে জানাবে তার ভিতরের কথা, অন্তরের কথা, সে কি চায়?
আমি ভাবি আজকে কত তারিখ? প্রতি মাসের বারো থেকে পনেরো তারিখের মধ্যে বাবা বাড়ি থেকে টাকা পাঠায়। তারিখের কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে মৃন্ময়ীর সাথে দেখা। আমাকে দেখেই বললো “আগামীকাল রেজিস্ট্রেশনের লাস্ট ডেট। রেজিস্ট্রেশন করছিস?” আমি কিছুক্ষন ঝিম মেরে থেকে বললাম “দোস্ত সকাল থেকে কিছু খাই নাই। ব্যাগে কি আছে?”
কিছু দিন আগে বাবা যে পাঁচহাজার টাকা পাঠিয়ে ছিল ওটার অর্ধেক টাকা দিয়ে ইবনাতের জন্মদিনে একটা শাড়ি গিফট করেছিলাম।আর সে শাড়ি পরেই গতকাল ও অন্য আর একজনের সাথে বের হয়েছিল। যেটা আমি ফরহাদের কাছ থেকে শুনেছিলাম।আমি বিশ্বাস করবো না বলে সে ছবিও তুলে এনে আমাকে দেখিয়েছে। আমার কি পরিমাণ খারাপ লেগেছিল, বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করেছিল কেউ যদি আমাকে একটু ছুয়ে দেখতে পারত তখন।ভেবেছিলাম টিউশনির টাকা আর বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনটা করে ফেলবো। কিন্তু টিউশনির টাকাটা এখনো দেয়নি। তখন আমার বাবার কথা খুব মনে পড়লো। আমার বাবা সব সময় আমাকে ফোন দিয়ে প্রথমে বলবে “ভালো আছো বাবা? পড়ালেখার অসুবিধা হয় না তো? যা যা দরকার আমারে বলবা। তোমার মায়ের কত স্বপ্ন তুমি অনেক বড় হবা। মাঝে মাঝে তোমার মা আমারে কয় “আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হাইটা যাবো তখন গ্রামের বেবাক মানুষ আমাগো দেইখা বলবো “আরে এটা কে? শোভনের বাপ মা না।?” তোমার মা একটু পাগল আছে আমি সত্য কইছি না বাবা? ও বাবা?”
আমি তেমন কিছু বলতাম না। টুক করে লাইনটা কেটে দিতাম। আমার বাবা মা আমাকে নিয়ে কত চিন্তা করে। আর আমি হাবিজাবি করে জীবন কাটাই। আমার চুপ থাকা দেখে মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে হাত ধুতে বলে। তারপর দুইটা রুটি আর আলু ভাজি দিল। আমি তেমন কিছু আর না ভেবেই খেতে লাগলাম। আর ও চুপ করে তাকায় থাকলো।তারপর বললো “তুই যখনি আমার সামনে এমন করে খাস মনে হয় তুই অনেকদিন না খেয়ে আছিস।খাওয়া শেষ কর।তারপর তোকে কিছু কথা বলবো।”
খাওয়া যখন শেষ হলো ও আমাকে বললো “আমার কথা শুনে তোর মন খারাপ হোক আর না হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। বাড়ি থেকে তোর বাবা প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠায়। রেজিস্ট্রেশন ফি এর টাকাও পাঠায়ছে। এই টাকা দিয়ে তুই কি করছিস? ইবনাতকে শাড়ি কিনে দিয়েছিস তাই না? শোভন, ইবনাত যে তোরে নিয়ে খেলে এটা তুই বুঝিস না?” সত্যি এসব আমি কিছু বুঝতাম না। এসব কথা আমার গায়ে মাখাতাম না। আমি শুধু ভাবতাম, বুঝতাম এই যে ও আমার পাশে থাকে, সারাদিনের ক্লানি আর ব্যস্ততার পর আমার সাথে কথা বলার সময় ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস নিত আমি তাতে লক্ষ লক্ষ অনুভূতি খুঁজে পেতাম। যে অনুভূতির মাঝে থাকতো আমার কাছে ছুটে আসার, একটু ভালোবাসার কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা। আর আমি বলতাম চলো হারিয়ে যাই ভালোবাসার সমুদ্রে। তোমাকে ভিজিয়ে দেই। নিবা আমার এক মুঠো ভালোবাসা? ব্যাস এই তো। আমার কি আর বেশি কিছু চাওয়া ছিল? আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। আমাকে উঠতে হবে। টিউশনির টাকার জন্য ছাত্রীর মাকে কখনো কিছু বলিনি। বলার প্রয়োজন পড়েনি। যথাসময়ে টাকা দিয়ে দিত। কিন্তু এই মাসে কি হলো জানি না। আমি মৃন্ময়ীর কথার প্রতিভাষ না দিয়ে বললাম “খাওয়ানোর জন্য ধন্যবাদ। ভার্সিটিতে যত দিন আছি তোর হাতের রান্না ততদিন খাইয়ে যাস। দোয়া করি একটা ভুড়ি ওয়ালা স্বামী যেন পাস। বাসর রাতে যখন জামাইয়ের সাথে কি কথা বলবি কোন কিছু খুঁজে পাবি না তখন আমার কথা চিন্তা করে হাবিজাবি বলতে পারিস।” আমার কথা শুনে ও ওর ব্যাগটা দিয়ে একটা বাড়ি মেরে বললো “ছাগল আমি জীবনে বিয়েই করমু না।দরকার হলে বনবাস দিব।” তারপর আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বললো আজকেই রেজিস্ট্রেশন করবি। আর অবশ্যই সুদ হিসেবে একশ টাকা বেশি দিয়ে টাকা পরিশোধ করবি।” আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।মাঝে মাঝে ওকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে কেন তুই আমাকে প্রায় হেল্প করিস? আমি এটাও জানি এই যে ও এই টাকাটা দিল এটাও নিতে চাইবে না।আচ্ছা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কেমন?
অনেক রাতে ইবনাত আমাকে ফোন দিয়ে বললো “আমার কিছুই ভালো লাগছে না। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।” আমি ঝিম মেরে থাকি।ইতস্ততা করে বললাম “খারাপ লাগছে কেন হঠাৎ? সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “তেমন কিছু না। তোমাকে তো কিছু বলি নাই। আমি জানি তোমাকে বললে তুমি মন খারাপ করতা। কয়েক দিন আগে থেকে বাসায় বাবা মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। আমি কাউকে কিছু বুঝাতে পারছিলাম না। বাবা মাকে সাহস করে তোমার কথা বলতেও পারছিলাম না। পরে অনেক ভেবে চিন্তে বাবা মাকে বললাম “যে ছেলের কথা তোমরা বলছো আমি না হয় আগে ছেলের সাথে দেখা করি। তার সাথে কথা বলি। তাকে বুঝি, সে আমাকে বুঝোক। তারপর তোমাদেরকে জানালে তোমরা বিয়ের কথা ভাববে। এটা তো আর পুতুল খেলা না।” আমার কথায় রাজিও হলো। আমি প্ল্যান করে রেখেছিলাম একদম সাধারন ভাবে যাবো। যেন আমাকে দেখে পছন্দ না করে। কিন্তু আম্মু আমাকে তোমার দেওয়া শাড়িটা পরতে বললো। আম্মু তো জানে আমি বন্ধুদের কাছ থেকে জন্মদিনে অনেক কিছু পেয়েছি। আম্মু আমাকে নিজ হাতে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে আর সাজিয়ে দিয়েছে। ছেলের সাথে দেখা হওয়ার পর ভদ্রতার খাতিরে টুকটাক কথার বলার একটু পরে আমি উনাকে বলেছি আমি একজনকে ভালোবাসি। আমি অনেক সংকোচতা নিয়ে কথা গুলো ছেলেটাকে বলেছি।আমি যখন কথা গুলো বলেছি তখন মনে মনে ভাবছি আমি তোমার জন্য চাইলে অনেক কিছু করতে পারি। ছেলেটা ভালো বুঝছো? ছেলেটা তার ফ্যামিলিকে অন্য যে কোন কারণ দেখিয়ে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিবে। আমার এখন একটু হালকা লাগছে। তোমার জন্য আমি কতকিছু করলাম। দেখছো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি? একা একা কত কষ্ট সহ্য করি? তুমি হলে পারতা? বলো পারতা?
আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। আমি কি যা তা ওকে নিয়ে ভেবেছি। আর এই মেয়েটা নিজে নিজে এতো কিছু করে গেলো।ও যদি অন্যরকম হতো তাহলে তো আমার কাছে সব কিছু হাইড করে রাখতো। ও তো কিছুই লুকায়নি।আমি প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড চুপ করে থাকলাম।
আমরা মানুষেরা এপার প্রান্ত থেকে অনেক কিছু ভাবি অপর প্রান্তের মানুষটাকে নিয়ে। তার কথা বলার ধরনকে নিয়ে। তার আচার আচারণকে নিয়ে। প্রায় সময় এসব আচার আচারণ থেকে আমরা মানুষেরা অনেক কিছু বুঝতে পারি। আবার অপর প্রান্তের মানুষটাও হয়তো এমন করে ভাবে। প্রত্যেকটা মানুষই ভাবে। সারাদিন মানুষ এই ভাবনার মাঝে তার দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পূর্ণ করে। আর রাত হলে তাকে একাকীত্ব ঘিরে ধরে। সারাদিন এইসব ভেবে ভেবে আমার মনে যতটা খারাপ লাগা প্রবেশ করেছে ওর কথা শুনে আরো বেশি খারাপ লাগছে। না নিজের জন্য না। ওকে নিয়ে আমি এসব ভেবেছি তার জন্য।আমি বললাম “তুমি যখন আমার সাথে কথা বলো আমি তখন বেশির ভাগই চুপ করে থাকি। চুপ করে থাকি এই না আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। আমি কথা বলার চেয়ে তোমার কথা শুনতেই বেশি ভালো লাগে। এই যে আগ্রহ নিয়ে তোমার কথা শুনি তাতে আমার মাঝে প্রগাঢ় অনুভূতি হয় বুঝতে পেরেছো কি? ইবনাত আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। আমি ভাবুক একটা মানুষ। সারাদিন এই সেই নিয়ে ভাবি। ভাবি এই বুঝি তুমি উড়াল দিবে। উড়তে উড়তে মেঘ বয়ে চলে যাবে দুর বহু দুর।আর আমার কাছে পরে থাকবে তোমার দেওয়া ভালোবাসা, অনুভূতির স্মৃতি গুলো। কিন্তু এই যে আমার ভিতরটা আছে না? এই ভিতরটাতে আমি তোমাকে বন্ধি করে রেখেছি। সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে ইবনাত আমার। ও চাইলেই হারিয়ে যায় না। উড়াল দেয় না। সে আমার মাঝেই চুপ করে ভালোবাসার উষ্ণতা বুনে।
দুই
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার অফিসে এসে আমি অপেক্ষা করি সম্পাদক আরিফ ভাই এর সাথে দেখা করবো বলে। আমার একটা পার্সেল এসেছে। তাও পার্সেলটা একটা মেয়ের। নাম তাহমিনা।কাল রাতে আরিফ ভাই আমাকে ফোন করে পার্সেল এর বিষয়টা যখন বললো আমি অনেক ভাবলাম তাহমিনা নামের কি আমি কাউকে চিনি? কিন্তু আমি কাউকে মনে করতে পারলাম না। আরিফ ভাই এর সাথে পরিচিত, আমার ছাত্রী নাদিয়ার মাধ্যমে। আরিফ ভাই হলো নাদিয়ার চাচাতো ভাই। নাদিয়াকে পড়ানোর সময় ও একদিন হঠাৎ করেই আমাকে বললো “আপনি যে কবিতা লিখেন আমি জানতাম না।কাল আপনার ভার্সিটির নোট খাতাটা ভুলে রেখে গিয়েছিলেন।রাতে এমনিতে আপনার নোট খাতাটা দেখছিলাম তখন নোট খাতার কিছু পাতা উলটাতেই শেষের দিকের পাতায় একটা কবিতা দেখলাম।ভালো লেগেছে। আপনার কবিতা পড়ে মনে হলো আপনার ভিতরে অন্য একটা ছায়া বাস করে। ছায়াটা অনেক কষ্টে আছে।কষ্টটা মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু সে কোন ভাবেই মুক্তি হতে পারে না।”
আমি অনেকক্ষন ঝিম মেরে ভাবছিলাম তাকে কি বলা যায়। আমি কারো জন্য কবিতা লিখি না। শুধু মাত্র ইবনাতের জন্য লিখতাম। আমি যে তার জন্য কবিতা লিখতাম সেটা ইবনাতও জানতো না। যখন ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মন খারাপ হয়ে যেত ঠিক তখনি লিখতাম। এই কবিতা গুলো আমার নিজের মাঝেই রেখে দেই। আমি কবি না।সেদিন আমার ভীষণ মন খারাপ ছিল। সেদিনের পর থেকে ইবনাতের সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই। আমার কবিতার কিছু লাইন এমন ছিল…
তুমি আগুন জ্বেলেছো
আমার অশ্রুজলে তা যদি নিভে,
শত আলোকবর্ষ চোখের পাতা বুজলেই অদৃশ্য হবে
তারপর একদিন হবো উদাসীন
আকাশ কালো হবে, তবু জানাবো না তোমায়
সেই যে আগুন জ্বেলেছো, নিভে যাওয়ার পরো কেন বুক জ্বলে যায়?
ইবনাতের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পর দু মাস পর ভার্সিটিতে এসে এই কবিতাটা লিখেছিলাম। নাদিয়া আমাকে বলেছিল “আপনার কবিতাটা কি আমি নিতে পারি?” আমি অনেকক্ষন ভেবে বলেছিলাম “না নিতে পারো না।আমার কবিতা লতা পাতার মত। কারো কাছে রেখে দিলেই সেটাতে পচন ধরবে। একটা সময় দুগর্ন্ধ ছড়াবে।আমার কবিতা কারো মাঝে দুগর্ন্ধ ছড়াক আমি চাই না।” কিন্তু যখন পড়ানো শেষ করে চলে যাচ্ছিলাম তখন আমি তাকে বললাম “আমার কবিতাতে কোন আলো নেই। যদি অন্ধকারেও যত্ন করে রেখে দিতে পারো তাহলে নিতে পারো।” সে শুধু একটা হাসি দিয়ে বলেছিল “কবিতা মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকে। যত্ন করে ঘরের কোনে রেখে দেওয়ার মত নয়।আমাকে যখন দিলেন তাহলে এটার দায়িত্বটা আমার। আমি এটাকে যত্ন করবো। দেখুন আমি কি করি।” তার দু সপ্তাহ পর আমি জানতে পারলাম কবিতাটা দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশ হলো।আমি বিমূঢ় হয়ে নাদিয়াকে বলেছিলাম “এটার দরকার ছিল না।ছায়াটাই আমার কাছে ভালো। এতো আলো দিয়ে আমি কি করবো?”
নাদিয়াকে আমি এখন পড়াই না। ওকে পড়ানো বাদ দিয়েছি গত বছরের শেষের দিকে। মুলত ভার্সিটি শেষ করার কয়েক মাস আগে থেকেই ওকে পড়ানো বাদ দিয়েছি। আর আরিফ ভাই এর অনুরোধে মাঝে মাঝে এই পত্রিকায় লেখা দিতাম।পার্সেলটা নিয়ে যখন আমি বের হতে যাচ্ছিলাম তখন পত্রিকার অফিসের দুজনকে দেখলাম একজন আরেকজনকে বলছে “সামনের বছর কানাডায় চলে যাবো। এই দেশে শুধু অশান্তি আর অশান্তি। ভালো লাগেনা।”
বিকেল বেলায় টঙ্গের দোকানে চা খেতে থেতে আমি ভাবলাম “এই দেশে অশান্তি নাকি মানুষের মনে অশান্তি? এই মনের অশান্তি থেকেই মানুষ আড়াল হতে চায়। নিজেকে লুকাতে চায়। এই কথা ভাবতেই ভাবতেই ইফতির কথা মনে পড়লো।মৃন্ময়ী যেমন আমার ভালো বন্ধু ইফতিও আমার তেমন একজন। ও এখন সেই কানাডায় থাকে। ওর সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। গত তিন মাস আগে একবার ফোন করে বললো “কতবার ভাবছি এখানে আইসা মনের ভিতরের যে শব্দটা লুকায় আছে সেটা বাহির করে ফেলবো। একটা সময় দুজন মানুষ ভালোবাসায় কত অনুভূতি তৈরি করে। অনুভূতিটা যখন ভোতা হয়ে যায় তখন একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য উঠে পড়ে। আমার বাবা মা এই বয়সে এসে ডিভোর্স নিল। তারা একটাবারও কি আমার কথা ভাবছে? বল ভাবছে? তাদের কিসের এতো অশান্তি ছিল? কিন্তু দেখ তাদের এই অশান্তি আমাকেই চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো।তাদের ডিভোর্সের কারণে সাদিয়া আমার থেকে আলাদা হলো।কত চেষ্টা করলাম ওর ফ্যামিলি এটা মেনে নিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ও অন্যজনের বউ হলো। এই কানাডার শহরের মানুষেরা যখন তুষারের স্তুপে স্কিয়িং করে, আইস স্কেটিং করে লুটোপুটি খায় আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজেকে ওদের মাঝে ব্যস্ত রাখি। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু পারতেছিনারে। এই অশান্তি ভুলতে পারতেছি না। তোর খবর কি?” আমি শুধু ওরে বললাম “আমরা মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন।সবারই একই প্রাণ একই আত্মা কিন্তু চাওয়া পাওয়া ভিন্ন। এই চাওয়ার পাওয়ার কারণেই বেশির ভাগই আমাদের বিচ্ছেদ হয়। আমাদের প্রত্যেকের অতীত থাকে আমরা এটাকে চাইলেই ভুলতে পারি না। আমরা মানুষেরা অনেক ভাবি। যখন ভাবি তখন নিজেকে প্রাধান্য দেই বেশি। কিন্তু অপর মানুষদের কথা তেমন ভাবি না। তুই হয়তো ভাবছিস তোর বাবা মা একটু বেশি করে ফেলছে। কিন্তু তাদের মাঝেও হয়তো অনেক কিছু হচ্ছিল। তাদের মুক্তির দরকার ছিল। তবে তারা চাইলে তোর কথা ভেবে এমনিতে আলাদা থাকতে পারতো। তুই যখন তাদের বিচ্ছেদের ব্যাপারটা একটা সময় জানতে পারবি তখন নিশ্চয় বুঝতে পারবি। আমি আপাতত বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। দোয়া করিস। আর ওখানে কত সাদা চামড়ার মেয়ে আছে। ভাব জমাইয়া বিয়ে করে ফেল।বিয়ের পর ফুটবল খেলার একটা টিম বানা। আমি রেফারি থাকবো।” আমার কথা শুনে সে “দুর শালা” একটা গালি দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল।
পার্সেলটা পাওয়ার এক সপ্তাহ হওয়ার পরো আমি এটা খুলে দেখলাম না। আজকাল আমি কেমন যেন অলস হয়ে গেছি। গতবছরটা আমার কাছে একটা বিষাদ বছর ছিল। আমি চাইলেও এই বছরটা ভুলতে পারবো না। বাবা ইন্তেকাল হওয়ার এক মাস পর ইবনাতের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হলো। বাবা মারা যাওয়ার পর মা কান্নাকাটি করছিলো। আর আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অনেকক্ষন পর আমি বললাম “এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। বাবা এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো কেন?” আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কান্না করতে থাকে। আমি জানতে পারলাম আমার বাপটার লিভারে সমস্যা ছিল। যা আমাকে বলা হয়নি। আমি মাকে বললাম “তোমরা আমাকে বলোনি কেন? সারাটা জীবন আমার ভালো বাপটা আমাদের জন্য খেটে গেছেন। নিজে না খেয়ে আমাদের কথা ভেবেছেন। আমি কেমন একটা সন্তান মা? নিজের বাপের জন্য কিছু করতে পারি নাই গো মা।ও মা। আমার ভালো বাপটাকে ফিরে আসতে বলো। বলো না। আমার কষ্ট লাগতেছে। বলো না ক্যান?”
আমি ভালো ছিলাম না। আমার দুঃখ লাগতো।পড়া লেখা থেকে আড়ালে ছিলাম তিন মাস। মায়ের পাশে পাশে ছিলাম।মা প্রতি রাতে কান্না করতো। আমাকে দেখলেই ভান করতো যেন আমি বুঝতে না পারি। বাবা চলে যাওয়ার পরে অনেক দিন কেমন করেই আমাদের জীবন চলছিল। একদিন মা আমাকে বললো “আব্বু তোমারে কষ্টে দেখলে আমার কষ্ট হয়। এই দেহো আমি শোক কাটাইয়া উঠতেছি। তুমি না ছেলে? স্বাভাবিক অবস্থায় যাইতে হইবে না? পড়ালেখা করতে হইবে না? কই তুমি আমারে বুঝ দিবা আর তোমারে আমার বুঝ দেওয়া লাগে। ও বাপ ঠিক হয়ে যাও।” আমার চোখে তখন সমুদ্রে ভরা জল। আমি একটা চিৎকার দিলাম। হাউমাউ করে কান্না করেছিলাম।
আমি পার্সেলটা খুলে অনেকক্ষন লেখাটার দিকে চোখ বুলালাম। তাতে লিখা…
প্রিয় কবি,
আমরা মানুষেরা প্রিয় কোন কিছুকে এতো সহজে হারিয়ে ফেলি কেন? আমার মাঝে মাঝে ভীষণ খারাপ লাগে। জীবনে প্রথম যার হাত শক্ত করে ধরলাম সে একটা সময় দুঃখের ঝড় তুলে চলে গেলো। এই আমার জীবনে একগাদা জায়গা করে ছিলাম তাকে আমার জমানো শব্দ দিয়ে ভালোবাসার ঝড় দেখাবো বলে। পারলাম কই? আপনি হয়তো আমার এসব লেখা পড়ে মনে মনে পাগল ভাবছেন। জানেন আপনার প্রথম কবিতাটা যখন আমি পড়লাম তখন মনে হলো কবিতাটা শুধু একান্ত আমাকে ভেবেই লেখা হয়েছে। তারপর অনেক দিন পর আপনার আরো একটা কবিতা পড়লাম। এরপর থেকে প্রতিবার আপনার কবিতার জন্য অপেক্ষা করতাম। আপনার সব কবিতা গুলো আমার কাছে রেখে দিয়েছি। যখন খারাপ লাগে তখন আপনার কবিতা গুলো পড়ি। তখন আরো খারাপ লাগে। সব কবিতা এতো কষ্ট দিয়ে লিখেছেন কেন? আপনি কি একটা কষ্টের সমুদ্র? কষ্টের সমুদ্রের পানি কেমন হয়? যে মানুষটা মনের ভাষা পড়তে পারে সেটাকে আবার ছন্দে রুপান্তর করতে পারে আমার মনে হলো তাকে একটা চিঠি লেখা যেতেই পারে।
একটা কথা বলুন তো কাউকে মন থেকে চাইলেই তাকে পেতে হবে? অসীম এই চাওয়ায় হাজার কথা হয়।যখন আমরা প্রিয় মানুষটাকে না পাওয়ার জায়গায় ঠায় দেই তখন তার প্রতি কি অভিমান তৈরি হয়? না অন্য কিছু? আপনি চাইলে উত্তরটা দিতে পারেন আবার না ও দিতে পারেন।ভালো থাকুন।
আমার ঘাড়ে বিশাল দায়িত্ব। আমাকে ছুটতে হবে। চারপাশের এই আবেগ মায়া থেকে সংযত রাখতে হবে। আমি প্রতিনিয়ত অভিনয় করে দিন কাটাচ্ছি। মানুষকে সুন্দর করে বলতে শিখেছি “ভালো আছি” কিন্তু আমি জানি, হ্যাঁ আমি জানি, আমি জানি, আমি এই মানুষটা কেমন আছি। চিঠিটা আমি রেখে দেই। পরের সপ্তাহে আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। আপাতত তা নিয়ে ভাবতে হবে। চাকরিটা হয়ে গেলেই মাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আজকাল মাকে ছাড়া ভালো লাগে না। আমার মা টা একা একা ওখানে পড়ে আছে।
তিন
সকাল সকাল আমার এমন একটা অবস্থা হবে এটা আমি বুঝতে পারিনি। সকাল হতেই টয়লেটে গিয়েছি চারবার।আজকে অফিসেও যাইনি। এমন সময় মৃন্ময়ী আমাকে ফোন দিয়ে বললো “তোর সাথে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। বিকেলে আমার সাথে দেখা করতে পারবি?” আমি আমতা আমতা করে বললাম “দোস্ত আপাতত আমি বিশাল একটা প্রেমে জড়ায় গেছি। এখন গেলে পাঁচ বার হবে তার সাথে দেখা। আমি যাই দোস্ত ও খুব করে আমায় ডাকতেছে। মেসেজ দিয়ে রাখ কোথায় দেখা করবো।” এটা বলেই আমি বাকি প্রেমটা করতে গেলাম।কাল রাতে এমন করে ভাজা পোড়াটা খাওয়া আমার ঠিক হয়নি।রাতে এই নিয়ে মায়ের কাছ থেকেও বকা শুনেছি। এমন করে আমাকে আরেকজন বকতো। ইবনাত। মাঝে মাঝে আমি ওকে ইচ্ছে করেই ফোন দিতাম। দেখা হওয়ার পরেও ফোন দিতাম। সে আমাকে বলতো “ঘন্টা খানেক আগে না তোমার সাথে দেখা করে আসলাম। আমি এখন বাসায়। তুমি ভালো করেই জানো বাসায় তেমন কথা বলতে পারি না। ফোন করেছো কেন?” আমি হাসি দিয়ে বলতাম “চুমু খাওয়া জন্য।” ও রাগ দেখিয়ে বলতো “ধ্যাত। তোমারে নিয়ে পারি না। রাখলাম” আমি চুপ করে থাকতাম। আমি চুপ করে থাকলে ও বুঝে ফেলতো। আমাকে বলতো “কি হলো চুপ করে আছো কেন? আল্লাহ হাফেজ বলো।” আমি তারপরো ঝিম মেরে থাকতাম।তারপর সে বলতো “ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি। উম্মা।আল্লাহ হাফেজ”
বিকেলে দেখা হওয়ার কথা থাকলেও মৃন্ময়ীর সাথে দেখা হলো সন্ধ্যায়। ওর সাথে দেখা হলেই ও আমার জন্য ভালো মন্দ খাবার নিয়ে আসে। সেই ভার্সিটির অভ্যাসটা এখনো আছে। আমি পায়েশ খেতে খেতেই বললাম “কি জন্য দেখা করতে বলছিস?” সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “খেয়ে নে তারপর বলবো।” আমি জানি ও এখন কিছু বলবেও না। আমি কিছু খেলে ও আমার খাওয়া দেখে। খাওয়া যখন শেষ হলো তখন ও বললো “বাবা বিয়ে ঠিক করেছে। বিয়ের পর ছেলের সাথে আমেরিকা চলে যাবো।কিন্তু আমার বাহিরের দেশ ভালো লাগে না। তুই একটা কিছু কর। চল ভাইগা যাই।বাসায় পরে জানাবো তোর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।” আমি ওর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাসতে হাসতে বললাম “রাতে কি কোন রোমান্টিক ফিল্মস দেখছিস? নিশ্চয় ছ্যাক খাওয়া?” আমার এমন করে বলা দেখে তার মুখটা কেমন হয়ে যেতে দেখলাম। তারপর হঠাৎ করে সে নিজেই হেসে দিয়ে বললো “দেখছিস তোরে কেমন করে চমকিয়ে দিয়েছি? ব্যাটা আমি কি তোর মত ছাগল? বিয়ের পর আমেরিকা শিফট হয়ে যাবো এর চেয়ে ভালো সুযোগ আসবে? আমার সেই ছোট বেলার ইচ্ছা “আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে” যাওয়ার। আর ওখানের শহরে আমি থাকবো ভাবা যায়?” এটা বলেই সে আবার হাসতে থাকে। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম ওর চোখ মুখ অন্য কথা বলছে। আমি ইতস্ততা করে বললাম “আমি মানুষের কথার ধরন, আচার আচারণ দেখে বা শুনে কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি কোনটা মিথ্যে আর কোনটা সত্য। কিন্তু প্রকাশ করি না। তুই আমার কাছে আমার সব চাইতে ভালো বন্ধুটা হয়েই থাক।আমার এই সাতরং হাহাকারে অনেক অংকের গরমিল। তা সংশোধন করতে গেলেই মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।” মৃন্ময়ী আমার কথা শুনে অনেকক্ষন ঝিম মেরে থেকে বললো “তোকে অনেক মিস করবোরে। তুই কি জানিস তুই খুব ভালো একটা মানুষ?” আমি কিছু বলি না। বলতে ইচ্ছে করে না।
রাত যখন গভীর হলো আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে থাকি।তাহমিনার প্রথম চিঠির জবাব দিয়েছিলাম এক মাস পর। এরপর ওর সাথে আমার অনেক চিঠি আদান প্রদান হয়েছে। আজও সে আমার কাছে আরো একটা চিঠি লিখেছে। তার প্রথম চিঠির জবাবটা এমন ছিল…
প্রিয় তাহমিনা
প্রথমে আপনাকে জানাই আমি কবি না। কবিরা অনেক বড় হয়। তাদের মন প্রসস্থ হয়। তারা বিষাদের মাঝে থেকেও মেঘের ভেলায় দিন কাটিয়ে দিতে পারে।সে তুলনায় আমি অনেক ক্ষুদ্র।আমি গ্রামে বেড়ে উঠা একজন সাধারণ ছেলে।তবে খুব পুলকিত হয়েছি এমন একটা চিঠির জন্য।আজকাল কেউ এমন চিঠি লিখে? “আমরা মানুষেরা প্রিয় কোন কিছুকে এতো সহজে হারিয়ে ফেলি কেন?” আপনার এই কথাটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়েছে। এর উত্তর আমার কাছে নেই। তবে বলতে পারি প্রিয় কোন কিছু একজন মানুষের মনে আলোর উত্থান ঘটায়।তারপর মেঘের অভয় একদিন অবহেলা হয়ে হাজির হয়। আমাদের নিরব করে দেয়।হারিয়ে যায়।এতে অভিমান তৈরি হয় নাকি অন্য কিছু জানতে চেয়েছেন।আমি খুব লজ্জিত একজন ছেলে হয়েওে বলতে হচ্ছে আপনার এই কয়েকটা লাইনে চোখের জল আর নাকের জল এক করে আমি সারা রাত ঝিম মেরে অন্ধকারে বসে ছিলাম। এরপরের সপ্তাহে আমার ইন্টারভিউ ছিল এবং আমার চাকরিটা হয়।পৃথিবীটা একটা আবেগকেন্রিক। প্রতিনিয়ত এর চারপাশে কত অনুভূতি ঘুরে বেড়ায়।আপনি আমার এমন লেখায় বুঝে ফেলার কথা আমিও এই আবেদগকেন্দ্রিক বা ভালোবাসায় ভিজে ছিলাম।ভালো থাকুন।
আমি বেড সুইচ একবার জ্বালাই আর একবার নিভাই। তাহমিনার ভালোবাসার মানুষটার নাম ছিল আদনান।তাদের এই ভালোবাসায় অনেক ঝামেলা হয়।তাহমিনার ফ্যামিলি মানতে নারাজ।দুজনে স্টুডেন্ট। আদনানের বাবা বেসরকারী কলেজের একজন পিয়ন। ছোট বোন আছে একটা। সবকিছু ভেবেই তারা ওয়াদা করে যা কিছু হোক একসাথে থাকবে। কিন্তু হঠাৎ করে আদনান সব কিছুর সমাপ্তির অবসান ঘটিয়ে তাহমিনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুরু হয় দুরত্ব। কেন আদনান এমন করলো সে নিজেও এখনো জানে না। আজও সে অপেক্ষা করে তার মানুষটা তার কাছে আসবে।
তাহমিনার দেওয়া আজকের চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু আমি এই সেই ভাবতে ভাবতেই পড়ে ফেললাম। সে জানিয়েছে আমার কাছে চিঠি লিখছে মনের কথা শেয়ার করে যাচ্ছে উদ্ভট কথা বলে আমি বিরক্ত কিনা।কেন আমি শুধু তার চিঠির উত্তর দিয়ে যাই। নিজে থেকে কিছু বলি না কেন? এবং শেষে বলেছে প্রিয় কবি আপনি কি মানুষের খোঁজ খবর নিতে জানেন না?”
আমি চুপ করে ভাবি “আপনি কি মানুষের খোঁজ খবর নিতে পারেন না?” আসলেই কি আমি খোঁজ খবর নিতে পারি না? ইবনাতও এমন বলতো। ওর সাথে রিলেশনে থাকার সময় হঠাৎ করে দু তিন দিনের জন্য কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমি জানতে চেয়েছিলাম, প্রশ্ন করে ছিলাম। এই যে আমি এসব ভাবি, তা কি ঠিক? কেন তোমাকে নিয়ে এমন করে ভাবতে হয়?” সে আমাকে বলেছিল “তুমি আমাকে সন্দেহ করো? বিশ্বাস করো না?” আমি বলেছিলাম “সন্দেহ এর কিছু নেই। এটা জানার আমার অধিকার আছে। বলো আছে না?” এই নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হলো। বলা হলো তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। একদম বলবা না।” তারপর ঠিকি কথা হলো না। কিন্তু আমি ঠিকি ফোন দিয়ে ছিলাম। ফোন অফ ছিল। তিনটা দিন কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও এটাই চেয়েছিল। তাহলে এখানেই শেষ? কিন্তু না আমাদের সম্পর্কটা তখনো শেষ হয়নি। তিনদিন পর সে হঠাৎ করে ফোন দিয়ে বললো “এই আমি গ্রামে আসছি। এখানে একদম নেট পাওয়া যায় না।কি কুয়াশা বাবা। ঠান্ডায় মরে যাচ্ছি।বেড়াতে আসছি তো তোমাকে একটা ফোনও দেওয়া হয়নি। স্যরি। রাগ করে ফোনটাও অফ করে দিয়েছিলাম। তুমি আমায় একটুও মিস করোনি তাই না? আমি কথা না বলতে বললে তুমি বলবা না? এতোটা স্বার্থপর? তোমার একদিন কি আমার একদিন, আমি এসে তারপর দেখছি। আমাকে ইগনোর করা। এই ইবনাতকে?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।ওকে নিয়ে যা ভাবি পরে সব কিছু কেমন হয়ে যায়।আমি বুঝেছিলাম, আর যাই হোক আমাকে কখনো ও হাতছাড়া করবে না। কিন্তু বাবা যখন ইন্তেকাল করলো আমি তখন মায়ের কাছে ছিলাম।খবর পেলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে। যেখানে আমাকে সাপোর্ট দেওয়া ওর কথা ছিল সেখানে ও আমার একটাবারো খোঁজ খবর নেয়নি। এই নিয়ে তার সামনে আমার যাওয়া হয়নি। আমি আড়ালে আড়ালে থেকেছি। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি কেন এমনটা হলো?
পরিশিষ্ট
আমি মনে হয় মনে মনে একটু আহত হলাম। ইবনাত আমার সামনে বসে আছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোটা গুলো মাটিকে স্পর্শ করা খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য। এই দৃশ্য আমাদের মানুষের মনে কখনো আনন্দ ছড়ায় আবার কখনো বিষণ্নতা ছড়ায়। আমি খেয়াল করলাম ইবনাতের চেহারাটা কেমন হয়ে আছে। আমি এর আগে ওকে এমন করে এতোটা বিধ্বস্ত দেখিনি। আমি খুব ইতস্ততা করে বললাম “তাহলে আমাদের আবার দেখা হয়েই গেলো।মাঝে মাঝে নিজেকে খুব দুর্বল লাগে।এই যে ভিতরটা আছে না, এটাতে অনেক কিছু হয়। জানোই তো দুঃখ মানুষের মনে বাস করে। মন থেকে একসময় দুঃখটা মুছে যায় কিন্তু বিশ্বাস করো ব্যাথাটা যায় না। মনে পড়লেই ছ্যাত করেই ব্যাথা আবার শুরু হয়।তখন বুঝি আমি কতটা অসহায়।
ইবনাত আমার কথা শুনে চোখের জল ফেলে বললো “আমি কি খুব খারাপ একটা মানুষ ছিলাম? সত্যি করে বলো তো? আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ঘৃনা করতে শুরু করেছো। তোমার অসহায় এই চোখ গুলো দেখলেই বুঝা যায়। ফারাজ এর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়। যেই ভাবলাম তোমাকে জানাই, তুমি কিছু একটা করবা। ঠিক তখনি জানলাম তোমার বাবা মারা গেলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।আমার সাহস হচ্ছিল না, তোমাকে জানাতে আর না পারছিলাম তোমাকে চাপ দিতে। আর না পারছিলাম ফ্যামিলির অবাধ্য হতে। আমি মেয়ে তো। তারপর দেখোই না কি হয়ে গেলো। এই যে এতো কিছু হয়ে গেলো বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি। প্রায় আমাদের ভালোবাসার দিন গুলোর কথা ভাবি আর নিরবে কাঁদি।” এইটুকু বলেই চোখের জল মুছে ইবনাত ওর হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। তারপর বললো “আমাকে যে উঠতে হবে।” যখন ও উঠে চলে যাচ্ছিল আমি ডাক দিয়ে বললাম “তুমি আমার কাছে স্পেশাল একজন মানুষ। আমি চাইলেই এই মানুষটাকে ঘৃনা করতে পারি না। কখনোই না।”
আমিও রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাটি। নিজেকে একজন যাযাবর ভাবি।বাসায় গিয়ে তাহমিনাকে একটা চিঠি দিতে লিখতে হবে।তাকে জানাতে হবে আদনানের সম্পর্কে আপনি হয়তো অন্য কিছু ভাবছেন। কিন্তু আমরা যা ভাবি তা অনেক সময় ঠিক হয় না। আপনি তার সাথে দেখা করুন নিশ্চয় সে তার ফ্যামিলির কথা এসব কষ্টের কথা ভেবে দুরে সরে আছে। সবার সাথে হয়তো অভিনয় করে দিন পার করছে। কিন্তু হতেও তো পারে এই ছেলেটাও রাতের অন্ধকারে হাউমাউ করে কান্না করে। আমি আকাশের দিকে তাকাই। আজ আকাশটা স্পষ্ট। আমি অনুধাবন করি একজন যাযাবরের জীবন আর কেমন হতে পারে? আমি জানি না কবে আমি একটা বিশাল স্বস্তি নিব। একজন যাযাবরের জীবন কাটিয়ে নেওয়ার স্বস্তি…
বিঃদ্রঃ এই গল্পটা লেখা হয়েছে মানুষের চিন্তা ভাবনাকে কল্পনা করে। এই যে আমরা উঠতে বসতে কত কিছু ভাবি।সেটা যে কোন বিষয় হোক। একটা সম্পর্কে অনেক কিছু হয়। কিন্তু সম্পর্কে কখনো “কারণ বা অযুহাত” থাকতে নেই। যে সম্পর্কে “কারণ বা অযুহাত” থাকে সে সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয় বেশি। আপনি সব কিছু রিয়েলাইজ করে উপনীত হয়েছেন এই সম্পর্ক আর সম্ভব না।কিন্তু তাকে বলতেও পারছেন না। তখন অনেকেই দুরত্ব তৈরি করে, ব্যস্ততা দেখিয়ে অপর মানুষটাকে ইগনোর করা শুরু করে। বলা হয় একের পর এক মিথ্যে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই অপর মানুষটাও এসবের কারণ ভেবে ভেবে বুঝতে পারে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে। কারণ আমরা সবাই জানি মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়ে যায়…