ভুল এবং অভিমান

ভুল এবং অভিমান

অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের অর্থনীতি ক্লাস নেবার পর টিচার্স কমনরুমে ঢুকেই আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার সামনে লাল শাড়ি পড়ে একজন মেয়ে সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে। এ যে অর্থি! আমার অর্থি! আরিয়ানা রহমান অর্থি! আমার ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কাটিয়ে উঠবার আগেই একটি রসগোল্লা আমার মুখের সামনে ধরল মেয়েটি। আমি মুখে নিলাম। চিবানোর শক্তি পাচ্ছিলাম না চোয়ালে। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার মুখে পাথর দিয়েছে।আমার গলা দিয়ে মিষ্টি নামলো না। বেসিনে মুখের মিষ্টিটুকু ফেলে দিয়ে টিচার্স কমনরুম থেকে বের হলাম। আমি ইমদাদুল আদ্রিয়ান। দেবগঞ্জ সরকারি কলেজে অর্থনীতি পড়াই। একদিন ইন্টার ফার্সট ইয়ারের স্টুডেন্টস দের ক্লাস নিচ্ছিলাম। বোর্ডে চাহিদা রেখার চিত্র এঁকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছি। আমাদের কলেজের পিয়ন আনিস চাচা ডেকে বললেন-

—-প্রিন্সিপাল স্যার আপনেরে ডাকে। নতুন অর্থনীতির ম্যাডাম আইছে। দেহা করতে কয়। আমি বললাম-

—-আচ্ছা, গিয়ে বলো আমি এই ক্লাস শেষে আসছি। এতবড় কলেজে আমরা মাত্র দু’জন অর্থনীতির টিচার ছিলাম। আমি এবং সামাদ স্যার। মাসের মধ্যে চার-পাঁচ দিন’ই সামাদ স্যার অসুস্থ থাকেন। তার ক্লাসগুলো আমাকে নিতে হতো। প্রিন্সিপাল স্যারকে একদিন বললাম,

—-স্যার আরো একজন অর্থনীতির টিচার দরকার। ঠিক সামলে উঠতে পারছি না। প্রায়ই ক্লাস মিস যায়। স্যার বললেন,

—-আচ্ছা,

দেখছি। এজন্যই নতুন টিচার আনা হয়েছে কলেজে। অন্যান্য সব ডিপার্টমেন্টে ৩-৪ জন টিচার।শুধু অর্থনীতিতে দু’জন হবো কেন? প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে গিয়ে দেখি নীল শাড়িতে প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে বসে আছে নতুন অর্থনীতির টিচার। কুশল বিনিময় করার জন্য নতুন টিচারের উদ্দেশ্যে বললাম-

—-কেমন আছেন আপনি?

কাজলনয়নে আমার দিকে তাকিয়ে মুখের কোণে ছোট্ট হাসি ফোটার আগেই উবে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে আমার দিকে। কাজল নেয়ার এই হরিণ চোখ জোড়া আরো বেশি মায়ারূপধারী লাগছিলো। আমি তাকিয়েই আছি। পলক পড়ছে না। এ যে আর কেউ নয়। এ যে অর্থি! আমার অর্থি! আরিয়ানা রহমান অর্থি! যে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো আর পাঁচ বছর আগে। ছোট্ট কিছু মান নিয়ে। খুবই সামন্য অভিমান নিয়ে। আমি সেই অভিমানে হয়েছি পুড়ে ছারখার, ছুটে গিয়েছি তার কাছে বারংবার। আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো অভুক্ত ভিখারির ন্যায়, তার সামনে গিয়ে করিনি আর কখনো অন্যায়। ভালোবাসার শিকলে ছিলাম আমি বাধা,মিলাতে পারিনি জগতসংসারের ধাঁধা। আজ থেকে সাত বছর আগের কথা। অর্থির সাথে আমার রিলেশনশিপের একমাস মাত্র! বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু। কোন ঝামেলা আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো।এক সকালে হঠাৎ অর্থির ফোন-

—-হ্যালো!
—-হ্যাঁ, হ্যালো…(ঘুম ঘুম চোখে)
—-এখনো মহিষের মতো ঘুমুচ্ছো?
—-কেবল তো সকাল সাতটা। এখন উঠে করবো টা কি?
—-ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে পার্কে আসো। খুব জরুরী কথা আছে।
—-কি কথা বলো?
—-সামনাসামনি বলি?
—-এখন আগে বলো।
—-আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

আগামি সপ্তাহে আমার বিয়ে। কার্ড দেওয়ার জন্য ডেকেছি। এসো। ফোনটা রেখে সোজা বাথরুমে চলে গেলাম। মনে মনে বললাম- একটা মেয়ে কিভাবে এতটা পাগল হতে পারে? ওহ একটা কথা তো বলাই হয়নি। আমরা দু’জন একই ক্লাসে এবং একই কলেজে পড়ি। একদিন অফ পিরিয়ডে কলেজ ক্যাম্পাসে হাঁটার সময় অর্থির কল-

—-এই যে মিস্টার, কই আপনি?
—-এইতো বকুলতলায়। তুমি কোথায়?
—-তোমার পিছনে তাকিয়ে দেখো। ওমা আমার পিছনে অর্থি! বিস্ময় কাটিয়ে উঠার আগেই বললাম-

—-এখান থেকে কল করার কি দরকার ছিলো?
—-তোমাকে চমকে দেবার জন্য কল করলাম।
—-বুঝেছি,বুঝেছি। তোমার ক্লাস নেই?
—-আছে।
—-তাহলে এখানে কেন?
—-এমনি। চলো আজ রিকশায় ঘুড়বো।
—-সত্যি?
—-হুম।
—-চলো।
—-চলো….

ইন্টারমিডিয়েটের প্রথমেই আমাদের রিলেশন হয়েছিলো। এখন ইন্টার পরিক্ষা শেষ। দু’জন দুই ভার্সিটিতে। যোগাযোগ খুবই কম হয়। প্রথম প্রথম দিনে একবার কথা হতো। এখন সপ্তাহে একবার হয় কিনা সন্দেহ!দু’জন দু’জনকে নিয়ে ব্যস্ত। দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমশই একদিন আমি আমার নতুন একটা সিম থেকে অর্থিকে কল করলাম।কিন্ত, রিসিভ করলো না।আবার কল করলাম।  আবারো রিসিভ করলো না। তখন একটা টেক্সট করি আমি। সন্ধ্যার  পর অর্থি আমার নতুন নাম্বারে কল দিলো। আমি রিসিভ করলাম না। তখন টেক্সট করলো। দু’ঘন্টা অপরিচিত হয়ে কথা বললাম অর্থির সঙ্গে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন আমি ওর বয়ফ্রেন্ড! আমার খারাপ লাগলো। কষ্ট পেলাম আমি। যাকে চেনে না, অপরিচিত কারো সাথে এভাবে কথা বলতে হবে কেন? আমি রাতে কল করলাম আমার নিজের নাম্বার থেকে-

—-হ্যালো অর্থি।
—-হ্যাঁ আদ্রিয়ান বলো।
—-ফ্রি আছো?একদিন দেখা করি।
—-না। এই সপ্তাহে সময় নেই।
—-মিথ্যে বলছো কেন?
—-তুমি বিশ্বাস করছো না?
—-না।
—-তাহলে আমার কিছু করার নেই। রাখতে পারো।
—-অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ করলে তার সাথে দেখা করতে যেতে চাইছো, আর আমাকে মিথ্যে বলছো?
—-মানে?
—-ঐইটা আমার নাম্বার।
—-কিহ?
—-হ্যাঁ।
—-এতটা নিচু তুমি?
—-জাস্ট দেখলাম।
—-ব্যাস, হয়েছে।

অনেক হয়েছে। ব্রেকাপ। আমি হতভম্বের মতো শুনছিলাম কথাগুলো। সত্যি সত্যিই আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে কল দিতাম। রিসিভ করতো না। কখনো কখনো রিসিভ করে কড়া কথা শুনিয়ে দিতো। আমিও আর ঘাটাতাম না।

এভাবেই চলো গেল পাঁচটা বছর। পাঁচ বছর পর আবার সেই অর্থি। কখনো মনেই হয়নি ওর সাথে আমার দেখা হবে। বিশ্বাসী ছিলাম না আমি। একই ডিপার্টমেন্টের টিচার হওয়ায় মাঝে মাঝে জরুরী বিষয়ে কথা বলতে হতো। এমনভাবে কথা বলতাম যেন আমরা কেউ কাউকে চিনিনা। প্রথম দেখায় আমরা যেভাবে কথা বলি সেভাবে কথা বলতাম। অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ব্যাচ নিয়ে আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। আমার পাশে অর্থি। দু’জন চুপচাপ। রাত অনেক হয়ে গিয়েছে। সবাই এতক্ষণ চিল্লাপাল্লা শেষ করে ঘুমিয়েছে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে অর্থি আমাকে বলল-

—-কেমন আছো তুমি?
—-ভালো আছি। বেশ ভালো আছি।
—-বিয়ে করেছো?
—-নাহ্। তুমি?
—-আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট!
—-ভালো। বেশ সুখেই আছো তাহলে?
—-এতদিন ছিলাম। তোমাকে দেখার পর থেকে আর নেই।
—-কেন?
—-পূর্বের স্মৃতিগুলো বড্ড মনে পড়ে।
—-তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে।
—-হুম।
—-আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

অতীত অতীতেই থাকুক। আমার মুখে এখন আর ‘আমার অর্থি’ কথাটা মানায় না। অর্থি এখন অন্য কারো স্ত্রী। একজন মা। কখনো কখনো কিছু ছোট্ট অভিমান নষ্ট করে দেয় একটি জীবন। হারিয়ে দেয় ভালোবাসাকে। আমি অর্থিকে ভালোবাসতাম। এখনো বাসি। বেসেই যাবো যতদিন বাঁচি আমরা হেরে যাই নিজেদের ইগো,অহংকার,অভিমানে, ভালোবাসা গুলো পড়ে থাকে নিভৃতে কোণ এক কোণে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত